মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৩৪)

0
377

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ৩৪)
সায়লা সুলতানা লাকী

রেশমার মৃত্যুতে ছন্দ হারিয়ে ফেলা পরিবারটা আবার একটু একটু করে পুরনো সেই ছন্দের দেখা পেতে শুরু করল। চলতে লাগল স্বাভাবিক ধারায়। তবে লাবন্য কেনোজানি বাসা থেকে বের হতে গেলে বা বাসায় ফেরার সময়টায় মনে মনে খুব টেনশনে থাকে আর পুরোটা সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনারত থাকে যাতে লিখনের বৌয়ের সামনে না পড়ে কখনও। কারন ও নতুন করে আর কোন ঝামেলা সৃষ্টি হোক জীবনে তা চায় না। যেমন চলছে তেমন টাতেই নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করছে এখন। নিজের পড়াশোনার প্রতি বেশি ফোকাস দিতে শুরু করেছে, যাতে পড়া শেষ করে ওই বিদ্যা দিয়ে নিজেকে একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ওর খুব কাছের বান্ধবীর কাছে জীবনের কঠিন এক গল্প শুনেছে বেশ ক’দিন আগে। বান্ধবীর কাজিনের বাবা নতুন করে বিয়ে করেছিল, প্রথম দিকে ওদের সংসারের খরচপাতি দিলেও পরে আর খোঁজখবর তেমন একটা রাখতো না। নতুন ঘরে বাচ্চা হওয়ার পরে ওদের প্রতি আদর মায়া মমতাও নাকি কমে গিয়েছিল। এখন নাকি ওই কাজিনরা এর ওর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চলে। কথাটা শোনার পর থেকেই ভয়েও চাপে আছে খুব লাবন্য। তাই ওদের অমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই নিজেদেরকে এক শক্ত অবস্থানে আনার প্রচেষ্টায় আছে । নানি যদিও বলে এসব নিয়ে টেনশন না করতে তবুও লাবন্যের মন থেকে এসব টেনশন যেনো যায় না এক মুহুর্তের জন্যও।

হিমেলের চাকরিটা হওয়ায় ও এখন আর হুটহাট এই বাসায় আসতে পারে না। মাঝে মাঝে নাকি ঢাকার বাহিরেও যেতে হয়। তবে লাবন্যকে কল দিতে ভুলে না কখনও। যদিও লাবন্য সব বারই প্রশ্ন করে “কেন কল দিয়েছো, তোমার কল আমি কেন রিসিভ করব? আমার প্রয়োজনে আমি তোমাকে পাশে পাই নাই। তুমি আর আমাকে বিরক্ত করবা না। ”
উত্তরে হিমেল বারবারই হাসবে আর বলবে “আমার নানুমনির খবর নিতে কল দেই। আর তা তোকে রিসিভ করতেই হবে, আমাকে জানাতেই হবে তার প্রতিদিনকার অবস্থা । নানুমনির খবরটা তুই ছাড়া আর কে দিবে? আমি নানুমনির দায়িত্বটা নিয়েছে এটাতো তুই জানিস ।”
লাবন্য আর তখন কথা বাড়ায় না। আসলেইতো, নানি হিমেলের আশ্বাসেই এখানে আসতে পেরেছে তার সব বাঁধন ছেড়ে। তার খোঁজ খবরতো হিমেলকে প্রতিনিয়ত দিতেই হবে। কিন্তু মন খুলে আর মনের কথাগুলো বলা হয় না কখনও হিমেলের সাথে। হিমেল দুই একবার ট্রাই করতেই লাবন্য লাইন কেটে দিয়েছিলো। মনে করিয়ে দিয়েছিলো ওর মা আর বোনদের কথাগুলো। তারা যা চায় না তা যেনো কখনও হিমেল না করে, এমনটাই বারন ছিলো ওর। তাই এখন আর হিমেলও তেমন একটা বলে না। শুধু যোগাযোগটা মেইনটেইন করে চলে আর অপেক্ষা করে কখন ওর বন্যর মনের জমা থাকা মেঘগুলো কেটে যায়। হঠাৎ করেই কতগুলো এবড়ো থেবড়ো মেঘ এসে মনের আকাশটাকে ঘন অন্ধকারে ছেয়ে ফেলেছে। এসবের আড়াল থেকে ও ওর হাসোজ্জল জীবনটায় আবার ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশায় দিন গুনতে থাকে।

