#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ১৫
#Lamyea_Chowdhury
নক্ষত্র অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে, শায়েরী পাশের টেবিলে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। নক্ষত্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো দুটো সুন্দর এবং ফিটফাট ছেলে মেয়ে বসে কথা বলছে। পাশেই একজন বডিগার্ড এর মতন দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র একবার শায়েরীর চোখের দিকে তাকালো। তারপর শায়েরীর চাহনী অনুসরণ করে বুঝতে পারলো শায়েরী বারবার দুরুকের দিকে তাকাচ্ছে। নক্ষত্র পাস্তায় কাঁটা চামচ না চালিয়ে চামচ দিয়ে টেবিলে শব্দ করে বার কয়েক আঁচড় দিলো। শায়েরী তারপরও ওদিকেই তাকিয়ে আছে। না খেয়ে প্লেটে চামচ ঘুরাচ্ছে সে। নক্ষত্রের তখন ভয়ানক রাগ হলো। নক্ষত্র আচমকা শায়েরীর হাতে কাঁটাচামচ চেপে ধরলো। অপ্রত্যাশিত আক্রমণে শায়েরী ব্যথায় আহ্ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গলগল করে হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে তখন। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া চোখ দুটি দিয়ে নক্ষত্রের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “আমি ব্যথা পাচ্ছি তো। হাত সরাচ্ছো না কেন?”
নক্ষত্র উল্টো কাঁটাচামচ আরো জোরে চেপে ধরে বলল, “বিলটা পেমেন্ট করে দিও। বাই।”
তারপর ঝড়ের গতিতে চলে গেল। আকস্মিকতায় প্রহর থ হয়ে বসে রইল। শায়েরী হাত চেপে ধরে প্রহরকে বলল, “আমার ব্যগে একটা রুমাল আছে ওটা বের করো তো।”
প্রহর তড়িৎ রোমাল বের করে শায়েরীর হাতে বেধে দিলো।
প্রহর বলল, “ওদের কাছে ফার্স্ট এইড বক্স থাকতে পারে, আমি নিয়ে আসছি আপি।”
“না লাগবে না, তুমি টাকাটা রাখো। খাওয়া শেষ করে পে করে দিও। আপির সময় হয়ে গেছে, আপি চলে যাচ্ছি।”
প্রহরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে শায়েরী সেই রক্তাক্ত হাত নিয়েই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রুচিদের বাসায় চলে গেল। রুচি শায়েরীর হাত দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এমন হলো কি করে ম্যাম?”
শায়েরী হেসে বলল, “তোমাদের বাসায় আসার সময় রাস্তায় এক পাগল এর সাথে দেখা। পাগল ডেকে বলল সে নাকি গত এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। আমি দয়া দেখিয়ে নিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে বসিয়ে খাওয়াতে।”
রুচি কপালে চোখ তুলে বলল, “তারপর ম্যাম?”
“তারপর আরকি? পাগলের তো মাথায় ব্যামো। খেতে বসে তাই আচমকাই সে কাঁটাচামচ আমার হাতে চেপে ধরে এই অবস্হা করলো।”
রুচি একছুটে গিয়ে মায়ের ঘর থেকে ফার্স্ট এইড বক্স আনলো। তারপর শায়েরীর হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার সময় প্রশ্ন করল, “ম্যাম ছেলে পাগল না মেয়ে পাগল?”
শায়রী মৃদুস্বরে বলল, “ভাববার বিষয়।”
একথা শুনে রুচির তখন মাথায় হাত। শায়েরী সেই সারা বিকেল রুচিকে স্বাভাবিকভাবে পড়ালেও রুচি পুরোটা সময় ছিল অন্যমনস্ক। তার মাথায় শুধু একটা বিষয়ই ঘুরছিল, পাগলটা ছেলে পাগল না মেয়ে পাগল। শায়েরী ছুটি দিয়ে চলে যাওয়ার পরও সে এই বিষয়টাতেই ডুবে ছিল। রাতে খেতে বসে সে আবিষ্কার করল পাগলটা ছেলে পাগল কেননা ম্যাম পাগল বলেছেন, পাগলী বলেননি। রুচির হঠাৎ করে পাগলটার জন্য কি যে মায়া হলো! সে না খেয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে গেল। রুচির মা অবাক হয়ে বলল, “কি হলো না খেয়ে উঠে গেলি যে?”
