মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-৪,৫

0
360

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-৪,৫
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৪

‘এই ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে
চল পলায়ে যাই
আজ ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে
চল পলায়ে যাই,’
সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। গানের তালে তালে নাচছে মজলিসের আমন্ত্রিত জনতা। ইফরানের গায়ে হলুদ আজ।
হাসিঠাট্টা, কোলাহল, কলরবে ‘গীতাঞ্জলী’র পরিবেশ মুখোরিত। চারদিক লাইটিং এর আলোয় ঝলমল করছে। বিলাসবহুল সাজসজ্জা আর চোখ ধাঁধানো সব আয়োজন দেখলে মনে হবে কোন রাজা মহারাজা সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তুতি চলছে। বাড়ির প্রধান ফটক থেকে স্টেজ পর্যন্ত সমগ্র রাস্তায় লাল গালিচা বিছানো। গেট সাজানো হয়েছে সিনেমার থিম অনুসারে। রাহেলা মির্জা টাকা পয়সা খরচের ব্যাপারে কোন কৃপণতা করেন নি। তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। গোটা এলাকায় শোর ফেলে দিয়েছেন। খুশিতে মুখ থেকে হাসিই সরছে না। ছেলের বিয়ের আনন্দে অকারণেই হাসছেন।

সকাল থেকে যদিও টিপটিপ বৃষ্টি ছিলো তবে এখন আকাশ একদম পরিষ্কার। তাই আনন্দোৎসবে কোন ভাটা পড়ে নি। বাড়ির প্রত্যকটা মানুষ বিয়ের আনন্দে হৈহুল্লোড় করছে। শুধুমাত্র ইফরান ছাড়া।

ইফরানের মতিগতি বোঝা দায়। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্টেজে উঠে বেশ কিছুক্ষন নাচানাচি করেছিলো। কিন্তু তারপর আবার দুজন কাজের লোককে বিনাকারণে উত্তম মধ্যম দিয়েছে। মার খেয়ে কেউ আর ভয়ে তাঁর কাছে ঘেষছে না। এখন আপাতত ক্লান্ত হয়ে শান্তভাবে বসে আছে। কিন্তু মুখখানা এমন করে রেখেছে যেন,অকারণে এই বিয়ে নিয়ে এত মাতামাতি তাঁর একদম ভালো লাগছে। নিতান্তই বাধ্য হয়ে বসে আছে। অথচ গীতাঞ্জলীর প্রতিটি বালুকণা জানে তাঁকে বাধ্য করা ঠিক কতখানি অসম্ভব। তাঁকে বাধ্য করতে হলেও তাঁর মর্জি লাগে।

একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার ঘুরে ঘুরে তাঁর ছবি তুলছে। ক্যান্ডিড ফটোগ্রাফি। পরবর্তী সময়ে সে যাতে এই ছবিগুলো দেখে নিজের সুন্দর মুহূর্তটার কথা মনে করতে পারে সেজন্যই বিশেষভাবে এই ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছেন রাহেলা মির্জা। কিন্তু একটা ছবিতেও ইফরানের মুখে হাসি নেই। সব ছবিতে অত্যন্ত বিরক্তিযুক্ত, বিদঘুটে এক্সপ্রেশন দিচ্ছে।

রাহেলা মির্জা সেটা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন। ছেলের পাশে বসে সস্নেহে তাঁর মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘স্টেজ কি তোমার পছন্দ হয় নি?’
—‘না।’
—‘ইভেন্ট ম্যানেজারকে তিনলক্ষ টাকা দিয়েছি স্টেজ ডেকোরেশন এর জন্য। বেস্ট ডিজাইন চয়েস করা হয়েছে। তাও তোমার পছন্দ হয় নি?’
—‘যেখানে বিয়েই আমার পছন্দ মত হচ্ছে না সেখানে স্টেজ কি করে হবে?’
রাহেলা মির্জা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ইফরান কবে একটু বুঝদার হবে? কবে মাকে একটু বুঝবে? সারাজীবন কি এই একইরকম অবুঝ, একরোখা রয়ে যাবে? কখনো নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখবে না?