রুশ এখন পুরোটাই আছে আদর আহ্লাদে ভরপুর। যখন তখন আব্বুর কাছে এটা সেটা বায়না তার চলতেই থাকে। রাত যতই হোক আব্বুর সাথে বাহিরে চলে যায় খেতে। ছুটিরদিনগুলেতে শপিংমলগুলোতে হানা দিয়ে মন পছন্দ নতুন নতুন ব্র্যান্ডের টিশার্ট প্যান্ট জুতা কিনতে। একটা সময় লাবন্যের নানি যেন হাপিয়ে গোলো এগুলো দেখতে দেখতে। অতি আহ্লাদে নাতি যেন নষ্ট না হয়ে যায় তাই নিজেকেই শক্ত হতে হল এই ব্যাপারগুলো ঠিক করতে। সময় করে একদিন লিখনের সাথে কথা বললেন সাবধান করে দিলেন মাত্রাতিরিক্ত আবদার না গ্রহণ করার জন্য। ছেলের চাওয়াতে লাগাম দিতে বুঝালেন সাথে ভালো মন্দ বোঝানোর দায়িত্বটাও দিলেন যে দায়িত্বটা এতদিন পালন করছিল রেশমা, এখন তা লিখনকেই করতে হবে। নানি এও বললেন যে তিনি বললে রুশ হয়ত তা নেগেটিভ ভাবেই নিতে পারে। তাই লিখনকেই এসব বোঝাতে হবে, কারন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করার দায়িত্বটাযে এখন পুরোটাই ওর।
লিখন চুপচাপ শাশুড়ির প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল আর নিজের ভুলগুলোকেও চিহ্নিত করে নিল। মনে মনে ঠিক করে নিল ছেলেকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে। কারন রুশকে যে ও সত্যি সত্যিই মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে চায়।

