#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে
#পর্ব_১৩,১৪
#আতিয়া_আদিবা
১৩
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। ফার্মহাউজের শীতের বিকেলটা সুন্দর। অন্যরকম সুন্দর। এই সৌন্দর্যের সাথে শহরের ব্যস্ততম বিকালের কোনো সদৃশতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শহরের অলিতে গলিতে এ সময় বাচ্চারা খেলায় মেতে ওঠে। সামান্য খালি জায়গা পেলো তো কাজ হলো! ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কেটে ফেলে। আয়োজন করে লাইট লাগানো হয়। সন্ধায় সেই লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। ধূলো মাখা রাস্তার পাশে গায়ে চাদর জড়িয়ে ধোঁয়া ওঠা চিতই বিক্রি করে নারী অথবা পুরুষ। সাথে কয়েক পদের ঝাল বাটা। নারিকেল আর গুড়ের পুর মিশিয়ে অনেকে বিক্রি করে ভাপা পিঠা। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের আড্ডার ছলে শহর যেনো ভিন্নরকমের পিঠা উৎসবে মেতে ওঠে।
শিহাব উঠানে বসে আছে। কিচির মিচির শব্দে মুখরিত চারিদিক। জায়গাটি বেশ খোলামেলা হওয়ায় সেই কিচির মিচির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবিরত। সূর্যটা মেঘের আড়ালে থাকলেও আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যতদূর পর্যন্ত চক্ষু মেলা যায় সিল্কের পর্দার মত কুয়াশা আস্তরণ ।
শিহাব আজ ফিরতে পারে নি। দুপুরের দিকে তক্তার চালার অবস্থা চলে যায় নিয়ন্ত্রনের বাইরে।
ক্ষণিককাল আগে রাজনৈতিক দুই দলের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। গোলাগোলির শব্দও পাওয়া গিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ অত্র এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে ছুটে আসে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে,
বাজার ঘাট সব বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। রাস্তায় কোনো জনমানব নেই। শুধু এলাকার কুকুরগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে শূন্য রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সাথে শিহাবের বোকামি এখনো বাটখারা পেরোতে পারে নি। তাই সে আজ নিয়াজ করিমের ফার্ম হাউজে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত ঝামেলার মাঝেও খুশির সংবাদ বলতে শেষ অব্দি নিয়াজ করিম তার ফার্মহাউজে টাওয়ার বসাতে রাজী হয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন নাকি বর্ষার অনুরোধে রাজি হয়েছেন তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
এমন খোলামেলা স্থানে শীত একদম জেঁকে বসে। শিহাবের পরনে শুধুমাত্র ফর্মাল একখানা শার্ট। বেচারা কাঁপতে শুরু করলো। কপালটাও ব্যাথায় টনটন করছে। যদিও সেসময় ড্রেসিং করে নিওস্ট্রিপ লাগিয়ে নিয়েছে সে। তবে বোঝা যাচ্ছে, রাত যত গভীর হবে ব্যাথাও তত বাড়তে শুরু করবে। জ্বরও আসতে পারে। তুফানকে আশে পাশে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ফারুকের সাথে আছে। গল্পগুজব করছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মাঝে বেশ ভাব জমে উঠেছে। মোবাইল ফোনে চার্জ নেই। চার্জারও সাথে করে আনা হয় নি। ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছে। শিহাবের ফোন বন্ধ। মা নিশ্চয়ই চিন্তা করবে! তাকে ফোন করে সবটা জানানো প্রয়োজন। এ বাড়িতে কারো মোবাইল ফোন আছে বলে মনে হয় না। তবুও বর্ষার কাছে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে ধরিয়ে সেই যে উধাও হয়ে গেলো! মধ্যাহ্নভোজের সময়ও তার দেখে মেলে নি।
বর্ষা লম্বা সময় ঘুমিয়ে উঠলো। জ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করলেও তার শরীরটা দুর্বল। জাগনা পেয়েই সে পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করলো। উঠে রান্নাঘরে গেলো। অবেলা করেই চারটে ভাত খেলো। মালা জিজ্ঞেস করলো,
আফা, চা খাবেন? চা বানায়ে দিমু?
না। চা খাবো না। কফি খাবো। কফি আছে?
জ্বি আফা। কপি আছে।
কপি না মালা। ক-ফি। বলো ক-ফি?