ইফরানের বিরক্ত লাগছে। বিড়বিড় করে বললো,’আমি টাকা চাইলেই বাহানা। এখন এই ফালতু বিয়েটার জন্য খামোখা টাকা নষ্ট করা হচ্ছে। তাও যদি ক্লাস মেইন্টেইন হতো। আত্মীয়তা তো হচ্ছে একটা মিডেলক্লাস, আনকালচার্ড ফ্যামিলির সঙ্গে। কি দিয়ে যে বশ করেছে আল্লাহই জানে।’
রাহেলা ছেলের ক্ষিপ্ত মুখপানে চেয়ে পূর্ববৎ কোমল কন্ঠে বললেন,
—‘তুমি আর কি চাও বলো? যা চাইবে তাই দেবো। বলো কি চাও? যা যা শর্ত দিয়েছো সব মেনে নিয়েছি। এর পরেও যদি কিছু বাকি থাকে আমাকে বলো। আমি ব্যবস্থা করবো।’
—‘যেগুলো বলেছি সেগুলো মনে রাখলেই হবে। অবশ্য না রাখলেও আমার কিছু করার নেই। এই শেষ। আমি আর এসবের মধ্যে নেই। এর পর থেকে যা হবে সব আমার ইচ্ছে মতো হবে।’
—‘হবে। তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে। কিন্তু এবার একটু হাসো। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার একদমই ভালো লাগছে না।’

ইফরান মায়ের কথা শুনে ফটোগ্রাফারকে উদ্দেশ্য করে চব্বিশ পাটি দাঁত বের করে অত্যন্ত বিরূপ এবং কদর্য একখানা হাসি দিলো। সে যে ভেতরে ভেতরে ভয়ানক খেপছে সেটা তাঁর এই হাসি প্রমাণ করছে। রাহেলা মির্জা সামান্য হাসলেন। হাতের মুঠোয় ছেলের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
—‘আমার রাজপুত্রকে আল্লাহ সৎবুদ্ধি, সদিচ্ছা দান করুক। সে যেন খুব সুখী হয়।’


হলুদের অনুষ্ঠান যেন তেন ভাবে শেষ হলেও বিয়ের দিন ইফরান পুনরায় বেঁকে বসলো। মেয়ের বাড়ি যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে বিয়ে করতে অসম্মতি প্রকাশ করে দিলো। খবর শুনে রাহেলা মির্জা দুশ্চিন্তায় আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। অনুনয়, বিনয় তোষামোদ, কোন কিছুর আর কসরত রইলো না। ইফরানকে রাজি করাতে গিয়ে বাড়ির সকলের ঘাম ছুটে গেলো। তথাপি বান্দা নাছোড়।

ইফরানের হঠাৎ এই বেঁকে বসার কারণ হচ্ছে তাঁর বন্ধুদের ইন্ধন। বন্ধুরা কোথা থেকে যেন খবর পেয়েছে সম্পত্তির লোভে ইফরানের সঙ্গে বিনির বিয়ে দিচ্ছেন তাঁর বড় চাচা আবু সুফিয়ান। ব্যস! খবরটা বাতাসের বেগে পৌঁছে গেলো ইফরানের কানে। আর তাকে কে আটকায়? মায়ের সঙ্গে বাধিয়ে দিলো তুলকালাম।

বিনি তাঁর বড় চাচার কাছে মানুষ। বাবা মা মারা গেছে সেই ছোটবেলায়। বড়চাচাই বিনিকে আদরযত্ন দিয়ে লালন পালন করেছেন। তিনিও আর্মি অফিসার ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় একজনকে ভালোবেসে আর বিয়ে করেন নি। চাকরীর সূত্রে আবু আলী মির্জার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তাঁর। সেই সুবাদেই বিনির সঙ্গে ইফরানের বিয়ের প্রস্তাব দেন রাহেলা মির্জা। যদিও বিনিকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছা ছিলো না আবু সুফিয়ানের। তিনি ভেবেছিলেন বিনির পড়াশোনা শেষ করে তারপর বিয়ের কথা ভাববেন। কিন্তু রাহেলা মির্জা এমনভাবে ধরলেন যে সুফিয়ান সাহেব আর না করতে পারলেন না। তাছাড়া ইফরান দেখতে শুনতে মানানসই। বংশও ভালো। বিনি সুখেই থাকবে।

