বিবি পর্ব (৫)

0
366

বিবি পর্ব (৫)

#রোকসানা_রাহমান

দরজার কাছে পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চমকে উঠে কোমল। দৌড়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে দমটা আটকে রাখল। যেন নিশ্বাস ফেললেই তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে।

দরজার পাশে নীরব অপেক্ষার সময় গুণছিল নিবিড়। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারও বলল,
” চুপ করে থাকবেন না। কিছু একটা বলুন। আপনার জন্য ভবিষ্যৎ বাজি রেখে ছুটে এসেছি। ”

কোমল নিশ্বাস ছেড়ে দরজা থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। ওড়না খামচে ধরে একধ্যানে তাকিয়ে রইল বন্ধ দরজার কপাটে। যেন কোনো দৈবশক্তির মাধ্যমে নিবিড়কে দেখতে পাচ্ছে!

নিবিড়ের ধৈর্য্যশক্তি লোপ পাচ্ছে ধীরে ধীরে। সময় দেখছে ঘনঘন। ব্যর্থতার এক আবছা ছায়া স্পষ্ট হতে চাচ্ছে কৈশোরের মুখটায়। সে দরজায় মৃদু আঘাত করল। কিছু একটা বলতে চেয়েও পারল না। কোমলের মা ধমকে বললেন,
” এই ছেলে, সর আমার মেয়ের রুমের সামনে থেকে। কোমল তো বলেছেই এখন কথা বলবে না। তাও ঝামেলা পাকাচ্ছিস! ”

এবার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” তুমিও চুপ করে দেখছ সব? মেয়ের কথা না শুনে এর কথা শুনছ কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না! ”

রাবেয়া খাতুনের কণ্ঠে একাধারে রাগ, বিস্ময়। স্বামীর এহেন আচরণ মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। আরও কিছু কড়া কথা শুনাতে ব্যস্ত হলেন। সেই সুযোগে কোমলের দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল নিবিড়। সবাইকে বিস্ময়ের সাগরে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার এই দুঃসাহসিক কর্মে কোমল চমকে গেল, ভীত হলো। চড়কিবেগে পেছন ঘুরল। দ্রুত ওড়না দিয়ে আবৃত করল নিজেকে।

” এই অপরিচিত আমিটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন একসময়। পরিচয় হওয়ার পর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আর আজ যখন জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি তখন দূর করে দিচ্ছেন? ”

কোমলের মায়া হলো। নরম মনটা কৃত্রিম শক্ত শেঁকল ভেঙে দিল। কথা বলার জন্য অস্থির করে তুলল। উত্তর দিতে গিয়ে দেখল তার ঠোঁট কাঁপছে, কণ্ঠস্বরে আওয়াজ নেই। জড়তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে।

নিবিড় উত্তরের আশায় থাকতে থাকতে নজর গিয়ে পড়ল কোমলের চুলে। রেশম কালো চুলগুলো পিঠ ছড়িয়ে আছে। ওড়নার প্রশস্ত অংশ সম্পূর্ণ ঢাকতে পারেনি। নিচদিক থেকে কয়েক ইঞ্চি এলোমেলো হয়ে কোমড় ছুঁয়ে আছে আদুরে ভাবে। তার দৃষ্টি মুগ্ধতায় রূপ নিতে পলক ফেলল। বলল,
” চুল বেঁধে নিন। ”

নিবিড়ের কণ্ঠে অনুরোধ নাকি আদেশ বুঝা গেল না। তবুও কোমল চুল বেঁধে নিল দ্রুত। জড়তা কেটে গেল নিমেষেই। গলার অবশতা ভেঙে বলল,
” তুমি অভদ্র আচরণ করছ। এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। ”