ক-পি।
‘প’ না। ‘ফ’ উচ্চারণ করবে। বলো ‘ফি’।
মালা দুই তিনবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে তার উচ্চারণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না। কফি কে সে কপিই বলতে লাগলো। বর্ষা হাল ছেড়ে দিলো। মালাকে দুই মগ কফি বানাতে বলে সে বেরিয়ে আসলো।
শিহাব এখনো আগের জায়গাতেই বসে আছে। বর্ষাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।
বর্ষা হেসে বলল,
আমি কি মন্ত্রী মিনিস্টার? আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াতে হবে কেনো?
শিহাব কোনো উত্তর দিলো না। হেসে পুনরায় চেয়ারে বসলো। বর্ষা অন্য চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
আপনি গেস্ট রুম বাদ দিয়ে এখানে কি করছেন?
রুমে থাকতে ভালো লাগছিলো না। This place is wonderful! ভাবলাম একটু এক্সপ্লোর করি।
বর্ষা হেসে ফেললো। বললো,
উঠোনে বসে বসে ‘এক্সপ্লোর’ করছেন?
শিহাব বলল,
আসলে আমি তো পুরো জায়গা চিনি না। এক্সপ্লোর করতে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই?
বর্ষা শিহাবের কথা শুনে বোকা বনে গেলো। হারিয়ে যাবে মানে! সে বিস্মিত জিজ্ঞেস করলো,
এই জায়গায় আপনি হারাবেন কেনো?
This place is unknown to me! হোয়াট ইফ ঘুরতে ঘুরতে অন্য কোথাও চলে গেলাম। আর ফেরার রাস্তা খুঁজে পেলাম না। My god! It would be a horrible experience.
বর্ষা ক্ষণিককাল বড় বড় চোখ করে তাঁকিয়ে রইলো। এই যুগের ছেলে এত গাধা কিভাবে হতে পারে। গাধাও এতটা গাধা বলে বর্ষা মনে করে না!
বর্ষা আগ্রহ ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি এত ভম্বল কেনো বলবেন?
শিহাব আরোও অবাক হলো। বলল,
ভম্বল মানে টা কি?
বর্ষা হেসে বলল,
কিছু না। আপনার শীত করছে?
শিহাব কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়লো।
আসলে সকালে যখন বের হয়েছি ইট ওয়াজ এ ব্রাইট সানি ডে! এখানে এসে এমন অবস্থা হবে বুঝতে পারি নি। তাই সাথে কিছু নিয়ে আসা হয় নি।
তো বলেন নি কেনো শীত করছে? বললে বুঝি আপনার গলা টিপে ধরতাম?
সেটা তো বলি নি! আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
করুন।
আপনি কি আমাকে অনেক অপচ্ছন্দ করেন।
অনেক অপচ্ছন্দ করি না। আবার পচ্ছন্দও করি না। উত্তর পেয়েছেন?
হু। থ্যাংক ইউ।
ওয়েলকাম। আপনি একটু বসুন আমি আসছি।
বর্ষা ঘরে ফিরে গেলো। নিজের একটি মোটা চাদর নিয়ে ফিরে এলো। চাদরটি যত্নের সহিত শিহাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
নিন। এটা গায়ে জড়িয়ে থাকুন। শীত কম লাগবে।
শিহাব অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে চাদরটি নিলো। গায়ে জড়িয়ে মুচকি হেসে বর্ষার দিকে তাকালো। এই মুচকি হাসির অর্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
কালো রঙের দুটো মগে মালা কফি নিয়ে এসেছে। ধোঁয়া গুলো কুয়াশার সাথে মিশে যাচ্ছে। বর্ষা একটি মগ শিহাবকে দিলো। আরেকটি মগ নিজের কাছে রাখলো। চায়ের বদলে কফি দেখে শিহাব জিজ্ঞাসু চোখে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা বিষয়টা বুঝতে পারলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। শান্ত কণ্ঠে বললো,
চলুন হাঁটি। হেটে হেটে পুরো ফার্মহাউজ ঘুরে দেখাই। ‘এক্সপ্লোর’ করি। আশা করি, আমি সাথে থাকলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা আর পাবেন না।
শিহাব মাথা নেড়ে বলল,
অবশ্যই না।
বর্ষা আঙুল দিয়ে সামনের দিকটা দেখিয়ে বলল,
এসময় ওদিকের লণ্ঠনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ভীষণ সুন্দর লাগে দেখতে। চলুন ওদিকটায় এগোই।
প্রথম যেদিন এসেছিলাম ওই লাইটস গুলো দেখে আই ওয়াজ সারপ্রাইজড! ভাবছিলাম, এসব কেনো ঝুলিয়ে রেখেছে।
আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে।
কি সেটা?
