বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ৪,৫

0
504

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৪,৫

নীলাম্বরে রঙ ধরেছে। গাড় কমলা রঙ। পশ্চিম দিগন্তে তেজ হীন ডুবু ডুবু সূর্যটা রাত নামার পূর্বাভাস। পশ্চিমের জানালায় ক্লান্ত চোখ মেলে লালচে রঙের ডুবন্ত সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে কুমু। উদাসীন ভাবটা চেহারায় বেশ জোরালো ভাবে ফুটেছে। সেই বাড়ি ফিরে এই টেবিলে বসেছে আর ওঠেনি। স্থির দৃষ্টি তার জানালার বাইরে বিদ্যমান। চঞ্চল মন উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশের পানে। দিগন্ত পেরিয়ে। এতো কিছুর মাঝেও কোথায় যেন একটা কমতি মনে হচ্ছে। বারবার পিছুটান তার মনে ঝেঁকে বসছে। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। হতাশ শ্বাস ছেড়ে টেবিলে পড়ে থাকা ডাইরিটার দিকে তাকাল। সাদা পাতাটা এখনো ফাঁকা। অনেক কিছুই লেখার আছে। কিন্তু শুরুটা করে উঠতে পারছে না। আজ বড্ড অগোছালো লাগছে নিজেকে। অনেক ভেবেও কারণ খুঁজে পেলো না। হিমেলের সাথে কথোপকথনের দৃশ্যটা মস্তিস্কে ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। তারপর থেকেই ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। হিমেল যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আরও কিছু বলতে চায় কিনা সেই সময় কিছুই বলতে না পারার আক্ষেপটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। এই নিয়ে মানুষটার সাথে তার দ্বিতীয়বার দেখা। আর দুই বারেই অকল্পনীয় ব্যক্তিত্তের পরিচয় পেয়েছে সে। যা তাকে ঐ মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে নিয়ে এভাবে ভাবার বিষয়টা কুমুর কাছে বেশ অস্বাভাবিক ঠেকলেও সেটা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না। বারবার সেই অচেনা মানুষটাকেই দেখার প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠছে। নিজেকে সামলান কঠিন হয়ে পড়ছে কুমুর জন্য। মন খারাপ নিয়েই লিখতে বসলো ডাইরিতে।

বগাব্দ ১৪২৮, ২০ শে ফাল্গুন

“কাউকে একবার দেখার আকুলতায় ভীষণভাবে জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছা করছে আজ। অচেনা মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণায় এই মন আজ কাতর হয়ে উঠেছে। আর যদি কখনো সেই মানুষটার সাথে দেখা নাহয় সেটা ভাবতেই ভেতরটা কেমন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে আমি জানি না। তাহলে কি আমি প্রেমে পড়েছি? নাহ! এ তো প্রেম নয়। প্রেমে পড়তে এখনো ঢের বাকি। এ তো কেবল ভাললাগার শুরু। ভাললাগা থেকে ভালোবাসা হলেও দুটোর অনুভূতি একদম আলাদা। প্রথমটার অনুভূতি একদম সাধারণ। আর দ্বিতীয়টার বিশেষ। তবে এই সাধারণ অনুভূতি যে বিশেষে পরিণত হবে বা হবেই না এর কোনটাই আমি বলবো না। কারণ এই অজানা অচেনা অনুভূতি কখন, কোথায়, কিভাবে আসে কেউ জানে না।“

————–
–তুই নাকি প্রেম করছিস?

চায়ে ডুবানো বিস্কুটটা উপরে তুলতেই সেটা আবার চায়ের মধ্যে গলে পড়ে গেলো। শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে হাতে ধরে থাকা সেই চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। হতাশ দৃষ্টি তার। বিস্কিট চায়ে পড়ে যাওয়ায় হতাশ নাকি সদ্য বলা কথার প্রভাব বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রাবণকে উদ্দেশ্যে করে সৌরভের বলা কথাটা কানে আসতেই হিমেল সচকিত দৃষ্টিতে একবার সৌরভের দিকে আবার শ্রাবণের দিকে তাকাল। দুজনেই তার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। শ্রাবণ পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করেই অপ্রস্তুত হেসে বলল
–মা মনে হয় ডাকছে।

