#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ১০+১১+১২+১৩

0
424

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ১০+১১+১২+১৩
#Lamyea_Chowdhury

মৌন সারাটা রাস্তায় একটা কথাও বলল না। সায়াহ্ন গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ধীরগতিতে বাইক চালিয়ে যখন বাসার অনেকটা কাছে চলে এলো, তখন মৌনের মনে পড়ল, আদুরী আর শায়েরী সায়াহ্নের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তারপর ফিরে কিসব উল্টাপাল্টা বলল। মৌন বলল,
“তাড়াতাড়ি চালাও না, এত স্লোউলি চালাচ্ছ কেন? ”
সায়াহ্ন বলল,
” এত তত্তরি কিয়ের? ঘরে যাইয়া সিলিম ফ্যান মুছপি?”
মৌন বাইকে ভয় পায় না, তাই সায়াহ্নকে ধরে বসতে হয়নি। আরামসে এক সাইড হয়ে বসে বাইকের পিছনদিকটায় ধরে বসেছিল। মৌন হাতটা সরিয়ে সায়াহ্নকে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি করল, কিন্তু ধরল না। উল্টো সায়াহ্নের পেটে জোরে চিমটি কাটল।
সায়াহ্ন আহ্ করে উঠল। চোখ মুখ বিকৃত করে বলল,
“এই হাতি কি অইছে তোর?”
মৌন এবার সত্যি সত্যি মন খারাপ করল। আর একটা কথাও বলল না। সায়াহ্ন অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বাইক থামাতেই, মৌন চুপচাপ নেমে দ্রুত পা চালিয়ে লিফটে উঠে গেল। সায়াহ্নকে বাই পর্যন্ত বলল না! সায়াহ্ন ভাইয়া এমন করে বলল কেন? একবার খাঁটো বলল, এখন আবার হাতি বলে!
লিফটে দাঁড়িয়েই মৌন একবার নিজেকে দেখে নিলো। কোথায় মোটা সে? একদম ফিট, স্লিম বডি। হ্যাঁ, একটু খাঁটোই! তাই বলে এমন করে বলতে হয়? এসব ভাবতে ভাবতে মৌন সায়াহ্নকে সেদিনের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গেল।
.

রুচিকে পড়ানোর কথা ছিল সকাল নয়টায়। কিন্তু শায়েরী দশটায় কল দিয়ে রুচির আম্মুকে বলল,
” আন্টি আমি অসুস্হ ছিলাম তো তাই দেরি হয়ে গেছে, রুচির কি এখন আর কোনো প্রাইভেট আছে?”
রুচির আম্মু বলল,
” হ্যাঁ, আছে তো শায়েরী। তবে সন্ধ্যায় কিংবা বিকেলে আসতে পারো। ”
” আন্টি পাঁচটার পর আসব।”
রুচির আম্মু চিন্তিত গলায় বললেন,
” আজ না এলেও তো পারো, তুমি তো অসুস্হ বললে। ”
” আরে না আন্টি, ও কিছু না, এখন একদম ঠিকঠাক। তাহলে আমি পাঁচটায় আসি, কেমন? ”
” ঠিক আছে, এসো। ”
রুচির মায়ের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে শায়েরী বাড়িতে ফোন দিলো। মায়ের সাথে কথা বলে জানালো সন্ধ্যায় কিছু টাকা পাঠাবে। বাকিটা পাঠাবে সপ্তাহখানেক পর। মায়ের সাথে কথা বলা শেষে শায়েরী গেল ভার্সিটিতে। ভার্সিটিতে ক্লাস করে আর বাসায় ফিরলো না। তিনটা পর্যন্ত ক্লাস ছিল। তারপর, আর বাসায় আসার সময় নেই। বাসায় এসে আবার রুচিদের বাসায় যাওয়া তিন-চার ঘণ্টার ব্যাপার। জ্যামে গাড়ি চলে পিঁপড়ার গতিতে। শায়েরী ভাবল, তারচেয়ে বরং ক্যাম্পাসেই বসে আড্ডা দেওয়া যাক। মৌনটা তো আজ আসেইনি ভার্সিটিতে। ওর উড বির সাথে দেখা করতে গিয়েছে। সায়াহ্ন ভাইকে ঠিকঠাক সব বলতে পারবে তো? ইশ্, মানুষটা কি সুন্দর! এত সুন্দর একটা মানুষকে কি করে মৌন রিজেক্ট করতে পারে? কি সুন্দর, নীল চোখ, একদম ডুবে যেতে ইচ্ছে করে!
