মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-২,৩

0
385

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-২,৩
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-২

ইফরান বাড়ি ছেড়েছে একসপ্তাহ মতন হয়েছে। এই এক সপ্তাহ তাঁর কোন খবর পাওয়া যায় নি। রাহেলা মির্জা ইতোমধ্যেই বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন। ছেলের চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এই একটি মাত্র ছেলে তাঁর। কোথায় গেছে কি করছে কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক থেকে একটা টাকাও তোলে নি ইফরান। মায়ের ওপর রাগ করে না জানি কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে আছে! এইসব চিন্তায় প্রেশার মাত্রাতিরিক্ত হাই হয়ে গেছে রাহেলার।

ছেলের চিন্তায় গতকাল রাত থেকেই আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। এতকাল যাবত তিনিই প্রশ্রয় দিয়ে ছেলেকে মাথায় তুলেছেন এখন যদি সেই ছেলে শাসনের অভাবে উচ্ছন্নে যায় তবে সেই দোষ কার? নিশ্চয়ই তার নয়? ইফরান ভালো মন্দের কি বুঝে? উঠতি বয়স। রক্তগরম। কি বলতে কি বলে ফেলেছে ঠিক নেই। তাই বলে তিনি কি করে ছেলেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললেন! তিনি তো মা! গাছ যদি ফলের ভার সইতে না পারে তবে কে সইবে?

দিশেহারা জননী অস্থির হয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুললেন। তাঁর ছেলে নিখোঁজ অথচ এই বাড়ির কারোর কোন মাথাব্যথা নেই। টাকা দিয়ে এক একটা কালসাপ পুষেছেন। একবার ইফরান বাড়ি ফিরুক তারপর সবকটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন।

বাড়ির পুরোনো ভৃত্য হালিম মিয়া রোজকার ডিউটি অনুযায়ী বাগানে পানি দিচ্ছিলো। চিৎকার শুনে সে পড়িমরি করে ছুটে এলো। ক্ষিপ্ত রাহেলাকে শান্ত করার চেষ্টায় জোড়হস্তে আর্জি জানিয়ে বললো,
—‘যেখান থেকে পারি ছোটবাবাজী কে ধরে আনবো মা। আপনি শান্ত হোন। এভাবে উত্তেজিত হলে আপনার শরীর খারাপ করবে।’

ছেলের শোকে কাতর পুত্রজননী ক্রোধে গর্জে উঠলেন। বাম হাত উঁচিয়ে বাধা দিয়ে বললেন,
—‘থাক। আমার ছেলের জন্য তোদের কাউকে ভাবতে হবে না। তোরা যে ওর ভালো চাস না সে আমি ভালো করেই জানি। আমি নিজে যাবো থানায় ডাইরি করতে। আমার ছেলেকে খুঁজে বার করবো। তুই বিদায় হ আমার চোখের সামনে থেকে।’

স্নেহের প্রতিদানে এমন মিথ্যে অপবাদ সইতে পারলো না হালিম মিয়া। সহসা চোখ ছলছল করে উঠলো। ইফরানকে সেই ছোটবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে সে। কখনো এতটুকু আঘাত লাগতে দেয় নি। দুজনের ভীষণ ভাবভনিতাও ছিলো। বড় হওয়ার পরে সেটা অনেকাংশে কমে গেছে যদিও কিন্তু তাই বলে ইফরানের ক্ষতি চাইবে এমন অকৃতজ্ঞ, নিমকহারাম হালিম মিয়া নয়। এখনো ইফরানকে আগের মতই স্নেহ করে সে। ইফরানও পারতপক্ষে হালিমের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। হালিম মিয়া আহত, মলিন কন্ঠে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললো,

—‘আপনি ভুল করছেন মা। ছোটবাবাজী কে আমি নিজের ছেলের মতই ভালোবাসি। তাঁর ক্ষতি আমি কোনদিন চাইবো না। সে তো হাতের ওপর দিয়েই বড় হয়েছে। তাঁর ক্ষতি আমি কি করে চাই?’

