#সুখের_নেশায় পর্ব ২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
‘ চৈত্রিকার গালে থাপ্পড় দেওয়ার অধিকার আমি কাউকে দেই নি। তোর সাহস কি করে হলো জেরিন?এখুনি বেরিয়ে যাবি আমার বাড়ি থেকে। নয়ত আমি ভুলে যাবো সম্পর্কে কিছু হোস আমার।’
হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে সাফারাত। চেষ্টা করে যাচ্ছে রাগ সংবরণের। কপালের শিরা গুলো ফুলে,ভেসে উঠেছে স্পষ্ট। চোখ দুটো যেন জলন্ত অগ্নিশিখা। সাফারাতের এহেন ক্রোধান্বিত রূপে বাড়ির সকলে ভয়ে সেঁটে আছে। জেরিন ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
‘ মেয়েটা তোমাকে অনুমতি বিহীন স্পর্শ করেছে সাফারাত। আমি তো জাস্ট মেয়েটার বেয়াদবির জন্য থাপ্পড় দিয়েছি। তাছাড়া তুমি তো চিনো না মেয়েটাকে। অচেনা একটা মেয়ের এমন ব্যবহার মোটেও শোভা পায় না। ফকি,,
মুহুর্তে সাফারাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জেরিনের দিক,যা দেখে বেলুনের মতো চুপসে গেল জেরিন। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল সাফারাত,
‘ অচেনা একটা মেয়েকে থাপ্পড় মারা শোভা পায় তোর?তাও যে তোর বয়সে বড়?আমার বাড়ি তে কে আসবে,কে আমায় স্পর্শ করবে সেটা আমি ভাববো। তুই কেন আঘাত করবি?তুই এ বাড়িতে সেদিনই পা রাখতে পারবি যেদিন চৈত্রিকা তোকে ক্ষমা করবে। পাক্কা দশ মিনিট পর যেন তোকে এই বাড়ির আনাচে কানাচেতে ও না দেখি আমি।’
‘ এটা আমার মামার বাড়ি। তুমি এভাবে আমাকে বের করে দিতে পারো না সাফারাত।’
‘ এটা আমার বাড়ি। আমার মায়ের বাড়ি।’
তেজী কন্ঠে চিল্লিয়ে বলে উঠল সাফারাত। জেরিন ভয়ে সরে গেল চোখের সামনে থেকে। ড্রইং রুমে উপস্থিত সাফারাতের চাচা-চাচী,চাচাতো ভাই-বোন,ছোট ফুপু কিছুই বলার সাহস পেল না।
জেরিনের মনটা উসখুশ করছে। তার মন বলছে সাফারাতের পূর্ব পরিচিত চৈত্রিকা। তবে সাফারাত কেন চৈত্রিকা কে অস্বীকার করল?ভাবনা ভুলও হতে পারে। কারণ সাফারাত নিজের বিষয়ে অন্য কারো হস্তক্ষেপ সহ্য করতে পারে না। হতে পারে তার আর চৈত্রিকার মধ্যে সে ঢুকেছে বলে সাফারাত এতো রেগে গেছে!
কিন্তু সে কখনও চৈত্রিকার মতো মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে না। কখনও না।
.
.
এলোমেলো পায়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে চৈত্রিকা। চোখ,মুখে বিধস্ত ভাব! গায়ের শুভ্র রঙের ওড়না টা বাতাসে পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে দু’দিকে। বুকের যন্ত্রণায় পা দু’টো ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। তবুও ভাঙ্গা মন নিয়ে এগিয়ে চলছে বাসার দিকে। যেই সুখের আশায় এতগুলো বছর অপেক্ষা করে গেল,সেই সুখ দুঃখ রূপে ফিরে এলো চৈত্রিকার জীবনে। সুখ নেই তবুও সুখের নেশা প্রকট। বেহায়ার মতো ছুটে গিয়েছিল সুখের টানে। কোনো একদিন যেই মানুষ টা নিজে বলেছিল-
“আমাকে স্পর্শ করার জন্য অনুমতির প্রয়োজন নেই তোমার। মন,দেহ দুটোই স্পর্শ করার অধিকার শুধুই চৈত্রিকার।”
অথচ একই ব্যক্তি আজ পুরোনো অভ্যাসবশত স্পর্শ করার অপরাধে অপমান করল তাকে। সময় কত কিছু বদলে দেয়। অধিকারবোধও কি ছিনিয়ে নেই?