কলা ভবনের সামনে ঘাসের উপর বসে শায়েরী আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। কি সুন্দর, স্বচ্ছ নীল আকাশ! জীবনটা কেন এত কঠিন? এমন স্বচ্ছ হলেই তো পারতো। কতো কতো কাজ তার! সবচেয়ে বেশি চিন্তা হয় বাবাকে নিয়ে। বাবা ভালো হবে তো? আবার শায়েরীর পুরোনো সুখের দিন ফিরে আসবে তো? নাকি সারাটা জীবনই তাকে এমন কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে? শায়েরীর ভাবনায় ছেদ পড়ল মোবাইলের রিংটোনে। মোবাইল স্ক্রিনে প্রহরের নাম দেখে শায়েরী ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মোবাইলটা বন্ধ করে রেখে দিলো। সকাল থেকেই মেয়েটা ফোন করছে, কিন্তু শায়েরী একবার‌ও রিসিভ করছে না। কারণ, সে জানে, ফোন রিসিভ করলেই প্রহর ওকে বাসায় যেতে বলবে। আর শায়েরী এ বাসায় যাবে না, আর কখনোই যাবে না সে! এত অপমান কেন সহ্য করবে সে? বয়সে বড় দেখেই মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। নয়তো কবেই দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতো! মামানীর গুলো নাহয় মানা যায়, কিন্তু নক্ষত্র ভাই, জাস্ট ইনসেইন! নিজেকে কি যে মনে করেন! আহারে পুরুষ….! আহারে মামানী….! আর, আহারে মামানীর গর্দভ ছেলে!!#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়
#Lamyea_Chowdhury
পর্বঃ১১

শায়েরী এতটা সময় কি করবে খুঁজে পেল না। তারচেয়ে বরং বসে বসে ছবি আঁকা যায়। শায়েরীর একমাত্র প্যাশন ছবি আঁকা। মন খারাপ হলে কাউকে কিছু বলতে না পারলেও ক্যানভাসে জল ছিটিয়ে ছবি এঁকে ফেলে। শায়েরী ব্যাকপ্যাক খুলে বড় ড্রয়িং খাতাটা বের করল। তারপর পেন্সিলও বের করল। আনমনে আঁকিবুঁকি করতে লাগল। মৃদুল হাওয়ায় ঘাসের ডগা তিরতির করে কাঁপছে। সেই ফুরফুরে হাওয়ায় বসে শায়েরী বেশ মন দিয়ে স্ক্যাচ আঁকছে। দুটো চোখ, ভীষণ সুন্দর দুটো চোখ এঁকেছে সে, ফিনিশিং দিচ্ছে মন দিয়ে। ঠিক সেসময়েই শায়েরীর পাশে এসে কেউ একজন চুপটি করে বসল। টুঁ শব্দটিও করেনি সে তাই শায়েরীও পাশে বসা মানুষটাকে খেয়াল করল না। সে এখন ভিন্ন জগতে, যেখানে সব দুঃখ রঙতুলির আঁচরে তারার মতন খসে পড়ে। এখন কি আর এই জ্বালাময় পৃথিবীর খোঁজ নেওয়া চলে!!!