হালিমের কথায় কিছুটা শান্ত হলেন রাহেলা। শাড়ির আঁচলে চোখে মুছে বললেন,’তবে যেখার থেকে পারিস আমার ছেলেকে নিয়ে আয়। ওকে দেখতে না পেলে আমি মরে যাবো।’

হালিম মিয়া দেরী করলো না। তৎক্ষণাৎ ড্রাইভার লতিফকে সাথে নিয়ে ইফরানের বন্ধুদের বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলো। একমাত্র বন্ধুদের বাসায় গেলেই ইফরানের খোঁজ পাওয়া যায় নইলে আর কোথাও নয়।

যাওয়ার সময় রাহেলা বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন,’ইফরান যদিও আসতে না চায় তাহলে বলবি আমি অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। ডাক্তার আমাকে টেনশন করতে বারণ করেছেন। আমি শুনছি না। বারবার করে শুধু ওর কথা বলছি।’
একমাত্র ছেলে। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনলে নিশ্চয়ই রাগ করে থাকতে পারবে না। হালিম অমত করলো না। রাহেলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইফরানের বন্ধুর বাসায় রওনা হলো।


এই একসপ্তাহ ইফরান বন্ধুর বিয়েতে ছিলো। ঢাকা থেকে প্রায় দেড়’শ কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জে বন্ধুর বিয়ে। গতকালই অনুষ্ঠান শেষ করে হোটেলে ফিরেছে। টাকাপয়সা যা ছিলো সব ফুরিয়ে গেছে। ভেবেছিলো আজকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলবে। কিন্তু এসে দেখলো ড্রাইভারকে লতিফকে নিয়ে হালিম মিয়া হাজির।

তাদেরকে দেখে খুব বেশি চমকালো না ইফরান। মাকে তাঁর চেনা আছে। প্রতিবারই রাহেলা মির্জা এমন রাগ দেখিয়ে ইফরানকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন তারপর আবার অসুস্থতার ভান করে নিজেই বাড়ি ফিরিয়ে নেন। কিন্তু এবার আর ইফরান ফিরবে না। এবার মাকে খুব ভালো করে একটা শিক্ষা দিতে চায় সে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করাটা যে ঠিক হয় নি সেটা মাকে বোঝাতে হবে।

ইফরানকে দেখে লতিফ অত্যন্ত কাঁদোকাঁদো ভঙ্গি করে বললো,’মায়ের শরীর খুবই খারাপ ছোটহুজুর। বিছানায় শয্যা নিয়েছেন। আপনাকে বাসায় যেতে হবে।’

ইফরান আলমারি থেকে একটা সাদা একটা শার্ট বের করলো গায়ে দেওয়ার জন্য। সেটার ভাঁজ খুলতে খুলতে হালিম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—‘কি হয়েছে?’

কি অসুখের কথা বলতে হবে সেটা শিখিয়ে দেন নি রাহেলা মির্জা। হালিম মিয়া বিপাকে পড়ে গেলো। ঘুরে ফিরে একটা অসুখের নামই মাথায় আসছে তাঁর। সেটা হলো হাইপ্রেশার। প্রতিবারই এই এক-ই অসুখের কথা বলে হালিম। আজও তাই বললো।
—‘প্রেশার বেড়েছে। খুব টেনশন করছে আপনার জন্য।’
—‘ডাক্তার দেখাও নি?’
—‘ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর নিদ্রাহীনতা থেকে শরীর খারাপ হয়েছে। আপনি না গেলে সমস্যা আরো বাড়বে। আপনাকে একবার যেতে হবে বাবাজী।’

ইফরান অলরেডি গায়ে শার্ট জড়িয়ে নিয়েছে। হাতা ফোল্ড করে গায়ে পারফিউম স্প্রে করলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে প্রশ্ন করলো,’তুমি ঠিকানা পেলে কার কাছ থেকে?’
—‘আপনার বন্ধু দিয়েছে।’
—‘ঠিক আছে তোমরা যাও। আমি বিকালে আসবো।’
—‘এখন আমাদের সঙ্গে যাবেন না?’
—‘না। এখন আমার একটা কাজ আছে।’

গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেলো ইফরান। বাইরে তাঁর বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। একটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে তাদের সঙ্গে। কিন্তু হালিম মিয়া আর লতিফ নড়লো না। তাঁরা বিকাল পর্যন্ত হোটেল রুমেই বসে রইলো। টানা পাঁচঘন্টা বসে থাকার পরেও যখন ইফরানের দেখা মিললো ন, তখন বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফোন করলো হালিম। হালিমের স্ত্রী সফুরা জানালো বাড়িতে যায় নি ইফরান।
তারমানে ফাঁকি দিয়েছে। অবশেষে হালিম মিয়া এবং লতিফ নিজেদের আলোচনা করে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো। এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। ইফরানকে সঙ্গে করে বাড়িতে না নিয়ে গেলে রাহেলা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবেন। তখন আর নিঃশ্বাস ফেলার জো থাকবে না।

