#মালিনী পর্ব ১

0
1319

#মালিনী পর্ব ১
#নূর_নাফিসা

– সকালের রোদের এতো তেজ! গা জ্বলে যাচ্ছে একেবারে! দূর! আরো আগে আসার দরকার ছিলো! বাজার নেই ঘরে সেটা কি আগে বলতে পারলো না! দুই দুইটা মেয়ে মানুষ রান্নাঘরে পড়ে থাকে অথচ আগে আর মনে হয় না কি দরকার! ফুরিয়ে এলে যত্তসব তাড়া!
জুটি বাধা চুল খোপা করে নিয়েছে মলি। তীব্র রোদের মাঝে এই জনবহুল বাজারে এসে ঘেমে গোসল হয়ে যাচ্ছে! মা আর ভাবির উপর বিরক্ত হয়ে তাদের ফুসতে ফুসতে সবজি কিনছে ঘুরে ঘুরে! শেষ সময়ে এসেছে বাজারে। তবুও লোকের ভীড় কম নয়!
দোকানীর সাথে কথা বলছিলো, হঠাৎ তার ঘাড়ে আঁচড় পড়লো! হাতের স্পর্শ পেয়েছে বিধায় বুঝতেই পারছে কেউ নখ দিয়ে আঁচড় দিয়েছে ইচ্ছে করে! পেছনে ঘুরে তাকালো কিন্তু কাউকে সন্দেহ করতে পারছে না! লোকজন কয়েকজনই আছে আর পেছনের দিকে, সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত!
” বজ্জাত লোকজন! মেয়ে মানুষ দেখলেই লুচুগিরী শুরু করে দেয়! এসবের জন্য ঘর থেকে বের হতে পারে না মেয়েরা!”
বকাঝকা করতে করতে ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে ঘাড়সহ মাথা ঢেকে নিলো। পাক্কা দরদাম করে সবজি কিনে হেটে হেটে বাসার পথে রওনা হলো।