এরই মধ্যে একদিন লাবন্যের ছোট মামা আসল বাসায় মায়ের জন্য অনেক ফলফলাদি ও খাবার নিয়ে। লাবন্য খেয়াল করল ওর নানির মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল তাকে দেখেই। ছেলেকে কাছে পেয়েই ছেলের পছন্দ অনুযায়ী খাবার রান্না শুরু করলেন। লাবন্যের মামাকে দেখা গেলো বারবারই মা’কে নিয়ে মা’য়ের রুমের ভেতর চলে যায়। সেখানে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করে। লাবন্য বা রুশকে সামনে দেখলেই কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় তার। একবার দুইবার খেয়াল করে পরে আর লাবন্য তার কথা বলায় কোন ডিস্টার্ব করে না। রুশকে নিয়ে নিজের রুমেই বসে থাকল। দুপুরের খাবারের সময় নানি নিজে বেড়ে বেড়ে ছেলেকে খাবার গুছিয়ে দিতে লাগলেন। ছেলেও চুপচাপ খেয়ে নিল। মামার চোখ দেখে বোঝা গেল যে মামা কেঁদেছে। নানির চোখও ভেজা। লাবন্য পরিস্থিতি আন্দাজ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। খাওয়া শেষে মামা চলে গেল না। ড্রয়িং রুমে বসে রুশ আর লাবন্যকে ডেকে কাছে নিয়ে বসল। লাবন্য কিছুটা ভয়ে ভয়েই ছিলো মামা কি বলে তা চিন্তা করে, কিন্তু না মামা বেশ স্বাভাবিক আলোচনাই করল। ওদের পড়াশোনার খোঁজ খবর নিল।কার কি পছন্দ সেসব জানল, টুকটাক গল্প করে যাওয়ার সময় দুই ভাইবোনের হাতে বেশ কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলল, পছন্দ মতো জিনিস মামার পক্ষ থেকে যেনো কিনে নেওয়ার হয় । এই প্রথম মামাদের পক্ষ থেকে কিছু পাওয়া লাবন্যেদের। অন্য কোন সময় হলে নিশ্চয়ই ও এটা ফিরিয়ে দিতো কিন্তু আজ কে যেনো পিছন থেকে বাঁধা দিতে লাগল অনবরত। বারবার কে জানি বলছিলো কোন রকম বেয়াদবি করা যাবে না, মামা মনে কষ্ট পায় এমন কিছু করা যাবে না।যা ঘটছে তা যেনো স্বাভাবিক তাই সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হবে। আর তাই লাবন্য সব কিছু মেনে নিয়েছিল। মামা মাথায় হাত বুলিয়ে দুজনকেই অনেক আদর করে বিদায় নিয়েছিল। লাবন্য শুধু ওর নানির চেহারাটাই বারবার খেয়াল করছিলো। তার চোখেমুখে এক পরিতৃপ্তির আনন্দ খেলা করছিল তখন। যা ওর মনকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল বারবার।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর লাবন্য চুপচাপ নানির কাছে গিয়ে বসল।
“কিরে কিছু বলবি?”
“নাহ,”
“মিথ্যা বলছিস কেন?”
“আজকে তুমি আর মামা দুজনই কেঁদেছো। কিন্তু এরপরও তোমার চোখেমুখে একঅন্য রকম আনন্দ। বিষয়টা বুঝলাম না।”
“সবকি আর বোঝ যায়? সব কিছু বুঝতে নেই। যত কম বোঝা যায় ততই শান্তি। ”
“বলতে চাচ্ছো না তাইতো?”
” জানিস,আমরা মানুষ বড় অদ্ভুত প্রকৃতির। দাঁত থাকতে কখনও দাঁতের মূল্য দেই না। কেউ কেউ জানিই না যে এর মূল্য দিতে হয়। আবার কেউ কেউ হয়ত জানি, কিন্তু দিতে গাফলতি করি। কিন্তু যখনই জিনিসটা হারাই তখনই উপলব্ধি করে কি জিনিস যে হারালাম। আমি যখন সংসারে ছিলাম। তখন ছিলাম ওদের চোখে হিটলার হয়ে। সব ক্ষমতা নিজের হাতে ছিলো, বৌরা এদিক সেদিক বলে বেড়াতে আমি হিটলার, ওদেরকে একটুও ছাড় দেই না। সব কিছু নিয়মে বেঁধে সবাইকে কষ্ট দেই। আমার কাজ কারউ চোখে পড়তো না কিন্তু অন্য সবাই কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়তো আমার যন্ত্রণায়। যদিও কেউ মুখ ফোটে বলতো না কিছু কিন্তু বোঝার মতো শক্তি ছিলো আমার। এই হাতেই ছেলেরা বেড়ে উঠলো ওদের বিয়ে দিলাম ওদের সংসার হল ছেলেমেয়ে হল। তাদেরও এক সময় বিয়ে হল নাতি হল। এতটা বছর সবার চোখের সামনে ছিলাম কিন্তু কারো অন্তরে ছিলাম বলে মনে হতো না। আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমাকেই মনে করিয়ে করিয়ে কিনে আনাতে হত।না থাকলে সমস্যাটাতো আমারই হত। এরজন্য কারো কোন দোষ ছিলো না।কারন ওরাতো দায়িত্বই নেয়নি কখনও আমার, জানতোই না আমার কখন কি প্রয়োজন। আমার ডাক্তার দেখানোর জন্য একেকবার একেকজনকে হাতে পায়ে ধরে রাজি করাতে হতো। বিনিময়ে ওদেরকে নানান সুবিধা দিতে হত। বিনিময় ছাড়া যেন কেউ কারো নয়। সে এক বিশাল লেনদেন চলত নীরবে । সময়ের সাথে সময়ের, প্রয়োজনের সাথে প্রয়োজনের। যেখানে মনের সাথে মন থাকতো সম্পূর্ন কাল্পনিক।
আজ যখন আমি সব কিছু ওদের হাতে দিয়ে চলে এসেছি। ওদের সংসার, ওদের সময়, ওদের প্রয়োজন সব যখন ওদের নিজের হাতে তখন ওরা আমার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছে। অথচ আমি থাকতে আমার অস্তিত্বটা কেউ টের পায়নি। আজ মনে হচ্ছে ওদের মা নেই ওদের কাছে। আজ মনে হচ্ছে মা ওদের জন্য কি ছিলো। কি ওরা হারালো। এখন…… ”