জোনাকি পোকা চিনেন?
নাম শুনেছি। ওদেরও লাইটস আছে।
বর্ষা হেসে বলল,
হ্যা। খুব সুন্দর করে জ্বলে ও নিভে। রাত গভীর হলে ফার্মহাউজের এসব লণ্ঠন নিভিয়ে রাখা হয়। তখন সেই জোনাকি পোকাগুলো কই থেকে যেনো এদিকটায় আসে! সবুজ রঙে আলোকিত হয়ে যায় চারিদিক।
আসলেই বিষয়টা অনেক ইন্টারেস্টিং তো!
হুম। চলুন হাঁটি। মনে হয় লণ্ঠন জ্বালানো শুরু করে দিয়েছে।
বর্ষা আর শিহাব পাশাপাশি হাঁটছে। বিকেলটাও প্রস্থানের পথে। যে পাখিগুলো পুরো বিকেল জুড়ে বিরামহীন ডেকে যাচ্ছিলো তারা যেনো নীড়ে ফিরে গিয়েছে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে শীতল বাতাস ভেসে আসছে। নির্জনতা আশ্রয় নিয়েছে। ফারুক আর তুফানের দেখা মিললো। কিছু দূরেই তারা আনন্দ নিয়ে লণ্ঠন জ্বালাচ্ছে। আর এর মাঝ দিয়েই হেটে যাচ্ছে তারা দুজন!
শিহাবের অজ্ঞাতসারে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
আচ্ছা বর্ষা, আমাদের বিয়েটা হলে কি খারাপ হতো?
বর্ষা কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
বিপরীতমুখী দুজন মানুষ আমরা। হয়তো হতো। ঝুঁকি নেয়ার কি প্রয়োজন?
এমনি জিজ্ঞেস করলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না। তাই মাইন্ড করি নি। নচেৎ করতাম।
কেনো আমাদের আর দেখা হবে না কেনো?
দাদাজান, টাওয়ার বসাতে রাজি হয়েছে। আপনার কাজ শেষ। আগামীকাল ফিরে যাবেন। দেখা হবে কিভাবে?
রাইট। ভুলে গিয়েছিলাম।
শিহাবের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলো না। কিছু কিছু অনুভূতি কখনো প্রকাশ করা যায় না। শুধুমাত্র অনুভব করা যায়। অথচ অনুভুতির শুরুটা বেশ আগের থেকে হলেও, তা অনুধাবনে ঢের সময় লেগে যায়!
#পর্ব_১৪
#আতিয়া_আদিবা
নৈশভোজের আয়োজনটাও নিয়াজ করিমের ফার্মহাউজে ভিন্ন। ডায়নিং টেবিলে বড় সাইজের তিনটি মোমবাতি জ্বলছে। পুরো ঘরে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। কেমন ভুতুড়ে পরিবেশ। দেয়ালে নিজের ছায়ার নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে অপচ্ছায়া হাত ইশারায় ডাকছে!
শিহাব আবার ভূতে ভয় পায়। এমন পরিবেশ দেখে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো।
নিয়াজ করিম বললেন,
ইয়ং ম্যান, শুটকি খাওয়ার অভ্যাস আছে?
শিহাব অবাক হয়ে বলল,
শুটকি কি জিনিস?
নিয়াজ বললেন,
শুটকি হলো বিশ্রি গন্ধযুক্ত রোদে শুকানো মাছ যা আমার নাতনি পচ্ছন্দ করে। দুনিয়ার সব বিশ্রি জিনিসগুলো ওর খুব পচ্ছন্দ। খাবার টেবিলে শুটকি আনলে ভকভক করে এর অরুচিকর গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। আমি নাক চেপে বসে থাকবো আর আমার নাতনি পেটপূজা করবে। আপনি চাইলে আমার ঘরে রাতের খাবারের পর্ব চুকিয়ে ফেলতে পারেন।
শিহাব ক্ষণিককাল চুপ করে রইলো। আগামীকাল সে ফিরে যাবে। হয়তো বর্ষার সাথে আর কোনোদিন তার দেখা হবে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে। মেয়েটার গলায় কঠিন থেকে কঠিনতর কথা শুনতেও তার ভালো লাগে। ‘ইংলিশ বাবু’ অথবা ‘ভম্বল’ নামটাও মধুর শোনায়!
