মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১

0
469

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-১
অরিত্রিকা আহানা

মালিবাগ মোড়ের ৮ নম্বর বাড়িটার নাম “গীতাঞ্জলী”। বাড়ির মালিক অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবু আলী মির্জা, খুব শখ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন ”গীতাঞ্জলী”। তিনি রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র সংগীত, রবীন্দ্র রচনা, রবীন্দ্র চর্চা ছিলো তাঁর অবসর সময়ের একমাত্র সঙ্গী ।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমানে তিনি জীবিত নেই। একমাত্র পুত্র এবং স্ত্রীকে রেখে প্রায় পনেরো বছর আগে গত হয়েছেন। বাড়িটা এখনো আগের মতই আছে। মাঝখানে শুধু দুবার রং করা হয়েছে। এর বাইরে কোন নতুন সংযোজন করা হয় নি।

নয় কাঠা জমির ওপর নির্মিত প্রকান্ড এই বাড়িটির বয়স খুব বেশি নয়। বড়জোর ত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর হবে। চতুর্দিকে পুরু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ফটক পেরিয়ে সামনে এগোলেই হরেক রকমের ফুলের বাগান। দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। এছাড়া দক্ষিণ পাশে টেনিস কোর্ট, পেছনে সারি সারি নারিকেল আর সুপারির বাগান। সবমিলিয়ে মনে হয় আগেরকার দিনের সম্ভ্রান্ত কোন জমিদার বাড়ি। এই বাড়িতে নেই এর মধ্যে কেবল একটা পুকুর। একটা পুকুর থাকলে একেবারে সোনায় সোহাগা হতো।

বাড়িটির বাহ্যিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর হলেও এর প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে, ভেতরের সৃষ্টিকর্মগুলো! অন্তঃপুরের এক একটি কামরা যেন এক একটি শিল্পকর্ম! বসার ঘরের দেওয়ালটি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগরের খোদাইকৃত স্মৃতিস্তম্ভ দিয়ে সাজানো। দেখলে মনে হয় যেন অভ্যাগত অতিথিদের দিকে চেয়ে হাসছেন রবীঠাকুর। অতিথিদের বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছে একপাশের বেতের সোফা দিয়ে। আরেক পাশে নকশা করা বইয়ের তাক। যেগুলোর বাজারমূল্য এখনকার সময়ে লাখেরও বেশি। সবগুলোই মজবুত সেগুন কাঠ দিয়ে গড়া। তাকে সাজানো বইয়ের সমাহার দেখলে বোঝারই উপায় নেই এগুলো ব্যক্তিগত সংরক্ষণ। সংখ্যায় গুণে শেষ করা যাবে না এত বই।

এছাড়া প্রতিটা কামরায় কারুকাজ খচিত আসবাবপত্র আর দামী দামী শোপিস। এগুলো নিঃসন্দেহ বাড়ির মালিকের আভিজাত্যের নিখুঁত প্রমাণ বহন করে। আর ঠিক সেইজন্যই ঢাকার শহরের অগণিত বিলাসবহুল বাড়ির মাঝেও এই বাড়িটির বিশেষত্ব সবার আলাদা ভাবে নজর কাড়ে।

কাজের লোক বাদ দিলে এই বাড়ির মোট সদস্য সংখ্যা মোটে তিন। আর যদি কাজের লোকে সহ হিসেব করা হয় তবে সংখ্যাটি প্রায় বিশের কাছাকাছি গিয়ে পোঁছায়।

গীতাঞ্জলীর পরিবেশ আজকে উত্তপ্ত! ভেতরের প্রত্যেকেটা মানুষ এই মুহূর্তে আতংকে আছে। তাদের এই আতংকের কারণ মির্জা দম্পতীর একমাত্র ছেলে ইফরান মির্জা। এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী, রাহেলা মির্জার নয়নের মণি। বিগত পনেরো দিন যাবত বাড়ির বাইরে ছিলো ইফরান। বন্ধুদের সঙ্গে সিলেট ভ্রমনে বেরিয়েছিলো। এই পনেরো দিন বাড়ির সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিলো না তাঁর। আজকে সকালেই ফিরে এসেছে। এসেই হুলুস্থূল। এইমুহূর্তে রাহেলা খন্দকারের সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলছে তাঁর।

