নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে #পর্বঃ ৭

0
366

#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে
#পর্বঃ ৭

বর্ষাদের বাড়ি থেকে শাহানাদের বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। পায়ে হাঁটা পথ ৮-৯ মিনিট। রিক্সায় গেলে তিন মিনিট সর্বোচ্চ। দশ তলা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর ছাদে আবার পুলের ব্যবস্থা আছে। এই মফস্বল শহরে এরকম চোখ ধাঁধানো বিল্ডিং একটাই আছে। শাহানার বাবার মদের ব্যবসা। দেশী মদের পাশাপাশি বিলেতি মদও বিক্রি করেন তিনি। একজন মানুষ শুধুমাত্র মদ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলো। গুলশানে ফ্ল্যাট ও কিনে ফেললো। আল্লাহ কিছু মানুষকে সৃষ্টি করেন শুধুমাত্র দুনিয়া ভোগ করার উদ্দেশ্যে। তারা দুনিয়ার সব সুখ টাকা দিয়ে কিনে ফেলে। তবুও নিজেদের সুখী বলে দাবী করে না। এদের চাহিদার শেষ নেই।

বর্ষা কলিং বেল চাপলো। ক্রিং করে আওয়াজ হলো। এবাড়ির কলিং বেল এর আওয়াজটা জঘন্য। কেমন বিশ্রি ক্রিং শব্দ! বর্ষা মনে মনে ঠিক করলো শাহানাকে বলবে কলিং বেল চেঞ্জ করতে। বাজারে পাখির ডাক যুক্ত কলিং বেল পাওয়া যায়। সুইচ চাপলেই শোনা যাবে কিচির মিচির কিচির। ঘরে থেকেও মনে হবে সুন্দরবনে বিচরণ করা হচ্ছে। এক ঝাঁক নাম না জানা পাখি ডাকছে কিচির মিচির কিচির।
শাপলা সদর দরজা খুলে দিলো। বর্ষা হাসিমুখে বলল,
কেমন আছিস শাপলা?
ভালা। আফনে?
ভালো আছি। শাহানা কি করছে?
আফা ঘরে।
ঠিকাছে।
বর্ষা সোজা শাহানার রুমের দিকে এগোতে লাগলো। দরজা বন্ধ। এই মেয়ের দরজা বন্ধ করে থাকার রোগ আছে। রুমে টোকা দেওয়ার সাথে সাথে শাহানা দরজা খুলল। যেনো সে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিলো। বর্ষা মুচকি হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। শাহানা তাকে সে সুযোগ দিলো না। হাত ধরে টান দিয়ে রুমের ভেতোর নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানা থেকে বালিশ সরিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
দোস্ত দেখ, কি জিনিস পেয়েছি!
বর্ষা দেখলো খাটের ওপর ভটকার বোতল। বোতলটি স্বচ্ছ কাচের। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ দামী।
বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
তোর খাটের ওপর ভটকার বোতল কি করে?
বাবার ড্রয়ারে পেয়েছি। তাই ঘরে নিয়ে এসেছি।
এটা দিয়ে কি করবি এখন?
কি করবো আবার, খাবো।
আগে কখনো ভটকা খেয়েছিস?
খেয়েছি তো। প্রতিটা মদের স্বাদই আমি জানি। তুই খাবি বর্ষা?
না।
একটু টেস্ট করে দেখ না! স্প্রাইটের সাথে মিশিয়ে দিবো উইথ আইস কিউব।
না।
শাহানা আয়োজন করে ভটকা খেতে বসলো। স্প্রাইটের বোতল খোলা হলো। পাত্রে আইস কিউব রাখা। ছোট একটি গ্লাস নেওয়া হলো। তাতে তিনটি আইস কিউব রাখলো। গ্লাসে খুব যত্ন করে ভটকা ঢালা হলো এবং স্প্রাইট মেশানো হলো। এক শট নাওয়ার পর শাহানা ঝাঁঝালো গলায় বলল ‘আহ!’

