#মনের কোণে পর্ব_১৯

0
241

মনের কোণে পর্ব_১৯

আফনান লারা
.
একলা ফাঁকা পথে হাঁটছে নাবিল।আবাসিক এলাকা গুলোর পথে পথে মানুষ খুব কম থাকে।বেশিরভাগ সময় গৃহযাপন করাই তাদের ধর্ম।অফিস থেকে বাসা,বাসা থেকে অফিস।কেউবা সকালে একটু সময় বের করে জগিংয়ে বের হয়।তাও হাঁপাহাঁপিতে অফিসে ছোটা।
তবে এক দল মানুষ দেখতে পাওয়া যায় যাদের অফিস নেই,সংসারের চাপ নেই।বার্ধক্য পাড়ি জমিয়েছে তাদের জীবনে।তারা এই ফাঁকা পথটাকে একলা রাখতে দেয়না।
নাবিল তাদের মতন কজনের দেখা পেয়েছে ইতিমধ্যে।তবে সন্ধ্যার এই সময়টায় সেই বয়স্ক মানুষগুলো মোটেও একা না,সাথে তাদের সঙ্গীর ও দেখা মেলে।
কেউ নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বেরুচ্ছে,আর কেউ নিজেট প্রাণপ্রিয় পুরনো বন্ধুদের নিয়ে।
বয়স হয়ে গেলে বুঝি মানুষ জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে।তবে বয়স থাকতে কেন নয়?
বেশ বিরক্ত হলো নাবিল।বয়স্ক কাপল দেখে তার রাগ হলো কিঞ্চিত। একজন আরেকজনকে আইস্ক্রিম খাইয়ে দিচ্ছিলো।মিনিট পাঁচেক ধরে সেই কাপলকে লক্ষ করে নাবিলের এখন হিংসা লাগে।মাথা বাঁকিয়ে তাদের দালানের চতুর্থ তলার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।লিখির সাথে তার হয়ত প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক নেই,কিন্তু কাগজে কলমে তো তারা স্বামী-স্ত্রী;পাশাপাশি হাঁটা তো নিষিদ্ধ না।বিয়ে না করেও কতজন কত কি করে ফেলে আর তারা বিবাহিত হয়েও দোক্কা খাচ্ছে।
মুখটা কালো করে নাবিল আরও সামনের দিকে চললো।
সন্ধ্যা সাতটা তিন মিনিট।এসময়ে পথে বাবুর দেখা মিলবেনা।সন্ধ্যার এই সময়টাতে তার একবার প্রচুর নেশা ছিল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার।পরে মামা বুদ্ধি করে এসময়ে ওর জন্য প্রাইভেট টিউটর রেখে দিলেন।গুনে গুনে দু ঘন্টা পড়াবে সেই স্যার।বাবুর আড্ডার বারোটা বেজে গেলো।স্যার চলে যায় নয়টার সময়।তখন ওকে মামি চেপে ধরে ডিনার করিয়ে নেওয়ান,তারপর ঘুম।রাতের আড্ডা দেওয়া আর কোনোদিন বুঝি হবেনা তার।স্যার সপ্তাহের সাতটা দিনই পড়ান।ঝড়-তুফান-বৃষ্টি-হিমে ঘেরা শীতের সন্ধ্যা কিংবা চামড়া সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতন গরমকাল, কোনো কিছু তার কাছে সমস্যা না।
কি মুশকিল!
মামার বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় এক নজর তাকালো নাবিল।প্রয়োজন ছাড়া মামার বাসায় আসা পছন্দ করত না সে।আর এখন রীতিমত বাধ্য।
এক চক্কর কেটে আবারও ব্যাক করছে বাসার দিকে।দূর থেকে শোনা যায় কারোর ডাক।নাম নাবিল শুনতে পেলো বলে চোখ বড় করে দেখার চেষ্টা করলো কে আসে এত ডেকে ডেকে।কলোনীর ল্যাম্পপোস্ট এখনও জ্বলেনি বলে নাবিল চোখের সামনে ছুটে আসা মানুষটাকে দেখতে পেলোনা স্পষ্ট।অনেক কাছে আসার পর চিনতে পারলো ওটা লিখি।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো,’ ভাল্লাগছেনা একা’

‘আমি তো খুব করে সাধলাম,তুমিই তো এলেনা’

‘এখন আসলান তো,চলুন আইস্ক্রিম খাব’

নাবিল অবাক চোখে লিখির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন এই ইচ্ছেটা তার হয়েছিল,অদ্ভুত!লিখি কেমন করে জানলো?’

নাবিলকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিখি বললো,’আমি তখন বারান্দায় নিচে বসে ছিলাম,আমাকে হয়ত দেখেননি।আপনি যে হা করে আইস্ক্রিম খাইতে থাকা কাপল দেখছিলেন আর বারবার করে আমাদের বারান্দা দেখছিলেন তার কারণ আগাগোড়া বেশ বুঝেছি আমি।’

নাবিল মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেলো।মনে হলো লিখির সামনে একেবারে ছোট হয়ে গেছে।লজ্জার চোটে মাথা তুলে ২য় বার তাকায়নি।কালো কঙ্করের পথটাকে দেখতে দেখতেই পথ চলা শুরু করেছে।
লিখিকে দেখে মনে হয় উদ্যমে আছে।লাফালাফি করছে,পথের পাশে হেলে থাকা ফুল গাছ থেকে লাফ দিয়ে ফুল ছিঁড়ছে।ফুলটাকে ভালভাবে দেখে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে আবার নাবিলের মুখে ছুঁড়ে মারছে।
‘মেয়েটার হলো টা কি?সন্ধ্যায় অন্ধকারে একা বাসায় থেকে জ্বীনে ধরলো নাকি!
লিখি?’

লিখি থেমে পেছনে ফিরে বললো,’কি?’

‘তুমি ঠিক আছো?’

‘আমার হবে কি?’

‘না কিছুনা। এরকম ছটফট আগে করতেনা তো তাই একটু অবাক হচ্ছি’

লিখি ভ্রু দুটোকে কুঁচকে বললো,’আগেও চুরি করতাম,এখনও চুরি করলাম।তফাৎ কি দেখলেন?’

‘ফুল ছিঁড়ে মাথায় দেওয়াকে আমি চুরি হিসেবে ধরিনা কখনও।ফুল সুন্দর, দেখলেই ধরতে ইচ্ছা করে।হাতে নিতে ইচ্ছা করে।কিন্তু ছিঁড়ে পাশের জনের মুখে ছুঁড়ে মা*রাকে আমি স্বাভাবিক নিতে পারলাম না’

‘মনে করেন আমার মনে রাগ ও আছে,উড়াউড়ি ও আছে।দুটো একসাথ হয়ে গেলে চুরির জিনিস ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হয়।বুঝলেন?’

নাবিল বুঝলো লিখি বুঝি রেগে আছে।তবে রেগে থাকার কারণ কি?
কারণ বের করতে চায়নি নাবিল।কারণ সামনে এসে পড়েছে সংখ্যায় সংখ্যায় আইস্ক্রিম ঝুলানো আইস্ক্রিমওয়ালা।লিখি বললো প্রথমে সে শুকনো কোণ খাবে অনেকগুলো।তারপর কোণে আইস্ক্রিম দিয়ে খাবে।
যেমন হুকুম তেমন কাজ।নাবিল বারতি টাকা দিয়ে শুকনো আইস্ক্রিম কতকগুলো কিনে দিয়েছে।মচমচে কোণগুলো লিখি বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলো,এরপর আইস্ক্রিমের পুর নিয়ে সামনের দিকে চললো।আরও সামনে।অথচ তারা এখন তাদেরই বাসার সামনে।লিখি কি আরও হাঁটতে চায় নাক?নাবিল নিজেও একটা আইস্ক্রিম নিয়েছে।মিষ্টি খাবার তেমন একটা পছন্দ না ওর।তাও নিলো।সামনে একজন খাবে আর সে চেয়ে থাকবে,এটা সে হজম করলেও তার পেট হজম করবেনা,রাগ করে গুড়গুড় করবে।লিখির তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে ওর মনে হচ্ছিল খাওয়া হয়ে গেছে, অথচ ওর হাতে দিব্যি আইস্ক্রিম রয়ে গেছিল।লিখি সামনের একটা দালানের সামনে করলা গাছ দেখে দুটো ছিঁড়ে দৌড় মে*রেছে।নাবিলের মনে হলো ওর চুরি করার স্বভাব এবার তুলতে হবে।এখন আর সেই লিখি না যে চুরি করে পেট চালাবে।মা যে টাকা দেয় তাতে করে নেক্সট চৌদ্দ জেনারেশন অনায়াসে বসে খেয়ে যেতে পারবে।