“এক মিনিট এক মিনিট, এবার আমি আগে ভাগে একটা কথা বলে নেই, তুমি এবার থামো। ঘটনা বেশ জটিল বলে বলে মনে হচ্ছে। ”

” আগে শেষ করি….”

“উঁহু, বাকিটা বলার আগে শোনে নাও, আমাদের চারপাশে তোমরা ছিলে না তাই হয়তো আম্মু তোমাদের ভাগের আদর স্নেহ ভালোবাসাটুকুও তার নিজেরটার সাথে যোগ করে আমাদের দুজনকে দিতো। আমরা কখনও কোন কিছুর অভাব দেখিনি। হঠাৎ করেই আম্মু চলে গেল আর আমাদের পুরো রঙিন জীবনটা শুকনো বিবর্ণ মরুভূমি হয়েগেল চোখের পলকেই। কি এক ভয়ংকর সময় কাটিয়েছি তা বনর্নায় বলা মুসকিল। এরইমধ্যে একদিন তুমি এক পসলা বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়লে আমাদের উপর। আমরা পুরোটাই শুষে নিয়ে নিজেদের সিক্ত করলাম। এখন যদি তুমি আবার আমাদেরকে সিক্ত দেখে চলে যেতে চাও আগের ঠিকানায় তবে কিন্তু আমরা আবার মরুভূমি হয়ে যাবো। তুমি কিন্তু বলেছো তোমার বাকিটা সময় শুধু রেশমার।মানে আমার আম্মুর। তুমি কিন্তু চলে যেতে….. ”

“তুইও নিজেরটাই দেখছিস?”

“হুম দেখছি, কারন আমরা অথৈ সাগরে পড়ে আছি তুমি হচ্ছো একটা মাত্র.. ….. ”

“হুমম বুঝেছি। চুপ থাক। আর কিছু বোঝাতে হবে না। শোন আমি যখন এসেছি তখন আর এমনিতেই যাচ্ছি না। যতক্ষন না মনে হয় যে আর দরকার নাই এখানে আমার।”

“আমাদের দরকার আজীবন থাকবে। আম্মু নাই, কিন্তু তোমাকে পেয়ে কিছু কষ্ট ভুলতে পারছি।”

“এবার বাসা থেকে বের হয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হল আমার আরও আগেই বের হওয়া দরকার ছিলো। আমার অনুপস্থিতিটা ওদেরকে আরও আগে জানান দেওয়ার দরকার ছিলো। তাহলে আর মনের মধ্যে এতটা কষ্ট চাপা পড়ে থাকতো না আমার।আপনজনের অবহেলাগুলো বড় কষ্ট দেয়।
আসলে দূরত্ব অনেক কিছু শিক্ষা দেয়, পাশাপাশি শত বছর থেকেও তা শিক্ষা পায় না।আপনজনরা কতটা আপন তা জানার জন্য মাঝে মাঝে আপনজন থেকে কিছুটা দূরত্বে থাকা জরুরি। তাতে আপনজন আরও আপন হয়, আরও কাছে আসে। ”

“হয়তো ঠিকই বলেছো! কিন্তু দেখো তুমি যে আমার এত কাছের, এত আপন তা আমি জানলাম যখন তুমি আমার খুব কাছে এলে। দূরত্ব শুধু তোমার আর আমার মাঝে দূরত্বই বাড়িয়েছিলো।”

