শ্রাবন আধারে তুমি পার্ট:১৭

0
633

শ্রাবন আধারে তুমি পার্ট:১৭
লেখিকা:আফরিন ইসলাম

রাইয়ের নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে ছুটে চলেছে সাদি ৷হাজারো মানুষের ভিরে সাদির মতো লোকের আজ বড্ড অভাব ৷ বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে রাইকে নিয়ে যেতে ৷সাদি চলমান গাড়ী গুলোর থেকে সাহায্য চাইতে লাগলো ৷কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না ৷সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ৷বাস্তবতা বড্ড কঠিন ৷এখানে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করতে হয় ৷ এই দুনিয়াতে কেউ কারো জন্য নয় ৷ সবই দুই দিনের মায়া ৷ সাদির ডাকে চকচক করা প্রাইভেট কারের মালিকেরা সাড়া দিল না ৷কিন্তু একজন বৃদ্ধ ভ্যান ওয়ালা এগিয়ে আসল ৷ বৃদ্ধ লোকটা ভরাট গলায় বলল

আব্বা আমার ভাঙ্গা ভ্যান গাড়ীটায় আম্মাটারে উঠান ৷আপনে কই যাইবেন ৷আমি লইয়া যাইতাছি ৷

সাদির চোখ ছলছল করে উঠলো ৷যেই মানুষটা কিনা কোটি টাকার গাড়ী ছাড়া কখনো বের হয় নি ৷সে আজ কতটা অসহায় ৷রাইকে নিয়ে আসার সময় মানিব্যাগটাও নিয়ে আসে নি ৷ মোবাইলটাও ভুল করে গাড়ীতে ফেলে এসেছে ৷কারো কাছে সাহায্য নিতে পারছে না ৷ এর জন্যই হয়তো টাকা নিয়ে ,ক্ষমতা নিয়ে অহংকার করতে নেই ৷কারন আল্লাহ কখন কাকে কোথায় নিয়ে দাড় করায় তা কেউ জানে না ৷কখন কার সাহায্য দরকার হয় তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না ৷

সাদি সময় নষ্ট করলো না ৷রাইকে ভ্যান গাড়ীটার মধ্যে শুইয়ে দিল ৷ভ্যান গাড়ীটা বৃদ্ধ লোকটা বাতাসের বেগে চালাতে লাগলো ৷

এই দুনিয়াতে আল্লাহ যাকে অর্থদেয় তাকে মন দেয় না ৷আর যাকে মন দেয় তাকে অর্থ দেয় না ৷তাই হয়তো চোখের সামনে কেউ মরে গেলেও কারো কিছু যায় আসে না ৷

অপরদিকে মিশকা নিজের ঘরে বসে আছে ৷আজ একদিন সে খাওয়া দাওয়া করছে না ৷মেয়েটার পাগল প্রায় অবস্থা ৷সাদি কেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করলো ৷মিশকা ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলো ৷হঠাৎ করেই নিজের কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই মিশকা সে দিকে তাকালো ৷

আনিলা বেগম মেয়ের চোখের পানি মুছে দিল ৷মিশকা নিজের মাকে ধরে জোড়ে কেদেঁ উঠলো ৷আড়াল থেকে আবরার ফুপু সবই দেখলো ৷তার মুখে হাসি ৷সে তো এটাই চেয়ে ছিল ৷ভালবাসার মানুষকে হাড়ানোর যে কতটা কষ্ট তা আফজাল খানের ছেলে মেয়ে বুঝবে ৷যেমনটা একদিন সেও পেয়ে ছিল ৷আফজাল খান সেইদিন তার চোখের পানির ভাষা বোঝে নি ৷কিন্তু এবার নিজের ছেলেমেয়ে চোখের পানির ভাষা বুঝবে ৷

রাই কে কিছুক্ষন আগে সাদি হাসপাতালে এনেছে ৷ডাক্তারা রাইয়ের চিকিৎসা শুরু করেছে ৷রাইয়ের অবস্থা ভালো না ৷হার্টবিট অনেক কম ৷রাইয়ের জ্ঞান নেই ৷ সাদি প্রিয়ন্তীর মোবাইল থেকে নিজের ম্যানেজারকে কল করে টাকার ব্যবস্থা করতে বলেছে ৷চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে রাইকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার সব ব্যবস্থা করতে বলেছে সাদি ৷চার পাঁচ জন ডাক্তার রাইকে দেখছে ৷রাইয়ের কাছে কারো যাওয়া নিষেধ ৷ আইসিইউ থেকে প্রিয়ন্তী বেড়িয়ে আসতেই সাদি বলল

কি রে রাইয়ের কি খবর ৷ও ঠিক আছে তো ৷আমি ওকে কালকের মধ্যে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব ৷রাই ঠিক হয়ে যাবে তো বলনা ৷