করলা হাতে লিখি বললো মামির হাতে দেবে।করলা ভাজি খেতে ইচ্ছে করছে অনেক।

‘শোন লিখি, আর কোনোদিন চুরি করবেনা।আজ থেকে চুরি করা ছেড়ে দেবে তুমি’

লিখি যেন শুনলোই না।করলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে আর বলছে মনে হয় বাড়িওয়ালা ঠিকমতন সার দেয়নি।করলার সাইজ ছোট একেবারে।
নাবিল শেষে ওর হাত ধরে থামিয়ে চোখ রাঙিয়ে নিজের কথাটা আবার বললো।লিখি চুপচাপ কথাটা শুনে বললো,’শুনেছি।কিন্তু আমি তো আপনার কথায় চলবোনা।আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।সামনে যা দেখি তাই নিয়ে নিতে ইচ্ছা করে’

‘অভ্যাস কি করে ছুটাতে হয় তা আমার জানা আছে।হাত -পা বেঁধে বসিয়ে রাখবো।তোমার চুরি করা কি করে বাপ বাপ করে না পালায় তা শুধু দেখবো’

‘ওটার ইচ্ছে তো মনের।হাত পা বেঁধে কি হবে?
“আমার হাত বান্ধিবি,পা বান্ধিবি
মন বান্ধিবি কেমনে?
আমার চোখ বান্ধিবি,মুখ বান্ধিবি
পরাণ বান্ধিবি কেমনে?”

গানটা গাইতে গাইতে লিখি আরও সামনের দিকে চললো।নাবিল ভূত দেখার মতন মুখ করে ওর পিছু পিছু চলেছে।লিখির কিছু একটা তো হয়েছে।কেমন পাগলা লালনের মতন শুরু করেছে।হাবভাব কেমন যেন!!’

লিখি থেমে গিয়ে বললো,’চলুন ফিরে যাই,সোজা মামার বাসায়,করলা ভাজি করতে সময় লাগবে তো’

নাবিল ওর কথামতন চললো।মামার বাসায় এসে মামির হাতে করলা দিয়ে লিখি বললো আলু কুচি করে ভাজি করে নিতে।মামি হাসছেন খিলখিলিয়ে।নতুন বউ নাকি করলা ভাজি খাবে,তাও স্বাদ করে গাছ থেকে ছিঁড়ে এনেছে।
এই খবর বাবুর কানে যাবার পর সে এসে নাবিলকে বললো,’ভাবীর কি গাছের তরতাজা সবজি ছিঁড়ার অভ্যাস আছে?আমাদের গাছের সব বেগুন ছিঁড়ে রান্নাঘরে রেখে গেলো কাল,ভাজি করার জন্য।এখন আবার কাদের না কাদের গাছের করলা নিয়ে আসলো।তুমি এক কাজ করো,তোমাদের বাসার সামনে সবজি বাগান করো,ভাবীর তাহলে আর কষ্ট হবেনা’

নাবিল গালে হাত রেখে লিখির মুখের দিকে চেয়ে আছে।এরা তো কেউ জানেনা লিখি কয় নাম্বারের চোর।
লিখি বাবুর হাতের সোনালী ঘড়িটা দেখছে।ভীষণ দামী ব্রান্ডের মনে হয়।নাবিল বিষয়টা বুঝতে পেরে বাবুকে বললো,’বাবাই তোর ঘড়িটা খুলে আলমারিতে রাখ তো।ভাল লাগছেনা দেখতে,সিলভার একটা আছেনা?ওটা পর’

‘কেন?আম্মু আব্বু বললো সুন্দর লাগে,আর তুমি বলছো সুন্দর না?’

‘বললাম তো খুলে আলমারিতে রাখ যা’

লিখি ভেংচি কেটে রুমে চলে গেছে।নাবিল কিছুক্ষণ পর রুমে আসতেই লিখি গাল ফুলিয়ে বললো,’আমি কি ঐ ঘড়িটা নিতাম?মুখের উপর ঐ কথা কেন বললেন?’

‘তোমার স্বভাব জানা আছে’

লিখি আঙ্গুল তুলে বললো,’আমার শুধু আপনার হাতের ঘড়িটার দিকে নজর। অন্য ঘড়ি এই লিখি নেবেনা!’

নাবিল তাচ্ছিল্য করে হেসে নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখলো তার হাতে ঘড়ি নেই।অমনি খচখচ আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে দেখলো লিখি ওর ঘড়িটা উপরে তুলে নাড়ছে আর হাসছে।

‘কেমনে নিয়ে নাও? টেরই পাইনা।’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here