বর্ষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল,
বাসা থেকে কি বলে এসেছি জানিস?
শাহানা জিজ্ঞেস করল,
কি বলে এসেছিস?
বলে এসেছি তোর বড় ভাইয়ের জন্মদিন। দাওয়াত খেতে এসেছি।
শাহানা বলল, আমার কোনো বড় ভাই আছে তুই না বললে জানতাম না।
বর্ষা হাসল।
শোন, তোর বাসায় আজ রাতে আমার বাবা হামলা দিতে পারে।
কেনো?
কারণ আমি আজ রাতে বাড়ি ফিরছি না। বাসায় বলে এসেছি আমি তোর বাসায় আছি। ঈর্ষাকে অবশ্য একথা বলিনি। ওর সামনে আমি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না।
ঈর্ষা কে কি বলেছিস?
ওকে সত্যিটা বলেছি। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
শাহানা বিস্মিত গলায় বলল,
তুই আসলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?
হু।
কিন্তু কেনো?
সব কেনোর উত্তর দেওয়া যাবে না। রহস্য হিসেবে রেখে দিতে হবে। যাতে অন্যরা সে রহস্য উদঘাটন করার সুযোগ পায়।
তুই খুব অদ্ভুত কথা বলিস বর্ষা।
বর্ষা আবারো মিষ্টি করে হাসলো।
তোদের বাসায় দুপুরে খেয়ে বের হয়ে যাবো।
কোথায় যাবি?
বলা যাবে না। এটিও রহস্যের অন্তর্গত।
শাহানা হেসে বলল,
আচ্ছা বলতে হবে না। তুই দুপুরে কি খাবি সেটা বল।
বর্ষা চিন্তায় পরে গেলো। কি দিয়ে ভাত খাওয়া যায়? হাসের মাংস দিয়ে? হাসের মাংসে তার এলার্জি আছে। ক্ষণিককাল পেরোলেই একনাগাড়ে হাঁচি দেওয়া শুরু হবে। নাকে পানি চলে আসবে। গলা বসে যাবে। অনেক দিন পর অসুস্থ্য হতে পারবে বলে বর্ষার আনন্দ লাগছে।
সে বলল,
আমি হাসের মাংস দিয়ে ভাত খাবো। সাথে মুসুরির ডাল আর লেবু। সম্ভব হবে?
অবশ্যই সম্ভব হবে।

শাহানা ইন্টারকম চাপলো। বাবুর্চি রবিউল টেলিফোন কানে নিয়ে বলল,
‘বাবুর্চি রবিউল স্পিকিং’।
রবিউল খুব সুন্দর করে বলে ‘বাবুর্চি রবিউল স্পিকিং’। এই লাইনটা পুনরায় শোনার জন্য শাহানা লাইন কেটে পুনরায় ইন্টারকম চাপলো।
ওপাশ থেকে শোনা গেলো ‘ বাবুর্চি রবিউল স্পিকিং’
শাহানা হাসি চেপে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,
আমি শাহানা ম্যাডাম বলছি।
জ্বি ম্যাডাম বলুন।
আজ দুপুরে হাসের মাংস আর মুসুরির ডাল রাঁধবেন।
জ্বি আচ্ছা ম্যাডাম।
এক ঘন্টার মধ্যে যেনো ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, হাসের মাংস, মুসুরির ডাল আর লেবু ডায়নিং টেবিলে সাজানো থাকে।
আপনি কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। অবশ্যই এক ঘন্টার মধ্যে সব আইটেম টেবিলে সাজানো থাকবে।

বাস ছেড়ে দিয়েছে। জানালার পাশের সীটে বসেছে বর্ষা। তার হাঁচি শুরু হয়ে গেছে। এলার্জিক এট্যাক। সে জানালার পাশে মুখ নিয়ে রাখলো। ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে আঁছড়ে পরছে। এতে ঠান্ডা বেশি করে লাগবে। বুকে জেঁকে বসবে। শ্বাস নিলে গড়গড় শব্দ হবে। রাতের মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হওয়া তার লক্ষ্য। ক্ষুদ্র পরিসরে অসুস্থ্য হয়ে লাভ নেই। অসুস্থ্য হলে বৃহৎ পরিসরে অসুস্থ্য হওয়া উচিত। যাতে সুস্থ্য থাকার মর্ম বোঝা যায়।
কিছু সময়ের মধ্যে বর্ষার শরীর ভার হয়ে এলো। তার শীত লাগছে। মাথায় চাপ ধরা ব্যাথা। শরীরও ম্যাজম্যাজ করছে। এসবই প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পূর্ব লক্ষণ।

হেফাজত করিম বারান্দায় পায়চারি করছেন। তার রাগ হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করেছে। এই শীতেও দরদর করে ঘাম ঝরছে। রুমানা দরজার পাশে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হেফাজত করিম বললেন,
মেয়ে কখন বেরিয়েছে বললে?
সকালে।
কার বাসায় যেনো গিয়েছে?
শাহানাদের বাসায়।
শাহানাদের বাড়ির এড্রেস জানো?
না।
জানো টা কি তুমি? মেয়ের এত ঘনিষ্ট বান্ধুবী, বাড়ির এড্রেস জানো না?
পুরাতন বাড়ির এড্রেস জানি। নতুন বাড়ির এড্রেস জানি না।
তুমি একটা অপদার্থ মহিলা। অপদার্থ মানে বুঝো? যার মাঝে কোনো পদার্থই নেই।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করো না।

