#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-৬,৭
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৬
চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। দুপুর বেলার এই সময়টাতে গীতাঞ্জলীর পরিবেশ একেবারেই অন্যরকম। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করে গোটা বাড়িতে।
দুপুরের খাবার শেষে সবাই বিশ্রামে থাকে। রাহেলা মির্জা তাঁর ঘরে ঘুমাতে চলে যান। হালিম মিয়া বারান্দার চৌকিতে বসে ঝিমুয়। লতিফ চুপিচুপি মিনুর সঙ্গে প্রেমালাপে মেতে উঠে নইলে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে চলে যায়। দুপুরের খাবার শেষে দোকানে বসে এককাপ চা খেতে তাঁর বেশ ভালো লাগে।
বিনি মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। আজকে সকাল থেকেই তাঁর শরীর খারাপ। গায়ে জ্বরজ্বর লাগছে। বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে রান্নাঘরে আহারে বসলো। কিন্তু রুচি হলো না। পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লো।
মনটা আজ বড্ড বিষন্ন হয়ে আছে। বড়চাচার কথা খুব মনে পড়ছে। বৃদ্ধ বয়সে একা রান্নাবান্না করে খেতে হচ্ছে মানুষটাকে। অসুখ বিসুখে যত্ন নেওয়ার মত কেউ রইলো না।
বিনি আজকে সকালে একবার কথা বলেছে। শরীর ভালো নেই। গতকাল রাতে নাকি জ্বর এসেছে। বড়চাচার অসুস্থতার খবর শোনার পর থেকেই তাঁর মন উতলা হয়ে আছে। খুব দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। ভাবছে রাহেলা মির্জাকে বলে বিকেলে একবার ঐ বাড়িতে যাবে। চাচার জন্য ভালো দেখে একজন রাঁধুনি ঠিক করে আসবে। অসুখের সময়টাতে অন্তত খাওয়া নিয়ে আর কষ্ট হবে না।
রান্নাঘরে থালাবাসন গুছিয়ে ঘরে ফিরে এলো বিনি। পরিশ্রান্ত, অবসন্ন দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা ধরে আছে। বিশ্রামের প্রয়োজন। শুয়ে থাকতে থাকতে চোখ লেগে গেলো।
ঘুম ভাঙলো কারো হাসির আওয়াজে শুনে। ঘরের বাতি জ্বালানো। খাটে বসে ইফরান তাঁকে উদ্দেশ্য করে হাসছে। বিনি লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে গেলো। এই প্রথম ইফরানকে সামনাসামনি দেখছে সে। হঠাৎ করে ভূতের মত সামনে এসে পড়েছে মানুষটা!
★
ইফরান একটু আগেই বাড়ি ফিরেছে। ঘরে আসার সময় রাহেলা মির্জার সঙ্গে একচোট হয়ে গেছে তাঁর। কিন্তু কথার মারপ্যাঁচে স্নেহময়ী রাহেলা মির্জা কখনোই ইফরানের সঙ্গে টিকতে পারেন না। ইফরান কোন না কোনভাবে ঠিক তাঁকে ম্যানেজ করে ফেলে। আজও তাই হলো।
রাহেলা মির্জা প্রথমে একদিন ইফরানের বাড়ি না ফেরা নিয়ে বেশ রাগারাগি করলেন। কিন্তু যেই না ইফরান বিয়ের আগের শর্তগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলো অমনি তিনি ফুঁটো বেলুনের মত চুপসে গেলেন। নিজের অপারগতার দরুণ কপাল চাপড়ালেন। অসহায়ের মতন হা-হুতাশ করে বললেন,
—‘সব আমার দোষ। আমি নিজে হাতে মেয়েটাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। নইলে অমন মেয়ের রাজকপাল হতো। এমন গুণী, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের বরের অভাব হতো না।’
ইফরান কৌতুহল বশতই মায়ের সেই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটিকে দেখার জন্য দ্রুত ঘরে গেলো। কিন্তু ভেতরে ঢুকে বিনিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মনে মনে ভীষণ অবাক হলো। তার অনুস্থিতিতে কি সুন্দর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চাপলো। বিনিকে ভড়কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
