বিবি রোকসানা_রাহমান পর্ব (৪)

0
500

#বিবি
রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)

কোমল ছোটবেলা থেকেই ডাক্তারি খেলনা দিয়ে খেলত। সাদা জামা, প্লাস্টিকের স্টেথোস্কোপ, হাতে ঘড়ি পরে পুরোবাড়ি উড়ে বেড়াত। বাড়িসুদ্ধ মানুষের চিকিৎসা করার অভিনয় করত গম্ভীরভাবে। খেলা শেষে বিমল হেসে বলত, ‘ বাবা, আমি কিন্তু ডাক্তার হব। ‘ মেয়ের আহ্লাদীপনায় মধুর হাসতেন আনিস মোল্লা। মেয়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সর্ব চেষ্টা করতেন। গ্রামে ভালো উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় জেলা স্কুলে ভর্তি করান। একা যেতে কষ্ট হবে দেখে কোমলের মাকে সাথে পাঠাতেন। মেয়ের সাথে সারাদুপুর বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই কাটাতেন রাবেয়া খাতুন। যত্ন-আত্তি হতো বাড়াবাড়ি রকমের। সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও বিপদ আটকাতে পারলেন না কেউ। একদিন বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার স্বীকার হোন মা-মেয়ে দুজনেই। কোমল ডানপায়ে আঘাত পায়। এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি থেকে ব্যথা সারলেও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারল না। সময়ের সাথে সাথে খুঁড়িয়ে হাঁটায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। ঐসময় কোমল দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। কিছুদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা। শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল থাকায় পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তার মনে হয়েছিল পরীক্ষা দিলে ফেল করবে। বাবাকে জানায়, পরের বছর ভালো পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিবে। কিন্তু ভাবনার মতো সহজ কাটেনি পরের বছরও। নিজের ত্রুটিতে ভেঙে পড়ে আরও। পড়ালেখায় মন বসাতে পারেনি একদম। একা থাকলেই কেঁদে ফেলত। বাবা সাহস দিতে বলত, ‘ চিন্তা করিস না, মা। তুই মন দিয়ে পড়। আমি কাঁধে করে নিয়ে হলে বসিয়ে দিয়ে আসব। ‘ আশাবাদী বাবাকে দেখলে কোমলের পড়ার গতি আরও কমে যেত। মাকে জড়িয়ে কাঁদত সারারাত। বলত, ‘ আমি ডাক্তার হওয়ার বদলে রোগী হয়ে গেলাম, মা। ‘

বাবার কাঁধে না চড়লেও পাশে বসে পরীক্ষার হলে যেত কোমল। লিখতে পারত না কিছুই। শুধু মনে হতো, ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে সে। যদি ডাক্তার হতে না পারে তাহলে পড়ে কী লাভ? ‘ এক বছর পিছিয়ে পরীক্ষা দিয়েও লাভ হলো না। অনুত্তীর্ণ হলো। ফলাফলে একটুও বিচলিত দেখায়নি কোমলকে। সুন্দর করে বাবাকে জানিয়ে দেয়, আর পড়বে না সে। আনিস মোল্লা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আরও একবার পরীক্ষার হলে বসিয়েছিলেন মেয়েকে। ভালো ফলাফল না হলেও উত্তীর্ণ হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন কলেজে ভর্তি করাতে। কিন্তু কোমলের ইচ্ছে ছিল না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল পুরোপুরি। কলেজের পথ অনেক দূরে হওয়ায় আনিস মোল্লাও জোরাজুরি ছেড়ে দিলেন। তারপক্ষে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করা সম্ভব নয়। একা ছাড়তেও পারবেন না। দরুন কোমলের পড়ালেখা ওখানেই স্থগিত হলো।