সেরা সব গল্পের লিংক All Best Story Link

সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করলো মলি। মা বাবা বড় ভাই ও ভাবি নিয়ে তার পরিবার। বসবাস তাদের বস্তিতে। ভাইয়ের একটা তিন বছর বয়সের ছেলেও আছে। বাবা একজন ছোটোখাটো ব্যবসায়ী ছিলেন। স্ট্রোক হয়ে গত ছ’মাস যাবত বিছানায় পড়ে আছেন। সংসারের হাল ধরেছে ভাই মুহিত। সেও এইচএসসি পাশ করেছিলো। বাবার পক্ষে সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে পড়াশোনা ছেড়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লেগেছিলো। গত বছর তার প্রমোশন হয়েছে ম্যানেজার পদে। কিন্তু তার কিছুদিন পরই আবার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে! এখন সম্পূর্ণ সংসারের দায়িত্ব তার ঘাড়ে।
সংসারের করুণ অবস্থা দেখে মলিকে মেট্রিক পাশ করার পর পড়াশোনা করতে নিষেধ করেছিলো ভাই ও মা। কিন্তু মলির ইচ্ছে ছিলো পড়ার। বস্তির বাচ্চাদের টিউশনি করে কিছু উপার্জন করতে পেরেছিলো সেটা দিয়ে নিজের ইচ্ছাতেই স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়েছে। অন্তত ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়ার তার প্রবল ইচ্ছে আছে। তাই বাকিদের কথা উপেক্ষা করে নিজের ইচ্ছাতেই কলেজে ভর্তি হয়েছে। নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হবে তাই টিউশনির পাশাপাশি অন্য একটা কাজ বেছে নিয়েছিলো। এখনো লেগে আছে সেখানে।
খুব ভালো নকশিকাঁথা বানাতে পারে সে। স্কুলে পড়ুয়া থাকতেই পাড়ার এক মহিলার কাছে শিখেছিলো। নিজেদের জন্য বানিয়েছে কিছু এরপর তার এক বান্ধবীর সাহায্যে সে এগুলো বিক্রি করার সুবিধাজনক স্থান পায়। গুলিস্তানের মার্কেটে তার বান্ধবীর বাবার কাপড়ের দোকান আছে। তাদের দোকানে রেখে কাথা বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছে বিনিময়ে মুনাফার অর্ধেকটা দোকানদারকে দিতে হবে। তাতেই রাজি হয়েছে। সপ্তাহে বা পনেরো দিন পর পর দু’একটা তৈরি করে দোকানে দিয়ে আসে। টিউশনি আর কাথা বেচে তার নিজের খরচটা উঠে আসতো। দুবছর এভাবেই কেটেছে তার, আর তা দিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছে।
এইচএসসি শেষ হয়েছে এখন আর তার নিজেরই কোনো ইচ্ছে নেই পড়াশোনার! বাবার ওষুধপত্র কিনতেই প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে!
.
– এই নাও বাজার! আর কখনো ঝুড়ি ফাকা করে বাজার করার কথা বলেছো তো খবর আছে তোমাদের!
রান্নাঘরে এসে বাজারের ব্যাগটা থেতলে ফেললো। কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো মলি। বাজারের ব্যাগ উঠাতে উঠাতে মলির ভাবি নীলিমা বললো,
– দেমাক কতো! আনছে তো আনছেই! আবার আছাড় দিয়ে ফেলছে!
মলির মা পাশেই ছিলো। তিনি জবাব দিলেন,
– যাক! কিছু কইয়ো না। আনো দেহি কি আনছে।
মলি বাথরুমে এসে গোসল করে নিলো। রান্নাঘরে এসে চুপচাপ হাড়িপাতিল খুলে দেখলো। গরম ভাত আছে আর তরকারি কিছুই রান্না করা নেই! নীলিমা বললো,
– বাটিতে অর্ধেক ডিম ভাজি আছে দেখো। তোমার ভাই অর্ধেক খেয়ে রেখে গেছে। আপাতত ওটা দিয়েই খাও।
– হৃদয় খেয়েছে?
– না, রান্না শেষ করি। পরে খাওয়াবো।
– হৃদয়…?
– কি ফুপি?
– ক্ষুধা লাগেনি বাবাটার?
– না।
– এসো আমার সাথে।
মালি প্লেটে ভাত নিয়ে নিজের ঘরে গেলো হৃদয়কে সাথে নিয়ে। হৃদয়কে খায়িয়ে বাকিটুকু সে খেয়ে নিলো। নীলিমা আর তার মা সবজি কেটেকুটে রান্না করছে। মলি প্লেট রাখতে এসে বললো,
– বাবাকে সময়মতো খায়িয়ে ওষুধ দিও ভাবি।
– আচ্ছা। এখনই বের হবে?
– হ্যাঁ। ফিরতে দেড়ি হবে একটু। সময় পেলে মাকে নিয়ে কাথার মুড়ি ভেঙে দিও। না পারলে আমিই ফিরে করবো।
মলি তৈরি হয়ে বানানো কাথা দুইটা সাথে নিলো। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।
এ সপ্তাহে ভাবি আর মায়ের সাহায্যে দুইটা কাথা তৈরি করতে পেরেছে। কে জানে, গ্রাহক পাবে কিনা! ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হাটছে মলি। বাসা থেকে দোকানের দুরত্ব প্রায় দু কিলোমিটারের পথ। আংকেলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার কাপড় আর সুতা কিনতে যেতে হবে। আবার বিকেলে বাচ্চাদের পড়াতে হবে! কতো কাজ আজ!
– এই যে শুনো?
হঠাৎ কেউ পেছন থেকে ডাকলো। মলি ঘুরে তাকিয়ে দেখলো গাড়িতে থেকে একজন মহিলা মাথা বের করে ডাকছে তাকে। এই মাত্রই গাড়িটা তার সামনে দিয়ে গেছে। মলি আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
– আমাকে?
– হ্যাঁ, তোমাকেই।
মলি কাছে যেতেই মহিলাটি বললো,
– এগুলো কি তোমার হাতে? নকশিকাঁথা?
– হ্যাঁ।
– কিনে এনেছো? নাকি বিক্রি করবে?
– জ্বি, বিক্রি করবো। দোকানে নিয়ে যাচ্ছি।
– তুমি নিজে বানিয়ে বিক্রি করো?
– জ্বি।
– দেখি একটু?
মহিলাটি গাড়িতে থেকেই দরজা খুলে দিলো। মলি কাথা দুইটা এগিয়ে দিলো মহিলাটির হাতে। মহিলাটি নেড়েচেড়ে দেখলো। পাশে ড্রাইভিং সিটে একজন পুরুষ বসে আছে। তাকে বললো,
– দেখ, সুন্দর না?
– হ্যাঁ, কিন্তু এখন হসপিটাল যাওয়ার বদলে কি তুমি কাথা কিনবে?
– কেনার তো ইচ্ছে আছে! এজন্যই তো তোকে গাড়ি থামাতে বললাম।
– ফেরত দাও, পড়ে কিনে নিও।
মহিলাটি মলিকে বললো,
– বাসায় ডেলিভারি দাও?
– না।
– আমি তো এখন হসপিটাল যাচ্ছি তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিতে পারছি না। তুমি কি বাসায় গিয়ে দেখিয়ে আসতে পারবে? বাসা বেশি দূরে না আমার। যদি যাও, তাহলে আমি দুই তিনটা নিবো।
এই বাজারে এমনিতেই গ্রাহক তেমন পাওয়া যায় না। বড় মার্কেটে যেতে পারলে তার ভালো ইনকাম হতো। ইনি, দুই তিনটা নিতে চায় তাহলে এতো বড় অর্ডার তো মিস করা যায় না! তাই মলি বললো,
– ঠিক আছে, বাসার ঠিকানা দিন।
মহিলাটি পার্স খুজে এক টুকরো কাগজ বের করে বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিলো।
– এই নাও।
– কখন যাবো?

[আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓

https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]

– আজ বিকেলে যেতে পারবে?
– বিকেলে আমার সময় হবে না। কাল সকালে গেলে হবে?
– আচ্ছা, কাল দশটার দিকে যেও।
– আচ্ছা।
গাড়ি চলে গেলো মলি সেখানে দাড়িয়েই ভাবতে লাগলো! আংকেলকে যে বলে রেখেছে আজ দোকানে নিয়ে যাবে! কিন্তু এগুলো দোকানে নিয়ে গেলে এই মহিলাকে কি দেখাবে! তার চেয়ে ভালো আংকেলকে বলে দিক আজ নিয়ে আসবে না। তিনচারদিন পরে যাবে। দোকানে না নিয়ে বেচতে পারলে মুনাফাও বেশি পাবে! এই টাকা থেকে তো আর আংকেলকে দিতে হবে না! মুখে হাসি ফুটিয়ে মাঝপথ থেকে সে আবার বাড়ির দিকে রওনা হলো।
এতো তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে দেখে নীলিমা বললো,
– আবার ফিরে এলে কেন? ভুলে গেছো কিছু নিতে?
– না, আজ কাথা নিবো না।
– কেন?
– এমনি, কাল নিয়ে যাবো। একজন দেখতে চেয়েছে, তাদের বাসায় গিয়ে দেখাতে হবে।
– মানুষ চিনে বাসায় যেও।
– ভদ্র মহিলা। হসপিটাল যাচ্ছে তাই ঠিকানা দিয়ে গেছে। আমি যাই, কাপড় আর সুতা কিনতে হবে।
মলি কাথা দুইটা ঘরে রেখে আবার বেরিয়ে গেলো। মার্কেটে গিয়ে আংকেলকে জানিয়ে দিলো এখন সমস্যা আছে তাই তিনচারদিন পরে নিয়ে আসবে কাথা। আগের পাওনা টাকা নিয়ে কাপড় আর সুতা কিনে আবার বাসার পথে ফিরলো।
বাসায় ফিরেই আবার কাথা বানাতে লেগে গেছে। আগেরটা ভাবি মুড়ি ভেঙে কমপ্লিট করে দিয়েছে। বিকেলে টিউশনিতে সময় কেটেছে। বাচ্চাদের পড়ানো শেষ হলে সন্ধ্যায় ভাবির সাথে রান্না করলো। বাবার রাতের খাবারটা সে ই খায়িয়ে ওষুধ খাওয়ালো। রাতে আবার বসেছে কাথা সেলাই করতে। পরীক্ষা শেষ, পড়াশোনা নেই, এখন অবসর সময় কাথার পেছনেই ব্যয় করে।
সম্পূর্ণ প্রস্তুতকৃত তিনটা কাথা এখন আছে তার কাছে। এগুলোই নিয়ে যাবে কাল ওই মহিলাকে দেখাতে।
সকাল দশটার দিকে তিনটি কাথা সাথে নিয়ে মলি রওনা দিলো সেই বাড়ির উদ্দেশ্যে। গলি থেকে বের হওয়ার পথেই রাস্তায় থাকা কিছু কুকুর ভেউ ভেউ করে উঠলো! মলি ভয় পেয়ে এক দোকানের বারান্দায় উঠে গেলো। দোকান বন্ধ, রাস্তা প্রায় ফাকা! একা একা সামনে এগোতেও ভয় পাচ্ছে! দূরে থেকেই হাত নেড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
– হুশ! হুশ! হেই, যাহ!
দুজন লোক হেটে যাওয়ার সময় দেখে কুকুর গুলোকে তাড়িয়ে দিলো। মলি তাড়াতাড়ি লোকগুলোর পিছু পিছু হেটে বের হলো গলি থেকে। এপাশ ওপাশ না তাকিয়ে নাক বরাবর হেটে যাচ্ছে। মাঝপথে হঠাৎ করেই পা থেমে গেলো!

চলবে

[আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓

https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here