“উঁহু ভুল, আমার আর তোর মাঝের দূরত্ব বেড়ে ছিলো শুধু ইগোর কারনে। তুই ভাবতি আমি তোর মাকে কষ্ট দিচ্ছি, আর আমি ভাবতাম আমার মেয়েটা…… বাদ দে এসব কথা। এগুলো এখন ভুলতে চাই। আজ মন ভালো। তাই ভালোই থাক, কি বলিস।” বলে নানি একটা হাসি দিল। লাবণ্যও তার সাথে মিলে হাসল প্রান খুলে ।

আজ হিমেল আসবে বাসায় তা জানতো লাবন্য। গতরাতেই রাজশাহী থেকে এসেছে ও। মাস দুয়েক কাটলো চাকরিতে জয়েন করেছে। কোথায় এখন জনাবের আমেরিকায় ফারদার স্টাডি করতে যাওয়ার কথা সেখানে কি না এনজিওর চাকরি নিয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে হচ্ছে। কেন করছে এসব তাই বুঝে না লাবন্য, এখন আর বোঝার ইচ্ছেও করে না, তাই জিজ্ঞেস ও করে না।
নানিকে দেখলো হিমেলের জন্য আলাদা করে নাস্তা বানাচ্ছে বুয়া খালাকে নিয়ে। নানি যে হিমেলকে খুব পছন্দ করে তা ও জানে। আর হিমেলও আগে পরে কেমন ছিলো জানে না তবে এ বাসায় আসার পরে নানির টেককেয়ারটা পরিপূর্ন ভাবেই করছে। ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ঔষধ এনে দেয়। কখন কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে সে সময়টা যেভাবেই হোক মেনেজ করে। কখনও নিজের সেধে নেওয়া দায়িত্বটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় না। লাবন্য প্রথম প্রথম কাজটা নিজে করতে চাইলেও নানির জন্য আর হয়ে উঠে নাই। তার এক কথা এযুগের ছেলে মেয়েরা দায়িত্ব নিতে চায় না যেকোন অযুহাতে নিজের দায়িত্ব অন্যের উপর চাপাতে পারলেই বাঁচে। সেখানে ও যখন নিজ থেকেই করছে তখন আর বাধা দিস না ওকেই করতে দে। যদি কখনও এমন হয় যে ও পারছে না তখন তুই করিস। কিন্তু হিমেল তেমন কোন সুযোগই দিচ্ছে না লাবন্যকে।

ঠিক ঠিক বিকেল পাঁচটায় বান্দা এসে হাজির হল বাসায় হাতে দুইটা প্যাকেট নিয়ে। ঢুকেই সেই চেনা হাসিটা হেসে বলল
“বাহবা! আজ সূর্য কোনদিকে উঠল? বন্য আজ আমার আসার পথ চেয়ে বসে আছে দেখছি!”
“কি আশ্চর্য! কি আবোলতাবোল বলছো? আমি আবার কখন তোমার পথ চেয়ে বসে থাকলাম!”

“জানিতো এখন শুধু শুধু ঝগড়া বাধাতে চাইবি ঝগড়া করা যে তোর স্বভাব।বাদ দে তুই আর মানুষ হবি না বন্য বন্যই থাকবি। এখন দেখতো এই শাড়িটা আমার বন্যর জন্য কেমন মানাবে?”
“শাড়ি? শাড়ি কেনো? বন্য মানে আমার জন্য শাড়ি আনতে তোমাকে কে বলছে? আমি শাড়ি নিবো না।”
“কে বলছে তাতো তোকে বলব না। এত কেঁচরমেঁচড় না করে শাড়িটা মেলে খুলে দেখ কেমন হলো? আর এটা আমার নানুমনির জন্য। এটা দেখতে হবে না। এটা এমনিতেই মানিয়ে যাবে। নানুমনি যেই লেভেলের সুন্দর সবাইতো আর এরকম না।তাই একটু টেনশনে আছি।”

“আমার কোনো ঠেকা পড়ে নাই যে আমি দেখব। তোমারটা তুমিই দেখো। আমি কখন বলছি যে আমি অনেক সুন্দর? শুধু শুধু খোঁচাও কেন?”

“আহা! এমন করছিস কেন? জীবনে প্রথম একটা শাড়ি কিনলাম নানুমনির জন্য তুই একটু দেখবি না? নানুমনির জন্য শুধু আনলে তখনতো আবার তোর মনে হিংসা হবে, হবে কি না বল ?”

