বিবি রোকসানা_রাহমান পর্ব (৬)

0
311

বিবি
রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৬)

নিবিড়ের সাথে কোমলের আলাপ হয়েছে মাত্র একবার। সেটাও ঘটনাচক্রে। সেসময় তো বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা হয়নি। প্রেমে পড়ার মতো কোনো কারণও তৈরি হয়নি। তাহলে এমন পাগলামির কারণ কী? বিয়ের জন্য এত মরিয়া হচ্ছে কেন?

কোমল ভাবনার অতলে ডুবতে ডুবতে উদাস হয়। খেয়াল হারায়। সেই উদাসতা ভাঙে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। সময় বয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট ও ক্ষীণ শব্দটা নতুন ভাবনার উৎপত্তি করে। মস্তিষ্কে শক্তি জোগায়। শব্দ জমায়। মনে পড়ে, নিবিড়ের পরীক্ষার কথা। ভবিষ্যতের কথা। জেদে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এমন বোকামো কি নিবিড়কে মানায়? প্রশ্নটা মনের মধ্যে জেগে উঠার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে যায় কোমল। সামান্য হাসে। আপনমনে বিড়বিড় করে, ‘ মানায়। ওর বয়সটাই তো জেদের। একরোখা আর বেপরোয়া হওয়ার। ‘

কোমল আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজের মনকে শান্ত করল। চিন্তা-ভাবনাকে স্থির করল। সমস্যা থেকে বেরুতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখা সব থেকে জরুরি। এতে বুদ্ধি খুলে দ্রুত। সঠিক সমাধান পাওয়া যায়। কয়েক মুহূর্ত ঠাণ্ডা মেজাজে কাটিয়ে দেওয়ার পর একটা সিদ্ধান্তে আসল কোমল। নিবিড়ের চাওয়া থেকে টলানো অসম্ভব প্রায়। এতক্ষণ চেষ্টা করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে একটু প্রশ্রয় দেওয়া শ্রেয় হবে। কোমল তাই করল। নীরবতা ভেঙে বলল,
” তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি। ”

নিবিড় সেকেন্ডের চেয়েও কম সময়ে বলল,
” সত্যি আপনি রাজি? ”

নিবিড়ের কণ্ঠে বিস্ময়, অবিশ্বাস। কোমল একটু সময় নিয়ে বলল,
” কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। যদি তুমি শর্ত মানো তবেই বিয়ে হবে। ”

আনন্দে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল নিবিড়। কোনোরূপ ভাবনায় না গিয়েই বলল,
” আমি সব শর্তে রাজি। ”
” এত অধৈর্য্য ভালো নয়, নিবিড়। সাবধান হতে শেখ। সতর্ক হও। বুদ্ধিমানদের মতো আচরণ করো। ”

নিবিড় থতমত খেল। এখানে বুদ্ধিমানের কাজ কী বুঝতে পারছে না। কোন ব্যাপারে সতর্ক হবে? প্রশ্নটা কোমলকে না করলেও সে উত্তর দিল,
” কেউ যখন শর্ত দিচ্ছে তখন শর্তগুলো জানা উচিত। খুব ভালো করে বুঝা উচিত। এবং সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্বে বিবেচনা করা উচিত। ”

নিবিড় বুঝতে পারলেও খুব একটা আগ্রহ পেল না। তার মনে হলো, কোমলের রাজি হওয়ার পেছনে হাজারটা শর্ত জুড়ে দিলেও তার কোনো যায়-আসে না। সেই শর্তে যদি তাকে মৃত্যুর সাথে লড়তে হয়, লড়বে। আগুনে ঝাপ দিতে হয়, দিবে। এই মনে হওয়ার বিরল অনুভূতিটুকু প্রকাশ করল না নিবিড়। কোমলকে খুশি করার জন্যই বলল,
” বলুন, আপনার কী কী শর্ত। ”

কোমলও সময়ব্যয় না করে নিজের শর্তগুলো তুলে ধরল,
” প্রথমত, আমাদের বিয়েটা আইনি নিয়মে হবে না। ধর্মীয়ভাবে হবে। সাক্ষী থাকবে শুধু তোমার আর আমার পরিবার। এই দুই পরিবার ব্যতীত আর কেউ এই বিয়ে সম্পর্কে জানবে না। ”
” কেন? ”
” দ্বিতীয় শর্তের জন্য। ”