নক্ষত্র মাথায় উল্টো করে পরা ক্যাপটা টেনে ঠিক করল আবার। ঠিক বলতে উল্টো করেই পরা, সে সবসময় ক্যাপের সামনের দিক পিছনে আর পিছনের দিক সামনে এনে ক্যাপ পরে। নক্ষত্রের জাতীয় পোশাক বলা চলে। নক্ষত্র শায়েরী থেকে আরো একটু দূরে যেয়ে বসল। বলা তো যায় না কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সে! শায়েরী যখন ছবি আঁকে তখন শায়েরীকে নক্ষত্রের কাছে আকাশ মনে হয়, স্বচ্ছ নির্মল সবাইকে ছায়া দেওয়া রঙধনুময় বিপুল পবিত্রা এক আকাশ! শায়েরীর তখনও হুঁশ নেই সে এঁকেই চলেছে। নক্ষত্র আসন করে বসে আছে সেই কবে থেকে! একবারের জন্যও ডাকেনি শায়েরীকে। কি দরকার ডাকার! ডাকলেই তো অপ্সরীপরী আসমান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবে! থাকুক না আসমানে, নক্ষত্রের পাশাপাশি! নক্ষত্রের ইচ্ছে করছে হাত বাড়িয়ে শায়েরীর গাল ছুঁয়ে দিতে। খুব করে ইচ্ছে করছে! ইচ্ছে শুধু এইটুকুতে দমে থাকলেই হতো কিন্তু ইচ্ছের তো লাগাম নেই! তাই নক্ষত্র আরো একটু দূরে সরে বসল। দূর থেকেই পূর্ণদৃষ্টিতে শায়েরী কি আঁকছে দেখতে চেষ্টা করল। এতদূর থেকে দেখতে চেয়ে বিফল হয়ে আবারো নিষ্পলক শায়েরীকে দেখতে লাগল। শায়েরীর আঁকা থেকে স্রষ্টার আঁকা শায়েরী বেশি নিপুণ, শৈল্পিক, জাদুময়ী। শায়েরীর আঁকা শেষ তখন। বাকিটা বাসায় যেয়ে আঁকবে। এখন ঘড়িতে সময় দেখতে হবে। রুচিদের বাসায় যেতে হবে তাকে! শায়েরী খাতা বন্ধ করে ব্যাগে রাখলো। ডান হাতের দিকে তাকিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। বড্ড পিপাসা পেয়েছে তার। ব্যাগে পানি আছে? থাকার তো কথা! শায়েরী ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল বের করল। বোতলের মুখ খুলে বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগল। নক্ষত্রের কাছে কি যে সুন্দর লাগছে এ দৃশ্য! সে মনে মনে বলল,
” আমি মানুষ না হয়ে এইচটুও হলাম না কেন? ”
কিন্তু মনের কথা মনে চেপে নক্ষত্র বাজখাঁই গলায় শায়েরীকে ধমকে বলল,
” কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায় কোনো সাড়া শব্দ নেই কেনো? ”
শায়েরী হকচকিয়ে উঠল। ধমক শুনে পানির বোতল হাত ফসকে পড়ে গেল। বিষম খেল সে, কাশতে লাগল অনবরত। নক্ষত্র হাত বাড়িয়ে শায়েরীর মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিলো কয়েকবার। এই মাথায় ছুঁয়ে দেওয়ার সময়টায় যদি কেউ নক্ষত্রের হাতটা দেখতো তাহলে কম্পমান হাত দেখেই বুঝে যেত এই কাঠখোট্টা ছেলেটার মাঝে একটা হৃদয় আছে, যে হৃদয়ে প্রতি সেকণ্ডে সেকণ্ডে কারো জন্য ভূমিকম্প হয়। কিন্তু আফসোস কেউ তা দেখল না।শায়েরীর কাশি বন্ধ হলো। শায়েরী ঘাবড়ে গেল নক্ষত্র ভাই আবার দেখেনি তো চোখজোড়া! তাহলে আম্মার কাছে ফোন করে ঝামেলা পাকাবে নিশ্চয়। কুটনা বুড়া একটা!
বোতলের পানিতে শায়েরীর জামার অনেকটা অংশই ভিজে গেছে। সে হাত দিয়ে জামা থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
” কখন ডেকেছ? আমি তো শুনিনি। ”
” শুনবে কি করে খাতার মধ্যে ঢুকে যাওয়াই তো বাকি!”
শায়েরী সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল একবার। কি জানে নক্ষত্র ভাই দেখে ফেলল না তো আবার! আম্মার কাছে আজকেই ফোন যাবে, কি জ্বালা! শায়েরী স্বাভাবিক থাকাট চেষ্টা করে বলল,
” তুমি এখানে যে? ”
” তোমার নাকি শরীর খারাপ? ”
শায়েরী অবাক হয়ে বলল,
” আমার আবার শরীর খারাপ কখন?”