“ইচ্ছে করছে না মা।”
রুচির দাদী রুচির মাকে ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, “মাইয়াটারে আদরে আদরে তুমিই বান্দর বানাইতাছো। খাইব না মানে কি? মুলি লও হাতে, দুই একটা পিডে পড়ুক তাইলেই গপগপাইয়া খাইব।”
রুচির মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আম্মা যা বুঝেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না তো। সেদিন কি আর আছে? দড়াম দড়াম কিল দিয়ে বাচ্চা মানুষ করা যায় না।”
রুচির দাদী মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “আহ্লাদ! টেনে পড়ে মাইয়া, তাও বাচ্চা রইছে? যা চায় তাই দিয়া দিয়া খারাপ করতাছো। কই লেখাপড়া শিইখ্যা ডাক্তার হইব তা না আঁকাআঁকি শিখাও।”
রুচির মা হেসে বললেন, “পড়ছেই তো, পাশাপাশি আর্ট শিখছে। ওর যেহেতু এটায় ঝোঁক তা করুক না।”
“সামনে ম্যাট্রিক দিব। এসময় আমরার কালে মানুষরে দেখতাম চোখে মুখে কাপড় বাইন্ধা পড়তে বসতো। আর তোমার মাইয়া সারাদিন ঢ্যাংঢ্যাং কইরা বিকালে মেডামের দারে আর্ট করতে বসে। রাইতেও সেই নাডাগুডাই চলে।”
রুচির মা বুঝতে পারলেন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই তাই নিঃশব্দে খেতে লাগলেন।
রুচি নিজের ঘরে গিয়ে শায়েরীকে ফোন করলো। মৌন তখন শায়েরীকে লোকমা দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিল। শায়েরী হাতের ব্যথায় না খেয়ে ঘুমুতে চাওয়ায় মৌন খাইয়ে দিতে বসেছে। এখন পড়েছে সে মহাবিপাকে। শায়েরীকে খাওয়ানোর চেয়ে রান্না করা ঢের সহজ। লোকমা একটা মুখে নিয়েই শায়েরী বলতে শুরু করবে, অ্যাই ঝুল দিচ্ছিস না কেন? আলু এত কম কেন? এত বড় লোকমা কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। মৌন কটমট করে শায়েরীর দিকে তাকিয়ে আছে। শায়েরী হেসে বলল, “কি হলো তোর?”
মৌন শায়েরীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, “তোর জন্য লোকমা মাখানোর চেয়ে মাস্টার শেফ অব আমেরিকা হয়ে যাওয়াও সহজ।”
শায়েরী খেতে খেতে বলল, “উফ্! মরিচের বিচিগুলো দে শুধু।”
মৌন মাথা নেড়ে বলল, “আর কোনোদিন যদি তোকে খাওয়াতে বসি তো আমি ক্যারাটে করাই ছেড়ে দিব।”
আদুরী পাশেই স্ট্যান্ড ফ্যানের কাছে দুহাত ছড়িয়ে বসে আছে। নেইল পেইন্ট শুকাচ্ছে সে। চিন্তিত ভঙ্গিতে সে প্রশ্ন করল, “তোর কাজিনটাকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার না?”
শায়েরী অবাক হয়ে বলল, “কাকে?”
মৌন আদুরীর কথায় সায় দিয়ে বলল, “ঐ যে তোর মামীর ছেলেকে।”
শায়েরী কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনিই রুচির ফোনটা আসলো। শায়েরী ফোন ধরে বলল, “কি ব্যাপার রুচি, এত রাতে ফোন করলে যে?”
“এমনি ম্যাম। আপনার হাতের ব্যথা কমেছে?”
“হ্যাঁ আগের চেয়ে কম। তুমি চিন্তা করো না আমি কালই আসব।”
” না ম্যাম এখন আসতে হবে না। আপনার হাত ভালো হলে তারপর আসুন।”
শায়েরী হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, ডিয়ার।”
রুচি ফোন রেখে দিতে নিয়েও ফোন রাখলো না। আবার প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ম্যাম, পাগলটা নিশ্চয় রাতেও কিছু খেতে পায়নি, তাইনা? আমার না খুব মায়া হচ্ছে। খেতে বসে খেতেও পারলাম না। ইচ্ছে করছিল টিফিনবক্সে খাবার নিয়ে সারা শহর খুঁজে সে পাগলটাকে খুঁজে বের করি। তারপর নিজের সামনে বসিয়ে তাকে খাওয়াই।”
শায়েরী মুখে ওড়না চেপে হাসি থামালো। তারপর প্রশ্ন করল, “আমি খাওয়াতে গিয়ে কি বিপদে পড়লাম দেখলে না?”
রুচি মাথা চুলকে ভেবে বলল, “ম্যাম আমি আমার হাতে গ্লাভস পড়ে রাখব। এরপরেও এক আধটু ব্যথা পেলে তা মানিয়ে নিব। কি যে মন খারাপ লাগছে ম্যাম…”
শায়েরী হাসতে হাসতে বলল, “পাগলী মেয়ে, ঘুমাও তো।”
রুচি ফোন রেখে দেওয়ার আগে বলল, “ম্যাম আমাকে কিন্তু পাগলটার কাছে নিয়ে যাবেন। আমি সত্যি সত্যি পাগলটার জন্য খাবার নিয়ে যাব।”
শায়েরী কল কেটে দিয়ে স্বগতোক্তির মত করে বলল, “তার খাবারে আমি বিষ মিশিয়ে রাখব। দ্যা বিগেস্ট ড্রিম অফ মাই লাইফ!”