গল্প – ইরার কথা
পর্ব – ১০
তাশরিফের কল এসেছে। এবং আমি সত্যি সত্যি নার্ভাস হয়ে গেলাম। কারন রাতুল অলরেডি সামনে। রিংটোন বেজেই চলেছে। লাগাতার ভাবে। এটা খুব বাজে একটা ব্যাপার। বলা যায় অস্থির করা বিষয়। বুকে কাঁপুনি ধরায় যে কোন রিংটোন।
: কি আশ্চর্য তুমি কলটা রিসিভ করছো না কেন?
রাতুল খুব সহজ ভাবে কথা বলছে। কিন্ত তার চোখের ভাষা ছিল অন্যরকম। ভিন্ন টাইপ। খুব চতুরতায় রাতুল সব নজরে রাখছে। আমিও তাই বুঝতে দিলাম না। বেশ সাবলীলভাবে তা মেনে নিয়ে হাসলাম। কারন আসামীর কাঠগড়ায় আমি দাঁড়িয়ে আছি।
নিরুপায় আর অসহায় এক মানুষ।
: ওমা! এই সময় ফোন রিসিভ করব কি করে? তুমি নাশতা করবা অফিস যাবা, এখন কি গল্প করার সময় পড়েছে? চলো নাশতা খাবে
আমি ডাইনিং এ চলে যাচ্ছি। পেছন থেকে রাতুল প্রায় চেচিয়ে ডাকল।
: ইরা তোমার ফোনটা আগে ধরো।
ওর কথাতে আমিও বিরক্ত। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কত উদার সে।
অথচ কাল রাতেই এসব নিয়ে নাটকের সীমা ছিল না।
রাগে সত্যি গা জ্বলে যাচ্ছে।
: হ্যালো।
কথাটা বলার সময় আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। কিন্ত হচ্ছে না বা পারছি না। কাঁপা গলার আওয়াজ বের হলো।
আমি তাকিয়ে আছি রাতুলের দিকে। কাল রাতের বিশ্রী ঘটনাটা মনে পড়ছে। যে ঘটনাগুলো আমাদের মত মেয়েদের সাথে বারবার ঘটে। আমরা প্রায়দিন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়গুলোর মুখোমুখি হই। কেউ সবকিছু মেনে নিই। পরাজয়ের গ্লানি মেখে।কেউ তর্কে জিততে যাই। জোর করে। কিন্ত সত্য হলো এসব আমাদের জীবনে ঘটতেই থাকে। আমরা সংসার করতে এসে প্রতিদিন নিজেকে প্রমান করতে থাকি। কে ভালো, কে খারাপ। এসব প্রমান আসলে পুরুষরাই করায়। নিজেকে বাঁচাতে নিজেকে প্রমান করতে পুরুষদের কাছে নিজেকে বারবার পরীক্ষা দিতে হয়। এটা কত যে কষ্টকর। কতটা অসহায়ত্বের তা মেয়েরাই জানে।
সংসার মানেই বিশাল এক যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে খেলা চলে হারজিতের। খেলা চলে টিকে থাকার।
হারিয়ে দেবার, হারাতে দেবার কখনও আবার নিঃশেষ হয়ে যাবার। কখনও কখনও হারতে হারতে আমরা নুয়ে পড়ি। শরীর মনের যুদ্ধের শেষ তবুও হয় না। আসলেই হয় না। কখনও হয় না। কখনও হবেও না।
আমিও ঠিক তেমন চরম বিধ্বস্ত অবস্থায়। তাই শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে রাতুলকে দেখছি।
যাহোক তাশরিফের কল ধরলাম। কথাও বলতে শুরু করেছি কিন্ত রাতুলের রিএ্যকশান একেবারে জিরোতে। এটা আমায় অবাক করল।
কারন তার মুখভঙ্গি খুব স্বাভাবিক। আমি খুব কায়দা করে ফোনটা হাতে ব্যলকনিতে চলে আসি। আসার সময় দেখলাম সে ওয়ালেট হাতে নিয়েছে । ঘড়ি পড়ল। আজ আবার ফিতা ঘড়ি পড়েছে। চেইন ঘড়ির বদলে। পারফিউম দিলো আবার। ভুরভুর ঘ্রান বেরুচ্ছে সেই পারফিউমের। মাথা ধরে এমন ঘ্রানে। কিন্ত এসব আমার চিন্তার বিষয় না। আসল জিনিস হলো রাতুল এত নরমাল আচরন কেন কারনে করছে এটা নিয়ে।
: ইরা, কি অবস্থা আপনার?
