#”মালিনীপর্ব- ৩০+ শেষপর্ব

0
655

#”মালিনীপর্ব- ৩০+ শেষপর্ব

#(নূর নাফিসা)
.
.
নতুন পরিবেশে তাদের সম্পূর্ণ বেমানান! সারাদিনে এমনিতেই অন্যদিনের মতো তেমন একটা ঘুম হয়নি, এখন রাতও নির্ঘুম! একটু পর পরই জেগে উঠে আর রোল তুলে কান্নার! ফাহিমা আজ তাদের কাছেই থাকতে চাইলো। শুধু শুধু রাত জাগবে তাই ফরহাদ নিষেধ করলো। তাছাড়া মলি এখন সেদিনের মতো এতোটা অসুস্থ না। একটু আধটু হাটাহাটি করতে পারবে বাচ্চাদের নিয়ে। দুই বাচ্চা নিয়ে তাদের বাবা মায়ের অর্ধেক রাত ঘুমে কাটলো বাকিটা নির্ঘুম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচ তলার সব কাজকর্ম সেড়ে জেরিন দোতলায় এলো। মলি বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে আর ফরহাদ গোসল করছে। জেরিন দরজার কাছে এসে বললো,
– মলি, আসবো?
– হ্যাঁ, ভাবি। জিজ্ঞেস করার কি আছে।
– আছে অনেক কিছুই। বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে?
– একজন জেগেছে, অন্যজন ঘুমিয়ে আছে।
জেরিন বাচ্চার কাছে এসে নাক স্পর্শ করে নাড়াতেই সে হাত পা ছুড়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। তা দেখে জেরিনও হেসে উঠে বললো,
– ইশ! এমনিতে কোলে আসতে চায় না। এখন মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে পাকনামি!
মলি জেরিনকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাবি আপনি কি প্রেগন্যান্ট?
এমন প্রশ্নে জেরিন অবাক হয়ে তাকালো মলির দিকে। অত:পর বললো,

[আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓

https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]

– এমনটা কেন মনে হলো?
– না মানে, কেন জানি মনে হচ্ছে আপনাকে দেখে। তাছাড়া কাল রাতে আমার সাথে দোতলায় আসার আগে ভাইয়া বলছিলো না আপনাকে সাবধানে চলাফেরা করতে। তাই একটু বেশিই মনে হলো আরকি!
জেরিন ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বললো,
– মনে হলে মনেই থাকুক। কেউ যাতে না জানে।
– কেন! জানলে কি হবে?
– তেমন কিছু না। আমি শিওর না এখনো। তাই আরকি।
– ওহ্, আচ্ছা। তাহলে ডাক্তারের কাছে গেলেই হয়।
– হুম, যাবো।
জেরিন যে লুকাতে চাইছে বিষয়টা সেটা মলির কাছে সহজেই ধরা পড়ে গেছে! কেননা, শিওর না হলে তো আর ফারদিন তাকে এভাবে সাবধান করে দিতো না। ফারদিনের নির্দেশনাও তখন কেমন যেন চুপিচুপি ছিলো। তাই মলির সন্দেহ, নেয়ামত উল্লাহ জেরিনকে দায়িত্ব দিয়েছে বাচ্চাদেরসহ মলির দেখাশোনার। তাই সে নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য এই বিষয়টি গোপন রাখছে। বাচ্চার সাথে আরেকটু খেলা করে জেরিন বললো,
– বাচ্চাদের ময়লা কাপড়চোপড় কোথায়? ধুয়ে দেই আমি।
– ওর বাবা নিয়ে গেছে।
– ধুয়ে দেওয়ার জন্য!
– হ্যাঁ।
– বাব্বাহ! জিহান ছোট থাকতে তার কোলে হিসু করে দিলেই চেচিয়ে আমাকে না হয় মাকে ডাকতে শুরু করতো! আর এখন নিজে ধুয়ে দেয়! ভাবা যায় এগুলো!
মলি মুচকি হেসে বললো,
– সব কিছুই তো নিজে করে। যেন তিনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত!
জেরিন হেসে বললো,
– হ্যাঁ, ঘাড়ে পড়েছে তাই এতো দক্ষ হয়ে গেছে! তাহলে আমার আর কি কাজ, জিহানকে রেডি করে দিয়ে আসি স্কুলের জন্য। পরে তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি।
কথা বলে বসা থেকে উঠতে যাবে, এরই মাঝে জিহান দৌড়ে রুমে এসে লাফ দিয়ে খাটে উঠে বসলো এবং বললো,
– আমি আজ স্কুলে যাবো না।
– মাইর দিবো একেবারে! স্কুল মিস করা যাবে না। এক্সাম সামনে।
– আজ তো আর না! আব্বুর কাছে বলে এসেছি আমি! আজ মেহতাজ ও ফাইয়াজের সাথে খেলবো আমি।
মলি বললো,
– স্কুল থেকে এসেও তো খেলতে পারবে, বাবা!
– উহুম! আমি আজ যাচ্ছি না। আম্মু তুমি একবারও বলবে না। একবার বললে আমি দুবার স্কুল মিস দিবো!
– বাহ! বাহ! কি কথাই না শিখে যাচ্ছো আজকাল বাবার কাছ থেকে! চিন্তা করো না, আমিও তোমার বাবাকে সহ স্কুলে ভর্তি করে দিবো!
– ওয়াও! তাহলে তো আরও বেশি মজা হবে! আব্বু আর আমি এক ক্লাসে পড়ব!
মলি হাসলো তাদের কথা শুনে। পরক্ষণেই ফরহাদ বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। হাতে কাপড়ের বালতি। জেরিন বললো,
– ফরহাদ, তোমার খাবার কি দোতলায় নিয়ে আসবো?