” কাল রাতে জ্বর হয়েছিল, তাইনা? ”
শায়েরী মনে করে দেখল হ্যাঁ তাই তো জ্বর তো হয়েইছিল। বলল,
” নক্ষত্র ভাই, তুমি কি করে জানলে? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ”
নক্ষত্র কিছু বলল না আর, চুপচাপ উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে শায়েরীর ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল,
” প্রহর গাড়িতে অপেক্ষা করছে চলো।”
শায়েরী থমথমে গলায় বলল,
” ব্যাগ রাখো নক্ষত্র ভাই, আমার এখন টিউশনিতে যেতে হবে। ”
নক্ষত্র বলল,
” প্রহরের প্র্যাক্টিকেল খাতা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট কাল। এখন এগুলো এঁকে দিবে কে? ”
” আমার কাছে দিয়ে যাও, আমি বাসায় যেয়ে এঁকে দিব, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে নিয়ে যেও রাতে। ”
নক্ষত্র আহত হলো কিছুটা। ড্রাইভার কেন? শায়েরী কি একবারো ওকে এসে নিয়ে যেতে বলতে পারল না! রাগ করল নক্ষত্র! ভয়ানক রাগ! গমগমে গলায় বলল,
” তুমি একমাসে টিউশনীতে কতো টাকা পাও? যত পাও তোমাকে এক্ষুণী দিয়ে দিচ্ছি। প্রহরের খাতাগুলো একটু এঁকে দাও।”
শায়েরী ঘাসের উপর বসে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে রইল অনিমেষ! কান্না আসছে কেন আবার? একদম কাঁদবে না সে, একদম কাঁদবে না!
নক্ষত্র ওয়ালেট বের করে টাকা বের করছে আর তাচ্ছিল্যের সাথে বলছে,
” প্রহরটাও ভারি নাটক দেখায়! নিজের প্র্যাক্টিক্যাল নিজে করবে না। আচ্ছা না করুক, দোকানে দিলেই তো হয়। নাহয়, আমার বন্ধুকে দিয়েও তো করাতে পারি। আর্কিটেক্ট এ পড়ে, আমাদের বুয়েটেই। না উনি উনার গুরুমা শায়েরী আপিকে দিয়েই করাবেন। ”
নক্ষত্র জানে না শায়েরী টিউশনিটায় কত টাকা পায় তাও আন্দাজে দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলো। শায়েরী হাসল খানিক, সে হাসিতে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর কষ্ট লুকিয়ে আছে। শায়েরী হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলোও। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” ব্যাগটা দাও নক্ষত্র ভাই। টাকাটা রাখতে হবে। হাতে থাকলে হারিয়ে যাবে। আমার কাছে দশ হাজার টাকাই অনেক। দশ হাজার টাকা দিয়ে বাবার এক মাসের ঔষধের ব্যবস্হা হয়ে যাবে। ”
নক্ষত্র ব্যাগটা শায়েরীর দিকে বাড়িয়ে দিতেই শায়েরী ছোঁ মেরে ব্যাগটা নিতে দেরি হলো কিন্তু হাতের টাকা ছুঁড়ে ফেলতে দেরি হলো না। নক্ষত্র থতমত খেয়ে গেল। সে প্রস্তুত ছিল না এর জন্য। শায়েরীর ইচ্ছে করছিল টাকাটা নক্ষত্রের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলতে কিন্তু সেটুকু আর করল না। হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতন টাকাগুলো উড়িয়ে দিয়ে পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করল সে। কলা ভবনের ঘাসের উপর হাওয়ায় উড়া টাকাগুলো অনেকেই দেখল কিন্তু কেউ দেখল না একটা মেয়ের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া, আর একটা ছেলের ভয়ানক রাগ থেকে করা ছোট্ট একটা ভুল নামের মস্ত বড় অপরাধ, কেউ দেখল না!

নক্ষত্র গাড়িতে ফিরে এসে বেশ শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করল। প্রহর দুহাতে কান চেপে ধরে বলল,
” দাভাই কি হলো তোমার? ”
নক্ষত্র গাড়ির স্টিয়ারিং এ বার কয়েক ঘুষি মেরে বলল,
” আমার কিছু হয়নি, হবে তো তোর শায়েরী আপির। টাকাগুলো কেমন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো!”
প্রহর চোখের চশমা আঙুল দিয়ে নাকের ডগা থেকে উপরে তুলে বলল,
” এমা! আপির কিছু হবে মানে? কে করল এই সর্বনাশ?”
নক্ষত্র বাম হাতে প্রহরকে চড় দিতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত আর দিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” একদম মেরে ফেলব তোকে। বস্তির মেয়েদের মতো কথা বলবি না। ”
প্রহর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
” আপি কোথায়? ”
নক্ষত্র চিৎকার করে বলল,
” শ্মশানে! সেখানে সতীদাহপ্রথায় শায়েরীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে! এবার খুশি?”