দুজনে চুপচাপ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেটের কাছাকাছি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। ইফরান তাদের দেখতে পেলে ভেতরে ঢুকবে না। তাই এই বুদ্ধি।

সন্ধ্যা থেকে বসে থাকতে থাকতে মশার কামড়ে দুজনেরই বেহাল দশা। অন্ধকারে রক্তচোষা দানবের মত আক্রমণ করছে মশাগুলো। লতিফ অত্যন্ত বিরক্তের সহিত একদলা থুথু নিক্ষেপ করে বললো,’শালায় একটা জালিম হালিম ভাই। মাইনসের রুহ নাই এর মধ্যে। নইলে গর্ভধারিণী মায়ের অসুখের কথা শুইন্নাও কেউ এমুন করে? আমি হইলে এমন পোলারে ত্যেজ্য করতাম।’

হালিম মিয়া নিজেও মশার কামড়ে অস্থির। তথাপি লতিফের কথায় জবাব দিলো না সে। চুপচাপ ঘাপটি মেরে বসে রইলো। রাত দুটোর দিকে ইফরানের ছায়ার মতন কিছু একটা দেখা গেলে দুজনেই সতর্ক হলো। গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট ধরিয়েছে ইফরান। নিশ্চিত হতেই লাফ দিয়ে তাঁকে জাঁপ্টে ধরলো দুজনে। ইফরান শতচেষ্টা করেই নড়তে চড়তে পারলো না। আহত সিংহের ন্যায় গর্জন করলো কিছুক্ষণ কিন্তু দুজনের কেউই তার চিৎকার কানে তুললো না। জোরপূর্বক গাড়িতে উঠিয়ে হাতমুখ বেধে দিলো।


মুখের বাঁধন খুলতেই ইফরান গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে বাঘের মতন হুংকার ছাড়লো। ক্রোধে অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো তাঁর ফর্সা চেহারা। ঘাড়ের রগ ফুলে উঠলো। লতিফের পশ্চাৎদেশে সজোরে লাথি মেরে বললো,
—‘শুয়োরের বাচ্চা কি দিয়ে মুখ বেঁধেছিস? গন্ধে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো।’

লতিফ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বললো,’আমার কুনো দোষ নাই ছোটহুজুর। হালিম ভাইয়ের ঘামছা।’

ক্ষ্যাপাটে ইফরান তৎক্ষণাৎ হালিমের দিকে বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হালিম ভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। রাহেলা অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’এত রাগ করিস না বাবা। ওদের কোন দোষ নেই। আমি ওদেরকে পাঠিয়েছে। তোকে না দেখে যে থাকতে পারছিলাম না।’

ইফরান গা থেকে মায়ের হাতটা সরিয়ে ঠাটিয়ে চড় বসালো লতিফের গালে। চড় খেয়ে লতিফ হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়লো। কান লাল হয়ে আগুনের মত ধোঁয়া বেরোতে শুরু করলো। রাহেলা এবং হালিম দুজনেই ভয়ে আতংকে পাণ্ডুর হয়ে গেলো। ইফরান রাগে কাঁপছে। জানোয়ার দুটো এমন শক্ত করে তাঁর হাত বেঁধেছে যে রক্ত জমে কালশিটে পড়ে গেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে রাহেলা মির্জা ইশারায় দুই অনুচরকে দ্রুত প্রস্থান করার নির্দেশ দিলেন। অনুমতি পেয়ে লতিফ আর একমুহূর্তও দেরী করলো না। একদৌঁড়ে বাড়ির বাইরে। ইফরান পিছু ডেকে বললো,’হারামজাদা দাঁড়া তুই। তোর পালোয়ানগিরি আমি ছুটাচ্ছি।’

হালিম দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি পালাবে বুঝতে পারছিলো না। রাহেলা সেটা লক্ষ্য করে ধমকে উঠে বললেন,’তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোদের জন্য কি আলাদা করে ছেলের সাথে দুটো কথাও বলতে পারবো না? যা দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে।’