– কোনো প্রয়োজন নেই।
ফরহাদ ছাদে যাওয়ার জন্য বালতি নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। পিছু পিছু ছুটলো জিহান। জেরিন নিচে এসে আবার মলির জন্য খাবার নিয়ে উপরে এলো। মলি খেয়ে নিলো এতোক্ষণে জিহান বাচ্চাদের সাথে খেলতে লাগলো আর ফরহাদ শার্ট পড়ে মাথা আঁচড়ে নিজে ফিটফাট হয়ে গেলো। ফরহাদ বাচ্চাদের কপালে চুমু দিয়ে জিহানকে নিয়ে নাস্তা করার জন্য বের হতে গেলে মলি বললো সেও যাবে। ফরহাদ নিষেধ করার আগেই সে বললো একা একা কতোক্ষন বসে থাকবে, তার চেয়ে ভালো বাচ্চাদের নিয়ে নিচে গিয়েই বসে থাকুক। তাহলে আর ফাহিমাকেও সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে না বারবার। তাই ফরহাদ বাচ্চাদের কোলে নিয়ে নিলো। মলি খাবারের প্লেট ধুয়ে সাথে নিয়ে এলো। জেরিন এগিয়ে এসে বললো,
– এগুলো আনতে কে বলেছে! আমিই তো যেতাম উপরে।
– এতোটা অচল না আমি। একটু আধটু কাজ করতে পারবো। আর খাবার উপরে নিয়ে যেতে হবে না। আমি নিচে আসতে পারবো।
জেরিন প্লেট নিয়ে গেলে মলি এসে সোফায় বসলো। ফরহাদ তার কাছে বাচ্চাদের দিয়ে খেতে বসলো। জিহান আছে মলির পাশে, আজ মলিও ফরহাদের মতো দুজনকে একসাথে নিয়েছে কোলে। খাওয়া শেষ করে নেয়ামত উল্লাহ এসে মলির কাছ থেকে একজনকে নিয়ে সোফায় অন্যপাশে বসলো। জিহান পাশে বসে তার সাথে দুষ্টুমি করায় এখন সে কাদছে না। ফরহাদ এসে বললো,
– বাবা, ওরা এখানে থাকলে আমি আর চিটাগং যাবো না।
– তাহলে ওদিকটা দেখবে কে!
– কিন্তু এদিকে তো আমার প্রয়োজন।
– হ্যাঁ, তাহলে ফারদিন চলে যা চিটাগং। ফরহাদ না হয় এখানে ব্যবসা সামলে নেক!
মলি লক্ষ্য করলো মুহুর্তেই ফারদিনের মুখটা মলিন হয়ে গেছে! জেরিন জিহানকে খাওয়ানোর জন্য প্লেট নিয়ে এসেছে। বাবার কথা শুনে মলিন মুখে ফারদিন ওদিকে জেরিনের দিকে তাকালো। জেরিনেরও মনমালিন্য! নেয়ামত উল্লাহ ফারদিনকে বললেন,
– কি? যাবি না?
মলিন মুখে জোরপূর্বক মৃদু হাসির রেখা ফুটি ফারদিন বললো,
– হ্যাঁ। তুমি বললে যাবো না কেন! ফরহাদ চলো তাহলে আজ দেখেশুনে সবটা সামলে নাও।
নেয়ামত উল্লাহ বললেন,
– না, আজ মলির বাড়িতে যাবো। সামনের সপ্তাহে বাচ্চাদের আকিকার অনুষ্ঠান করা হবে। দাওয়াত করে আসবো।
– আচ্ছা, যাও তাহলে। আমি অফিস যাই।
ফারদিন অফিস চলে গেলো। নেয়ামত উল্লাহ ফাহিমাকেও বললো একটু পর যেন রেডি হয়ে থাকে। ফরহাদ দোতলায় চলে গেলো। ফাহিমা এসে মলির কাছ থেকে বাবুকে নিলে মলি সাবধানে হেটে হেটে দোতলায় চলে এলো। ফরহাদ বারান্দায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো। মলি এসে তার পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। ফরহাদ ফোনে কথা বলা শেষ করেই তাকে বললো,
– এজন্যই তো নিষেধ করেছিলাম। বারবার উপরে আসবে আর নিচে নামবে তারপর আমার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে হসপিটাল!
কথা বলতে বলতে ফোন পকেটে রেখে মলিকে কাছে টেনে ঠোঁটে আলতো কামড় বসিয়ে দিলো। অত:পর কোমড় জড়িয়ে রেখে আবার বললো,
– কোনো সমস্যা বাধালে মেরে ফেলবো একেবারে।
মলি মুখ মুছে দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে বললো,
– ছি! এখন আর সেই ভয় নেই যে নিচ থেকে কেউ দেখবে?
ফরহাদ গলা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে তারপর আবার বললো,
– আজ তো নিচে কেউ নেই! জহির ভাই ওপ্রান্তে। তাছাড়া কে দেখবে দেখুক! আজ কোনো সমস্যা নেই।
মলি ফরহাদের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলা করতে করতে বললো,
– চিটাগং আপনারই যাওয়া প্রয়োজন ছিলো।
– কেন?
– জেরিন ভাবি প্রেগন্যান্ট।
– তো?
– তো আবার কি! ফারদিন ভাইয়ার এখানে থাকার প্রয়োজন না! আপনি ভাইয়ার অবস্থায় থাকলে সেখানে যেতে চাইতেন!
– আমারও তো ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা আছে! ভাইয়ার যেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তোমার এতো সমস্যা কোথায়! সহ্য হচ্ছে না নাকি আমাকে?
ফরহাদ বিরক্তি নিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে তার কাছ থেকে সরে যাওয়ার আগেই মলি তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। তার বুকে মাথা রেখে বলতে লাগলো,
– আপনি যে একটু স্বার্থপর হয়ে গেছেন সেটা কি ভেবে দেখেছেন একবারও? বেশি রাগে ভুলেই যাচ্ছেন আপনি হিংসে করছেন ফারদিন ভাইয়ার সাথে। আপনি তো একটু হলেও অভ্যস্ত দূরে থেকে কিন্তু উনি তো উনার বউ বাচ্চা ছেড়ে দূরে থেকে অভ্যস্ত না। তারউপর ভাবি প্রেগন্যান্ট! আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি কিন্তু আমি দেখেছি আংকেল যখন বলেছে তাদের উভয়ের মুখ মলিন হয়ে গেছে। তাছাড়া আপনিও জেরিন ভাবির সাথে কেমন ভাবে কথা বলেন! তারা তো শুধরে নিতে চাইছে তাহলে সুযোগ দিচ্ছেন না কেন! সুযোগ না পেলে তারা শুধরাবে কি করে!