★
বিনিকে চমকাতে দেখে ইফরানের হাসির আওয়াজ থামে না। উচ্চস্বরে হাসছে। বিয়ের পর বর তাঁর নতুন বউকে দেখে হাসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এমন অদ্ভুতভাবে হাসার কি আছে? অস্বস্তি বোধ করলো বিনি। ইফরানের হাসি দেখে মনে হচ্ছে তার সামনে নতুন বউ নয় কোন ক্লাউন বসে আছে।
এই প্রথম দেখা দুজনার অথচ কোন ভালোবাসা নেই। উচাটন নেই। আছে শুধু অভিযোগ, অবহেলা। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা এসে গ্রাস করে নিলো বিনিকে। এমন নির্জীব, প্রাণহীন সংসার তো সে চায় নি ? কি লাভ এত আভিজাত্য দিয়ে যদি মানুষটাই তাঁর নিজের না হয়? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
বাইরে আজও ঝুম বৃষ্টি। বাতাসে জানালার পাট্টায় শো শো আওয়াজ হচ্ছে। বিনি এলোমেলো চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিঁটালো।
ইফরান ততক্ষণে খাটে শুয়ে পড়েছে। মাথার নিচে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। বিনি ভেজা তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—‘খাওয়াদাওয়া হয়েছে?’
—‘কার আমার?’
ইফরানের চোখ বন্ধ রেখেই পাল্টা প্রশ্ন করলো।
বিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানের দুল পরছিলো। ইফরানের প্রশ্নের জবাবে বললো,
—‘হ্যাঁ।’
খাওয়াদাওয়া নিয়ে ইফরানের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে তাঁর একটাই উদ্দেশ্য। বিনিকে ভড়কে দেওয়া। শখ করে বিয়ে করেছে। বর সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা তো হওয়া চাই। হাতের তালুতে উরু ঘষে বললো,
—‘আসার সময় হোটেলে খেয়ে এসেছি। আচ্ছা, কি যেন নাম তোমার? বিনি না মিনি?’
—‘নাহার সিদ্দিক বিনি।’
—‘সিদ্দিক কে? তোমার বাপ?’
বিনি আড়চোখে চাইলো। ইফরানের স্বভাবের সাথে সাথে যে আচার-ব্যবহারেও ত্রুটি আছে সেটা তাঁর বুঝতে অসুবিধে হলো না। মাথা নাড়িয়ে বললো,
—‘হ্যাঁ।’
—‘আমার নাম জানো?’
—‘জানি।’
—‘বলোতো দেখি?’
—‘ইফরান আবিদ মির্জা।’
—‘বাহ্। একেবারে ফুল নেইম মুখস্থ আছে দেখছি। তা কি করো তুমি? আই মিন পড়ালেখা কত দূর?’
—‘অনার্স ফাইনাল দিয়ে এবার মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু তুমি আমাকে দেখে অমন হাসছিলে কেন?’
এতক্ষণ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বললেও প্রথম সাক্ষাতে বিনির এত সহজ বাচনভঙ্গি আর ‘তুমি’ সম্বোধন বেশ অবাক করলো ইফরানকে। সে ভাবতে পারে নি বিনি এত সহজে তাঁকে তুমি করে বলবে। পুনরায় সেই বিশ্রী, কর্কশ হাসিটা দিয়ে বললো,
—‘তুমি মাছের মতন হাঁ করে ঘুমাচ্ছিলে। দেখতে খুবই বিচ্ছিরি লাগছিলো। তাই হাসছিলাম।’
বিনি তাঁর কথায় বিশেষ গা করলো না। ছোটবেলা থেকেই সে যথেষ্ট ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। খুব সহজেই কোন কিছু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে না।
ইফরানকে অবাক করে দিয়ে স্মিত হাসি দিলো। তারপর একইরকম ভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চুল আঁচড়ানোয় মনোযোগ দিলো।
ইফরান কৌতুহল দমন করতে পারলো না। জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,’হাসছো যে?’