কোমলের কণ্ঠস্বর নিবিড়ের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল কয়েকগুণ। পাগলামি ছড়িয়ে পড়ল অঙ্গভঙ্গিতে। দ্রুত বলল,
” আপনি পাত্রের সামনে বসছেন, অপমানিত হচ্ছেন। এটাও আমার পছন্দ হচ্ছে না। ”
” ওটা অপমান নয়, সত্য কথা। ”
” সত্য কথা শান্তভাবেও বলা যায়, ভাঙচুর করতে হয় না। গালিগালাজ করতে হয় না। ”
” ওদের মিথ্যা বলা হয়েছিল তাই রাগ হয়েছে। ”
” কী মিথ্যা? ”

কোমল উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। একটু দম টেনে জিজ্ঞেস করল,
” এসব তুমি জানলে কী করে? ”

কোমলের মতো নিবিড়ও উত্তর চেপে গেল। একটু থেমে বলল,
” এত খারাপ ব্যবহার করার পরও তাদের পক্ষে কথা বলছেন। আপনার মধ্যে কি বিন্দু পরিমাণ রাগ নেই? ”
” কারও পক্ষে না, সত্য ও যুক্তির কথা বলছি। রাগ ছাড়া মানুষ হয় না। আমি মানুষ। তাই আমারও রাগ আছে। তুমি বুঝতে পারছ না? ”

নিবিড় ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে গেল। কোমল উল্টো ঘুরে থাকায় মুখের অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে না। গলার স্বর তেজালো নয়। উচ্চ নয়। সবসময়ের মতো শান্ত ও ধীর। তাহলে রাগটা প্রকাশ পাচ্ছে কিভাবে? নিবিড় বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বলল,
” রাগ করেছেন বলেই কথা বলতে চাননি? ”

কোমল নিরুত্তর রইল। নিবিড় পুনরায় বলল,
” অভদ্র আচরণ তো মাত্র করলাম। তাহলে পূর্বে রাগ করার কারণ কী? ”

কোমল আগের মতোই নিরুত্তর থাকলে নিবিড় নীরব থাকল। একটুক্ষণ ভেবে বলল,
” পরীক্ষা না দিয়ে এখানে এসেছি বলে? ”

এ পর্যায়ে মুখ খুলল কোমল। পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন এসেছ? ”

নিবিড় বিনাদ্বিধায় বলল,
” আপনাকে বিয়ে করতে। ”

কোমল আরও একবার চমকাল। বিস্ময়াপন্ন হলো। স্তব্ধ হয়ে কাটিয়ে দিল কয়েক মুহূর্ত। বহুকষ্টে উচ্চারণ করল,
” অসম্ভব! এমনটা কখনই হতে পারে না। ”
” কেন হতে পারে না? ”
” আমি তোমার থেকে অনেকটা বড়, এটা কি ভুলে গেছ? ”
” বড় হলে কি বিয়ে করা যায় না? ”

কোমল কী উত্তর দিবে ভেবে পেল না। মাথার ভেতরটা ফাঁকা বোধ হলো। একহাত কপালে ঠেকালে নিবিড় বলল,
” আপনার কি মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে? ”

নিবিড়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ কোমলের চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিল। কঠিন স্বরে বলল,
” তুমি আমার রুম থেকে বের হবে। এখনই। ”

নিবিড় বের হওয়ার বদলে দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। আরাম আসনে পা ভাঁজ করে বলল,
” আংকেল বলেছে, আপনাকে রাজি করাতে পারলে আমাদের বিয়ে হবে। রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছি না। দুঃখিত কোমল। ”

নিবিড়ের কণ্ঠে নিজের নাম শুনে কেঁপে উঠল। ভয়টা সাপের মতো প্যাচিয়ে ধরল আপাদমস্তক! নিশ্বাস নিতে বাঁধা পাচ্ছে বারবার। কথা বলতে কষ্ট হলেও বলল,
” তোমাকে ঢাকা পাঠিয়েছিলাম জ্ঞানার্জন করার জন্য। সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার জন্য। তার বদলে কিনা বাবা-মায়ের সম্মান নষ্ট করতে চাচ্ছ। আমাকে অপদস্ত করছ! ”
” আমি কারও সম্মান নষ্ট করছি না, অপদস্ত করছি না। নিজের চাওয়া পূরণ করার জন্য কৌশল অবলম্বন করছি মাত্র। ”
” তোমার চাওয়া তো ছিল, এমবিবিএস ডাক্তার হওয়া। ”
” ওটা আমার নয় বাবা-মায়ের চাওয়া। আপনার চাওয়া। ”