– আমিও আমার সন্তানদের ছাড়া দূরে থেকে অভ্যস্ত না। এখন আমার যে বাচ্চা আছে, তাদের কাছে আমাকে প্রয়োজন নেই? হ্যাঁ?
– আছে কিন্তু..
ফরহাদ মলিকে জোর পূর্বক ছাড়িয়ে রুমে চলে যেতে লাগলো। তার কথায় যেন কোনো গুরুত্বই দিলো না। তার কি কোনো মূল্য নেই ফরহাদের কাছে! সেই পরীক্ষা নিতে এবার মলি বলে উঠলো,
– শুধুমাত্র বড়মা বলেছে বিধায়ই আপনি বিয়ে করেছেন না আমাকে?
এমন উক্তিতে ফরহাদ থমকে দাঁড়ালো! পেছনে ফিরে তাকাতেই মলি আবার বললো,
– কি হলো? বলুন?
– হ্যাঁ।
– আসলেই আমি খুব বোকা! বুঝে উঠতে পারিনা সঠিক সময়! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ভালোবাসেন বলে বিয়ে করেছেন। কিন্তু এদিকে বড়মা মাকে কথা দিয়েছে বলেই যে আপনি বিয়ে করেছেন সেটা তো আমার সম্পূর্ণ অজানা! আপনার কাছে যে আমার কোনো মূল্য নেই সেটা তো অনেক আগেই কৌশলে বারবার আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন! তবুও আমি বুঝে উঠতে পারিনি! হ্যাঁ, জানি তো, এখনো বলবেন আমি দু লাইন বেশিই বুঝি সবসময়! তবু্ও বলবো, আপনি আমাকে সবার কাছে এতো মর্যাদায় রাখতে চাইছেন কেন? আপনার কাছেই তো আমার কোনো মূল্য নেই! কোনো প্রয়োজন ছিলো না তো এসবের! আমি আমার অবস্থানে খুব ভালো ছিলাম! প্রয়োজন ছিলো না আমার অতিরিক্ত মর্যাদা আর সম্মানের। বস্তিতে ওই ছোট ঘরখানা দেখেছিলেন না? অভাব থাকলেও সেখানে রয়ে গেছে লাখো সুখের মুহুর্ত। যেটা আপনার পরিবারে নেই। সেই ঘরখানায় সবাই সবাইকে মূল্য দিতে জানে। আপনারা সেটা জানেন না। বড়মা ভুল বলেনি তো, আপনি আংকেল থেকে কম কিসে! আপনারা না একটু পর আমাদের বাড়িতে যাবেন? দয়া করে আমাকে রেখে আসবেন? আমি সাথে কিছু নিয়ে যাবো না। আপনার সন্তানদের আপনার কাছে রেখেই যাবো। আপনার অর্থসম্পদও কিছু নিয়ে যাবো না। খালি হাতে এসেছি আমি খালি হাতেই নিজ গন্তব্যে পৌছাবো। আপনাকে আমি সবসময়ই সহ্য করতে পারি কিন্তু আপনি আমাকে কখনোই সহ্য করতে পারেন না। শুধু মাত্র বড়মার কথা রাখার জন্য আমাকে হজম করে যাচ্ছেন! এজন্যই তো আমার কথার কোনো মূল্য নেই! আর আমি সেটা বুঝতেই পারিনি এতোদিন!
ফরহাদ রেগে গিয়ে বললো,
– হ্যাঁ! এখন খুব ভালো বুঝে গেছিস! আর আমার ফিলিংস, কেয়ারনেস সব ভুলে গেছিস! মা কথা দিয়েছে বলে সন্ধান বের করেছি আমি কিন্তু মা কি আমার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে দিয়েছিলো! বিয়ে আমি আমার ইচ্ছায় করেছি! শুধু মায়ের অনুমতিটা প্রয়োজন ছিলো। সেইদিন ভুলে গেলি কিভাবে! আমার সব কাজকর্ম ফেলে রেখে আমি ছুটে আসি তোর কাছে আর আজ আমার ভালোবাসার উপর আঙুল উঠে! দিনরাত আমাকে প্রেশারে ফেলে তবে না হয় তোর শান্তি!
– সবসময় আমার উপর শুধু রেগে যাওয়া আর বকাঝকা যেন উনার স্বভাব হয়ে গেছে। সবাই তো চায় একটু সুখ, শান্তি আর স্বাধীনতা! কিসের আশায় থাকবো আমি এখানে! হোকনা সন্তানদের জন্য একটু কষ্ট! কোনো একজনের আত্মাকে তো শান্ত করে রেখে যেতে পারবো। আর উনাকে রেগে কথা বলতে হবে না, কাউকে বকাঝকাও করতে হবে না। কেউ আসবেও না উনার মুখ থেকে একটু ভালোভাবে কথা শুনতে। খুব বেশি সুখ জুটে গেছে আমার কপালে! যার যোগ্য আমি না।
মলি বিড়বিড় করতে করতে চোখ মুছে নিলো। ফরহাদ বুঝতে পেরেছে মলি আজ সিরিয়াস হয়ে কথাগুলো বলেছে। মলি নিচে যাওয়ার জন্য বারান্দা ছেড়ে রুমের দিকে যেতেই ফরহাদ পথ আটকে সামনে দাড়িয়ে বললো,
– বাড়ি থেকে চলে গেলে কিন্তু দ্বিতীয়বার প্রবেশ করতে পারবে না এবাড়িতে।
– কিসের আশায় দ্বিতীয়বার ফিরবো! নিজের ভাগ্যে যে সর্বদা দুর্গতি লেখা সেটা অজানা নয়।
নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে কথাটা বলে অন্যপাশ দিয়ে চলে যেতে নিলে ফরহাদ ওদিকে চেপে পথ আটকে বললো,
– ভালোবাসি তো।
– খুব দেখা হয়ে গেছে!
– ভালোবাসা দেখা যায়না, অনুভব করতে হয়।
– দেখাও যায়, অনুভবও করা যায়। আর সবটার সাথেই আমি পরিচিত হয়ে গেছি।
– অনুভব করেছো আমার ভালোবাসা? তাহলে চলে যাচ্ছো কেন?