গৃহকর্ত্রীর ইশারা পেয়ে হালিম আর দেরী করলো না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। বস্তুত তাকে ইফরানের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যেই জোরপূর্বক বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন রাহেলা মির্জা। নইলে ইফরানের যা রাগ উঠেছে দুচার কথা শুনিয়ে দিতে সে ছাড়বে না। আর স্নেহান্ধ হালিম সেটা সহ্য করতে পারবে না। কেঁদেকেটে সারা হয়ে যাবে।

রাহেলা ছেলের হাত ধরে টেনে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। এইবেলায় আর ভুলেও ছেলের বিয়ের কথা তুলবেন না। এখন আপাতত রাগটা কমাতে পারলেই হয়েছে। বিয়ের জন্য তিনি আলাদা প্ল্যান করে রেখেছেন।
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৩

ইফরানকে সচরাচর বাড়িতে পাওয়া যায় না। কদাচিৎ যদিও বা থাকে টেনিস কোর্টে বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস খেলবে কিংবা বাবার বৈঠকখানায় বসে সুরাপান করবে। এছাড়া বাড়ির অন্যকোন সীমানায় তাঁর পদচারণ নেই।

তবে আজকে অনেকক্ষণ যাবত বাগানে বসে আছে। বাগানে বসে একা একা সিগারেট ফুঁকছে। আশেপাশে বিয়ের জমজমাট আয়োজন। ইফরানের সেই দিকে মন নেই। সে ভাবছে অন্য কথা। যেই বিয়েটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে তাঁর এত হাঙ্গামা হলো ঘুরেফিরে সেই বিয়েটাই করতে হচ্ছে তাঁকে। অবশ্য এমনি এমনি বিয়েতে রাজি হয় নি সে। বিয়ের জন্য রাহেলা মির্জাকে কিছু শর্ত দিয়েছিলো। রাহেলা মির্জা বিনা প্রতিবাদে তাঁর সব শর্ত মেনে নিয়েছেন।

ইফরানের অনেকগুলো শর্তের মধ্যে অন্যতম কিছু শর্ত হলো, বিয়েটা হয়ে গেলে আর কখনো, কোন কিছু নিয়ে তাঁকে জোর করতে পারবেন না রাহেলা মির্জা, দ্বিতীয়ত আশি লক্ষ টাজা দিয়ে তাঁকে একটা নতুন রেঞ্জ রোভার গাড়ি কিনে দিতে হবে। প্রতিমাসে নিজের ইচ্ছেমত হাত খরচের টাকা তুলতে পারবে সে। এছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে যখন খুশি, যেখানে খুশি বেরোতে পারবে। কেউ কোন বাধা দেবে না।

আপনমনেই হেসে ফেললো ইফরান। এরকম হলে আরো দুচারটা বিয়ে করতেও আপত্তি নেই তাঁর।

বাগানের চারদিকে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। শিরশির একটা অনুভূতি। ইফরান সিগারেট নিভিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের গেঞ্জিটা খুলে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লো সুইমিংপুলে। শীতল আবহাওয়াতে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা। বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ওপরতলা থেকে রাহেলা তাঁকে দেখতে পেয়ে লতিফকে পাঠালেন পানি থেকে তুলে আনার জন্য।

লতিফ মিয়া কাছে এসে উদ্বেগ প্রকাশ করে বললো,
—‘আজকে আকাশের অবস্থা ভালো না ছোটহুজুর। বেশিক্ষণ পানিতে থাকা ঠিক হবে না। যে কোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে। এই বৃষ্টিতে ভিজলে বুকে কফ বসে যাবে।’

বাস্তবিকই আকাশে কালো মেঘ জমেছে। চারদিকে ধূসর অন্ধকার। ইতোমধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও পড়তে শুরু করে দিয়েছে। ইফরান পুল থেকে উঠে ডেকের ওপর বসলো। হাত ইশারায় লতিফকে কাছে ডেকে বললো,
—‘এদিকে এসো লতিফ মিয়া। তোমাকে একটা গোপন কথা বলবো।’

লতিফ মিয়ার হাতে পরিষ্কার, ধবধবে সাদা একটা তোয়ালে। অন্দরমহল থেকে ইফরানের মাথা মোছার জন্য নিয়ে এসেছে। সেটা তাঁর হাতে দিয়ে বললো,’মা উপরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে বলেছে গরম দুধ দিয়ে যেতে।’