রাহেলা মির্জা পাগলের মত ছেলেকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন বিয়ের প্রস্তাব আগে তিনি দিয়েছেন। বিনির চাচা আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তিনি এমন কিছু ভাবতেই পারেন না। টাকা পয়সা কম হলেও তিনি মানুষ ভালো। নির্ভেজাল, নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির লোক। ইফরানের বাবার অধীনেই কাজ করছেন। তিনি খুব সুনাম করতেন আবু সুফিয়ানের।

আর সত্যিই যদি তিনি তেমন কিছু ভেবে থাকেন তাহলে রাহেলা মির্জা নিজে বোঝাপড়া করবেন আবু সুফিয়ানের সঙ্গে।
ইফরান ভ্রুকুটি করলো। বললো,
—‘বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর বোঝাপড়া করে কি লাভ? ঐ মেয়ে তখন সম্পত্তির দাবি ছাড়বে? মোটেও ছাড়বে না।’
—‘ছাড়বে। বিনি শান্তশিষ্ট লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। সে এসব বিষয় সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’

কিন্তু ইফরানকে বোঝানো কি এত সহজ?
মাকে বোঝাতে না পেরে উলটে শর্ত ছুঁড়ে দিলো সে। শর্ত হচ্ছে বিয়ের পরে কোন ঝামেলা হলে ইফরান এবং বিনি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে আলাদা হতে পারবে। এক্ষেত্রে রাহেলা মির্জা কোনপ্রকার বাধা দিতে পারবেন না। সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন সবাইকে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে।

শর্ত শুনে রাহেলা মির্জা চিন্তায় পড়ে গেলেন। বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়ার আগেই ছেলে বিয়ে ভাঙ্গার কথা ভাবছে! ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—‘বেশ আমি রাজি তোমার শর্তে। কিন্তু সেরকম হলে অবশ্যই তাতে বিনির সম্মতি থাকতে হবে। তোমার একার সিদ্ধান্তে কিছু হবে না।’

এই একটা জায়গাতেই ফাঁক রেখে দিলেন রাহেলা মির্জা। বিনি নিশ্চয়ই জেনেশুনে নিজের বিয়ে ভাঙ্গতে চাইবে না? ইফরান তার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে হাসিমুখে সায় জানালো। তারপর চার’শ বরযাত্রী নিয়ে রওনা হলো বিনিদের বাড়ির উদ্দেশ্য।
এই ঝামেলার পর আর কারোরই আর বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ করার মত শক্তি রইলো না। সারাদিনের ঝক্কিঝামেলায় সবাই ক্লান্ত। আকাশের অবস্থা ভালো থাকায় বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো।