বিনি চুল আঁচড়ানো থামিয়ে সরাসরি ইফরানের দিকে চাইলো। ইফরান এখনো তাঁকে চেনে নি। ভাবছে অবলা নারী সে যাই করুক না কেন মুখ বুঝে সয়ে নেবে। কিন্তু এমন কিছুই হবে না। বিনি যখন এখানে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন ইফরানকে সোজা হতেই হবে। নিজে থেকে হলে ভালো নইলে বিনি সোজা করবে। অত্যাধিক শীতল কন্ঠে মুচকি হেসে বললো,
—‘তোমার দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে হাসছি।’
ইফরান সরু দৃষ্টিতে বিনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর আচমকাই সমস্ত ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করলো। হাসির দমকে শরীর দুলছে। বহুকষ্টে সেটা দমন করে বললো,
—‘তাই নাকি? আমার দুর্ভাগ্য? তা কিসের শুনি? তোমাকে বিয়ে করার?’
—‘সেটা তুমি সময় হলেই টের পাবে। টেবিলে খাবার দিচ্ছি খাবে এসো।’
—‘বললাম তো খেয়ে এসেছি।’
—‘দেখে তো সেটা বোঝা যাচ্ছে না?’
—‘তাহলে কি বোঝা যাচ্ছে?’
—‘মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে হাজত বাস করে এসেছো। সেখানে দুদিন যাবত কিচ্ছু খেতে দেয় নি।’
কথা শেষ করে বিনি দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। ইফরান একটা পা সামনে বাড়িয়ে তাঁকে ল্যাঙ মেরে বিছানায় ফেলে দিলো। মৃদু শীষ দিয়ে বললো,
—‘বড়বড় কথা! ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না?’
—‘কি বুঝেছো তুমি?’
—‘এই যে এতকিছুর পরেও তুমি নির্লজ্জের মত কেন আমাদের বাড়িতে পড়ে আছো, কেন তোমার চাচার বাসায় ফিরে যাচ্ছো না, এসব জানি আমি। ইচ অ্যান্ড এভ্রি ডিটেইলস। আমার কাছে সব খবর আছে।’
—‘কেন পড়ে আছি বলো শুনি? তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই?’
—‘এমন ভাব করছো যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানো না। টাকাপয়সার লোভেই তো এই বাড়িতে এসেছো। মাঝখানে আবার সাধু সাজার ভান করছো কেন?
অপমানে বিনির চেহারার বর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো। তথাপি উচ্চবাচ্য করলো না সে। ওষ্ঠাধরে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বললো,
—‘তারমানে তুমি নিজেও বোঝো তুমি যে একটা অকর্মা, অকেজো। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোমাকে বিয়ে করতে হলে কেবল বাপের টাকা দেখেই করতে হবে? তাইতো?’
বিনির বাক্যবাণে ভয়ানক আশ্চর্য হলো ইফরান। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো। চেহারা অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। তিরস্কারপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—‘কথা তো দেখছি বেশ জানো..’
