ফ্ল্যাট নাম্বার নয় ছয়পর্বঃ ৪৪
লেখকঃ লামইয়া চৌধুরী।
বিপাশা আর নক্ষত্র বসে আছে নক্ষত্রের ঘরের বারান্দায়, পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে। মিষ্টি সকাল, বাইরে নরম হাওয়া। বিপাশা হামি তুলতে তুলতে বলল, “আমার ঘুম নষ্ট করে আমাকে এখানে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসার মানেটা কি? জানিস ঘুমের চোটে তোর বাইক থেকে আমি পড়েই যাচ্ছিলাম।”
নক্ষত্র উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। কোথায় যেন কামারের হাতুড়ি পেটার মতন একটা শব্দ হচ্ছে। তার বুকের ভেতর নাকি? বিপাশা হঠাৎ নক্ষত্রকে চমকে দিয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলল, “নক্ষত্র এ যে বসন্ত বৌউরি!”
নক্ষত্রের কপালে ভাঁজ পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, “কিসের বসন্ত বউরি?”
“ওই যে শোন টুক টুক টুক।”
নক্ষত্র মৃদু হেসে বলল, “ওহ্ এটা পাখির ডাক ছিল! আমি আরও ভাবলাম কোথাও হাতুড়ি পেটা হচ্ছে।”
বিপাশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বারান্দার গ্রিলে দু’হাত চেপে ধরে বলল, “আওয়াজ কর্কশ হলেও সুরে রয়েছে চমৎকার তাল-লয়।”
নক্ষত্র হাতের আঙুলের নখের দিকে তাকিয়ে ছোট করে মাথা দুলালো। বলল, “হু।”
বিপাশা কেমন অন্যরকম একটা গলায় বলল, “ঠিক তোর মতন।”
নক্ষত্র মাথা তুলে বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই নাকি?”
বিপাশা ফের এসে নক্ষত্রের পাশের চেয়ারটায় বসল। বলল, “তোর ভালোবাসার ধরন আর বসন্ত বৌউরির ডাক একই ধাঁচের। কি কর্কশতা তবুও ব্যাকুলতা।”
নক্ষত্র ঢোক গিলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। বিপাশা দু’হাতে নক্ষত্রের মুখখানা ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল, “কবে থেকে ভালোবাসিস তাকে?”
নক্ষত্র নিজের নীচের ঠোঁটখানা কামড়ে ধরে অসহায় চোখে বিপাশার দিকে তাকিয়ে রইল। বিপাশা হঠাৎ অন্যরকম এক নক্ষত্রকে দেখল। নক্ষত্রের চোখে পানি টলমল করছে। কি যে ব্যাথাতুর দৃষ্টি! বিপাশা এই নক্ষত্রকে চেনে না, একদমই চেনে না। এই নক্ষত্র তার বন্ধু হতেই পারে না। তার বন্ধু নক্ষত্রের চোখে জল, এত তো অসম্ভব।
বিপাশার হাত ছাড়িয়ে নক্ষত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুই কি করে বুঝলি?”
বিপাশা ম্লান হেসে বলল, “আমি সব বুঝি, সব টের পাই।”
নক্ষত্র আচমকা বিপাশার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। বিপাশার হাত জোড়া নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল, “দোস্ত প্লিজ শায়েরীকে কিছু বলিস না।”
বিপাশা ঝঙ্কার দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে বলল, “কেন বলব না? আলবত বলব আমি। শায়েরীর জানা দরকার একটা মানুষ তাকে পাগলের মতন ভালোবাসে। তার জানা দরকার যে কেউ একজন রাত জেগে তার নামে চিঠি লিখে লিখে ল্যাপটপে ফাইলের পর ফাইল বোঝাই করছে।”
নক্ষত্র চমকে গিয়ে বলল, “তুই পাসওয়ার্ড কোথায় পেলি?”