বাইরে তখনো তুমুল বৃষ্টি। একটু পরপরই বজ্রপাত হচ্ছে। রাস্তাঘাটে বিদ্যুৎ কানেকশন নেই। এরমাঝেই ধুমধাম করে ছেলের বউ বরণ করলেন রাহেলা মির্জা। শাশুড়ির দেওয়া স্বর্ণালংকার সব এক করে বিনির গায়ে তুলে দিলেন। ইফরান পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তামাসা দেখলো। এই বিয়ে নিয়ে এখন আর তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। মা যখন জোর করে বিয়ে দিয়েছেন তখন ঝামেলা হলে মা-ই সামলাবেন। তার শুধু একটাই চিন্তা কাল সকালে কখন বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে বেরোবে। বন্ধুদের সঙ্গে বেরোনোর এই প্ল্যানটা বিয়ের আগেই করেছিলো। কিন্তু এখন চিন্তা হচ্ছে বিয়েবাড়ির এত ঝামেলার মাঝে বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে তো?
না পারলে ট্যুরটা মিস।
মনে মনে ফন্দি আটলো ইফরান। রাহেলা মির্জা তাকে কথা দিয়েছেন। তাই শর্ত অনুযায়ী তিনি চাইলেও এখন আর কোনকিছুতে ইফরানকে বাধা দিতে পারবেন না। বিয়ের পর আর কোনকিছু নিয়ে তিনি বাধা দেবেন না। কালসকালে দরকার পড়লে এই শর্তটা আবার তাকে মনে করিয়ে দেবে ইফরান।

#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৫

রাত বারোটা। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তথাপি ‘গীতাঞ্জলী’তে আলোর অভাব নেই। জেনারেটর আলোয় চারদিক ফকফকা। নিচতলায় বৈঠকখানায় গানের আসর বসেছে। রবীন্দ্রনাথ সংগীত, নজরুল গীতি, পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গানের চর্চা মাঝেমধ্যেই এই বাড়িতে হয়। স্বামীর পছন্দের বৈঠকখানাটি কে সুযোগ পেলেই জমজমাট করে তুলেন রাহেলা মির্জা। এবারের উপলক্ষ্য ইফরানের বিয়ে। আমন্ত্রিত অতিথিরা নাচে গানে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রেখেছেন।

কিন্তু এত আনন্দ উল্লাসের মাঝেও ইফরানের কামরাটা বেশ নিরব। ঘরে আলো নেই। বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে সে।

বধুবরণের যাবতীয় সব আচার অনুষ্ঠান শেষে বিনিকে তাঁর শ্বাশুড়ি মায়ের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ভারী সাজপোশাক বিনির অবস্থা খুবই কাহিল। ঘুমে অবস্থা ঢুলুঢুলু।
রাহেলা মির্জা আলমারি থেকে ভারী একটা জড়োয়া হার বের করে তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন। এই হার তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে ইফরানের দাদির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। বেশকিছুদিন ব্যবহার করে ছেলের বউয়ের জন্য যত্ন করে তুলে রেখেছেন।
বিনিকে হারটাতে খুব সুন্দর লাগছে। রাহেলা মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। বিনি পুনরায় শ্বাশুড়ি মাকে সালাম করতেই কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
—‘খুব সুখি হও মা। আমার ইফরানের সঙ্গে জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন তৈরী হোক তোমার।’

তারপর ইফরানের এক চাচাতো বোনকে সঙ্গে করে বিনিকে ইফরানের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ইফরানের ঘরে ঢুকে বিনি বেশ অবাক হলো। এমাথা ও মাথা গোটা একটা বাড়ির সমান হবে এত বড় ঘর। এই বাড়ির অন্যান্য ঘর গুলোর তুলনায় ইফরানের ঘরটা বেশ বড়। আবু আলী মির্জা শখ করে ছেলের জন্য এই ঘরটা বানিয়েছিলেন। বিনির কৌতুহলী চোখে চারপাশ চাইলো। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য চারদিকে। আভিজাত্য আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ন। কোথাও কোন খুঁত ধরার অবকাশ নেই। শৌখিন আসবাবপত্র আর দামি শোপিস দিয়ে ঘরের প্রতিটা কোণ চমৎকার ভাবে সাজানো।

তবে এতকিছুর মাঝেও সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয়টি হচ্ছে দেওয়ালে টাঙ্গানো ইফরানের ছবি। বাগানে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হাস্যরত অবস্থায় তোলা। বিনি নিষ্পলক চেয়ে রইলো ছবিটার দিকে। ছবির মানুষটা সুন্দর,সুদর্শন। কিন্তু বাস্তবে এখনো তাঁর দেখা পায় নি বিনি।

অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো বিনির খেয়ালই নেই। ঘুম ভাঙলো বৃষ্টির ছাঁট মুখে এসে পড়ায়। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। গা ছমছম পরিবেশ। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানের আওয়াজ আর বাইরের বেমক্কা বজ্রপাত ঘরের পরিবেশকে অনেক বেশি ভৌতিক করে দিচ্ছে। তারওপর থেকে থেকেই কুকুর ডেকে উঠছে। বিনির ভয় উত্তেজনা সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।
ইফরান ঘরে এসেছে অথচ তাকে ডাকলো না এই নিয়ে বেশ চিন্তায়ও পড়ে গেছে সে। ইফরান তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে চায় নি বলে ডাকে নি? নাকি অন্য কোন কিছু?

ফের বিকট আওয়াজে বজ্রপাত হলো। চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে বিনি উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিলো। ফিরে আসার সময় ইচ্ছে হলো বাতি জ্বালিয়ে বরের মুখটা একটাবার দেখে কিন্তু তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে ভেবে ইচ্ছে টা বাদ দিলো। অন্ধকারে খাটের পাশে চুপচাপ বসে রইলো। কিন্তু তাঁর এমনই কপাল যে, সারারাত ইফরান একবারের জন্যেও সচেতন হয় নি।


পরদিন একেবারে কাকডাকা ভোরে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো ইফরান। সে যখন বেরিয়েছে বাইরে বাড়ির একটা প্রাণীও তখন সজাগ ছিলো না। সারারাত জেগে থেকে ভোররাতের দিকে বিনিরও চোখ লেগে গেছিলো। সেই ফাঁকে ইফরান কখন বেরিয়ে গেছে টের পায় নি।

সকালে ঘুম ভাঙার পর ইফরানের চলে যাওয়ার খবর শুনে বিনি চরমভাবে আশ্চর্যান্বিত হলো! কাল রাতে ভালো করে দেখাও হয় নি দুজনের। আর ইফরান আজ সকালেই বেরিয়ে পড়লো? সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি কেন এত অবহেলা? ইফরান কি তবে স্বেচ্ছায় এই বিয়েটা করে নি?
সারাদিন এসব চিন্তায় ডুবে রইলো বিনি। কিছুতেই কোন হিসেবে মিলাতে পারলো না।
সকালে নাশতার সময় হালিম এসে ডেকে গেলো। দুপুরে খাবার টেবিলেও ডাকলো। কিন্তু বিনি গেলো না। সারা দিন ইফরানের ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনলো । এদিকে দেখতে দেখতে দুদিন হয়ে গেলো তবুও ইফরানের ফেরার নাম নেই।

বিনি ভেতরে ভেতরে উতলা হয়ে পড়লো। ইফরান কোথায় গেছে, কেন গেছে সে কিচ্ছু জানে না। কেন বিনির সঙ্গে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে তার কারণ জানতে না পেরে শান্তি পাচ্ছিলো না।

এদিকে রাহেলা মির্জা ছেলের স্বভাব ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চুপিচুপি হালিম মিয়াকে পাঠালেন ইফরানের বন্ধুদের বাসায়। সেখান থেকে হালিম মিয়া প্রতিবারই একই কথা বললো। ইফরান ফিরতে অসম্মতি প্রকাশ করেছে। যতদিন না তাঁর ভ্রমণ শেষ হচ্ছে ততদিন সে ফিরবে না।

রাহেলা মির্জা যতই গোপন রাখার চেষ্টা করুক না কেন বিনির কানে সব খবরই আসে। বাড়ির ভৃত্যদের কানাঘুষা কিছুই নজরে এড়ায় না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সে রাহেলা মির্জাকে সরাসরি ইফরানের কথা জিজ্ঞেস করে বসলো।