গাল বেয়ে অঝোর ধারায় ঝরছে জল। ফর্সা চেহারা টা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কপোল,হাতের ব্যাথার চেয়ে অজস্র ব্যাথার বসবাস চৈত্রিকার বক্ষস্থল জুড়ে। আচ্ছা এই ফুটপাতে বসে চিৎকার করে কাঁদা যাবে?যদি যায় তবে চৈত্রিকা মুক্ত করে দিবে গলায় দলা পাকিয়ে থাকা অশ্রুদের। চৈত্রিকার মেঘে ঢাকা জীবনেও রৌদ্দুরের দেখা মিলেছে একটা সময়। এক চিলতে সুখ নিয়ে জীবনে পদার্পণ করেছিল সাফারাত নামক যুবক। আজকের সাফারাতের সাথে বহু বছর আগের সাফারাতের ভীষণ অমিল। ভীষণ!সাফারাত হয়ত ভুলে বসেছে তার চৈত্র কে কিন্তু চৈত্রিকা মন,মস্তিষ্ক, অন্তর,হৃদপিণ্ড থেকে কখনও মুছতে পারে নি সময়ের গতিতে পিছনে ফেলে আসা স্মৃতি গুলো কে এবং ভালোবাসতে। এই তো এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে কানের কাছে ফিচেল স্বরে ডাকছে সাফারাত।
‘ এই চৈত্র মাস!’
চোখের জলকণা নিজ হাতে মুছে দিয়ে পরক্ষণেই রাগান্বিত কন্ঠে বলছে,
‘ তুমি আমাকে অনুমতি দিবে তোমার বাবাকে খুন করার?আমার মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমাকে আঘাত করছে না বরং খুন করছে প্রতিনিয়ত আমার আত্মার।’
বুকের কোথাও ভাঙন হচ্ছে চৈত্রিকার। দরজার অভিমুখে যেই মেয়েটার সাথে কথা হয়েছিল, সেই মেয়েটা যখন সজোরে থাপ্পড় বসালো গালে,সেই সময়ে চোখের সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার দেখতে পেল চৈত্রিকা। মুহুর্তেই নিজের করা কাজে ঘৃণা জন্মে নিজের প্রতি। কোনো দিকে না চেয়ে ঝাপসা দৃষ্টিতে পা ফেলে বেড়িয়ে এল ওই বাড়ি হতে।
_______
রক্তিম আভায় প্রকৃতি রক্তিম হয়ে উঠেছে। হালকা কমলা,লাল রঙে রাঙিয়ে নিয়ে মানব জাতিকে জানান দিতে মত্ত হয়ে পড়েছে ধরিত্রীর বুকে নেমে আসছে সন্ধ্যে। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে চৈত্রিকার। সিঁড়ি ভেঙে দু’তলা পর্যন্ত উঠে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়াল কোনো রকম। কলিং বেল চাপ দিতেই মা দরজা খুলে দিল।
চৈত্রিকার চক্ষুযুগল ফুলে আছে অতিশয়। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তিরতির করে। অভ্যন্তরীণ পীড়া,যন্ত্রণার ছাপ ফর্সা চেহারায় স্পষ্ট, বিশদ। মেয়ের হাত টা ধরে করুন চাহনি নিক্ষেপ করলেন ফাহমিদা। চৈত্রিকা মায়ের ভয়াতুর, চিন্তিত ভঙ্গি নেত্রপাত করতেই ক্ষীণ হাসল। রিনঝিনে স্বরে বললো,
‘ মাথা ব্যাথা করছে মা। খুব বেশি ক্লান্ত আমি। রেষ্ট নেই রুমে গিয়ে?’
‘ তুই কি কিছু আড়াল করছিস চৈত্রি?’
মায়ের মলিন স্বর শুনে চৈত্রিকা প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চাইল। ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে প্রতুত্তর করলো,
‘ যদি করি? মায়ের মন তো! ঠিক বুঝে যাবে।’
ফাহিমা বিচলিত নেত্রে চাইতেই গটগট পায়ে রুমে ঢুকে পড়ল চৈত্রিকা। রুমে ঢুকে দরজা আটকে মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। যতটা সম্ভব চেপে রাখছে কান্নার শব্দ। কান্নার শব্দ প্রাচীর ভেদ করে বাহিরে যাওয়াও নিষিদ্ধ করে দিয়েছে মেয়েটা। এতগুলো বছরে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়েছে। লোহার মতো শক্ত করেছে মন। কিন্তু এক নিমিষেই তা গলতে শুরু করেছে। যেই মানুষ টা কে হন্যি হয়ে খুঁজেছে মন, তার করা আঘাত হৃদপিণ্ডের ক্ষত তাজা করতে ব্যস্ত। বছরের পর বছর প্রতি নিকষকৃষ্ণ রজনীতে চক্ষু নির্মলিত করার পূর্বে দু’টো জিনিসই মন জুড়ে বিচরণ করত। বাবার ভালোবেসে একটা বার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে হলেও যেন সাফারাতের দেখা পায়। শুধু একটাবার!