সে বললো,
নো প্রবলেম। ইটস কমপ্লিটলি ওকে। এছাড়া ডায়নিং এ বসে খেতেই আমি কম্ফোর্ট ফিল করবো। থ্যাংকস ফর ইওর কনসার্ন।
নিয়াজ করিম মাথা নেড়ে বললেন,
ঠিকাছে। আমি তাহলে ঘরে যাচ্ছি। আজ নিজের ঘরে আরাম করে খাবো।
মালা ডায়নিং এ ছোট্ট একটি কাচের বাটি নিয়ে ঢুকলো। বাটিতে শুটকি। টেবিলের ওপর রাখার সাথে সাথেই পুরো ডায়নিং এ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেলো।
নিয়াজ মালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
আমার ঘরে খাবার দিয়ে আয়। আর তোর বর্ষা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়। খেতে বল। রাত অনেক হলো।
নিয়াজ করিম ডায়নিং থেকে চলে গেলেন। মালা বর্ষাকে ডেকে আনলো।
বর্ষা বললো,
শুটকির বাটিটা নিয়ে যা এখান থেকে মালা। আমি আজ খাবো না। ক্ষুধা নেই।
শিহাব ব্যস্ত হয়ে বলল,
কেনো খাবেন না? সময়মতো না খেলে ইউ উইল গেট সিক।
বর্ষা চোখমুখ শক্ত করে বললো,
তাতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
শিহাব চুপসে গিয়ে বলল,
না।
তাহলে চুপচাপ খেয়ে উঠেন। আজাইরা জ্ঞান দিতে আসবেন না। এই মালা, তুই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তুই কি স্ট্যাচু অব লিবার্টি? বললাম না শুটকির বাটিটা নিয়ে যা।
মালা শুটকির বাটি নিয়ে রান্নাঘরে গেলো।
বর্ষা শান্ত গলায় শিহাবকে বলল,
খাওয়া শেষ হলে আমরা একটু বের হবো।
কোথায়?
গেলেই দেখবেন। দ্রুত খাওয়া শেষ করুন।
আমি তো দ্রুত খেতে পারি না।
বিরক্ত স্বরে বর্ষা জিজ্ঞেস করলো,
আচ্ছা আপনি পারেন টা কি বলুন তো?
সেভাবে চিন্তা করতে গেলে কিছুই পারি না। কিন্তু কর্পোরেট সেক্টরে…
বর্ষা শিহাবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
কর্পোরেট সেক্টর এর কাহিনী বন্ধ। আপনার কিছু পারতে হবে না। দয়া করে খাবারগুলো গেলেন।
শিহাব বলল,
তাহলে স্ট্যাচু অব লিবার্টির কাহিনী বলি? অনেক ইন্টারেস্টিং কিন্তু!
স্ট্যাচু অব লিবার্টির আবার কিসের কাহিনী?
অনেকেই কিন্তু জানে না এই মূর্তিটি তামার। অথবা কেনো ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রকে এটি ডেডিকেট করেছিলো।
সবাই জানে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে।
রাইট! ইজন্ট ইট ইন্টারেস্টিং?
কিভাবে?
ফ্রেন্ডশিপের জন্য এত বড় একটি স্কালপচার ডেডিকেট করলো। আই মিন দিস ইজ ক্রেজি!
বর্ষা হতাশ ভঙ্গিতে বললো,
মুখ বন্ধ।
শিহাব মুখ বন্ধ করে খেতে লাগলো।
রাত নয়টা।
ফার্মহাউজের প্রতিটি লণ্ঠন এক ঘন্টার জন্য নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিহাব বর্ষার সাথে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিক একদম নিশ্চুপ। কাছে কোথাও শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ হচ্ছে। মনে হয়, কেউ আলগোছে পাতার ওপর হাঁটছে।
শিহাব কাঁপা গলায় বললো,
বর্ষা আমার ভয় লাগছে।
কিসের ভয়?