সকাল বেলা বারান্দায় বসে ম্যানেজারের সঙ্গে ব্যবসায়িক কিছু আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছিলেন রাহেলা মির্জা। বিনি চা দেওয়ার নাম করে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। তাঁকে দেখে ম্যানেজারকে বিদায় দিয়ে দিলেন রাহেলা মির্জা। মিষ্টিমধুর হেসে বললেন,
—‘এদিকে এসো বিনি। আমার পাশে এসে বসো। তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলি। ব্যস্ততার কারণে তো ঠিকমত কথাই বলতে পারছিলাম না।’
বিনি চায়ের কাপ তাঁর হাতে তুলে দিয়ে কোনপ্রকার ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করলো,
—‘আপনার ছেলে কবে ফিরবে মা?’
ইফরানের প্রসঙ্গ উঠতেই ব্রিবত হলেন রাহেলা মির্জা। তিনি নিজেও জানেন না ইফরান কবে ফিরবে! কবে তাঁর মর্জি হবে। তথাপি পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
—‘হালিমের কাছে খবর পাঠিয়েছে। আজ কালকের ভেতরেই ফিরবে। আসলে হুট করেই একটা ব্যবিসায়িক কাজ পড়ে গেছে তো, তাই আসতে দেরী হচ্ছে।”
—‘আপনার ছেলে ব্যবসার কাজে যায় নি মা। সে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছে। ওরা নাকি ছেলেমেয়ে একসাথে ভ্রমণে বেরোয়। হোটেলে রাত কাটায়।’
বিনি সত্যিটা জানতে পারায় ভীষণ লজ্জিত হলেন রাহেলা মির্জা। অসহায় মুখ করে বিনির দিকে চেয়ে রইলেন। বিনি সেটা উপেক্ষা করে বললো,
—‘আপনার ছেলে তো মদও খায় মা! এর সঙ্গে আপনি কি করে আমার বিয়ে দিলেন?’

বিনির এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই রাহেলার কাছে। তিনি বাকরুদ্ধ, নিরুত্তর! জবাব না পেয়ে বিনি ফুঁসে উঠলো। একবুক হতাশায় ভারী হয়ে এলো বুকের ভেতরটা। বিয়ে, স্বামী, সংসার নিয়ে সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষা মিথ্যে হয়ে গেছে তাঁর। অশ্রুসিক্ত ভেজা নয়নে চিৎকার করে উঠে বললো,
—‘আপনি কি করে আমাদের সঙ্গে এতবড় জালিয়াতি করলেন মা? আপনার কি একটুও বিবেকে বাধলো না? একটা মদখোর,মাতাল বখাটে, অসভ্য ছেলের সঙ্গে আপনি কি করে আমার বিয়ে দিলেন? এই কাজ যদি কেউ আপনার সঙ্গে করতো?’
রাহেলা অপমানে, লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে রইলেন। বুক ফেটে কান্না আসছে। ছেলের বউয়ের মুখ থেকে এমন অপমান জনক কথা শোনার চাইতে মরে যাওয়াও ভালো ছিলো। শুধুমাত্র ইফরানের জন্য তাঁকে এসব শুনতে হচ্ছে। ইফরান এই জীবনে কোনদিন শান্তিতে থাকতে দেবে না তাঁকে! চোখের পানি আড়াল করে বললেন,
—‘অন্যায় করে ফেলেছি মা। বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।’ বলতে বলতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

বিনি কাঁদছে। ডানা ঝাপ্টানো পাখির পালকের ন্যায় তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো সব ঝরে গেছে। নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। কিছুতেই আর মনকে শান্ত করতে পারছে না। এমন দুঃখ কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে তো মরে যাওয়াও ভালো। অথচ যার জন্য সে এত কষ্ট পাচ্ছে সে দিব্যি বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে।