উঠতেই সৌরভ হাত ধরে ফেললো। গম্ভীর আওয়াজে বলল
–তোকে কেউ ডাকে নি। আর ডাকার সম্ভাবনা নেই। কারণ এই মুহূর্তে বাড়িতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বাইরে।

শ্রাবণ কিছুটা সস্তি পেলো। কারণ তার মা যদি বাসায় থাকতো আর এই বিষয়ে কিছুই যদি আচ করতে পারতো তাহলে তাকে আজ বাড়ি ছাড়া করেই ছাড়ত। সৌরভ আবারো বলল
–আমি কি ঠিক শুনেছি?

শ্রাবণ তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারলো না। হিমেল সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কার কাছ থেকে এসব শুনলি?

সৌরভ বিরক্ত নিয়ে তাকাল। বলল
–আমার বউয়ের একমাত্র বড় ভাই। তুই তো সন্যাস নেয়ার ছক কষেই ফেলেছিস। তাই বলে কি তোর ছোট ভাইও তোর পথেই হাঁটবে? তুই ওকে চিনিস না। পাক্কা ধুরন্ধর শালা আমার। আর তুই কেমন বড় ভাই? নিজের সন্যাস জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে ছোট ভাই কি করছে সেসবও জানার আগ্রহ নেই।

হিমেল সম্পূর্ণ বিষয়টা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল
–ও এখন আর ছোট নাই। যথেষ্ট বড় হয়েছে। এক দুইটা প্রেম করতেই পারে।

বড় ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে হৃদপিণ্ড গতি কমিয়ে দিলো। ভয়ে ঘেমে যাওয়া কপালটা এক আঙ্গুলে মুছে ফেলে বলল
–তুমি ভুল শুনেছ ভাইয়া। এখনো প্রেম করছি না। প্রসেসিং চলছে। তোমাদের দোয়া থাকলে তাড়াতাড়ি শুরু করবো।

শ্রাবণের কথা শুনে সৌরভ হিমেল দুজনেই পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হিমেল কথা না বললেও সৌরভ বলে ফেললো
–কেমন নির্লজ্জ দেখেছিস? বলছে নাকি প্রসেসিং! এসব কথার মানে কি?

শ্রাবণ লাজুক ভঙ্গীতে হেসে বলল
–এখনো পুরোপুরি প্রেমটা হয়ে ওঠেনি। আমার দিক থেকে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওপাশ থেকেও কিছুটা সাড়া মিলেছে। কিন্তু মুখে বলাটা বাকি আছে। ওটা বলে দিলেই প্রসেসিং লেভেল কমপ্লিট হয়ে যাবে।

এবার আর হিমেল চুপ করে থাকতে পারলো না। ভাইয়ের এমন ছন্নছাড়া কথা শুনে বলল
–যা করছ করো। এখন তো কিছুই বলবো না। আগে রেজাল্ট দেখে তারপর সোজা মাকে সব বলে দেবো।

শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে অসহায়ের মতো বলল
–এতো বড় অন্যায় করো না ভাইয়া। তুমি প্রেম করছ না বলে কি আমিও করতে পারবো না। আমার তো একটা মন আছে তাই না? তোমার মতো পাষাণ তো আমি না। একটা মেয়ে চোখের সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করবে আর ভালো লাগলেও আমি বলতে পারবো না? তাছাড়া আর কিছুদিন পর তো আমার পড়ালেখাই শেষ। এখন থেকে বিয়ের প্রস্তুতি না নিলে কিভাবে হবে।

শ্রাবণের কথার উত্তরে হিমেল কড়া কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিতেই সদর দরজায় শব্দে সেদিকে তিনজনেই সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। শ্রাবণ চায়ের কাপটা সামনের টেবিলে রেখে বলল
–আমি দেখছি।

উঠে দরজা খুলতেই তার গম্ভীর কৌতূহলী চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। ওপাশের মানুষটার চেহারা দেখার জন্য সৌরভ আর হিমেল উদগ্রীব হয়ে পড়লো। শ্রাবণ হেসে উঠে জড়িয়ে ধরে বলল
–স্নেহা! কতদিন পর আসলে।

নামটা কানে আসতেই হিমেলের ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। সৌরভ স্নেহার চেহারা না দেখেই হিমেলের দিকে তাকাল। তার আহত দৃষ্টি দেখে বলল
–তুই স্বার্থপর!

