দরিয়া পর্ব- ২

0
200

দরিয়া
পর্ব- ২
আমিরাহ্ রিমঝিম

সমুদ্রের কাছে ওদের বাড়ি ছিলো একটা। মানুষজনের কোলাহল থেকে দূরে ছোট, ছিমছাম, সুন্দর একতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে সবুজ গাছ, বাগান। বাগানের পর প্রাচীর দিয়ে আড়াল করা। আফিয়ার বাবা খুব শখ করে করেছিলেন বাড়িটা। ব্যাবসায়িক কাজে এদিকে আসতে হলে এই বাড়িটাতেই থাকতেন তিনি। মাঝে মাঝে আফিয়া আর ওর মাকেও নিয়ে আসতেন, মা মারা যাওয়ার পর শুধু আফিয়াকে। তবে তুরাগ ওনার সঙ্গী হতো প্রায় সবসময়।

সেবারে আফিয়ার আনন্দটা একটু বেশিই ছিলো। কারণ প্রায় এক মাস তারা থাকবে এই বাসায়, সমুদ্রের কাছে। ওর বাবা যদিও নিজের কাজে এসেছেন, কিন্তু আফিয়ার তো কাজ নেই। ও ঘুরবে, আনন্দ করবে, সময়টা উপভোগ করবে নিজের মতো।

সদ্য পড়াশোনা শেষ করা তুরাগও সাথে এসেছে, আফিয়ার বাবাই নিয়ে এসেছেন। পড়া শেষ হয়েছে, এখন ব্যাবসায় আরো ভালোভাবে মনোযোগী হতে চায় সে। চাচার সাথে থেকে এদিকের কাজগুলো ভালোভাবে বুঝে নেয়াই এখানে আসার মূল কারণ। তার আসাতে আফিয়া যে ভীষণ বিরক্ত হয় তা সে বুঝতে পারে, কিন্তু এতে তার কিছুই আসে যায় না।

জিনিসপত্র গোছগাছ শেষ হলে দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয় সবাই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে আফিয়া আসরের নামাজ পড়ে তৈরী হয়ে নেয়। ওদের বাসায় কাজ করা মালতী আর এই বাড়ির কেয়ারটেকারের স্ত্রী রত্না – দুজনকে সাথে নিয়ে সমুদ্র দেখতে পা বাড়ায়। কাছাকাছি যেতেই ঢেউয়ের গর্জন এসে কানে ধাক্কা খায়।

সৈকতে এসে দেখে হয়ে যায় রোকসানার সাথে। আফিয়া আসবে এটা ওর জানা ছিলো না। চমকে যায় খুব, ভীষণ খুশি হয়। দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসে আফিয়ার কাছে।

রোকসানা এখানের মেয়ে। বাড়ি কাছেই। সমুদ্রের সাথেই তার বেড়ে ওঠা। ওর সাথে আফিয়ার প্রথম দেখা হয়েছিলো দুই বছর আগে, যখন আফিয়ার মা জীবিত ছিলেন। সমবয়সী বলে দুজনের মধ্যে ভাব হয়েছে খুব সহজেই। এরপর থেকে এই বাড়িতে এলেই রোকসানার সাথে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় থাকে আফিয়া।

কিন্তু, আফিয়াকে রোকসানা যতটা আপন করে ভেবেছিলো, রোকসানাকে হয়তো সেভাবে আপন করে নিতে পারেনি আফিয়া। ওর মনে রোকসানার জন্য বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি বোধহয় করুণা কাজ করতো। কেমন পুরাতন, মলিন পোশাকে সাগরপাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সৈকতে বেড়াতে আসা লোকজনদের কাছে এটা সেটা বিক্রি করে। আফিয়া মনে মনে ভাবে, “আহারে!”

কোনো মানুষের উপার্জন নিজের চেয়ে কম বলে যে তাকে করুণার চোখে দেখার প্রয়োজন নেই, যথাযথ সম্মানটুকু যে দিতে হয় এই বোধটুকু হয়তো আফিয়ার মস্তিষ্কে ছিলো না। এ কথা রোকসানা জানতে পারলে বন্ধুত্বটা হতো না হয়তো কখনোই।

“আফিয়া! কবে আসলে?”
“আজই, সকালে।”
“কতদিন থাকবে এবার?”
“এক মাস।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”

রোকসানার চোখেমুখে যেন খুশি উপচে পড়ছে। আফিয়ার মুখেও হাসি। টুকটুক করে গল্প করতে করতে সময় আগায়। একটা সময়ে কারো একজনের ডাক শুনে রোকসানা সেদিকে তাকায়। তারপর দ্রুত বিদায় নেয় আফিয়ার কাছ থেকে।

“বড়ভাই ডাকছে। গেলাম আমি। এই ঝিনুকগুলো রাখো।”

রোকসানার ভাইয়ের ডাক শুনে আফিয়াও তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। এই তাহলে ওর ভাই? এর আগে রোকসানার কাছে শুনেছিলো ওর বড় ভাই আছে একজন, আজ দেখতেও পেলো।

বান্ধবীর ডাকে আফিয়া চোখ সরায়। এক হাতে কুড়িয়ে পাওয়া ঝিনুকগুলো নেয়। রোকসানা চলে যাচ্ছে তার ভাইয়ের সাথে। আফিয়া মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। রোকসানার দিকে নয়, তার ভাইয়ের দিকে।

তুরাগ ও তার চাচা সোফায় বসে ব্যাবসায়িক আলোচনা করছিলেন। আফিয়া বাসায় প্রবেশ করে তখন। সেদিকে চোখ যেতেই তুরাগ বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুচকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।

পায়ের সমস্যার কারণে ছোট থেকেই সবার কাছে একটু বেশিই আদর পায় আফিয়া। তুরাগও খুবই স্নেহ করতো তাকে। কিন্তু দিন দিন সেই স্নেহে ভাটা পরতে থাকে আফিয়ার আচরণের কারণে। দুই তিনবার তুরাগকে তার বন্ধুদের সাথে হাহা-হিহি করে হাসতে দেখেছে, মামা-শালা বলে ডাকতে দেখেছে। সিগারেট খেতেও দেখেছে একবার। এতেই ধারণা করে ফেলেছে তুরাগ খারাপ লোক। হ্যাঁ তুরাগ মানছে যে সিগারেট খাওয়া কোনো ভালো কাজ নয়। কিন্তু আফিয়া এমন ব্যাবহার করে যেন তুরাগ কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী।

আফিয়ার মতো এমন জ্ঞান-বুদ্ধিহীন মেয়ে আর একটা দেখেনি তুরাগ। কতবার যে ওর সাথে ভালো করে কথা বলতে গিয়ে আফিয়ার ঝাঁঝালো কথা হজম করে এসেছে হিসাব নেই। প্রথম প্রথম আফিয়ার বয়স কম ভেবে ব্যাপারগুলো উড়িয়ে দিলেও এখন ওকে দেখলেই বিরক্ত লাগে।

বাবা-চাচার কথায় আফিয়াকে বিয়ের ব্যাপারে সায় তো দিয়েছে তুরাগ, কিন্তু এই মেয়ে যদি এমনই থাকে তবে সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। নিজের জীবনে যেচে অশান্তি কে আনতে চায়?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here