সময়ের সাথে সাথে কোমল সবটা মেনে নিলেও আনিস মোল্লা মনে রাখলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, পেশায় ডাক্তার এমন ছেলেকেই মেয়ের জামাই বানাবেন। তেমন পাত্র খুঁজে পেলেও যুৎসই হচ্ছিল না যেন। সম্পত্তির লোভে প্রস্তাব রাখছিল গ্রামের আশপাশের অনেকেই। আনিস মোল্লা রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি নির্লোভ ছেলে চাইতেন। সেরকম ছেলে আবার কোমলকে পছন্দ করছিল না। তারা চায় নিখুঁত আর সুন্দরী বউ। এরকম সময়ে নিবিড়ের বাবার প্রস্তাবে স্থাণু হয়ে পড়লেন। থমথমে কাটিয়ে দিলেন কয়েক মুহূর্ত। দাওয়ার কাছটায় দাঁড়ানো শীর্ণকায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” তোদের সাহস দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! এমনটা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, মতিন। ”

মালিকের কণ্ঠস্বরে চাপা রাগের আভাসে তটস্থ হলো মতিন মিয়া। ভীত চোখজোড়া জলে ডুবল। কম্পন পায়ে এগিয়ে এলো আনিস মোল্লার চেয়ারের সামনে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাতজোড় করে বলল,
” মাফ করবেন, মালিক। আমার একটাই পোলা। আপনে তো জানেনই ওর জন্য আমার কইলজা কাইটা দিতেও হাত কাঁপব না আমার। ”
” আমারও কাঁপবে না। ”

আনিস মোল্লার কণ্ঠে স্পষ্ট হুমকি। চোখদুটো জ্বলছে মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো। মতিন মিয়া তার পা চেপে ধরলেন। কাতর গলায় আরও একবার ছেলের প্রস্তাব রাখতে চাইলেন, পারলেন না। নিবিড় বিদ্যুগতিতে ছুটে এলো বাবার কাছে। কাঁধে ধরে জোর করে দাঁড় করিয়ে বলল,
” আমরা পাত্রপক্ষ, বাবা। ভিক্ষুক নই। এভাবে সম্মান লুটাচ্ছ কেন? ”

মতিন মিয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। শাসনের সুরে বললেন,
” তোরে কথা কইতে কইছি? চুপ থাক। তুই চাইছস, আমি দিমু। ক্যামনে দিমু সেটা আমার বিষয়। বাইরে গিয়া দাঁড়া। ”

নিবিড় বাইরে গেল না। কোমলকে চাই সে। যেকোনো মূল্যে। কিন্তু পিতা-মাতার সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে নয়। সে দীপ্ত গলায় বলল,
” তোমাদের ভিক্ষে চাওয়ার জন্য সাথে আনিনি। সম্মানের সাথে প্রস্তাব রাখার জন্য এনেছি। রাখা শেষ, এবার যাও। বাকিটা আমি বুঝব। ”

মতিন মিয়াকে কিছু বলার সুযোগ দিল না নিবিড়। তার সামনে এসে দাঁড়াল। আনিস মোল্লার চোখে চোখ রেখে বলল,
” আমার কাছে খবর আছে, আপনি কোমলের জন্য ডাক্তার পাত্র খুঁজছেন। সে হিসেবে আমি আপনার পছন্দ নই, কোমলের যোগ্য নই। কিন্তু আমি কথা দিতে পারি, যোগ্য হয়েই কোমলকে আমার ঘরে উঠাব। আংকেল, আমি কি একটা সুযোগ পেতে পারি না? ”
” কেমন সুযোগ? ”
” কোমল বধূবেশে আমার ঘরেই উঠবে এমন প্রতিজ্ঞা । ”
” কী বলতে চাচ্ছিস, পরিষ্কার করে বল। ”

নিবিড় একটু সময় নিল। নিজের চাওয়াটাকে নিয়ে ভাবল। কিন্তু গোছানো কোনো উত্তর বের করতে পারল না। নিমেষেই অসহায়বোধ হলো অন্তরে। দোষারোপ করতে থাকল ভাগ্যকে। কেন সবকিছুতেই দুর্বল, অযোগ্য হতে হলো?