হিমেল কঠিন চোখে তাকাতেই সে ফিসফিস করে বলে উঠলো
–এই মুহূর্তে নিজের কথা ভাবার চেয়ে তোর ভাইয়ের কথা ভাবা উচিৎ ছিল। দেখছিস না যেভাবে জড়িয়ে ধরছে। এই মেয়ের সাথে যদি প্রেম হয়ে থাকে তাহলে ভয়ংকর একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

সৌরভের কথা শুনে হিমেল কিছুটা সস্তি পেলো এটা ভেবে যে এরকম কিছু হলে অন্তত সে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। কারণ এই মেয়ে তার জীবনে একটা আপদ। পরক্ষনেই নিজের ভাইয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো। সৌরভের কথা যদি সত্যি হয়ে যায় তাহলে শ্রাবণের ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। স্নেহার গায়ে পড়া স্বভাবের কারণে মাও স্নেহাকে তেমন পছন্দ করে না। নেহাত বোনের মেয়ে বলেই সহ্য করে নেয়। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। যদি জানতে পারে তার বাড়ির বউ এই মেয়ে হবে তাহলে শ্রাবণের কোন নিস্তার নেই। মুখটা ফ্যাকশে হয়ে উঠতেই সৌরভ বলল
–শোন ছোট ভাই হয়। এখনো সময় আছে। যদি আমার ধারনা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে প্রসেসিং লেভেলেই আটকে দে। ওকে বোঝা ছেলেদেরও ইজ্জত থাকে। আর সেটা অনেক দামী। একবার হারিয়ে গেলে ফেরত পাওয়া যায়না।

সৌরভের এমন কথা শুনে হিমেল বিরক্ত হল। তার বিরক্তিটা রাগে পরিণত হতেই কাপটা ঠক করে টেবিলে রেখে গম্ভীর আওয়াজে বলল
–আমি বাইরে যাচ্ছি। আজ আর বাসায় ফিরব না। মাকে বলে দিস।

সৌরভ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এ কেমন বড় ভাই? একটা মেয়ের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অথচ ছোট ভাইটার কথা একবারও ভাবছে না। শেম অন ইউ হিমেল। শেম অন ইউ।

চলবে……

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৫

রান্না ঘর থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ঠেকতেই নিলু হাঁচি দিয়েই মায়ের দিকে তাকাল। তার মা বেশ আয়েশ করে বসে সিরিয়াল দেখছে। তার মুখের ভাব ভঙ্গী বলে দিচ্ছে এই মুহূর্তে বাড়িতে কি হচ্ছে সেসব নিয়ে ওনার কোন টেনশন নেই। সমস্ত মনোযোগ ঐ সিরিয়ালে। নিলু একটু কাছে এসে কণ্ঠ একদম নামিয়ে নিয়ে বলল
–স্নেহা রান্না ঘরে কি করছে সেটা দেখছ না কেন? কে জানে কার সাথে কি মিলিয়ে দিচ্ছে?

কথাটা যেন কানেই নিলেন না শান্তি বেগম। টিভির রিমোটে আনমনে চাপ দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
–মেয়েটা ভালই রান্না করে। বাসায় আসলেই আমাকে রান্না ঘরে ঢুকতে দেয়না।

নিলু মায়ের কথায় বিরক্ত হল। ঝাঁঝালো গলায় বলল
–ঐ মেয়ে আসার পর থেকে তোমার বড় ছেলে যে বাড়ি ছাড়া হয়েছে সেটা খেয়াল করেছো?