বিনি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
—‘আরো অনেক কিছুই জানি। ধীরে ধীরে টের পাবে। এখন চলো খাবে।’
ইফরান বেশিক্ষণ রাগ দমন করে রাখতে পারলো না। রুক্ষস্বরে বললো,
—‘খাবো না আমি। ফের যদি জোর করেছো মুখে কুলুপ এঁটে দেবো।’
এতক্ষণ কোমর বেঁধে ঝগড়া করলেও রাগত ইফরানকে দেখে পূর্বের কঠোর ভাব ধরে রাখতে পারলো না বিনি। নারীসুলভ স্নেহ বোধ করলো।ইফরানকে দেখতে ছোট বাচ্চাদের মতন অবুঝ, নিষ্পাপ লাগছে। বাকযুদ্ধে হেরে গিয়ে বাবুর মুখ কালো হয়ে গেছে। বিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপলো। ইনি নাকি আবার তাঁকে শায়েস্তা করবে। এদিকে তাঁকে হাসতে দেখে ইফরানের রাগ আরো বেড়ে গেলো। রাগে কটমট করে চাইলো সে। ভয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো বিনি।
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৭
রাত সাড়ে বারোটার মত বাজে। বাইরে মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে। অন্ধকারে বারান্দায় একা একা হাঁটাহাটি করছে বিনি। হাওয়ায় লুটোপুটি খাচ্ছে তার শাড়ীর শেষাংশ। শীতল আবহাওয়া শরীরে শিরশির অনুভূতি জাগাচ্ছে। কপালের চুলগুলো বারবার চোখে মুখে আছড়ে এসে পড়ছে।
বিনি ক্ষীণ আওয়াজে গুনগুন করে গাইলো,
আমার গানের মালা
আমি করবো কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান।
চোখে মলিন কাজল রেখা
কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা
কপোলে যার অশ্রুরেখা
একা যাহার প্রাণ
মালা করবো তারে দান।
শাঁখায় ছিলো কাঁটার বেদন
মালায় শুচির জ্বালা
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই
অভিশাপের মালা
বিরহে যার প্রেমারতি
আঁধার লোকের অরুন্ধতী
নাম না জানা সেই তপোতী
তার তরে এই গান
~মালা করনু তারে দান।
ইফরানের কথা ভাবছে বিনি। কি আছে তাঁর ভবিতব্যে? ইফরানের সঙ্গে কি আদৌ কোনদিন সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে তাঁর?
একটা গোলকধাঁধার মধ্যে আটকে গেছে বিনির জীবন। এমন জীবনের কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি সে। সহজ স্বাভাবিক সুন্দর একটা সম্পর্ক চেয়েছিলো। উদাস দৃষ্টির বাইরের দিকে চেয়ে রইলো।
★
রাহেলা মির্জা রাত জেগে ব্যবিসায়িক খসড়া তৈরী করছিলেন। বারান্দায় বিনিকে বিষন্নমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
তিনি ভেবেছিলেন বিনির সঙ্গে বিয়ে হলে ইফরানকে ঘরমুখী করা যাবে। এই মেয়েকে ভালো না বেসে ইফরান থাকতে পারবে না। এমন মিষ্টিমধুর মুখ! ইফরান ঠিক মায়ায় পড়ে যাবে।
কিন্তু বিগত কয়েকদিন ইফরান যা করেছে তাতে করে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নিজের লক্ষ্যভ্রষ্ট, মতিচ্ছন্ন সৃষ্টিছাড়া ছেলেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আমার জন্য তিনি একটা নিষ্পাপ, ফুলের মত মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছেন।
এগিয়ে গিয়ে বিনির কাধে হাত রাখলেন। স্নেহজড়িতে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘কিরে মা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘুম আসছে না?’
–‘বাইরে কি সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া। ভালো লাগছে। আপনি এখনো ঘুমান নি কেন?’
—‘এই তো যাচ্ছি। ইফরান কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছে?’
—‘না। বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে।’
রাহেলা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লেন। আক্ষেপ আর অনুশোচনা ছাড়া তাঁর কিছুই করার নেই। বিনির মাথায় হাত রেখে ক্লান্তস্বরে বললেন,
—‘এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকিস না। যা গিয়ে শুয়ে পড়।’
বিনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রাহেলা মির্জা শুতে চলে গেলেন।
★
ইফরান বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। বিনি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ঘড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
—‘রাত দুটো বাজে। শুতে চলো।’
দুপুরের ঝগড়ার কথা এখনো ভুলতে পারে নি ইফরান। বিনির কর্তৃত্ব ফলানো সহ্য হলো না। আড়চোখে একবার তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
—‘হুকুম না অনুরোধ?’
—‘দুটোই। প্রথমে অনুরোধ। না শুনলে হুকুম।’
—‘ঠিক আছে শুনবো না। কি করবে করো!’