“ও আচ্ছা তাই বলো, নানির জন্য এনেছো ঠিক আছে আর আমার জন্য এনেছো আমার হিংসার কথা ভেবে? আমাকে এতটা খারাপ ভাবছো তুমি?

“আমার জন্য মানে? এই বদমাস আমার জন্য কেন আনছিস? আমি না মানা করলাম। প্রথম দিতে হয় মা’কে, বুঝলি গাধা?”

“এক্সকিউজ মি নানুমনি।প্রথম বেতন পুরোটাই আব্বু আম্মুকে দিয়েছিলাম। দুজনকেই বলছি যা মন চায় তাই করতে। এবারেরটা মন চাইলে প্রিয় দুই মানুষের জন্য আনতে। তাই তাদের পছন্দ না জেনেই নিজের পছন্দ অনুযায়ি নিয়ে আসলাম।”

“তোমার প্রিয় হওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নাই। তোমাদের পুরুষদের কি এক অবস্থা, সময় বুঝে বুঝে তাদের প্রিয়ও চেঞ্জ হয়। আজ এ প্রিয় তো আগামিকাল ও প্রিয় হয়ে উঠে । আজব সব মুড সুইংএর মাঝে আমাকে টানবে না বলে দিলাম। ”

“এই এত কথা প্যাঁচাস কেন? আসলাম এক বুক আনন্দ নিয়ে আর তুই তাতে……. ধুর বারবার এই এক টপিকে কথা বলতে ভালো লাগে না। তুই আমার প্রিয় না। তারপরও তোর জন্য শাড়িটা আনছি। এখন তোর ইচ্ছে হলে পড়বি ইচ্ছে না হলে পড়বি না। ক্লিয়ার? জীবনে কাউকে ইচ্ছে হলে বিশ্বাস করবি ইচ্ছে না হলে করবি না। ঠিক আছে? বাই, আমার এখন এনার্জি শেষ,চললাম।” বলে ঘুরে দাঁড়ালো হিমেল।

“আরে আরে কোথায় যাস। তোর জন্য…”
“নানুমনি প্লিজ এখন আর কিছু ভালো লাগছে না। আমি এখন যাই।” বলে হিমেল বের হয়ে গেল। লাবন্য শাড়ি হাতে স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাধারনত ও এমন করে রিয়েক্ট করে না। তাই হঠাৎ এমন রিয়েক্টটা সহজে হজম করতে পারল না।

নানি একটু রাগ হয়েই লাবন্যের দিকে তাকাল। বেচারি নাতির জন্য কত কিছু বানালো আর নাতি তার কিছুই না খেয়ে চলে গেল তাই হয়ত মনটা একটু বেশিই খারাপ হয়েছে। তাই হয়ত লাবন্যের উপর একটু বেশিই রেগে গেলেন। আর দাঁড়ালেন না শাড়িটা তুলে নিজের রুমে চলে আসলেন তিনি৷

লাবন্য নিজের শাড়িটা নিয়ে নিজের রুমে ঢুকল। মনটা কেমন জানি উশখুশ করছে এখন। নিজের উপরই প্রচন্ড রাগ অনুভব করল।কেন যে সব কিছু সহজভাবে নিতে পারছে না তাই মাথায় আসছে না। হিমেল ওর জন্য শাড়ি এনেছে তাও আবার নিজের রোজগার দিয়ে এযে কত বড় পাওয়া তা কেন অনুভূতিতে আসছে না? একটা সময়তো এগুলো ওর রঙিন স্বপ্ন ছিলো, এখন এগুলো কোথায় হারালো? কেন হারালো? ওতো চায় না এগুলো মন থেকে হারিয়ে যাক তবে কেন হারিয়ে যাচ্ছে? কিসের এত বাঁধা? এসব বাঁধা ও মানবে কেনো? সব কিছু কেন নিজের মনে এত জটিল হয়ে আসছে? এসব ভাবতে ভাবতে একটা সময় ও মনের অজান্তেই কেঁদে ফেলল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here