শান্তি বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন স্বাভাবিক ভাবে। তারপর সচেতন দৃষ্টিতে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন
–সে তো ভালো কথা। এটা থেকে বোঝা গেলো যে আমার ছেলের ঐ মেয়ের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। বেশ ভালো কথা।

শেষের কথাটা বেশ উতফুল্য কণ্ঠে বললেন তিনি। নিলু বিরক্ত হয়ে বলল
–কিন্তু মেয়ের তো তোমার ছেলের প্রতি ভরপুর আগ্রহ। আগুন আর ঘি একসাথে রাখলে আগুন কিন্তু জলবেই মা। আজ তোমার ছেলের আগ্রহ নেই এই মেয়ের প্রতি। কিন্তু অন্য মেয়ের প্রতিও তো আগ্রহ দেখা যায়না। তাই বলছি আগ্রহ জন্ম নিতে সময় লাগবে না। সাবধান করে দিলাম। মাথায় রেখো।

নিলু উঠে চলে যেতেই শান্তি বেগম একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের কথাগুলো তিনি কানে তুললেন না। ছেলের উপরে তার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। যেমন তেমন মেয়েকে যে তার ছেলে পছন্দ করবে না সে নিয়ে তিনি একদম নিশ্চিন্ত। তার ছেলে যাকে পছন্দ করবে সে হবে একদম হিরা। যার পা এই বাড়িতে পড়লেই সংসার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। কথাটা ভাবতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি মুচকি হেসে টিভি দেখায় মনোযোগ দিলেন।

————-
মাথার উপরে খটখট করে ফ্যানটা শব্দ করছে। বাইরে রোদের তেজ বেশ। ক্লান্ত কুমু ঘেমে নেয়ে বাইরে থেকে এলো। বিছানার উপরে চোখ পড়তেই গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ঠিক মাঝখানটায় মৌ বসে আছে। ফ্যানের বাতাসে ঘাড় অব্দি পড়ে থাকা ফুরফুরে চূলগুলো উড়ছে। চোখ মুখ কুচকে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। এগিয়ে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে বলল
–কি করছ তুমি?

মৌ চোখ তুলে তাকাল। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে। আবারো নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল
–দেখছ না পড়ছি।

কুমু অবাক হল। বইটা উল্টে পাল্টে দেখে বলল
–এটা তো রাফির বই? তুমি কেন এটা পড়ছ?

মৌ বইয়ের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর আওয়াজে বলল
–এই বই পড়েই তো রাফি ভাইয়া প্রতি পরিক্ষায় ভালো নাম্বার পায়। আর বাবা মা ওকে আদর করে। আমি এই বই পড়েই ভালো নাম্বার পাবো। তাহলে ওর থেকে আমাকে বেশী আদর করবে।

কুমু হেসে ফেললো। তার হাসি দেখেই রক্তিম চোখে তাকাল মৌ। অমন দৃষ্টি দেখে কুমু হাসি বন্ধ করে দিলো। কিন্তু লাভ হল না। তাই ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বইটা বন্ধ করে ফেললো। তারপর বলল
–আমিও তো ভালো নাম্বার পাই। তাই বলে কি আমি রাফির বই পড়ি?

মৌ বিচক্ষনের মতো ভেবে মাথা নাড়ল। কুমু হেসে আবারো বলল
–যেটা যার বই সে সেটা পড়ে ভালো নাম্বার পেলে তবেই বাবা মা তাকে আদর করবে। তুমি তো পড়তে চাও না। তাহলে কিভাবে ভালো নাম্বার পাবে। ভালো নাম্বার পেতে হলে প্রতিদিন আমার সাথে পড়তে বসতে হবে। কিন্তু তোমার বই পড়তে হবে। পুরোটা আত্মস্থ করে ফেলতে হবে। তবেই ভালো নাম্বার পাবে। আর বাবা মা তোমাকেও আদর করবে।

–আত্মস্থ কি আ[পা?

খুব কষ্ট করে উচ্চারন করলো কথাটা। এমন কঠিন শব্দ যে এর আগে কখনো শোনে নি। কুমু ভড়কে গেলো। এমন কঠিন শব্দ যে মৌ বুঝবে না সেটা তার ভাবা উচিৎ ছিল। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–মুখস্ত করাকে আত্মস্থ বলে।

মৌ আবারো প্রশ্ন করলো
–তবে তুমি যে বল মুখস্ত করবে না। বুঝে পড়বে। তাহলে আমি কিভাবে আত্মস্থ করবো?