মলি তার কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো। ফরহাদ ওদিকে চেপেই পথ আটকে বললো,
– যেতে পারবে না তুমি। বাচ্চাদের তার মাকে প্রয়োজন।
মলির কান্না বেড়ে যাচ্ছে! সে ধাধালো কন্ঠে বললো,
– বাচ্চারা আস্তে আস্তে মানিয়ে নিবে, একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। বুঝতেই পারবে না কখনো তার মা ছিলো পাশে। আমি না হয় দূরে থেকেই তাদের ভালোবাসবো।
– বাচ্চাদের বাবারও তাদের মাকে প্রয়োজন।
– মনে হয়নি সেটা কখনো! আর যদি হয়েও থাকে বাচ্চাদের বাবাও নতুন কাউকে এনে মিটিয়ে নিবে প্রয়োজন।
এতোক্ষণ কথা বলতে বলতে তারা এপাশে ওপাশ করেই যাচ্ছে। মলির কথা শুনে ফরহাদ এবার তার দু বাহু চেপে ধরে জোর গলায় বললো,
– আমার তোমাকেই প্রয়োজন!
কড়া কণ্ঠ শুনে মলি ছলছল চোখে ফরহাদের চোখের দিকে তাকালো! তার চোখ একটুও মিথ্যে বলছে না! বরং এই কঠিন দৃষ্টি খুব কঠোর ভাবে প্রকাশ করছে ফরহাদ মলিকে কতটা ভালোবাসে। যেটা মলির আগেও জানা ছিলো।
আর আজ ভালোবাসার এতো তেজ দেখে তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে এক চিলতে হাসির রেখা! যা তাহার মহারাজের দৃষ্টি এড়িয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে হৃদ স্পর্শ করে গেছে! সাথে সাথেই কলি থেকে পরিপূর্ণ হয়ে ফুটে উঠেছে হৃদ নামক গোলাপ! যাহার মাধুর্য এখন কাছে টানছে বাগিচার রাজ্যের রানী মালিনীকে। আজ সে একটুও ভয় পাচ্ছে না, একটুও অসস্তি লাগছে না। বরং খুব ভালো লাগছে! বৈঠাহীন তরী যেমন স্রোতস্বিনীতে হারিয়ে যায়, ঠিক তেমনি করে তার দৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
মলি স্বেচ্ছায় তার একটা হাত উন্মুক্ত করে ফরহাদের মাথার পিছনে নিয়ে গেলো। ফরহাদ তাকে দু’হাতের বন্ধনে বেধে কাছ থেকেও আরও কাছে টেনে নিলো। হৃদয় থেকে হৃদয়ে কথা হচ্ছে শত থেকে হাজার, হাজার থেকে লাখো আর লাখো থেকে কোটি কোটি। সাথে সমস্ত মুখে কোমল স্পর্শ!
লজ্জায় নতশির মলির মাথা। ফরহাদ কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– সখী, ভালোবাসা কাহারে কয়?
– আপনি আমায় নিয়ে যাহা ভাবেন আর যাহা অনুভব করেন, তাহারেই ভালোবাসা কয়।
মলির এমন উত্তর শুনে ফরহাদ শব্দসহযোগে শরীর কাপিয়ে হাসতে লাগলো। মলি লজ্জায় তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বারান্দার দিকে যেতে যেতে বললো,
– ইশ! নির্লজ্জ কোথাকার! নিচে গিয়ে দেখুন আপনার ছেলে মেয়ে হয়তো রোল তুলে ঘর কাপাচ্ছে।
ফরহাদ বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– নিচে নামবে না আর একবারও। আমি তাদের উপরে এনে দিচ্ছি।
ফরহাদ রুম থেকে বেরিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে দরজার সামনে থেকেই বললো,
– চিটাগং কি তাহলে আমিই চলে যাবো?
মলির চেহারায় বিষন্নতা নেমে এলো। সে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– অন্যকোনো ব্যবস্থা করা যায় না?
ফরহাদ কোনো জবাব না দিয়ে বিষন্ন চেহারা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মলি জানালা দিয়ে বাগানের দিকে তাকালো। নিয়মিত পানি দেওয়ার ফলে ফুলগাছ তাজা আছে কিন্তু সৌন্দর্য নেই! কেমন যেন এলোমেলো দেখাচ্ছে। আগাছা কেটে পরিষ্কার করে না, বাগানের ময়লা পরিষ্কার করে না। নোংরা নোংরা দেখাচ্ছে পরিবেশ। তবুও গাছগুলো অভিমান করে না! প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে তার গায়ে ফুল ঠিকই ফুটে।
নেয়ামত উল্লাহ, ফাহিমা ও ফরহাদ মলিদের বাড়িতে গিয়েছে। মলির মা মুহিতকে জানিয়ে দিয়েছে ফরহাদের পরিবারের সাথে তাদের সম্পর্ক। মলি কল করে আগেই জানিয়ে দিয়েছে তারা আজ যাবে। মলির পরিবারকে নেয়ামত উল্লাহ আহ্বান করেছেন তাদের বাড়িতে আসার জন্য কিন্তু মুহিত রাজি না। অত:পর তারা বাচ্চাদের আকিকার অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলেন যেটা মুহিত গ্রহণ করেছে। বাচ্চাদের তারা দেখেছে ফোনে ভিডিও কলে। কিন্তু সরাসরি দেখা এবং কোলে নেওয়ার সুযোগ এখনও আসেনি।
রাতে খাওয়ার সময় গতকালের মতো ফরহাদ, ফারদিন, জিহান ও নেয়ামত উল্লাহ একসাথে বসেছে। মলি সারাদিন রুমেই ছিলো এখন নিচ তলায় নেমে এসেছে। ফাহিমা ও মলি দুজন দুজনকে নিয়ে হাটছে। খেতে খেতে ফরহাদ তার বাবাকে বললো,
– বাবা, ভাইয়াও যেতে পারবে না চিটাগং। আমিও যেতে পারবো না। তাহলে অন্য ব্যবস্থা করো।
নেয়ামত উল্লাহ ও ফারদিন উভয়েই ফরহাদের দিকে তাকালো। ফারদিন চমকেই বললো,
– আমি নিষেধ করলাম কখন!