রাগে অভিমানে শ্বাশুড়ি মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো সে। দুদিন একেবারে ঘর ছেড়েই বেরোলো না। একফোঁটা দানাপানিও মুখে তুললো নি। রাহেলা মির্জা অস্থির হয়ে পড়লেন। লজ্জায়, অস্বস্তিতে নিজে না এলেও বেশ কয়েকবার কাজের লোকদের দিয়ে খাবার পাঠালেন। কিন্তু বিনি খাবার মুখে তুললো না। জেদ ধরে বসে রইলো। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই এলেন বিনিকে খাবার খাইয়ে দিতে। এদিকে, বিনি কথা না বললেও তাঁর কোন অসম্মান করলো না। চুপচাপ তাঁর হাতে খাবার খেয়ে নিলো।

রাহেলা মির্জা বেরিয়ে গেলে হালিম মিয়া ভেতরে ঢুকলো। মলিনবসনা বিনির মুখপানে চেয়ে নিরবে চোখ মুছে আফসোস করে বললেন,
—‘অল্প বয়সে স্বামী হারিয়েছেন মা। ছোটবাবাজীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করেন নি। সমস্ত ঝড়ঝাপটা সব একা হাতে সামলেছেন। কিন্তু ছোটবাবাজী এসব বোঝে না। সে খালি মাকে কষ্ট দেয়। আপনাকেও দেবে। আপনি থাকবেন না এখানে। চলে যান। যত কষ্টই হোক না কেন চলে যান। নইলে সারাজীবন আপনাকে কষ্ট দিয়ে মারবে ছোটবাবাজী।’

সেদিন রাতে একফোঁটাও ঘুম হলো না বিনির। সারারাত ভাবলো। কিন্তু কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। যেখানে স্বামীর প্রতিই কোন ভালোবাসা নেই সেখানে শ্বাশুড়ির প্রতি দরদ থেকে কি হবে? কি লাভ এই সংসারে পড়ে থেকে? একটা অসভ্য, মাতালের সঙ্গে সংসার করার চাইতে সারাজীবন একা থাকা ঢের ভালো। কিন্তু আশ্চর্য নারীর মন। কখন কোন দিকে ঘোরে কেউ বলতে পারবে না। নইলে রাহেলা মির্জাকে এত কথা শুনিয়ে দেওয়ার পর বিনি আবার কি করে তাঁরজন্য দুঃখবোধ করে? কেন তাঁর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তৎপর হয়ে পড়ে?

পরদিন সকালে বিনিকে রান্নাঘরে দেখে রাহেলা মির্জা এবং ভৃত্যরা সকলে যারপর নাই অবাক হলো। লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি পরে কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে নিয়েছে বিনি। চুলায় রান্না করছে। শাড়ির আঁচলে ভাঁড়ারঘরের চাবি। রাহেলা মির্জাকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলো,
—‘চা খাবেন মা? একটু চা করে দেই?’
রাহেলা মির্জার চোখভর্তি পানি নিয়ে বিনির নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ মুখখানার দিকে চেয়ে রইলেন। মমতা মাখানো গলায় বললেন,
—‘সংসারের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিস। এবার দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ইফরান ঠিক তোকে ভালোবাসতে শুরু করবে।’
—‘আপনার ছেলে আপনাকে ভালোবাসে তো মা?’
বিনির ম্লান হেসে প্রশ্নটা করলো। রাহেলা মির্জা জবাব দিতে পারলেন না। হাত ইশারায় বিনিকে কাছে ডেকে বললেন,
—‘এদিকে আয় মা। তোকে একটু জড়িয়ে ধরি। আমার দুঃখ বোঝার মত কাউকে পাই না।’
বিনি তাঁর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
—‘আপনার দুঃখ আমি বুঝি মা। কিন্তু মেয়েরা কেন স্বামীর সংসার সহজে ছাড়তে পারে না বলতে পারেন?’
রাহেলা মির্জা নিজেও বাচ্চা মেয়েটির মত কেঁদে ফেললেন। দুজনেই স্নেহবঞ্চিত। একজন সন্তানের স্নেহ থেকে বঞ্চিত অপরজন স্বামীর স্নেহ থেকে বঞ্চিত।কান্নার মধ্য দিয়ে একে অপরের দুঃখগুলো ভাগ করে নিতে চাইলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here