বিপাশা ধমকে বলল, “সেটা দিয়ে তোর কি? আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড? বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছে লুকাতে তোর একটুও কষ্ট হলো না নক্ষত্র? ইউ ব্রোউক মাই হার্ট ব্রো। তুই আমার কাছ থেকে লুকিয়েছিস? আমার কাছ থেকে? আমি যখন বিষয়টা জেনেছি আমার যে কি কষ্ট হয়েছিল দোস্ত।”
নক্ষত্র ধরে আসা গলায় বলল, “রাগ করিস না বিপু। আমি যে ওকে ভালোবাসি সেটা নিজেকেও টের পেতে দিই না।”
বিপাশা চোখ মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তুই কি শালা মেয়ে মানুষ? বুক ফাটে তবুও মুখ ফুটে না কেন তোর? এমন চলতে থাকলে দুইদিন পর শায়েরীর বাচ্চাকাচ্চা তোকে এসে মামা ডাকবে হতচ্ছাড়া! তুই হবি বড় মামা, শিকু হবে ছোটমামা।”
নক্ষত্র আগুন চোখে বিপাশার দিকে তাকাল। বিপাশাও কটমটিয়ে তাকিয়ে বলল, “তোর মতন ছেলের বাপ হওয়ার সাধ্যি কই? তুই হবি নক্ষত্র মামা। উপস্ বড় মামা। বাপ হতে হলে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হতে হয়, বুকেরপাটা থাকতে হয়। তোর মতন মরা পাতা বড় মামাই হবে।”
নক্ষত্র ঝট করে উঠে দাঁড়াল। পাশে রাখা ফুলের টবটায় সজোরে লাথি বসাল। টব গড়িয়ে বিপাশার পায়ে এসে লাগলো। ব্যথায় বিপাশা ককিয়ে উঠে বলল, “মা গো জঙ্গিটা আমায় মেরে ফেলল।”
নক্ষত্র রাগে গরগর করতে করতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বিপাশাকে শালী বলে গালিও দিলো। বিপাশা তা শুনে খ্যাকখ্যাক করে হেসে উঠে বলল, “তোর শালা বিয়েই হবে না কোনোদিন। বউ পাবার’ই যার মুরোদ নেই তার আবার শালী। হেহ্!”
.
শায়েরী ঘুম থেকে উঠেই মৌনকে কল করল। মৌন কল রিসিভ করার আগেই আদুরী খপ করে মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। মৌন কর্কশভাবে বলল, “স্পিকার অন কর।”
আদুরী স্পিকার অন করে বলল, “তুই এখন কোথায় শায়ু?”
শায়েরী ফণা তোলা সাপের মতন হিসহিসিয়ে বলল, “শ্বশুরবাড়ি।”
আদুরী আঁতকে ওঠা গলায় বলল, “তাহলে আমার সন্দেহ’ই ঠিক!”
মৌন হতাশ গলায় বলল, “তুই তাহলে বিয়ে করে নিয়েছিস? আমি আরো ভাবলাম সায়াহ্ন ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ের আলাপ চালাব।”
শায়েরী খেঁকিয়ে বলল, “আমি বিয়ে করব কেন? আমার বাদুরীর মতন এত বিয়ে করবার শখ নেই।”
আদুরী কথায় বাগড়া দিয়ে বলল, “আমি বিয়েপাগল?”
শায়েরী জোরালোভাবে বলল, “আবার জিগায়!”
আদুরী ঝগড়াটে গলায় কিছু একটা বলতে নিলো। কিন্তু, মৌন বাধা দিয়ে শায়েরীকে প্রশ্ন করল, “তাহলে শ্বশুরবাড়ি বললি কেন?”
শায়েরী রিনরিনে গলায় বলল, “আমি কি আমার শ্বশুরবাড়ি বলেছি নাকি? আমি খেচরটার শ্বশুরবাড়ি বলেছি।”
আদুরী বিস্মিত হয়ে বলল, “তার মানে তুই তোদের বাড়ি?”
শায়েরী ভীষণ চটে গিয়ে বলল, “আশ্চর্য তো! আমার বাড়ি কেন নক্ষত্র ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি হতে যাবে? আমি নক্ষত্র ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ডের বাসায় আছি।”
আদুরী চোখ কপালে তুলে বলল, “উনার গার্লফ্রেন্ড তাহলে অন্য কেউ?”
“হ্যাঁ অন্য কেউ’ই তো। তুই কি ভেবেছিলি আমি ওই খেচরের প্রেমিকা?”
আদুরী অস্ফুট স্বরে বলল, “হু।”
“আরে না বিপাশা আপুর সাথে ভাইয়ের সিরিয়াস প্রেম চলে। খানিক আগেই দেখলাম বিপাশা আপু নক্ষত্র ভাইয়ের বাইকে করে কোথায় যেন যাচ্ছে।”
মৌন ভ্রু কুঁচকে বলল, “এত সকালে?”
শায়েরী জবাব দিলো, “জানিস আপু ঘুমে ঢলে পড়ছিল পুরোপুরি। তারপরেও ভাই এসে জোর করে নিয়ে গেছে। আপু তো বাইকে বসে নক্ষত্র ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়ের পিঠের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল। পড়ে টরে ব্যথা না পেলেই হয়।”
চলবে…