– তুমি নিষেধ করোনি ঠিক কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না তোমারও।
নেয়ামত উল্লাহ বললেন,
– ইচ্ছে না করার কারণ কি?
– ভাবি প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় রেখে ভাইয়া নিশ্চয়ই যাবে না সেখানে! এদিকে আমিও যেতে পারছি না ছোট বাচ্চাদের রেখে। তাহলে অন্য ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
ফারদিনসহ নেয়ামত উল্লাহ ও ফাহিমা তাকালো জেরিনের দিকে। আর জেরিন তাকিয়ে আছে মলির দিকে! মলি বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ফরহাদের দিকে!
মিসেস ও মিস্টার উল্লাহ ভাবছে খবরটা সত্যি কি-না! ফারদিন ভাবছে ফরহাদ জানে কিভাবে! আর জেরিন ভাবছে মলিকে নিষেধ করা সত্ত্বেও মলি বলে দিলো কেন! আর মলি ভাবছে, ফরহাদ কতটা নির্লজ্জ হয়ে সরাসরি বাবার সাথে ভাবির প্রেগ্ন্যাসির কথা বলতে পারে! একটু আটকালো না তার মুখে!
ফাহিমা বললো,
– জেরিন প্রেগন্যান্ট! আমি তো জানি না! ফরহাদ জানলি কিভাবে!
– কেন, মলিই তো বললো।
মলির চোখ তো আগেই বড় হয়ে আছে এখন মুখও হা হয়ে গেছে! সে সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো নেয়ামত উল্লাহ বাদে বাকি সবার দৃষ্টি তার দিকেই। সে এখন করুন দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদকে এখন চিবিয়ে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার! একে তো নির্লজ্জ! তারউপর কিভাবে সাবার সামনে নিজের বউকে এমন লজ্জাময় পরিস্থিতিতে ফেলে দিলো! নির্বোধ কোথাকার! জেরিন এখন কি ভাববে তাকে নিয়ে! এদিকে ফরহাদ ও নেয়ামত উল্লাহ খাওয়ায় ব্যস্ত। খাবার থেকে চোখ সরিয়ে মলির দিকে তাকিয়ে বললো,
– এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? সমস্যা হলে সেটা না বলে সমাধান বের করবো কিভাবে। সমস্যা নিয়ে কি তোমার মতো চুপটি মেরে ঘরের এক কোনে বসে থাকবো!
মলি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো। আর বাচ্চাকে নিয়ে অন্যদিকে হাটতে লাগলো। নেয়ামত উল্লাহ বললেন,
– তাহলে আর কিভাবে! আমি তো আর সেই ভার নিতে পারবো না। তাছাড়া ম্যানেজারের উপর তো আর সব দায়িত্ব দিয়ে বসে থাকা যাবে না। তুই ওটা ছেড়ে দিয়ে ঢাকায়ই একটা ব্যবস্থা করে নে। ফারদিন যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে তো আসতে পারবি?
– হুম।
ফরহাদের মনে থাকা সিদ্ধান্তটাই তার বাবা নিলেন, তাই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো তার।
পরদিনই ফরহাদ চিটাগং চলে গেলো। সেখানে দুদিন কাটিয়ে ব্যবসায় ঝামেলা মেটানোর সাথে সাথে বাড়ির ভাড়া ও কাজের মহিলার বিল মিটিয়ে ঢাকায় ফিরে এলো। বিজনেস পার্টনার দীর্ঘদিনের পরিচিত হওয়ায় অবসান ঘটাতে তেমন একটা ঝামেলা হয়নি। আর বাড়িতে আসবাবপত্র যা ছিলো প্রয়োজন ভেদে কিছু নিয়ে এসেছে আর অপ্রয়োজনীয়গুলো বিক্রি করে দিয়ে এসেছে।
বাচ্চাদের আকিকার অনুষ্ঠানে মুহিত ও তার পরিবার উপস্থিত হয়েছে নেয়ামত উল্লাহর বাড়িতে। জেরিনের পরিবার থেকে সবাই এসেছে জেনিফা বাদে। অনুষ্ঠান ভালোভাবেই সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু এদিকে জরুরি কাজে মলির পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছে। মেহমান সব চলে গেলে মলির ও ফরহাদের পরিবার নিয়ে বৈঠক বসলো ড্রয়িং রুমে। নেয়ামত উল্লাহ তার ভাই রহমত উল্লাহর সম্পত্তির দলিল মুহিতের দিকে এগিয়ে দিলেন সাথে নিজের সম্পত্তিও ছেলেদের মাঝে ভাগ করে দিলেন। ছেলেরা অমত পোষণ করলেও তিনি ঝামেলা একবারে মিটিয়ে নিতে চাইলেন তাই এই বন্টন ব্যবস্থা। বৈঠকে ফরহাদ তুলে ধরেছে মলির নামেও সম্পত্তি উইল করা আছে।
নেয়ামত উল্লাহ দলিল মুহিতের দিকে এগিয়ে দিলেও মুহিত সেটা নিলো না। উল্টো ফরহাদকে বললো,
– খুব চালাক তুমি, ফরহাদ। বাবার সম্পদ এতোদিন চাচার নিকট আটকে ছিলো। আর সুযোগ বুঝে তুমিও কৌশলে মলিকে বিয়ে কিরে নিয়েছো যাতে মলির সম্পত্তিটুকু তোমার অধিনে চলে আসে। আবার নিজেরাই আমাদের ভাইবোনের সম্পদ ভাগ করে দিয়েছো! ভাবতেই অবাক লাগে তোমাদের চালাকি! লাগবে না আমার এই সম্পত্তি।
ফরহাদ তার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো,
– ভাইয়া, আপনার বুঝতে ভুল হয়েছে। চাচার সম্পত্তিতে আমি হাত দিতে যাবো কোন দুখে! বাবার সম্পত্তি থেকে আমি যতটুকু পেয়েছি সেখান থেকেই ৫০ ভাগ মলির নামে উইল করে দিয়েছি।
মুহিতের জবাব দিয়ে ফরহাদ মলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– মলি, শ্বশুরবাড়ির সম্পদের মালিক হতে আমি চাই না। আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি, তাই সম্পদও অর্ধেক তোমার নামেই রেখেছি। তোমার কি প্রয়োজন আছে অতিরিক্ত সম্পদের, মানে তোমার বাবার সম্পদের?