প্রহর রাগে গটমট করে গাড়ি থেকে নেমে গেল। নামতে নামতে বলল,
” তুমি মরেছ? আগে নিজে মরে তারপর আপির সতীদাহপ্রথার ব্যবস্হা করে দিয়ে যাও। মারতে হলে আগে নিজে মরতে হয়। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস এর মতে প্রতিশোধের পথে যাওয়ার আগে দুটো কবর খুঁড়ে নিতে হয়। একটা নিজের জন্য অপরটা যার উপর প্রতিশোধ নিবে তার জন্য। হুহ্! ”
এই টুকু বলে প্রহরও নক্ষত্রের মত জোরে শব্দ করেই গাড়ির দরজা বন্ধ করল। তারপর রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। মেয়েটা এত তর্ক করে যে নক্ষত্রে মেজাজ চড়ে যায়গা। কিন্তু, আজ মেজাজ চড়ার বদলে নক্ষত্রের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নক্ষত্র কিছু বলল না আর। শায়েরীকে যদি সতীদাহপ্রথায় পুড়িয়ে মারতে হয় তাহলে আগে নক্ষত্রকে নিজে মরতে হবে। ইশ্ কি ভয়ঙ্কর মিষ্টি সমীকরণ! নক্ষত্র হাত বাড়িয়ে গাড়িতে রেডিও চালু করল। কি সুন্দর গান ভেসে আসছে,
” সোনা বন্ধু তুই আমারে…. সোনা বন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা। মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না…।”
নক্ষত্রও গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গাইলো,
“মনে তো মানে না…., দিলে তো বুঝে না।
.
প্রহর অনেকটা কষ্টে পুরো মাঠ খুঁজে শায়েরীকে খুঁজে পেল একটা ছাউনির নীচে। চুপচাপ বসে আছে শায়েরী। প্রহরকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখে সে বলল,
” প্রহর! আপিকে বিরক্ত করো না প্লিজ, মুড খারাপ এখন। তোমার খাতাগুলো দিয়ে যাও। আপি এঁকে রাখব। ”
প্রহর শায়েরীর পাশে বসে দুহাতে মুখ চেপে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
” দাভাই আমাকে মেরেছে, দাভাই আমাকে মেরেছে। ”
শায়েরী বেশ অবাক হয়ে বলল,
” বলো কি প্রহর! নক্ষত্র ভাই তোমাকে মেরেছে?”
প্রহরের কান্নার বেগ আরও বাড়ল। কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শায়েরীর বড্ড মায়া হলো। প্রহরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” দুপুরে কিছু খেয়েছ? এখন তো লাঞ্চ টাইম! ”
প্রহর বলল,
” না খাইনি। ”
শায়েরী উঠে দাঁড়িয়ে প্রহরের হাত ধরে টেনে তুলল। বলল,
” চলো খেতে চলো, কোথায় খাবে? আজকে আপি তোমাকে ট্রিট দিব। ”
প্রহর গুমড়ামুখে বলল,
” না আমি খাব না। ”
শায়েরী বলল,
” ধুর! তুমি ঐ খেচরটার জন্য না খেয়ে থাকবে? ”
খেচর বলে শায়েরী নিজেই জিহ্ব কাটল। ইশ্ প্রহরের সামনে এভাবে বলা ঠিক হয়নি। প্রহর যদি বলে দেয়! তে সর্বনাশ!