প্রিয়ন্তী হতাশ কন্ঠে বলল সাদি উত্তেজিত হস না ৷ রাইয়ের হাতে সময় নেই আর ৷আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে যদি জ্ঞান না আসে তাহলে শেষ কথা টুকুও বলতে পারবি না ৷ রোগটা একেবারে ছড়িয়ে পরে তারপর ধরা পড়েছে৷ আর ওর অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে কোথাও নিয়ে গেলেও আর কাজ হবে না ৷ওর ব্রেনে ছড়িয়ে পড়েছে টিউমারের বিষাক্ততা ৷যদি একবছর আগেও রোগটা ধরা পড়তো তবুও বাচানো যেত ৷কিন্তু এখন আর সম্ভব না ৷

সাদি ফ্লোরে বসে পড়লো ৷অবশেষে সে চেয়েও কিছু করতে পারবে ৷মেয়েটা তার সামনেই এভাবে ঝড়ে যাবে অকালে ৷ সাদি উঠে রাইয়ের দিকে তাকালো ৷বেডের ওপর কত নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে ৷ মুখটা কালো হয়ে গেছে ৷পুরো মাথায় চুলের ছিটে ফোটাও নেই ৷ডাক্তার নাকের ভেতরে চিকন পাইপ ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷পাইপটা ঢুকানোর সময় নড়ে উঠে ছিল ৷হয়তো প্রচন্ড কষ্ট হয়ে ছিল তখন ৷মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ৷চোখের চারপাশ কালো হয়ে গেছে ৷ পাশের মনিটরের সবুজ দাগটা আস্তে আস্তে ওঠা নামা করছে ৷ এই সবুজ দাগটা হঠাৎ যদি সমান হয়ে যায় তখন কি হবে ৷ভাবতেই সাদির চোখ চিকচিক করে উঠলো ৷

দিন শেষে রাতের আগমন ৷রাত বারোটা বাজে ৷ সাদি কিছুক্ষন আগে সামান্যই খেয়েছে ৷ওর মা জোড় করে খাইয়ে দিয়েছে ৷ রাইয়ের চিকিৎসা চলছে ৷এক বারের জন্য তার জ্ঞান ফিরে নি ৷

অপর দিকে আবরার নিজের বারান্দায় দাড়িয়ে একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে ৷রাইকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে ৷ মেয়েটা একটা বারো তাকে কল করলো না ৷আবরার সিগারেটের অভিমানি ধোয়া গুলো উড়িয়ে দিল ৷ রাতে কিছুই খায় নি আবরার ৷কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না ৷ বারবার রাইকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব তার ৷ নিজের সব কিছু প্যাকিং করেছে আবরার ৷কালকের ফ্লাইটে চলে যাবে বিদেশে আবার ৷আর কখনো আসবে না এই দেশে ৷

আফজাল খান নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন ৷ সে কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না ৷কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ৷আফজাল খানকে চিন্তিত দেখে আনিলা বেগম বললেন

ঘুমিয়ে পড় ৷রাত জাগতে নেই ৷ আফজাল খান স্ত্রীর কথার ভাজে কিছুই বললেন না ৷শুয়ে পড়লেন ৷

খোলা আকাশে তাকিয়ে আছে সাদি ৷তার ঠোটঁ জোড়া কাপছে ৷বিনা দোষে আজ সে শাস্তি পাচ্ছে ৷সে তো মিশকা কে সব জানাতে চেয়ে ছিল রাইয়ের ব্যাপারে ৷কিন্তু সেই সময়টাও পেল না সে ৷ভালবাসার মানুষকে ছাড়া থাকতে যে কত কষ্ট তা রাইকে দেখে সে বুঝেছে ৷ভালবাসায় এত কষ্ট কেন ৷আবরার যদি রাইয়ের অবস্থা একবার জানতো তাহলে কি করতো ৷আজকাল একটু বেশিই কেদেঁ ফেলছে সাদি ৷হয়তো আপন মানুষদের হারানোর যন্ত্রনা গুলো এমনই হয় ৷

অন্ধকার রাত পার হয়ে গেছে ৷সকালের সোনালী আলো সাদির চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল ৷কাল রাতে হাসপাতালের বারান্দাতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টের পায় নি ৷ রাইয়ের কথা মনে হতেই সাদি দৌড় লাগায় সেই দিকে ৷যেয়ে দেখে ডাক্তাররা রাইকে নিয়ে ব্যস্ত ৷সাদি প্রিয়ন্তীকে নার্স এর মাধ্যমে একবার ডাকে ৷প্রিয়ন্তী আসতেই সাদি বলে

রাই ঠিক আছে তো প্রিয়ন্তী ৷

না রে ৷ অবস্থা শুধু খারাপই হচ্ছে ৷হার্টবিট কমে যাচ্ছে ৷ওর আত্মীয় স্বজন কেউ থাকলে আসতে বল ৷যেন শেষ দেখাটা দেখে নেয় ৷

সাদি ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার রাইকে দেখলো ৷তারপর দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলো ৷সাদি নিজের গাড়ীতে বসে ড্রাইভ করতে লাগলো অতি দ্রুত ৷কাল রাতে সাদির ম্যানেজার গাড়ী দিয়ে গেছে হাসপাতালে ৷সাদি নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে ৷অনেক সহ্য করেছে আর না ৷ এবার সে আবরার মুখোমুখি হবে ৷

চলবে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here