আরে এই লোক দেখা যায় আমার নাম ধরে ডাকছে। এই যুগের ছেলেগুলি অতি আধুনিক। কোন কিছুর পরোয়া করে না।
: জ্বি এই তো ভালো।
আমি হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টায় আছি। কিন্ত হচ্ছে উল্টো।
: শুনুন লিরিকস পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্ত আপনার কাছে।হোয়াইটস আপ চেক করুন। কাল রাতে আমরা কিন্ত লাইভে আসবো, বুঝলেন?
রিশাদ আর আবিদ ভাইকে নিয়ে। ডিটেইলস কথা হবে লাইভে। আপনিও থাকবেন লাইভে।
আর রিহার্সেল এর ডেট কিন্ত আগামীকাল। কি সবটা ক্লিয়ার?
এতক্ষন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তাশরিফের প্রতিটা কথা আমার কানে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছে।
স্বপ্নজয় বা স্বপ্নকে ছুঁয়ে যাওয়ার মত অলীক একটা মুহুর্ত আমাকে ঘিরে তৈরী হচ্ছে। এতদিন কল্পনার আকাশ দেখতাম। আক্ষেপের বেদনা ছিল। কিন্ত আজ পরিপূর্ন আকাশটা হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আমি ছু্ঁয়ে দেখব আকাশটাকে।
আচ্ছা আমি কি ঠিক থাকতে পারব সেই মুহুর্তে নাকি কেঁদে ফেলব। হঠাৎ প্রাপ্তি বা অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দ এমনই হয়।
: ঠিক আছে।
নত মুখে কথাটা বললাম। আরো কিছু বলতে চাইলাম। কিন্ত রাতুল সামনে চলে আসায় বলা হয়নি।
ওপাশে তাশরিফ বকবক করেই যাচ্ছে। সবই দরকারি কথা। তবে আমার ভারী ভালো লাগছে শুনতে।
: ওহো, আরেকটা কথা কাল বিকেল চারটার মধ্যে আপনি কিন্ত কলাবাগানে চলে আসবেন। ওটা রিশাদ ভাইয়ের স্টুডিও।
আপনাকে সব টেক্সট করে দিচ্ছি। সময়মত যেন হাজিরা পাই।
আমি হাসছি এটা শুনে। হাসির কথাও। কেজি ক্লাসের বাচ্চাদের মত পড়া বোঝানো হচ্ছে।
: আচ্ছা।
আমি খুব ছোট ছোট কথা বলছি যাতে রাতুল বুঝতে না পারে। অন্যদিকে তাশরিফ ননস্টপ কথা বলছে। তার আনন্দিত কথাবার্তা আমাকেও আনন্দ দিচ্ছে। কিন্ত আধাআধি। কারন রাতুলের ঘুর্নিপাকে আমি আটকে যাচ্ছি।
জীবনের একটা বিশেষ কাজ হচ্ছে। সেটা নিয়ে উত্তেজনা কিংবা অধীর অপেক্ষার মুহুর্তগুলো আসলেই অন্যরকম।
কিন্ত কোথায় একটা দ্বিধা একটা কাঁটার খোঁচা জ্বালাতন করছে। থেকে থেকে।
আমি ফোন রেখে দেবার চেষ্টায় আছি। কিন্ত সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কথা বড় হচ্ছে।