ইফরান তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছলো। সিল্কি চুলগুলো ইতোমধ্যেই বাতাসে উড়তে শুরু করে দিয়েছে। দেখতে অপূর্ব লাগছে। এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে অবশিষ্ট পানি ঝরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—‘আমি এখন দুধ খাবো না। তুমি বসো। তোমার সঙ্গে আমার দরকারী কথা আছে।’
লতিফ প্রথমে কুণ্ঠিত বোধ করলো। সেদিন ইফরান ভালোমতোন রাগ ঝাড়তে পারে নি তাঁর ওপর। আজকে যদি সেরকম কিছু প্ল্যান করে থাকে তবে লতিফের কি হবে? কে বাঁচাবে লতিফকে ইফরানের হাত থেকে? যদি গোপন কথা বলার নাম করে ইফরান তাঁকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেয়? পানিতে লতিফের ফাঁড়া আছে। ছোটবেলা থেকেই পুষ্করিণী ভীষণ ভয় পায়। ভীত, দ্বিধান্বিত গলায় প্রশ্ন করলো,
—‘কি কথা?’
—‘বলছি। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা ওয়াদা করতে হবে। সেটা হচ্ছে এখন আমি তোমাকে যেই কথাটা বলবো সেটা তুমি আর কাউকে বলতে পারবে না।’
লতিফ ঘাড় কাত করে সায় জানালো। বললো,’বলবো না।’
ইফরান গলা খাদে নামিয়ে নিলো। খুব সন্তর্পণে এদিকে ওদিক চেয়ে ফিসফিস করে বললো,’বিয়ের দিন বর বদল হবে। আমি থাকবো না। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে যাবো। আমার জায়গায় অন্য একজন থাকবে। তুমি কিন্তু কাউকে বলো না আবার।’

লতিফ চোখ বড়বড় করে ইফরানের দিকে চাইলো যেন ভূত দেখেছে। রক্ত শূন্য পাণ্ডুর হয়ে গেলো তাঁর ভয়ার্ত মুখখানা। ছোটহুজুর এসব কি বলছে? রাহেলা মির্জা কত শখ করে ছেলের বিয়ের আয়োজন করছেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে জলের মতন টাকাপয়সা খরচ করছেন চারদিকে। কোথাও এতটুকু কার্পণ্য রাখছেন না। এখন যদি তিনি জানতে পারেন ইফরান তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পালানোর প্ল্যান করছে তাহলে নির্ঘাত হার্ট এ্যাটাক করে মরে যাবেন।
—‘পালানোর জন্য আমার তোমার সাহায্য লাগবে লতিফ মিয়া। আমি একা বাড়ি থেকে বেরোতে পারবো না।’
লতিফ তখনো বিস্ময়ে হতবুদ্ধি। ইফরানের ডাকাডাকিতে প্রাথমিক বিস্ময় ভাব কাটিয়ে আফসোসের সুরে বললো,’মা শুনলে খুব কষ্ট পাবে। তাঁর অনেক আশা ভরসা আপনার বিয়ে নিয়ে।’
—‘মায়ের সঙ্গে আমি বুঝে নেবো। তুমি শুধু আমার পালানোর ব্যবস্থাটা করে দেবে।’
লতিফ কথা বাড়ালো না। কাচুমাচু চেহারা নিয়ে বললো,’আমি একটু শৌচালয়ে যাবো ছোটহুজুর। প্রাকৃতিক চাপ পেয়েছে।’
—‘ঠিক আছে যাও।’
খানিকটা তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো লতিফ। যত যাই হোক কথাটা রাহেলা মির্জাকে জানাতেই হবে। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ানক বড় সর্বনাশ।

লতিফ চলে গেলে ইফরান ভাবলেশহীনভাবে তোয়ালে টা একপাশে রেখে পুনরায় পানিতে নেমে পড়লো। সে জানে একটু পর কি হতে চলেছে। বিয়ের এতসব জমজমাট আয়োজন, হৈ-হল্লা, আনন্দ উৎসব আর কিচ্ছু থাকবে না। তাঁর পালিয়ে যাবার খবর শুনে বাড়ির সবকটা লোকের হুঁশ উড়ে যাবে। রাহেলা মির্জা আর কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবেন না। এক এক করে সবাইকে লাগিয়ে দেবেন ইফরানের পেছনে গুপ্তচরগিরি করার জন্য। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ বোধ করলো ইফরান। যেই বিয়েতে তাঁর মত নেই সেই বিয়ে এত শান্তিপূর্ণ ভাবে সে হতে দেবে না। এবার বুঝুক সবাই ইফরানকে খেপানোর শাস্তি।