নিবিড়ের কাটা কাটা উত্তর কোমলকে হারিয়ে দিচ্ছে যেন। একটুক্ষণ চুপ থেকে নরম স্বরে বলল,
” অবুঝের মতো আচরণ করছ কেন, নিবিড়? বুঝার চেষ্টা করো। বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ। ”
” আমার তো এমনটা মনে হয় না। ”
” তার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হতে হয়। ”
” কোন ব্যাপারে প্রাপ্তবয়স্ক চাচ্ছেন? ”
” তুমি কিন্তু আমাকে লজ্জায় ফেলছ। ”

নিবিড় চুপ হয়ে গেল। কোমলও। দুজনের নীরবতার জন্যই হয়তো বাইরের শোরগোল ভেতরে প্রবেশ করল। রাবেয়া খাতুনের চিৎকার-চেঁচামেচি, দরজায় থাপড়ানোর জোরাল শব্দে বিরক্ত হলো নিবিড়। খানিকটা উঁচুস্বরে বলল,
” যদি খারাপ কিছু করার চিন্তা-ভাবনা থাকত তাহলে কি বাবা-মাকে সাথে নিয়ে আসতাম? বিয়ের প্রস্তাব দিতাম? আন্টি শান্ত হোন। কোমল রাজি হলেই আমি দোর খুলে দেব। ”

রাবেয়া খাতুন শান্ত হওয়ার বদলে রেগে গেলেন। রাগ ঝাড়তে লাগলেন আনিস মোল্লার উপর। নিবিড় সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আনল কোমলের দিকে। মেয়েটা তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল,
” আলো নিভিয়ে খাটে বসুন। আমি চাইলেও অন্ধকার ভেদ করে আপনাকে দেখতে পারব না। ”

কোমল সত্যি আলো নিভিয়ে দিল। খাটের কিনারে বসল নিঃশব্দে। নিবিড় মৃদু হাসল। চুপচাপ কিছু সময় পার করে সহসা বলল,
” সকাল দশটায় আমার পরীক্ষা। সাড়ে নয়টায় হলে পৌঁছাতে হবে। ”

কথাটা কোমলের উদ্দেশ্যে হলেও তার দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিবিড় আবার বলল,
” আপনি বোধ হয় চাচ্ছেন, আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি। ”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিবিড় বসা থেকে শুয়ে পড়ল। কোমল বুঝতে পেরে বলল,
” তোমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি। ”

কোমলের কণ্ঠে আর্দ্রতা, ব্যথা। নিবিড় শোয়া থেকে উঠে আবারও বসল,
” আপনি কি খুব কষ্ট পাচ্ছেন? ”

কোমল মিনতি করে বলল,
” ফিরে যাও। ”

বিপরীতে নীরব রইল নিবিড়। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর বলল,
” আপনার অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে আমার খুব খারাপ লাগছে। বিশ্বাস করুন, জোর করে বিয়ে করার কোনো উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। ”
” তাহলে করছ কেন? ”
” ভয় হচ্ছে। ”
” কিসের ভয়? ”
” আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে যদি দেরি করে ফেলি? ফিরে এসে আপনাকে না পাই? ”

নিবিড়ের সাথে কোমলের আলাপ হয়েছে মাত্র একবার। সেটাও ঘটনাচক্রে। সেসময় তো বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা হয়নি। প্রেমে পড়ার মতো কোনো কারণও তৈরি হয়নি। তাহলে এমন পাগলামির কারণ কী? বিয়ের জন্য এত মরিয়া হচ্ছে কেন?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here