কেনো চিৎকার করবো না? এমনিতেও এলাকায় মান মর্যাদা বলে কিছু নেই। চিৎকার করলে নতুন করে মান মর্যাদা নির্বাসনে যাবে না। মেয়েগুলোকে আদরে আদরে মাথায় তুলেছো। তোমার কি মনে হয় না? অতিরিক্ত আদরে বড় মেয়েকে লাইনচ্যুত করেছো? বড় মেয়ে লাইনচ্যুত হয়েছে মানে ছোট মেয়েও হবে। আগের নাল যেদিক দিয়ে যায়, পরের নাল তাকে অনুসরণ করে।

সেটা গরুর ক্ষেত্রে। মানুষের ক্ষেত্রে না।

তোমার মেয়ে গরু প্রজাতিরই। তার মাথায় মগজের পরিবর্তে গোবর আছে।

তুমি ঘরে এসে ঠান্ডা মাথায় বসো। বর্ষা চলে আসবে।

কোনো বসাবসি নাই। তুমি এঘর থেকে যাও এবং ঈর্ষাকে পাঠিয়ে দাও।
ঈর্ষাকে দিয়ে কি হবে?
সেটা তোমার না জানলেও চলবে। যেটা করতে বলেছি সেটা করো।

রুমানা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঈর্ষাকে পাঠিয়ে দিলো।
ঈর্ষা ভয়ার্ত স্বরে বলল,
বাবা ডেকেছো?
হেফাজত বললেন,
অবশ্যই ডেকেছি। তোর বড়বোনের ঘনিষ্ঠ বান্ধুবীর বাড়ির বর্তমান এড্রেস জানিস?
শাহানা আপুদের বাড়ির এড্রেসের কথা বলছো?
হ্যা ওই অসভ্য মেয়েটার বাড়ির এড্রেসের কথাই বলছি।
আপু তো অসভ্য মেয়ে না। ভালো মেয়ে।
তোকে ক্যারেকটারের সার্টিফিকেট দিতে বলি নাই। এড্রেস বল।
বড় পুকুর পাড়ের পাশে যে নতুন দশতলা বিল্ডিং হয়েছে। ওটাই শাহানা আপুদের।
হেফাজত করিম থমকে দাঁড়ালেন।
ওটা তো মদের ব্যাবসায়ী জুয়েল রহমানদের বাড়ি।
ঈর্ষা চুপ করে রইলো।
তোর বড় বোনের ঘনিষ্ঠ বান্ধুবীর বাবা মদের ব্যবসায়ী! সেও কি মদ খাওয়া শুরু করেছে? মদ খেতে ও বাড়ি যায়?
আমি জানি না, বাবা।
হেফাজত করিম শান্ত গলায় বললেন,
কয়টা বাজে রে?
আটটা।
তিনি পুনরায় পায়চারি শুরু করলেন এবং কয়বার এমাথা থেকে ওমাথা যাচ্ছেন তার হিসাব রাখতে শুরু করলেন।
ঈর্ষা অবাক হয়ে বলল,
বাবা কি গুণছো?
কয়বার পায়চারি করছি সেটা গুণছি। সাড়ে আটটার মধ্যে যদি তোর বোন বাড়ি ফিরে আসে তাহলে যে কয়বার বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা গিয়েছি সেই হিসেব অনুযায়ী বেতের বাড়ি দেওয়া হবে।
ঈর্ষা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,
আর যদি আপা সাড়ে আটটার মাঝে না আসে?

তাহলে ওই দশ তলায় হামলা দেওয়া হবে। তার কান ধরে বাড়ি নিয়ে আসা হবে এবং সাড়ে আটটা পর্যন্ত যে কয়বার হেঁটেছি সেই অনুযায়ী বেতের বাড়ি দেওয়া হবে। তুই এক কাজ কর, কাঠের আলমারি থেকে বেতটা এঘরে এনে রাখ।

ঈর্ষা খুব উৎসাহ নিয়ে বেত আনতে গেলো। সে জানে, তার বোন আজ ফিরবে না। বেতের বাড়িও খেতে হবে না।

চলবে…

লিখাঃ আতিয়া আদিবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here