বিনির এবার সত্যিই হাসি পেয়ে গেলো। ইফরান একেবারে ছোট বাচ্চাদের মতন রাগ করছে। যেকোন ভাবে বিনিকে পরাজিত জন্য একেবারে মরিয়া হয়ে আছে।
ইফরানের পাশে চেয়ার টেনে বসলো সে। মিষ্টি হেসে বললো,
—‘রুমে চলো। তারপর দেখাবো কি করি। বারান্দায় লজ্জা করে।’
বিনির মুখ থেকে এমন কিছু শুনবে ভাবতে পারে নি ইফরান। তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিনির নির্লজ্জতার মাত্রা দেখে সে তাজ্জব বনে গেছে।
বিনি এবার গলায় মধু ঢেলে কৃত্রিম অনুরোধের সুরে বললো,
—‘কি হলো যাবে না?’
ইফরান গলা খাঁকারি দিলো। দুপুরে ঝগড়ুটে বিনির অবতার থেকে হঠাৎ করে এমন অসঙ্গত আচরণ তাঁকে খানিকটা বিব্রত করে দিয়েছে। তবে বিনির থ্রেটে দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গলায় বিদ্রুপ ঢেলে বললো,
—‘বেশ চলো। দেখি তবে কার দম কতটুকু।’
বিনি উঠে দাঁড়ালো। হালকা হেসে বললো,
—‘দম আমার অনেক আছে। শুধু সুযোগের অভাবে দেখাতে পারছি না।’
ইফরান রাগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মেয়ে মানুষের এমন নির্লজ্জ আচরণ সে জীবনে দেখেনি। বিনি সেটা লক্ষ্য করে বললো,
—‘বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে দূরে দূরে থেকে লাভ কি? তারচেয়ে বরং একটা বাচ্চা নিয়ে ফেলি চলো।’
বাচ্চার কথা শুনে চোখ বড়বড় করে ফেললো ইফরান।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। এই মেয়ে তিল থেকে তাল, তাল থেকে তরমুজ করে ফেলছে! এত ফাস্ট। রীতিমত রকেটের গতিতে দৌঁড়াচ্ছে।
বিস্মিত কন্ঠে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলো,
—‘বাচ্চা!’
—‘হ্যাঁ। বাচ্চা। বোঝা না কেন। একটা বাচ্চা হলে তোমার মাকে খুব সহজে পটিয়ে ফেলা যাবে।’
কথা শেষ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বিনি। হাসির চোটে চোখে পানি চলে এলো।
তাঁর রঙ্গতামাশা ধরতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইফরান। এই মেয়েটা এতক্ষণ তাঁকে বোকা বানিয়েছে। ভ্রু কুঁচকে বিনির হাস্যরত মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—‘অসহ্যকর! হেসে হেসেই মাথাটা ধরিয়ে দিয়েছে।’
বিনি হাসি থামিয়ে দিয়ে বললো,
—‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি সত্যি সত্যি সম্পত্তি দখল করার কথা বললেই বোধহয় তুমি বেশি খুশি হতে?’
ইফরান জবাব দিলো না। বারান্দা থেকে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। বিনিও তাঁর পেছন পেছন গেলো। তবে বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারলো না। ফের খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ইফরান বিরক্ত হয়ে বললো,
—‘তোমার বাড়ির লোক তোমাকে সহ্য করতে না পেরেই বুঝি এখানে পাঠিয়েছে?
বিনি মুখটিপে হাসলো। বললো,
—‘সেই ভাবনা তোমার না ভাবলেও চলবে। তোমাকে যখন সহ্য করা যাচ্ছে তখন আমাকেও যেতো। আমি কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই এই বাড়িতে পড়ে আছি।’
—‘মায়ের দোহাই দেওয়া সহজ, কারণ মা প্রতিউত্তর করবেন না। আসল কারণ যে কি সেটা কেবল তুমিই জানো।’
—‘আচ্ছা? তবে কি ভাবা হচ্ছে? তোমার জন্যে পড়ে আছি?’ বলেই আরেকদফা হাসির লহর ছুটালো বিনি। ইফরানের মুখ গম্ভীর করে ফেললো। এই মূঢ়চিত্ত, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ঠোঁটকাটা রমনীর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। বৃথা সময় নষ্ট। চুপচাপ বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সে। বিনি আরেকদফা মুখটিপে হাসলো। আচ্ছা জব্দ করা গেছে বদরাগী, মাথামোটা, এংরি ইয়াং ম্যানকে।