চৈত্রিকার কল্পনাতেও আসে নি সাফারাত সুখ নয় বরং এক রাশ বিষাক্ত যন্ত্রণা ঢেলে দিবে তার আঁজলা তে। মা অনেকবার খেতে ডাকল কিন্তু ক্ষিদে নেই বলে এড়িয়ে গেল চৈত্রিকা। পারতপক্ষে সে আজ বাবার মুখোমুখি হতে চাই না। অনুশোচনা, কষ্ট নাহয় তাকে ঘিরে ধরবে প্রখরভাবে। মিম অনেকবার রুমে এলেও চৈত্রিকা মৌন মুখে বসে রইল। বোনের হাবভাব চোখে বিঁধতেই আর কিছু বলতে পারল না মিম। চুপ করে রুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেল। বড্ড কষ্ট হয় তার বোনের জন্য। বাবা তো চাইলেই বুকে জড়িয়ে নিতে পারে!ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারে!কিছু কিছু ঘটনা ইচ্ছাকৃত হয় না। বাবা বুঝেও যেন রাগ চেপে দূর করে দিয়েছে চৈত্রিকা কে চিরতরে।
.
.
গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্নে চৈত্রিকা হাতে, গালে কারো স্পর্শ অনুভব করল। নিমিষেই হালকা হতে শুরু করল নিদ্রা। তবে ঘুমের দাপটে লেগে থাকা আঁখিদ্বয় চেয়েও তৎক্ষনাৎ মেলতে সক্ষম হলো না। গালে আর্দ্র ছোঁয়ায় টেনে চক্ষু মেলল। অতঃপর জ্বলনে চোখে পানি এসে জড়ো হল। চোখ মুছে ড্রিম লাইটের আধো আধো আবছা দীপ্ততায় সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করল রুমের চার দেয়ালে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। দরজার দিকে নজর যেতেই দেখল অর্ধেক খোলা। হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠল চৈত্রিকার অধর যুগলে। হয়ত মা এসেছিল,হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সকাল বেলা পাত্রের সামনে যাবে না বলে জেদ ধরলে বাবা রাগে থাপ্পড় মেরেছিলেন। হাতে গরম চায়ের কাপ ছিল যা থাপ্পড়ের দাপটে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়েছিল ডান হাত ও গলার কিছু অংশে।
প্রভাতের মন মাতানো বিশুদ্ধ বায়ু দেহের সর্বাঙ্গে আলিঙ্গন করে নিতে চৈত্রিকা ছাঁদে এল। এই বাড়িটা তিনতলা। বছর খানেক ধরে এখানে ভাড়া থাকছে চৈত্রিকারা। খুব বেশি সুন্দর নয় আবার কম খারাপও নয়। তবে চৈত্রিকাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঠিকঠাক। নিচের দিকে চাইতেই দৌড়ে এসে পাশে দাঁড়াল মিম। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে মেয়েটা। শ্বাস ফেলার আওয়াজ কর্ণে প্রবেশ হতেই নিচ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পাশে তাকাল চৈত্রিকা। বোনের হাতে নানা রঙের জারবেরা দেখে চক্ষুদ্বয় বৃহদাকার ধারণ করল নিমিষেই। ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তোর হাতে এতগুলো ফুল কেন মিমু?কে দিয়েছে?’
‘ আমাকে দেয় নি আপু। তোকে দিয়েছে। নিচে গিয়েছিলাম দারোয়ান কাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। ভাগ্যিস বাবার হাতে দেন নি।’
মিমের হাঁফানো স্বর ঝংকার তুলে কর্ণধার হলো। বোনের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিল ফুলগুলো। একটা একটা করে আলগা করে ছাঁদের মেঝেতে ফুলগুলো রাখল। কিছুই পেল না একটা ছোট্ট কাগজ ব্যতীত এবং তাতে শুধুই লিখা ‘ চৈত্রিকা।’
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)