প্রহর বলল,
” যেহেতু খেচর বলে দাভাইকে বকা দিয়েছ তাই এখন আমার মুড ভালো হয়ে গিয়েছে। চলো আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে যাই।”
শায়েরী আলতো করে প্রহরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
” চলো তাহলে যাওয়া যাক। ”
প্রহর যেতে যেতে শায়েরীর অগোচরে নক্ষত্রকে টুপ করে একটা মেসেজ লিখে ফেলল।
” দাভাই, আমাদের ফলো করে তুমি রেস্টুরেন্টে এসো। তারপর মাস্ট বি আপিকে সরি বলবে। কি হয়েছে, কেন বলবে জানি না। কিন্তু অবশ্যই, অবশ্যই সরি বলতে হবে! নতুবা, তুমি যে আপিকে অন্য চোখে দেখো আমি মাকে সে কথা বলে দিব। ”
নক্ষত্র মেসেজ পেয়ে হতভম্ব হয়ে মোবাইলের স্ক্রিণে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর ফুঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট করল। প্রহর আর শায়েরীকে ফলো করে ওদের পিছন পিছন গেল সে।

শায়েরী প্রহরকে নিয়ে পাশেরই একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে। প্রহরের দিকে মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিয়ে শায়েরী বলল,
” নাও প্রহর চট করে অর্ডার দিয়ে ফেলো তো। ”
প্রহর মেন্যু কার্ড হাতে নিয়ে বলল,
” ধুর খেচরটা আবার এসেছে! কই একটু শান্তি মতো খাব, সেই সুযোগটাও আমার ভাই আমায় দেয় না। ”
শায়েরী পিছন ফিরে নক্ষত্রকে হেঁটে আসতে দেখে ভয়ে জমে গেল। খানিক আগেই সে নক্ষত্রের সামনে টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল। তখন হয়তো থতমত খেয়ে গিয়েছিল তাই কিছু বলতে পারেনি। এখন শায়েস্তা করতে আসছে নিশ্চয়! শায়েরী ফিসফিস করে “ফাবি আইয়ি আলা ইরব্বিকুমা তুকাজ্জিবান “পড়তে লাগল। নক্ষত্র এগিয়ে আসতেই নক্ষত্রের চোখের দিকে তাকিয়েও বার কয়েক পড়ল সে। আম্মা বলে আসামী যদি এটা বিচারকের চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ে তাহলে নাকি বিচারকের মনে দয়ার সৃষ্টি হয়। আচ্ছা শায়েরী কি আসামি? মোটেও না! শায়েরী ভাবলো, আসমি হবে নক্ষত্র ভাইয়ের বাপ! শুধু শুধু শায়েরী কেন আসামি হতে যাবে! টাকার গরম দেখায়! শায়েরী আনমনে হেসে উঠে বলল,
” ধুর! মামা কেন আসামি হবে?
নক্ষত্র চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
” হাসছো কেন তুমি? ”
নক্ষত্রের কথায় শায়েরী হাসি বন্ধ করে ফেলল। চোখে মুখে এক রাশ অস্বস্তি ফুটে উঠল শায়েরীর। মিনমিন করে বলল,
” ভাই! প্লিজ আম্মাকে কিছু বলো না। ”
নক্ষত্র বলল,
” সরি। ”
” নক্ষত্র ভাই প্লিজ! সরি বলো না। আম্মা যদি জানে আমি একটু আগে তোমার সাথে অমন করেছিলাম তাহলে বাড়ি গেলে আমার চুল ছিঁড়ে ফেলবে তোমার জন্য। ”
নক্ষত্র ইতঃস্তত করে বলল,
” ইয়ে মানে আমি ফুপ্পিকে বলে দিব বলে তোমাকে সরি বলিনি। ”
শায়েরী অবাক হয়ে প্রায় সাথে সাথেই চিৎকার করে বলল,
” তাহলে? ”
নক্ষত্র প্রহরের দিকে আরো একবার তাকালো। প্রহর তখন মেন্যু কার্ড নিয়ে ব্যস্ত, যেন নক্ষত্র আর শায়েরী কি কথা বলছে তাতে তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। নক্ষত্র প্রহর থেকে চোখ সরিয়ে শায়েরীর দিকে তাকালো। শায়েরীর কপালে তখনও ভাঁজ পড়ে আছে। নক্ষত্র মনে মনে বলল,
” শায়েরী তুমি কিন্তু আমার চরিত্র নষ্ট করে ফেলছ। একবার হাসো তো আরেকবার এমন করে তাকিয়ে থাকো! উফ্ কি করি আমি বলো, কি করি? ”
নক্ষত্রকে চুপ থাকতে দেখে প্রহর মেন্যু কার্ডে চোখ বুলাতে বুলাতেই কনুই দিয়ে নক্ষত্রকে খোঁচা দিলো। নক্ষত্র প্রায় সাথে সাথেই বলল,
” আমি আসলে সরি শায়েরী। তোমাকে টাকা দেওয়ার কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি। প্রহরের প্র্যাক্টিক্যাল জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট তো তাই টেনশনে তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ। ”
নক্ষত্রের কথা শুনে শায়েরী হা হয়ে আছে। কি বলছে নক্ষত্র ভাই?