মলি একবার মুহিত ও তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার ফরহাদের দিকে! ফরহাদ বললো,
– বলো, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে তোমার মতামতের প্রয়োজন আছে।
– আমার কোনো সম্পদেরই প্রয়োজন নেই। আপনারটাও সম্পূর্ণ আপনার নামেই রাখুন।
– আচ্ছা, আমারটা বাদ রাখো। পিতার সম্পদে তো তোমার কোনো দাবি নেই?
– না।
– ওকে। ভাইয়া, আশা করি এবার আপনার কাছে সবটা পরিষ্কার।
– হ্যাঁ, পরিষ্কার। সাথে এটাও পরিষ্কার, আমি কোনো সম্পদ নিব না।
নেয়ামত উল্লাহ বললেন,
– বাবা, এতো রাগ করছিস কেন! অভিমান না হয় আমার উপর। কিন্তু এটা তো ভেবে নে তোরও তো ভবিষ্যত আছে, তাছাড়া তোর সন্তানের কথাও তো ভাববি। এটা তোর বাবার সম্পদ।
– মাফ করবেন আংকেল। আমার বাবার সম্পদ আমার বাবা-ই ভোগ করে যেতে পারেনি সেটা আমি কিভাবে ভোগ করবো! আমার বাবা পরিশ্রম করে আমার জন্য যেটুকু রেখে গেছেন, আমি ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট। অতিরিক্ত কোন সম্পদের আমারও প্রয়োজন নেই। ওটাতেই আমার সন্তানেরও ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
মলির মা কোনো উক্তি রাখলেন না। কেননা ছেলের উপর নির্ভর করেই তিনি বেচে আছেন। নীলিমা হয়তো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তাদের মাঝে বলার সাহস পেলো না। বেশ কয়েকবার বলার পরও মুহিতের হাতে দলিল তুলে দিতে পারলো না। সন্ধ্যার পরপরই তারা চলে গেলো। হতাশ নেয়ামত উল্লাহ সাহেব!
ডিনারের পর বাচ্চাদের নিয়ে মলি বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে। রুমে প্রবেশ করে মুখটা মলিন দেখে ফরহাদ আলমারিতে ঘাটাঘাটি করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
– মন খারাপ কেন? বাচ্চারা যদি গাল ফুলানো শেখে তোমার খবর আছে। আমি চাই ওরা সবসময় হাসিখুশি থাকবে।
মলি মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
– বেড়াতে যাবো না মায়ের কাছে?
– নিষেধ করলো কে?
– আপনি না গেলে কিভাবে?
– কবে যাবে?
– কালকেই যাই?
মলি অনেক উৎফুল্ল হয়ে বললো কথাটা এবং ফরহাদের উত্তরের আশায় রইলো। ফরহাদ পেছনে ফিরে মলির উৎফুল্লতা দেখে মুচকি হেসে বললো,
– ওকে।
ফরহাদের জবাবে মলি খুশিতে বললো,
– কফি খাবেন? এক কাপ কফি নিয়ে আসি?
– সাহস কতো বড়ো!
– ডাক্তার এক মাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। আর একমাস কিন্তু পূর্ণ হয়ে গেছে!
ফরহাদ শার্ট খুলে রেখে মলির কাছে এসে বসে বললো,
– একমাস থেকেছো বেড রেস্টে? দু সপ্তাহ না যেতেই তো দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেছে! কফি খাবো না, এখন ঘুমাবো।
– ওপাশে যাবেন না?
– বাবুরা জেগে উঠুক, পরে যাবো। আপাতত এখানেই ফিক্সড।
পরদিন নাস্তা করেই ফরহাদ মলি এবং বাচ্চাদের নিয়ে মহল্লায় এসেছে। মুহিত বাড়িতে নেই, কাজে গেছে। নীলিমা ও মলির মা আছে বাড়িতে। হৃদয় বাচ্চাদের দেখেই লাফালাফি শুরু করেছে কোলে নেওয়ার জন্য। মলির মা এসে নাতি নাতনিকে কোলে নিচ্ছে, নীলিমাও। তারা আসার পরপরই নীলিমা রান্না বসিয়ে দিয়েছে তাদের জন্য। যত্নাদি তাদের ভালোই হচ্ছে। কিন্তু মলি নীলিমার মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখতে পেয়েছে। যদিও নীলিমা উপরে হাসিখুশি ভাব নিয়ে আছে। মলি জিজ্ঞেস করেছিলো তার মা কে, তার মা জানালো তিনিও জানেন না। সকাল থেকেই নাকি কেমন মনমরা হয়ে আছে। কথাবার্তা কম বলছে, জেদ নিয়ে কাজকর্ম সাড়ছে! জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছে না। দুপুরে খেয়ে ফরহাদ হৃদয়কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দোকানের দিকে গেলো। বাচ্চারা তখন ঘুমাচ্ছিলো। পাশে বসে আছে মলির মা। মলি ঘর থেকে থালাবাটি এনে কিচেনে রাখছিলো। আর নীলিমা সেগুলো ধুয়ে কিচেনে সব গুছিয়ে রাখছিলো। এমন সময় মুহিত এলো বাড়িতে। মলিকে দেখে অবাকই হলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো কে কে এসেছে। মলি জানালো সে আর ফরহাদ। অত:পর মুহিত ঘরে যাওয়ার আগেই রোজকার অভ্যাসে পরিণত ডাক দিয়ে বললো,
“নীলিমা, হৃদয় কোথায়?”
সাথে সাথেই নীলিমার মুখে উচ্চারিত হলো,
– মরে গেছে নীলিমা! ডাকবেন না আর এই নাম ধরে।
মুহিত থমকে দাঁড়ালো সেখানেই। আর মলি মাত্রই রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে পা দিয়েছে। নীলিমার কথার ভঙ্গি দেখে এবার সরাসরিই জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে ভাবি? আসার পর থেকে দেখছি তোমার মন খারাপ!
– কি আর হবে! আমি সবসময়ই খারাপ! আমার কথা কি কারো সহ্য হবে!