আনিস মোল্লা খেঁকিয়ে উঠলেন,
” এখনও কথা বলতে শিখলি না, আর বিয়ের জন্য উতলা হয়ে গেছিস। দূর হ চোখের সামনে থেকে। নাহলে কিন্তু…”

নিবিড় কঠিন দৃষ্টি দিলে আনিস মোল্লা মৃদু হাসলেন। বললেন,
” তোর ভেতরটা খুব মজবুত। কঠোর আত্মসম্মানবোধ। কিন্তু জাহির করতে পারছিস না। অভ্যাস নেই তো তাই। যখন অভ্যাস হবে তখন আসিস। আমি কথা বলব। ”

নিবিড় দ্রুত বলল,
” তখন কোমলকে পাব তো? ”

আনিস মোল্লা পুনরায় কঠোর হলেন। অন্তর্নিহিত দৃষ্টি ফেলে নীরব থাকলেন কিছুক্ষণ। সেকেন্ড কয়েক পর বললেন,
” তোর সুযোগ চাই তো? যা, দিলাম। ”

নিবিড় বুঝতে পারল না। অস্থির হয়ে জানতে চাইল,
” কী সুযোগ? ”
” কোমল যদি নিজ থেকে এসে বলে, তোর প্রস্তাবে রাজি। তাহলে আমি মেনে নিব। ”

আনিস মোল্লার হঠাৎ পরিবর্তনে মতিন মিয়া ও কুলসুম নাহার অবাক হয়েছিলেন। এবার তার শর্তে বিস্মিত হলেও খুশি হলেন মতিন মিয়া। তার ধারণা, কোমল আগে থেকেই রাজি। বাবার অনুমতির অপেক্ষায় আছে। গলা এগিয়ে বললেন,
” কইব, এখনই কইব। কোমলমাকে ডাক পাঠান। ”

আনিস মোল্লা আর ভাবনায় গেলেন না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” কোমলকে বলো, আমি ডাকছি। ”

স্বামীর আদেশ পেয়েও জায়গা থেকে নড়লেন না রাবেয়া খাতুন। মৃদু স্বরে বললেন,
” কোমল বাইরের কারও সাথে কথা বলে না, তুমি জানো না? ”
” ইচ্ছে না হলে বলবে না। ”
” তাহলে ডাকতে বলছ কেন? ”

আনিস মোল্লা এক পলক তাকালেন নিবিড়ের দিকে। সেদিকে দৃষ্টি ধরে রেখে বললেন,
” একে সুযোগ দিতে। ”

রাবেয়া খাতুন মেয়েকে ডেকে তুললেন। বাবার কাছে পাঠানোর পূর্বে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। কেন যেতে বলছেন, সেটাও বাদ রাখলেন না। সবটা শুনে কোমল বরফের মতো জমে গেল যেন। কিছু সময় নিল নিজেকে ধাতস্থ করতে। কয়েক পল পর সহজ গলায় বলল,
” বাবাকে গিয়ে বলো, এত রাতে আমি কারও সাথে কথা বলব না। খুব জরুরি হলে সকালে আসতে। ”

মেয়ের কথায় খুশি হলেন রাবেয়া খাতুন। তুষ্টমনে ফিরে গেলেন স্বামীর নিকট। মেয়ের ইচ্ছের কথা জানাতেই নিবিড় বলল,
” অপেক্ষা করার সময় নেই আমার কাছে। এখনই কথা বলতে হবে। ”

কথাটা উগলে দিয়েই হুড়মুড়ে ভেতরে ঢুকে গেল নিবিড়। কারও বাঁধা মানল না। সোজা হেঁটে গেল কোমলের রুমের সামনে। দরজা খোলা থাকলেও ঢুকল না। বাইরে থেকে বলল,
” আপনার সাথে কথা বলা জরুরি। দয়া করে একটু সময় দিন আমাকে। ”

দরজার কাছে পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চমকে উঠে কোমল। দৌড়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে দমটা আটকে রাখল। যেন নিশ্বাস ফেললেই তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে।

চলবে

[ চাইলেও বড় করে লিখতে পারছি না। লিখতে বসলেই সময় দ্রুত চলে যায়। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here