মাহফুজ সাহেব অনেকক্ষণ ধরে সায়াহ্নের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সিগারেটের এস্ট্রেতে সিগারেট নিভিয়ে সিগারেটটা ঘরের মাঝ বরাবর ছুঁড়ে ফেললেন তিনি। সায়াহ্ন ভারি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল ঘটনাটা। তার বাবা মাহফুজ সাহেব সিগারেট এমন করে ঘরে ফেললেন? কি করে সম্ভব? রিটায়ার্ড আরমি পার্সন হিসেবে তিনি খুব বেশিই গুছালো। অপরিচ্ছন্নতা, এলোমেলো ভাব এসবে এলার্জি উনার। জায়গার জিনিস জায়গা মতো না রাখলে বাসায় তুলকালাম চালান তিনি, আর তিনিই কিনা সিগারেট এস্ট্রেতে না রেখে ছুঁড়ে ফেললেন? সায়াহ্ন ঢোক গিলে বলল,
” বাবা তোমার শরীর ঠিক আছে তো? ”
মাহফুজ সাহেব থমথমে গলায় বললেন,
” তোমার নামের আগে যে ডাক্তার শব্দটা আছে সেটা আমার জানা আছে। তোমাকে এত ডাক্তারি করতে হবে না এখানে। তুমি তো বড় লায়েক হয়ে গেছো দেখছি। তা লায়েক সাহেবের পছন্দের লায়েক বিবিটা কে? ”
সায়াহ্ন বলল,
” বাবা, তুমি যা ভাবছো তা না। কোনো এফেয়ারও নেই। তাছাড়া কাউকে পছন্দ করি এমনও না। ”
মাহফুজ সাহেব চেয়ারে মাথা এলিয়ে আরাম করে বসলেন। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রেখে বললেন,
” তুমি মৌনকে বিয়ে করবে না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে তুমি যেসব মেডিকেল সাইন্স রিলেটেড কারণ দেখিয়েছ তা শুনে হাসি পেল খুব। আমি বলছি না তুমি যা বলেছ তা বেঠিক। বরং তোমার কথাগুলোই ঠিক যে এত কাছাকাছি তাও চাচাতো ভাই-বোনে বিয়ে হলে পরে ঝামেলা হয়। কিন্তু তুমি এখন যেতে পারো। ”
সায়াহ্ন বাবার মতিগতি কিছুই বুঝলো না। জিজ্ঞাসা করল,
” বাবা তুমি তো সিদ্ধান্তটা দিলে না। ”
মাহফুজ সাহেব সময় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘর জোড়ে পায়চারি করে সায়াহ্নের সামনের চেয়ারটায় আবার বসলেন। সায়াহ্ন এবার নিজ থেকেই সাহস করে বলল,
” বাবা, আমি কিন্তু মৌনকে বিয়ে করব না। ”
মাহফুজ সাহেব এবার বারুদের মতন জ্বলে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন,
” গেট লস্ট ডাক্তার সাহেব, গেট লস্ট! আমার মৌনকে আমি কোথায় বিয়ে দিব আপনি দেখে নিয়েন। আপনাকে জীবনে অনেক পস্তাতে হবে। এই আমি বলে দিলাম। ”
সায়াহ্ন আহত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। মাহফুজ সাহেব খানিক থেমে আবার বলতে লাগলেন,
” মৌনকে আমি নিজ হাতে গড়েছি। সোনা লক্ষী মেয়ে আমার! ওকে নিজের কাছে, নিজের ঘরে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে কপাল তো আর আমার হলো না। তবে বলে রাখলাম আমার প্রিন্সেসকে আমি যেখানে বিয়ে দিব তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। ইউ রিজেক্টেড মাই প্রিন্সেস! হাউ ডেয়ার ইউ? কোন মেয়ের জন্য তুমি ওকে রিজেক্ট করলে, সেই মেয়েটাকে আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ”
” বাবা ট্রাস্ট মি। আমি কারো জন্য মৌনকে রিজেক্ট করিনি। ”
মাহফুজ সাহেব অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন,
” নাউ ইউ শুড লিভ ডাক্তার সায়াহ্ন শাহরিয়ার! ”
চলবে…
.
একশত ভাগ গ্যারান্টি দিলাম আপনাকে শারীরিক মানসিক সহ মনে প্রাণে সব দিক দিয়ে ভাল রাখবে এই পেজ এর লেখাগুলো।
AK
বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন ভালবাসার গল্প, জোকস, প্রেমের কাহিনী পেতে এখনি পেজটি লাইক দিয়ে একটিভ থাকুন, আর পড়তে থাকুন মন ছুয়ে যাওয়া অসাধারণ কাহিনী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here