ইফরান মির্জা অবশ্য খুব নরম, কোমলচিত্ত একজন মানুষ। বর্তমান যুগে এমন মসৃণ, নমনীয় চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর দয়ালু চিত্তের উদাহরণ স্বরূপ আজকে সকালের ঘটনাটাই উল্লেখ করা যাক; সকাল বেলা বাসায় ফিরেই তিন তিনজন ভৃত্যকে জরিমানা করেছে সে। তাদের অপরাধ; নিষেধ করা সত্ত্বেও ইফরানের ঘরে খাবার নিয়ে গেছে তাঁরা এবং তিনজনেই তিন তিন বার করে খাবার অনুরোধ করেছে। এই হেতু নিয়ে অসহায় লোকগুলোর বেতনের পঁচিশ শতাংশ কেটে রেখেছে ইফরান। অপরাধিরা না পারছে সইতে না পারছে কোন প্রতিবাদ করতে।
কারণ, প্রতিবাদ করা মানে বেতনের পুরো টাকাটাই জলে যাওয়া। ইফরান সঙ্গে সঙ্গে বেতন কাটার ফরমান জারি করে দেবে।
রাহেলা যদিও পরে সমস্তটা পুষিয়ে দেন কিন্তু সেটা অনেক কথা শোনানোর পরে। সেইজন্যই ইফরান সামান্য কিছু হলেই ভৃত্যদের বেতন কেটে জব্দ করে।

সাধারণত ইফরান বাড়ির বাইরে থাকলেই ভৃত্যরা সকলে আনন্দে থাকে। স্বস্তি পায়। যতক্ষণ সে বাসার বাইরে থাকে ততক্ষণ বাড়িতে শান্তি বিরাজ করে। সে বাসায় এলেই শুরু হয় লঙ্কাকাণ্ড। একেকবার একেক ঘটনা নিয়ে রাহেলা মির্জার সঙ্গে কলহ বাধানো তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ গুলোর মধ্যে একটি। ছেলের সঙ্গে টিকতে না পেরে রাহেলা মির্জা মেজাজও থাকে তখন আকাশচুম্বী। ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় ভৃত্যরা সবাই। পান থেকেই চুন খসলেই চাকরী চলে যাওয়ার ধাতানি থেকে শুরু করে ইফরানের অকথ্য ভাষায় গালাগাল, প্রতিনিয়ত তাদের জীবনযাত্রাকে অসহ্য করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ইফরানের বয়স যখন দশ, তখন আবু আলী মির্জা পরলোক গমন করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর রাহেলা মির্জা পুনরায় বিয়ে করেন নি। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গোটা জীবন একা কাটিয়ে দিয়েছেন।
আর ঠিক সেই কারণেই ইফরান মায়ের কাছ থেকে একটু বেশিই আদর পেয়ে বখে গেছে। পিতৃহীন ছেলের সমস্ত আবদার পূরণ করতে গিয়ে রাহেলা মির্জা যে কখন ছেলেকে এতটা বেয়াড়া বানিয়ে ফেলেছেন সেকথা তিনিই নিজেও বুঝতে পারেন নি। ইফরান এখন পুরোদস্তুর বখাটে। রাত বিরেতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, যুবতী মেয়েদের ইভটিজিং করা, ক্লাবে বসে মদ্যপান করা, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে সিগারেট ফুঁকা ছাড়া তাঁর দিন চলে না। যত দিন যাচ্ছে এসব উশৃঙ্খলতা তত বাড়ছে।
রাহেলার কান্নাকাটি, অশ্রুবিসর্জন, মাথার দিব্যি কিছুই কাজে আসছে না। নিজের খেয়ালখুশি মতই চলছে ইফরান।

শেষকালে হিতৈষীদের পরামর্শে ছেলের বিবাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন রাহেলা মির্জার। ঘরে বউ এলে যদি এমন দস্যি ছেলের লাগাম টানা যায়। এছাড়া ইফরানকে ঘরমুখো করার আর কোন উপায় নেই।

সেই কারণেই, বিবাহ ভন্ডুলের অভিপ্রায়ে মায়ের সঙ্গে কাটাকাটি চলছে ইফরানের। মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। দরকার পড়লে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবে। তবুও চেনা নেই জানা নেই এমন কাউকে বিয়ে করবে না।

—‘আমি কিছুতেই ঐ মিডেলক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করবো না মা!’

রাহেলা মুখ বিকৃত করলেন। এই ছেলে দিবারাত্রি তাঁর হাড়মাংস জ্বালিয়ে খাচ্ছে। ছেলের দিকে কুপিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
—‘তবে কোন জমিদারের বাচ্চা তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে শুনি? বড়লোকের মেয়েরা তোমার এসব অন্যায়,অনাচার সহ্য করবে? থাকবে সব মেনে নিয়ে? মোটেও থাকবে না। দুদিন বাদে কপালে লাথি মেরে ভাগবে!’