– কি বলছো তুমি! পরিষ্কার না বললে বুঝবো কিভাবে!
নীলিমা এবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
– কাল তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পর আমি বলেছিলাম, যে জায়গাটা নিলেও পারতো। তোমার সন্তান আছে, তার কথাও একটু ভাবো। দিনকালের যা অবস্থা, বস্তি ছেড়ে ভালো জায়গায় উঠতে পারলেও সন্তানকে একটু ভালো মানুষ করতে পারবে। এটা বলাতেই আমি দোষী হয়ে গেছি! যা ইচ্ছে তাই বলেছে আমাকে! আমি নাকি লোভী, সম্পত্তি দেখেছি আর লোভে পড়ে এখন তাকে উষ্কে দিচ্ছি! সম্পত্তি কি আমি আমার বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলাম নাকি উনার নিজ সন্তানের জন্য বলেছিলাম! নিজের সন্তানের যে ভবিষ্যৎ পড়ে আছে সেই খেয়াল কি উনার নেই! এইটুকু বলাতেই যে আমি খারাপ হয়ে গেলাম! যদি লোভী হতাম তাহলে বলুক আমাকে, কিসের লোভে আমি এখানে পড়ে আছি! নিজ হাতে এতোদিন ধরে সংসার সামলে যাচ্ছি, কোনো আহামরি দাবি রেখেছি নাকি উনার কাছে! মুখ ফুটে এসব কিছু বলতে গেলে তো আবার মাইর পড়বে আমার উপর! তাই চুপচাপই সহ্য করে যাচ্ছি!
মলি তাকালো মুহিতের দিকে। মুহিত ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে ঘরে প্রবেশ করলো। মলির বিবেচনায় নীলিমা ঠিকই বলেছে। আর সে-ও এজন্যই এখানে এসেছে। মুহিত হাতমুখ ধুয়ে নিলে মলি খাবার নিয়ে এলো মুহিতের জন্য। বেড়ে দিয়েছে আবার নীলিমা ই। মুহিত হাত ধুয়ে প্লেট নিয়ে বললো,
– বাবুরা কোথায়?
– ঘুমাচ্ছে।
– খেয়েছিস?
– হ্যাঁ। ভাইয়া, কিছু কথা বলার ছিলো।
– হুম, বল।
– ভাবি কিন্তু ভুল বলেনি কিছু। জমিটা তোমার নেওয়া প্রয়োজন। বাবার ভাগ্যে ছিলো না, বাবা ভোগ করতে পারেনি। এখন ফেলে আসা দিনগুলো ভেবে কি আগামী দিনগুলো নষ্ট করবে! তোমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তো ভাবো। এখনে ক’জন মানুষ প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে দেখোতো! যারা নিজ চেষ্টায় একটু আধটু উন্নতি করতে পারছে তারা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে দূরে কোথাও বসত গড়ে তুলছে। আর বাকিরা ছন্নছাড়া! নিজ আত্মিয়েরই খবর নেই। যে যাকে নিয়ে ব্যস্ত! এখানে থাকলে আশেপাশের সবাইকে দেখে তোমার সন্তানও তো এমনই হবে। নিজ প্রচেষ্টা থাকলেও পারবে না তেমন ভাবে মানুষ করতে। কেননা পরিস্থিতি তাদের দিকেই ধাবিত করবে। আশপাশটা ভালো হলে আমি বলতাম না, কিন্তু এখন বাধ্য হচ্ছি। সেখানে গেলে সেই পরিবেশে থেকে একটু ভালো কিছু প্রত্যাশা করতে পারবে সন্তানের কাছে। আংকেলও খুব আশা নিয়ে বাবার সম্পত্তি তোমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছে, কিন্তু তুমি ফিরিয়ে দেওয়ায় হতাশ তিনি! এমনিতেই তিনি আমাদের জীবন ধারন ও বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে অনুতপ্ত! তার উপর একটা ইচ্ছে এখনো পুষে রেখেছে, তোমাদের ও বাড়িতে তুলবে। যাবে? একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো। একদিক দেখলে তো আর হবে না, সবদিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নাও।
– সেখানে গেলে এ বাড়ির কি হবে? এটাও তো আমার বাবার পরিশ্রমের টাকায় কেনা বাড়ি। বাবার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে।
– যদি এটা আশ্রয়হীনদের দান করে দাও তাহলে কি ভালো হবে না? আমার একান্ত ভাবনা এটা।
মুহিত জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে তাকালো মলির দিকে! যেই দৃষ্টিতে মলি আশার আলো খুঁজে পেলো! মুহিত আবার বললো,
– বস্তির সর্দার কি সেটা হতে দিবে! আশ্রয়হীনদের নামে উইল করে দিলে কৌশলে নিজেরাই ভোগ করে নিবে।
– তাহলে উইল না করে, তোমার অধীনে রেখেই তাদের আশ্রয় দাও। প্লিজ, চলে আসো না ওবাড়িতেই!
– আচ্ছা, যাবো।
সাথে সাথেই মলির মুখে ফুটে উঠলো হাসি! মুহিত বললো,
– নীলিমা খেয়েছে?

– হুম, মায়ের সাথে অল্প খেতে দেখেছি।
মুহিত এটো হাতেই দরজার সামনে এসে নীলিমার নাম ধরে ডাকলো। নীলিমা রান্নাঘরের দরজার সামনেই বসে সবজি কাটছিলো। মুহিতের ডাকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। মুহিত আবার বললো,
– এই, ডাকছি না তোমাকে!
– আমার আবার প্রয়োজন পড়ে নাকি কারো! আমি তো খারাপ, তাই কারো ডাকে সাড়া দেই না।
– যাবো ওবাড়িতে চলে। আসো এবার।
– তাতে আমার কি!
– আরে, বললাম তো যাবো। তোমার বাপের বাড়ি পাঠাবো না সম্পত্তি। আমার ছেলে মেয়ের জন্যই নিবো।
নীলিমা তার কোনো প্রতুত্তর করলো না। মলি তাদের রাগ অভিমান দেখে মিটিমিটি হেসে কিচেনের দিকে এগোচ্ছিলো। কিন্তু মুহিতের শেষের কথায় থেমে গিয়ে বললো,
– ভাইয়া, তোমার তো এক ছেলে। মেয়ে আবার এলো কোথা থেকে!