হঠাৎ খেয়াল করি রাতুল বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। ফোনটা তাড়াতাড়ি রেখে রুমে এলাম।
রাতুল পুরো রুম জুড়ে হেঁটে হেঁটে কথা বলছে।
: এত দায়িত্বহীন আমি নই। প্রজেক্টের বিষয়টা সাইদকে এ টু জেড ইনফর্ম করেছি । আমার কাজ নিয়ে সহজে কেউ কথা বলবে এমন সুযোগ আমি কাউকে দেই না।
রাতুল আরো কি কি সব বলছে। আমার ওসব শুনে কোন কাজ নাই। তার অফিস প্রজেক্ট এসব আমার চিন্তা না।
ওর কথার মাঝে আমি কিচেনে চলে আসি।
এসে পরোটা ভাজলাম। চিকেনটা আবার চুলায় বসিয়েছি। সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। চুলা খালি হতেই চায়ের পানি দিলাম। পানি জ্বাল হোক। মাঝারি আঁচ রেখে টেবিলে এসে দেখি রাতুল খেতে বসেছে। প্লেটে পরোটা সাজিয়ে দিয়েছি। সে পরোটার টুকরো ছিড়ে মুখে দিচ্ছে। কিন্ত ফোন হাতে আছেই। মেসেজ আসছে।ওগুলো চেক করায় ব্যস্ত।
আমি সেমাইটা সামনে দিয়ে চা করতে কিচেনে ঢুকি। কিন্ত স্পষ্ট শুনলাম ও সিয়াম ভাইয়ের সাথে কিছু বলছে।
আমার বুকে ধক করে একটা বাড়ি খায়। ওর আচরন কেমন একটু রহস্য রহস্য লাগল।
সিয়াম ভাইয়ের সাথে ও খুব নিচু গলায় কথা বলছে।
তবে সাবজেক্ট কি ছিল তা বোঝা যাচ্ছে না।
অফিস বা প্রজেক্ট সংক্রান্ত কিনা।
নাকি তাশরিফ বিষয়ক। রাতুল কি তলে তলে সব খবর নিচ্ছে? ও কি আমাকে নজরদারীতে রেখেছে?
তার মানে তো অনেক কিছু। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত আমার গান করার স্বপ্নটা অধরা রয়ে যাবে।
আরিয়ান বল হাতে ড্রইং রুম মাতিয়ে তুলছে। মিনু ওর সাথে পেরে উঠে না। একটু পর পর বসে পড়ে।
: ভাইয়া একটু খাড়ান, দম লইয়া লই।
আরিয়ান হেসে কুটি কুটি।
আমিও হাসছি। আমার দিকে চোখ পড়তেই মিনু বোকার মত হাসে।
: ইরা, এদিকে একটু আসো তো?
কিচেন থেকে ওর ডাকটা শুনে ডাইনিং এ আসি।
রাতুল তার নাশতা খাওয়া শেষ করেছে।
চায়ের মগ হাতে। একটু পরপর চুমুক দিচ্ছে তবে ভীষন অন্যমনস্ক।
আমি আসতেই চায়ের মগ সরিয়ে আমাকে বসতে বলল।।
আমি বসতে বসতে দেখি রাতুল আবারও মেসেজ চেক করল। প্রচুর ব্যস্ততা।
: ইরা আমি তিনদিনের ট্যুরে চিটাগাং যাচ্ছি।
আমি চমকে গেছি।
তবুও সামলে নিয়ে হাসলাম।
: কি ব্যাপার হঠাৎ ট্যুর কেন, তাছাড়া কবে যাচ্ছো?