নিবিড় অনাগ্রহ ভাবটা কাটিয়ে ভীষণ আগ্রহী হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
” দ্বিতীয় শর্ত কী? ”
” এখান থেকে যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ হবে না। বিয়ের ব্যাপারটা মাথা থেকে মুছে ফেলতে হবে একদম। আমাকে নিয়ে কোনোরূপ ভাবনায় মশগুল হতে পারবে না। কারও মাধ্যমে আমার খোঁজখবরও নিতে পারবে না। সহজ করে বলতে গেলে কোমলকে ভুলে যেতে হবে পুরোপুরিভাবে। ”
” এটা কী করে সম্ভব? ”
” আমি শর্ত দিচ্ছি শুধু। সম্ভব করার উপায় না। সেটা তোমার দায়িত্বে। ”

এক মুহূর্তের জন্য বিমুঢ় হলো নিবিড়। মাথার ভেতরটা ঝিম ধরেছে যেন। চারপাশের হাব-ভাব কিছুই টের পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বিশাল আগ্নেয়গিরিতে পতিত হয়েছে সে। যার উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে তার সকল আনন্দ, আহ্লাদ।

” তুমি কি শর্ত মানতে রাজি? ”

কোমলের প্রশ্নে নিবিড়ের বিমূঢ়তা কাটল। একটু সময় নিয়ে বলল,
” সময়সীমা বলুন। ”
” বুঝিনি। ”
” শর্ত পালনের সময়সীমা। কোমলকে কতদিন ভুলে থাকতে হবে? ”
” সেটাও তোমার উপর নির্ভর করছে। ”
” কীরকম? ”
” কাল তোমার ভর্তি পরীক্ষা না? যদি টিকে যাও। মেডিকেলে চান্স পাও। তাহলে এমবিবিএসের কোর্স শেষ হওয়া পর্যন্ত শর্ত প্রযোজ্য হবে। ”
” আর যদি চান্স না পাই, তাহলে ওখানেই শেষ? ”
” হ্যাঁ, বুঝে গিয়েছ দেখি। ”
” একটু বুঝেছি, পুরোপুরি না। এর শাস্তি কী হবে? ”
” তালাক। ”
” তালাক! ”

নিবিড়ের কণ্ঠে আরও একবার বিস্ময়, অবিশ্বাস খেলে গেল। কোমল শান্ত গলায় বলল,
” হ্যাঁ। তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে ডাক্তার হবে। তার জোরেই আজ তুমি আমার রুমে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছ। তাহলে সেই জোর যদি না থাকে, কথার খেলাফ হয়, তোমার পাগলামিকে প্রশ্রয় কেন দেব? ”

নিবিড় পাথরের মতো শক্ত হয়ে রইল। কিছু বলার মতো শব্দ, শক্তি কিছুই পেল না। কোমল বোধ হয় ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারল। নরম হয়ে বলল,
” কষ্ট পেও না। আরেকটু বড় হও, দুনিয়াকে চিনো। তখন বুঝতে পারবে, আমি তোমার ভালো চেয়েছি। ”

কোমলের সান্ত্বনাকে গ্রহণ করল না নিবিড়। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” যদি টিকে যাই, আপনার সব শর্ত মেনে এমবিবিএস কোর্সও শেষ করি সফলভাবে। তাহলে কোমলকে আমি মনে করতে পারব তো? ”

কোমল সাথে সাথে উত্তর দিল না। একটু সময় পর বলল,
” না। ”
” কেন? ”
” তখন আরেকটি শর্ত যোগ হবে। ”
” আবার শর্ত? ”

কোমল হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। নিবিড়ই অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” নতুন শর্ত কী হবে? ”
” আমার পর্দা সরে যাবে। ”

পর্দা সরে গেলে কোমলকে দেখতে পারবে নিবিড়। এতে তার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হয়নি। সে বুঝে গেছে এর মধ্যেও অন্যকিছু আছে, যা তার জন্য খুশি নয়। নিবিড় সন্দেহ থেকেই প্রশ্ন করল,
” পর্দা সরে গেলে কী হবে? ”
” তোমার কিশোরকালের বোকামিকে দেখতে পারবে। খারাপ পছন্দকে দেখতে পারবে। আবেগ তোমাকে কতটা জেদি করে তুলেছিল তা পরিমাপ করতে পারবে। ”
” তারজন্য এত অপেক্ষার কী আছে? এখনই সরিয়ে ফেলুন। আমার বোকামি, খারাপ পছন্দ দেখি। ”
” না, এখন দেখতে পারবে না। ”
” কেন? ”
” কারণ তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হওনি। ”