দুপুর বেলা খাবার টেবিলেই ইফরানের পালানোর বিষয়টা তুললেন রাহেলা মির্জা। লতিফ মোটেই দেরী করে নি। তৎক্ষণাৎ রাহেলাকে সব জানিয়ে দিয়েছেন।
খেতে বসে রাহেলা ছেলের নির্লিপ্ত, শান্তশিষ্ট ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করে গম্ভীর থমথমে গলায় প্রশ্ন করলেন,
—‘এসব আমি কি শুনছি ইফরান? তুমি নাকি বিয়ের দিন পালিয়ে যাবে বলেছো?’
ইফরান সোজাসুজি জবাব দিলো না। পাল্টা প্রশ্ন করে বললো,’লতিফ মিয়া বলেছে তোমাকে?
—‘কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। কথাটা সত্যি কিনা তাই জানতে চাইছি? তোমার সব শর্ত আমি মেনে নিয়েছি। বিয়ের আয়োজনও সব শেষ। তাহলে এখন এসব ঝামেলা করার কি মানে?’
—‘মজা করেছি।’

রাহেলার সন্দেহ গেলো না। ইফরানের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা। বিয়েটা সে নিজের ইচ্ছেতে করছে না। সুতরাং কোন একটা ঝামেলা যদি বাধায়ও তিনি অবাক হবেন না। লতিফ তো বলেছেই লাফাঙ্গা বন্ধুগুলোকে নিয়ে ইতোমধ্যে প্ল্যানও করে ফেলেছে। তারমানে ঝামেলা বাধানো নিশ্চিত। অগত্যা তিনিও চুপ করে গেলেন। তাঁর সন্দেহ হয়েছে বুঝতে পারলে ইফরান সতর্ক হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং চুপিচুপি নজরদারি রাখবেন।

ইফরান নির্বিকার। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মত খাচ্ছে। মনে মনে সে ঠিকই জানে মা তাঁর কথা বিশ্বাস করে নি। কিন্তু তাই বলে সত্যিটা বলে দিয়ে মাকে নিশ্চিন্ত করবে অতোটা ভালো ছেলেও সে নয়। উল্টে তাঁর মজা লাগছে। কারণ মা যদি টেনশনে থাকে তাহলে বাকিদেরও শান্তিতে থাকতে দেবেন না তিনি। একেবারে দায়িত্ব নিয়ে সবার ঘুম হারাম করে দেবেন।

লতিফ তখন এদিকেই খাবার নিয়ে আসছিলো। টেবিলে ইফরানকে বসা দেখে আর এগোলো না। সে যে রাহেলা মির্জাকে সব বলে দিয়েছে এতক্ষনে ইফরান নিশ্চয়ই জেনে গেছে। সামনে পেলে তাঁকে আর ছাড়বে না। তাই খাবারের বাটিটা মিনুর হাতে দিয়ে সে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলো। একদিন আর ভুলেও ইফরানের চোখের সামনে ধরা দেবে না।

বিয়ের বাকি দিনগুলো রাহেলা মির্জা কড়া পাহারার ব্যবস্থা ইফরানের জন্য। বাড়ির ভৃত্যদের কারো আর শান্তিতে দম ফেলার জো রইলো না। ইফরানের পেছনে নজরদারি, বিয়ের আয়োজন সবমিলিয়ে তাদের অবস্থা একেবারে নাজেহাল।
বিয়ের দিন ঝুম বৃষ্টির মাঝেই গেটে বিশজন ভৃত্যকে পাহারায় বসালেন রাহেলা মির্জা। ছয়সাতজন কে বসালেন ইফরানের ঘরের ঠিক সামনে। হালিম মিয়া আর লতিফ বসলো বারান্দায় পাহারা দিতে। মোটকথা যাই হয়ে যাক না কেন বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ইফরানকে কোন মতেই একা ছাড়া যাবে না। সর্বদা তার চারপাশে লোকজনকে থাকতে হবে।
ইফরানের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সবার শান্তি কেড়ে নিয়ে সে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝেমাঝে সবার দুবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here