গোস্ট ওর স্পিরিট। আমি শুনেছি এধরনের জায়গায় এসব নেগেটিভ এনার্জি এক্সিস্ট করে। মাই গড! কি স্পুকি!
বর্ষা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
এমনও তো হতে পারে আমিই ভূত। আপনার ঘাড় মটকে খাবো বলে এদিকটায় নিয়ে এসেছি।
একে তো ঠান্ডায় শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার ওপর বর্ষার কথা শুনে শিহাব একদম বরফ হয়ে গেলো।
বর্ষা অন্ধকারের মধ্যেও শিহাবের ফ্যাকাসে চেহারার চিত্র মনে মনে এঁকে ফেললো। সাথে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
শিহাব বলল,
এমন অদ্ভূত ভাবে হাসছেন কেনো?
আপনার অবস্থা দেখে।
নো রিয়েলি, আই এম স্কেয়ার্ড!
বর্ষা এগিয়ে এসে শিহাবের হাত ধরে বললো,
আপনি আমার হাত ধরে থাকুন। তাহলে ভয় লাগবে না।
শিহাব কোনো কথা বললো না। শক্ত করে নিজের আঙুলগুলো বর্ষার আঙ্গুলের মাঝে চেপে ধরলো।
মিনিট পাঁচেক পর, কোথা থেকে যেনো একটি দুটো করে জোনাকি পোকারা আসতে শুরু করলো। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ এমন করে করে শত শত জোনাকি পোকা চলে এলো। এরা ফার্মহাউজের সর্বত্র ছড়িয়ে গেলো।
জ্বলতে আর নিভতে লাগলো।
শিহাব এমন দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেলো। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
বিউটিফুল!
বর্ষা হেসে বললো,
এই দৃশ্য দেখে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যাবে।
শিহাব বললো,
সত্যিই তাই।
শিহাব এবং বর্ষা একসাথে হাঁটছে। জোনাকিপোকা গুলো এদিক সেদিক উড়ছে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে শিহাব বলে উঠলো,
বর্ষা, আমরা কি কোনোভাবেই একসাথে থাকতে পারি না?
বর্ষা থমকে দাঁড়ালো। বললো,
না পারি না।
কিন্তু কেনো?
বর্ষা হেসে বললো,
অনেক কারণ আছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি বলুন তো?
আমি সত্যি কারণটা জানতে চাই। আপনাকে নিয়ে অবশ্য ছোটখাটো রিসার্চ করেছি।
রিসার্চ করে কি পেলেন?
অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি।
কেমন ইনফরমেশন?
শিহাব নিষ্ক্রিয় স্বরে বললো,
ফর এক্সামপল, আপনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন? কথাটা কি সত্যি?
হু।
কেনো?
বর্ষা সহজ গলায় বললো,
কেনো আবার? প্রেম করতাম। বাসা থেকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাই পালিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ছেলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। বিষয়টাকে এখনো এলাকার মানুষজন নানাভাবে রসিয়ে বর্ণনা করে বেড়ায় আর আমার বিয়ে ভেঙ্গে যায়।
আই সি।
এখন বলুন। এমন মেয়েকে বিয়ে করাটা কি বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে?
না।
হু। আপনাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটা বোকা আপনি না। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমান আছেন। অবশ্য সব ছেলেরাই এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান হয়।
শিহাব দেখলো বর্ষা হাসছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে এই হাসির মাঝে হাজারো কষ্ট লুকিয়ে আছে। মেয়েরা হাসির আড়ালে কষ্ট লুকাতে জানে।
জোনাকি গুলো এখন প্রস্থানের পথে। শিহাব বর্ষার হাত ছেড়ে দিয়েছে। বর্ষা মনে মনে হাসছে। সে জানে শিহাবের মনে এখন হাজারো প্রশ্ন খেলা করছে।
সেদিন রাতে বর্ষা আর তার প্রাক্তনের মাঝে কিছু হয়েছিলো কিনা, বর্ষা ভার্জিন কিনা – ইত্যাদি।
হয়েছিলো। সেদিন অনেক কিছুই তাদের মাঝে হয়েছিলো।
আষাঢ়ে রাত। চারিদিকে ছিলো প্রচন্ড বৃষ্টি। বর্ষা কালো চাদরে মুখ লুকিয়ে কাক ভেজা হয়ে প্রাক্তনের বাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছিলো। ঠক ঠক! ঠক ঠক!
চলবে….