—‘ভাগলে ভাগলে। সে আমি বুঝবো। তুমি আগে বিয়ে ক্যান্সেল করো। আমার পক্ষে কিছুতেই এই বিয়েটা করা সম্ভব না। বন্ধুবান্ধব মহলে আমার একটা প্রেস্টিজ আছে। এই মেয়েকে বিয়ে করলে মানসম্মান বলে আর কিছু থাকবে না।’

অত্যাধিক দুঃখেও হাসি পেলো রাহেলার। রোজ মদ খেয়ে চাকর বাকরের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে তবেই সারা, সেই ছেলের নাকি আবার প্রেস্টিজ! হাসি থামিয়ে থমথমে গলায় বললেন,
—‘বিয়ে তোমার বিনিকেই করতে হবে।এই আমার শেষ কথা।’
—‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মা। আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’
—‘সে তোমার মর্জি! বিয়ের ডিসিশন ফাইনাল।’
—‘তাহলে আমারও একটা ফাইনাল ডিসিশন শুনে রাখো, বিয়ে আমি আমার পছন্দ মতই করবো। এবং এমন মেয়েকে করবো যে তুমি লজ্জায় আত্মীয় স্বজন কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। তখন বুঝবে বাড়াবাড়ি কি জিনিস!’
—‘মুখ তো আমি এখনো দেখাতে পারছি না। যেই মায়ের তোমার মত এমন কুলাঙ্গার সন্তান আছে সেই মায়ের কি মুখ দেখানোর জো থাকে?’
—‘তারমানে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না তাই তো?’
—‘না।’ অপ্রত্যাশিত দৃঢ় শোনালো রাহেলার কন্ঠস্বর।
—‘বেশ তবে আমি আজই বাড়ি ছাড়ছি। আর কখনো এই বাড়িমুখো হবো না বলে দিলাম।’
—‘ছাড়ো। আমিও দেখি তোমার কত ক্ষমতা! গিলছো তো বাপের হোটেলে। দুনিয়াদারির খবর রাখলে তবে না বুঝতে বাস্তবতা কি জিনিস। কত নিষ্ঠুর মায়ের কোল ছাড়া এই পৃথিবী! এই যে সাথের লাফাঙ্গা ছেলে গুলো আছে না? দুদিনও থাকবে না। একবার খালি বেরোও, দেখবে টাকা না পেলে সব লেজ গুটিয়ে ভাগবে।’

-‘শেষবারের মতন জিজ্ঞাসা করছি তুমি বিয়ে ক্যান্সেল করবে কি না?’

-‘না। বাকিটা তোমার মর্জি। তুমি বাড়ির ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি তোমাকে আটকাবো না। আমিও চাই তুমি বেরোও। বেরিয়ে দেখো, কত ধানে কত চাল।’

—‘ঠিক আছে,কিন্তু একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো, তুমি যদি এবার ভুল করেও হালিম চাচাকে পাঠিয়েছো আমাকে তুলে আনার জন্য তাহলে কিন্তু মহাঝামেলা হয়ে যাবে বলে দিলাম। এবার আমি আর ফিরবো না। তোমার অনর্থক জোর জবরদস্তি অনেক সহ্য করেছি। দিনদিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। আর না। এবার আমিও এর শেষ দেখতে চাই।’

রাহেলা হাঁ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কে কাকে সহ্য করার কথা বলছে তিনি বুঝতে পারছেন না। যেই কথা গুলো তাঁর বলার কথা ছিলো সেগুলো ইফরান বলছে। একেই বুঝি চোরের মায়ের বড় গলা বলে! ইফরান থামলো না। বললো,

—‘আর একটা কথা, একটু আগে তুমি আমাকে খাওয়ার খোঁটা দিয়েছো। কাজটা তোমার একদমই উচিৎ হয় নি। কারণ বাপের হোটেলে শুধু আমি একা গিলছি না তুমিও আমার বাপের হোটেলেই গিলছো! সুতরাং এর পর থেকে আর কখনো আমার সঙ্গে টাকার গরম দেখিয়ো না। আমার যখন যা প্রয়োজন আমি এখান থেকেই নেবো।’

বজ্রাহত, বিক্ষুব্ধ, শানিত হলেন রাহেলা! ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে রইলেন ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। এমন অসভ্য বর্বর ছেলে তিনি পেটে ধরেছেন ভাবতেই বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে! মাকে কিনা খাওয়ার খোঁটা দেয়? এমন মহাপাপী, পাষণ্ড কি আর ধরাধামে দুটো আছে? সহসা দুফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো দুঃখিনী জননীর চোখ বেয়ে। শেষকালে এই দেখতে হবে জানলে আগে থেকেই লাগাম টানতেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here