ক্লান্ত কুমু ভীষণ বিরক্ত হল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। এমন প্রশ্ন করা মৌয়ের স্বভাব। সুযোগ পেলে পেটের ভেতর থেকে সব প্রশ্ন হুড়হুড় করে বের করে দেবে। একটুও ভাববে না। তার এই মুহূর্তে প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–ভাইয়াকে বই দিয়ে আসো। ও পড়বে। যাও। নাহলে রাগ করলে কিন্তু মারবে।

মৌ বইটা নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো। চুপ করে রাফির টেবিলে বইটা রেখে কুমুর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। বিছানায় পা ঝুলিয়ে শুয়ে কুমু চলন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে একটাই দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে। অচেনা মানুষটা তাকে কি জাদু করলো যার কারণে বারবার তার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে নিজের চোখের সামনে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না তাকে। খানিকবাদেই মন কেমন অস্থির হয়ে উঠছে তাকে এক পলক দেখার আশায়। মৌয়ের ঝাকিতে চমকে তাকাল। কোমরে দুই হাতে রেখে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল
–কখন থেকে ডাকছি তোমাকে। শুনতে পাচ্ছ না?

কুমু একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বল কি হয়েছে?

–আমাকে এখন পড়াও। আমিও ভালো নাম্বার পাবো।

কুমু অসহায়ের মতো বলল
–আপা এখন ক্লান্ত মৌ। পরে পড়াবে। এখন খেয়ে ঘুমাও। ঘুম থেকে উঠে পড়বে।

মৌ মন খারাপ করে বিছানায় উঠে এক পাশে শুয়ে পড়লো। তার ভালো নাম্বার পাওয়ার আশায় আপা এভাবে পানি ঢেলে দেবে সেটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে এলো। রাফি ভালো নাম্বার পাওয়ায় তাকে আজ বাবা একটা শার্ট কিনে দিয়েছে। সেই থেকে মৌয়ের মনে হয়েছে তাকেও ভালো নাম্বার পেতে হবে তাহলে বাবা তাকেও এমন অনেক কিছুই দেবে। কিন্তু আপা তো তাকে পড়াচ্ছে না। তাহলে কিভাবে ভালো নাম্বার পাবে। আর শুয়ে থাকতে পারলো না মৌ। উঠে বসে তার বইটা নিয়ে পড়তে বসলো। কুমুর মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেলো বাইরে।

———–
বঙ্গাব্দ ১৪২৮, ২২ শে ফাল্গুন

“চারদিকে গুমোট কালো মেঘ। মনের ভেতরে ভীষণ তোলপাড় করা ঝড়। ভীষণ এলোমেলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে কি আর কখনো দেখা পাবো না? তবে কি হবে না তার সাথে পরিচয়? নামটা কি অজানাই থেকে যাবে? কখনো কি বলা হবে না ভালো লেগেছিল আপনাকে; কিন্তু ভালবাসাটা এখনো বাকি।“

ক্লান্ত কুমু প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ডাইরিটা বন্ধ করে ফেললো। ভেতরটা কেমন জ্বালা করছে। কাউকে দেখার তৃষ্ণা এতো ভয়ংকর হতে পারে তার জানা ছিল না। সেও যে এমন অনুভুতির স্বীকার হতে পারে সেটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। দমবন্ধ লাগছে। পরপর দুদিন সেই ফটোকপির দোকানের সামনে দাঁড়ানোর পরেও যখন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটার দেখা মেলেনি তখন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে এসেছিলো কুমু। ভীষণ তোলপাড় হচ্ছিল নিজের মধ্যে। অন্তর্মুখী কুমু কাউকে সেই অস্থিরতার কথা জানাতে পারলো না। আধ ভাঙ্গা মন নিয়ে কাটিয়ে দিলো দুটো দিন। ভালো থাকার অভিনয়টা চালিয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিল সে। সন্ধ্যা হতেই সেই অস্থিরতা বেড়ে গেলো। অস্থির হয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই মস্ত চাঁদটা চোখে পড়লো। মন খারাপটা আরও বেড়ে যেতেই ভীষণ সুন্দর জ্যোৎস্না দেখে মন ভালো করার প্রয়াশ নিয়েই ছুটে গেলো ছাদে। বেখেয়ালি ভাবে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে সে। কিন্তু কয়েক কদম বাড়াতেই সিঁড়ির মাঝেই ঘটে গেলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। যা কুমুর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here