মুহিতও রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
– কেন নীলিমা বলেনি! আরেক ছেলে বা মেয়েও তো আসছে শীঘ্রই!
মলি অবাক হয়ে গেছে। এদিকে মুহিত বটি সরিয়ে নীলিমাকে টেনে উঠিয়ে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। নীলিমা এটো হাত দেখে বুঝতেই পারছে খাওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাই বলতে লাগলো,
– আমি খেয়েছি একটু আগে আম্মার সাথে!
মুহিত বললো,
– আমি খাইনি, চলো।
মলি মৃদু হাসলো তাদের কান্ড দেখে! একটু পরেই নীলিমা খাবার চিবাতে চিবাতে আর আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে অভিমানের সমাপ্তি ঘটেছে। মলি তার সাথে হাটতে হাটতে বললো,
– ভালোই তো! এদিকে একজন, ওদিকে একজন!
– ওদিকে আবার কে!
– আমার জা ও পোয়াতি।
– তুমি আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে খেটেখুটে মরো না!
– আরে নাহ! এতোটা ভারি হয়নি এখনো। আমি যত্নেই আছি তাদের কাছে।
– হুম, দেখেই বুঝা যায়।
নীলিমা আবার সবজি কাটতে বসলে মলি পাশে দাড়িয়ে রইলো। হৃদয়কে কোলে নিয়ে ফরহাদ বাড়িতে ফিরতেই মলি হাসি মুখে তাকালো তার দিকে। ছোট উঠুনে নেমে ফরহাদের দিকে এগিয়ে যেতেই ফরহাদ বললো,
– হঠাৎ মলিন মুখে হাসির কারণ কি?
– ভাইয়াকে বুঝিয়েছি, ভাইয়া যেতে রাজি হয়েছে ওবাড়িতে।
– এজন্যই এখানে এসেছিলে না আজ?
– হুম।
– যাক! এতোদিনে তোমার দ্বারা একটা কাজ তো হলো! বুদ্ধিশুদ্ধি একটু হয়েছে তাহলে!
– হুহ্! নিজেকে একেবারে বুদ্ধির জাহাজ মনে করে!
মুহিত খাওয়া শেষ করে প্লেট নিয়ে বের হতেই ফরহাদকে দেখে জিজ্ঞেস কিন্তু কেমন আছে। ফরহাদও জবাব দিলো। এদিক থেকে নীলিমা মুহিতকে বললো,
– চাল ভাঙ্গিয়ে এনো। পিঠা বানাবো সন্ধ্যায়।
– আচ্ছা, গুছিয়ে রেখো।
ফরহাদ বললো,
– ভাইয়া, তাহলে বাবাকে আসতে বলবো নাকি দলিল নিয়ে। সাথে পিঠার দাওয়াতও হয়ে যাক!
– দাওয়াত করলে আসবে আংকেল?
– করে দেখুন।
পারিবারিকভাবে হয়ে গেলো ছোটখাটো এক পিঠা উৎসব। ও পরিবারের সবাই এসেছে মুহিতের আমন্ত্রণে। অতি শীঘ্রই মুহিত তার বাবার পিতৃনিবাসে উঠবে।
আজ বাগানটা খুব পরিপাটি দেখাচ্ছে। সকালে ফরহাদ আগাছা পরিষ্কার করেছিলো। আর এখন বিকেলে এই প্রথম ফাইজা ও মুবিনকে কোলে নিয়ে মলি ফরহাদ বাগানে এসেছে। সাথে এসেছে জিহান। ফুলের সাথে খেলা ও ছবি তোলা হয়েছে সবার। মলি তার কোলে থাকা বাচ্চাকে বললো,
– ফাইজা, মুবিন! আমার তো ইচ্ছে ছিলো তোদের ডাক নাম রাখবো ফুল আর মুকুল!
মলির কথা শুনে ওদিক থেকে ফরহাদ অন্য বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, জানিই তো! শেষ পর্যন্ত যে আমাকে বাগানের মালি বানিয়ে ছাড়বে আর ও থেকে যাবে মালিনী!
মলি হিহি করে হেসে উঠলো ফরহাদের কথা শুনে!
সন্ধ্যায় বাচ্চাদের পাশে নিয়ে দুজন বিকেলে তোলা ছবিগুলো দেখছে। মলির কোলে একজন সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর ফরহাদের কোলে একজন। ফরহাদ বাচ্চাকে কোলে নিয়েই উঠে এসে আলমারি থেকে একটা ফটো এলবাম বের করে মলির কাছে দিলো। মলি একের পর এক ছবি দেখে চরম অবাক! যে যখন বাগানে কাজ করতো আর ফুলের সাথে কথা বলতো এবং খেলা করতো সেই মুহূর্ত গুলো দোতলার বারান্দায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফরহাদ ক্যামেরায় বন্দী করতো! এজন্যই মলি তাকে মাঝে মাঝে দোতলায় দাড়িয়ে হাসতে দেখতো! এলবাম থেকে মলি চোখ সরিয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো পলকহীন তাকিয়ে আছে তার দিকে! তাই নির্দিধায় জিজ্ঞেস করলো,
– কি দেখেন এমন করে?
ফরহাদ মলির কপালে কোমল স্পর্শ দিয়ে প্রতুত্তরে বললো,
“দেখি আমার রূপকথাকে,
যে কি-না সেজেছে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে!
দেখি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে,
যে কি-না, বসে আছে আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে!
দেখি আমার রজনীকে,
যে কি-না, আটকে ফেলেছে আমায় মায়ার বাধন ও মনোমুগ্ধকর সুবাসে!
আমি তো দেখি আমার মালিনীকে,
যে কি-না সর্বদা থাকবে আমার বাগিচার রানী হয়ে।”
.
(শুভ সমাপ্তি।)
.
.
.
[ [আমাদের এই পেজে সব ভালো ভালো গল্পের লিংকই পোস্টই করা হয়। Pls Like, follow and share our page to get links to all the best stories. →↓

https://www.facebook.com/AllBestStoryLinkRiazUddinShakil/]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here