দরিয়া পর্ব- ১

0
600

দরিয়া
পর্ব- ১
আমিরাহ্ রিমঝিম

সৈকতে পাতা বেঞ্চে বসে অনেকক্ষণ ধরে অন্যমনস্ক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আফিয়া। আনেকটা সময়, অনেকগুলো মুহূর্ত। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে, যেন ভারী কোনো বোঝার ভারে ক্লান্ত হয়ে রেহাই চাইছে একটু।

“ইমা, এদিকে এসো তো একটু, ফুপিকে পানির কাছে নিয়ে যাও।”

আফিয়ার ডাকে অবাক হয় ইমা। ওর ধারণা ছিলো আফিয়া ফুপি সমুদ্র ভয় পায়, কারণ এর আগে যতবার ওরা সমুদ্রে এসেছে কোনোবারই আফিয়াকে সাথে নিয়ে আসতে পারেনি। আফিয়া কিছুতেই আসতে রাজি হয়নি। এবার ওদের সাথে আফিয়াও এসেছে, পানির কাছেও যেতে চাইছে, ব্যাপারটা ইমার জন্য বেশ আশ্চর্যের।

ইমার সাহায্য নিয়ে ভেজা বালুর উপর গিয়ে দাঁড়ায় আফিয়া। ইমা ওর হাতে ক্রাচ ধরিয়ে দিয়ে সরে যায়। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ এসে ভিজিয়ে দেয় পা। সেদিকে তাকিয়ে আবার ভাবনার সাগরে ডুব দেয় আফিয়া।

আজ কত বছর পর এলো সমুদ্রে? পনেরো? হ্যাঁ, পনেরো বছর। পনেরো বছর আগে সমুদ্রের কাছেই তো একটা বাসা ছিলো তার। তার, তার বাবার, চরম অপ্রিয় তুরাগ ভাইয়ার। না না, বাসাটা তো তার আর তার বাবার ছিলো, তুরাগ ভাইয়ার ছিলো না। তুরাগ ভাইয়া থাকতো শুধু সাথে।

সেসময় যখন ওই বাসাটায় আসা হতো, কতবার যে যাওয়া হতো সমুদ্রে! মাঝে মাঝে দিনে দুবার করেও যাওয়া হতো, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতো সমুদ্র সৈকতে। মালতী আপু আর রত্না আপু হতো ওর সঙ্গী, মাঝে মাঝে ওর বাবা তুরাগকেও পাঠিয়ে দিতেন সাথে। আর ছিলো রোকসানা।

আফিয়া ভাবতে পারে না আর, দুচোখ বন্ধ করে ফেলে। বালুর উপর ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়ে, কানের দুপাশ দিয়ে শো শো শব্দ তুলে ছুটে চলে সামুদ্রিক বাতাস, পায়ের নিচে নরম ভেজা বালু। আফিয়া ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। অনেক বছর আগের যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিগুলো মস্তিষ্কে এসে হানা দেয়।

………………………

তখন আফিয়ার বয়স সবে তেরো বছর। ছোটবেলা থেকেই পায়ের সমস্যার জন্য ক্রাচ নিয়ে চলতে হয় তাকে। কিশোরী আফিয়া যতটা না দুরন্ত, তার চেয়ে বেশি রাগী আর একরোখা। সে নিজে থেকে একটা বিষয় নিয়ে যা বুঝবে, এর বাইরে অন্য কেউ তাকে কিছু বুঝাতে পারবে না।

বাবার উপর চরম বিরক্ত সে। এটা এ কারণে নয় যে বাবার ধারণা আফিয়া চরম বোকা, বুদ্ধির পরিপক্বতাহীন, চিন্তাভাবনা ছাড়া কাজ করা অবাধ্য একজন মেয়ে। বরং কারণটা হচ্ছে তুরাগ ভাইয়া।

আফিয়ার দাদা ব্যাবসা করতেন। উনার পর উনার দুই ছেলে একত্রে বাবার ব্যাবসাকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনাদের সারাজীবনের পরিশ্রমের ব্যাবসা আগলে রাখার জন্য তুরাগ ছাড়া আর কোনো উত্তরাধিকার ছিলো না।

তুরাগ ছিলো আফিয়ার একমাত্র চাচার ছোট ছেলে, চাচাতো ভাই। তুরাগের বড় ভাই ব্যাবসার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। বাবা আর চাচার সাথে তুরাগও ব্যাবসার বিভিন্ন কারবার দেখাশোনা করতো। আফিয়ার বাবা চাচা দুজনেই বুঝে গিয়েছিলেন উনাদের অবর্তমানে ব্যাবসার হাল তুরাগ ছাড়া আর কেউ ধরবেনা।

মাতৃহারা, জেদি, অসহিষ্ণু আফিয়ার জন্য বেশ চিন্তিত থাকতেন আফিয়ার বাবা। তার উপর মেয়েটি আর দশজনের মতো সহজে হাটাচলা করতে পারে না। উনার পরে মেয়েটির মাথার উপর ছায়া হয়ে কে থাকবে- এই চিন্তায় তিনি মাঝে মাঝেই ভুগতেন। এসব ভাবনা থেকেই আফিয়ার জন্য তুরাগকে পছন্দ করলেন তিনি।

আফিয়ার সাথে তুরাগের বিয়ে হলে ব্যাবসার সমস্ত কিছু তুরাগের হাতে থাকবে। তাই তুরাগের বাবাও দ্বিমত করলেন না। আফিয়ার বাবার ইচ্ছা ছিলো মেয়েটার এইচএসসি শেষ হলেই বিয়েটা দিয়ে দিবেন, দরকার হলে কলেজে উঠার পরপরই দিবেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উনার দুশ্চিন্তা হয় ভীষণ।

এই কথা কোনোভাবে আফিয়ার কানে গেলো। আর যেদিন আফিয়া এসব জানতে পারলো রণক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়লো বাড়িটাকে। বাবার সাথে প্রচন্ড চেচামেচি করলো। আফিয়ার বাবা বললেন না কিছুই, মেয়ে কিছুটা শান্ত হলে বোঝালেন বিয়ের সময় আসতে আসতে ততদিনে যদি মনে হয় ও তুরাগকে বিয়ে করবে না তাহলে বিয়ে হবে না। আফিয়া তবু রাগে ফোসফাস করতে থাকে।

তুরাগকে ওর কাছে গুন্ডা গুন্ডা লাগে। মনে হয় অভদ্র একটা লোক সে, বন্ধু বান্ধবদের সাথে দুনিয়া ঘুরে উল্টাপাল্টা কাজ করে এসে বাপ-চাচার সামনে ভালো সেজে থাকে। উদ্ভট একটা লোক, একবার সিগারেট খেতেও দেখেছে তাকে। আফিয়ার উপর যেন সবসময় বিরক্ত হয়েই থাকে। এমন লোককে তো আফিয়া কখনোই বিয়ে করবে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here