কোমল আর কথা বাড়াতে চাইল না। তাই আবার বলল,
” পর্দা সরে যাওয়ার পর যদি তোমার সিদ্ধান্ত একই থাকে তাহলে তালাক হবে না। ”

নিবিড়ের হারিয়ে যাওয়া আনন্দটা আবার ফিরে এলো। আনন্দিত গলায় বলল,
” কোমলকে সারাজীবন মনে করতে পারব? আমার পাশে পাব? ”

কোমল উত্তর দিল না। কেমন যেন দ্বিধা আর অস্বস্থিতে পড়ে গেল। খানিকটা লজ্জাও ছুঁয়ে গেল মুখটায়। এই বিব্রত অবস্থা কাটাতে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল,
” তোমার উচিত ক্ষমা চাওয়া। ”

নিবিড় যেন আকাশ থেকে পড়ল এমনভাবে জিজ্ঞেস করল,
” ক্ষমা! কিসের ক্ষমা? ”

কোমল বুঝিয়ে দিল,
” এই সময় আন্টি-আংকেলের ঘুমানোর কথা। তা না করে তারা আমার বাসায়। নিশ্চয় নিজ ইচ্ছায় আসেনি। তুমি জোর করেছ, খারাপ ব্যবহার করেছ। এতে তারা কষ্ট পেয়েছে। বাধ্য হয়েছে এখানে আসতে। এজন্য তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। এতে তারা খুশি হবেন। ”

নিবিড় ঘাড় নেড়ে বলল,
” চাইব। ”
” ঠিক একই কারণে, আমার বাবা-মায়ের কাছেও চাইবে। ”
” আচ্ছা। ”
” দাঁড়িয়ে না থেকে তাই ক্ষমা চাইতে যাও। ততক্ষণে বাবার সাথে আমি কথা বলব। ”

নিবিড় দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে বলল,
” সবার থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। জোর করে রুমে ঢুকে অনেক বড় অন্যায় করেছি। সেই হিসেবে তো প্রথম ক্ষমাটা আপনার কাছেই চাওয়া উচিত। কিভাবে চাইব বলুন। ”

নিবিড় যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এতেই সে সন্তুষ্ট। তবুও বলল,
” এই পৃথিবীতে এমন কিছু দুর্লভ জিনিস আছে যা জোর করে পাওয়া সম্ভব নয়। আমি চাই, তুমি সেই জিনিসগুলোর ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করো এবং এমন অন্যায় জেদ থেকে নিজেকে বিরত রাখো।
” তাহলেই আমি মাফ পাব? ”
” হ্যাঁ। ”

________________

দুই পরিবারকে সাক্ষী রেখে নিবিড় আর কোমলের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। রাবেয়া খাতুন স্বামীকে আড়ালে টেনে নিয়ে বললেন,
” এই ছেলের মধ্যে এমন কী দেখলে যে এত সহজেই মেয়ের জামাই হিসেবে মানলে? ”
” কিছু তো দেখেছি। কিন্তু আজ নয়, কয়েক বছর আগে। ”
” কী দেখেছ? ”

স্ত্রীর কৌতূহলে আনিস মোল্লা মৃদু হাসলেন। বললেন,
” আজ নয়, অন্যদিন বলব। মেয়ের জামাই চলে যাবে এখনই। কিছু দোয়ার ব্যবস্থা করি। ”

আনিস মোল্লা ব্যস্ত হয়ে কোথাও একটা চলে গেলেন। রাবেয়া খাতুন তার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে উদাস হলেন।

_______________

বিয়ে সম্পন্ন হতেই তড়িঘড়িতে বেরিয়ে গিয়েছিল নিবিড়। কয়েক মিনিট পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো। কোমলের পাশে একটি কাঠের বাক্স রেখে বলল,
” আপনি চান, আমি কোমলকে ভুলে যাই। কিন্তু আমি চাই না, কোমল নিবিড়কে ভুলে যাক। তাই এটা আপনাকে উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম। ”
” উপহার? ”
” হ্যাঁ। আপনার কাছে হয়তো নিবিড় থাকবে না। কিন্তু তার মন থাকবে। আর আমি চাই, আপনি সেই মনটাকে জানুন। জানতে জানতে যদি ভালো লেগে যায় তাহলে আপনার মনে তাকে জায়গা দিবেন। ”

নিবিড়ের প্রেমময় কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারল না কোমল। ছোট্ট বাক্সের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী আছে এটার ভেতর? ”
” আমার ভালোবাসা। ”

চলবে

[ আজ এক চিমটি বড় লিখেছি, তাই আপনারাও এক চিমটি বেশি ভালোবাসবেন। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here