রাতুল নড়েচড়ে বসল।
: আর বলো না প্রজেক্টে একটা বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে। মানুষ এতটা দায়িত্বহীন হয়।কাল যাবো।
কথাটা শুনে আমার খুশী খুশী লাগছে। এতো মেঘ না চাইতেই জল।
রাতুলের সাথে যুদ্ধ করে জিততে হবে এটা আমার ইচ্ছে নয়। খুব আশায় আছি যেন সে আমায় বুঝে নেয়। কিন্ত তাকে বুঝিয়ে আমার মতে আনা বিশেষ কঠিন কাজ। তবুও আমি শেষ চেষ্টা করে যাবো যে করেই হোক।
আমি জিততে চাই কিন্ত রাতুলের সাথে যুদ্ধ করে নয়। কারন সব জেতাই জেতা নয়।
বাধার পাহাড় পেরুনো যে সহজ নয় এটাও তো জানা।
তবুও মনের ঘরে আশার বসতি ঘর বেঁধেছে। জ্বলজ্বল করা সেই ঘর আমায় বিমুখ করবে না।
: কবে ফিরবা?
: তিনদিনের কাজ।
: ওহ।
রাতুল চা শেষ করে সোজা রুমে গেলো। খুটখাট আওয়াজ পাচ্ছি।
এদিকে আমিও টেবিল ছেড়ে চলে এলাম কিচেনে। রান্না পড়ে আছে। মাছ ভিজিয়ে রেখেছি সকালে। খুব বেশী পদ করব না আজ। রোজ রোজ একই রুটিন ভালো লাগে না। তবে চিকেনের একটা পদ করাই লাগবে আরিয়ানের জন্য। ছেলেটা চিকেন না হলে খাবারই তুলবে না মুখে। ফ্রিজে ডাল রান্না আছে। মোটমাট দুইটা রান্না হলেই কাজ গুছানো হয়ে যাবে। তারপর ফ্রি হয়ে একটু শপিং যাবো। কিছু কেনাকাটা আছে।
হঠাৎ করে মনটা হু হু ভালো লাগায় ভেসে যাচ্ছে।
রাতুলের ট্যুর হঠাৎ করে হওয়াটা কি ভালো কিছুর পূর্বাভাস?
আরিয়ানের হৈ চৈ চলছে। মিনুকে এখন ডেকে আনা দরকার। কিন্ত ছেলেটার মন খারাপ হবে।
থাক একাই দেখি কতটুকু করতে পারি।
আমি মাছে হলুদ মরিচ জিরার গুড়ো দিয়ে মাখিয়ে রাখলাম। টমেটো পেয়াজ কাটা আছে। ওটা মাখা মাখা করে ভুনা করব।
টমেটোর একটা টক করতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত সময় কম। তাই সরিয়ে রাখলাম।
চুলায় হাঁড়ি চড়িয়ে পেয়াজটা ঢেলে দিতেই রাতুল ডাকতে লাগল।
: ইরা দরজাটা লাগিয়ে দাও।
: আসছি।
চুলার আঁচ কমিয়ে দরজার কাছে এসে দেখি রাতুল ফোনে কথা বলছে। আমি হাত ইশারায় বাই বলি। কিন্ত ফোনে থাকায় রাতুল এর জবাব না দিয়ে খুব দ্রুত সে লিফটে পা রেখে চমৎকার একটা হাসি দিলো।
হাসিটা বেশ ইঙ্গিতপূর্ন। ভালো খারাপ বুঝতে পারলাম না। আসলেই বুঝতে পারলাম না। কারন রাতুল খুব চালাক। খুব বেশী বুদ্ধিমান। কিন্ত আমার সাথে ওর চালাকি বা বুদ্ধির খেলা কতদুর গড়াবে সেটাই ভাবছি। আমি কি পারবো ওর সাথে আমার ছকে জিততে?
নাকি হেরে যাবো।
বুঝতে পারছি না।
বিঃদ্র- প্রিয় পাঠক আপনাদের অসীম ভালবাসায় অভিভুত আমি।
ভালবাসার প্রতিদানে আবারও বলব আপনাদের অসাধারন কমেন্টস এর জন্য বারবার লিখতে সাহস পাই,, আপনারা আমার লেখার মূল শক্তি,,তাই শ্রদ্ধা, সন্মান সবটুকু আপনাদের জন্য রইল,, সবটুকু থাকবে,
আবারও ভালবাসা এবং 🥰🥰🥰🥰
…… তামান্না হাসান