ইরার কথা পর্ব – ১২

0
292

গল্প – ইরার কথা

পর্ব – ১২

: ম্যাম কিছু অর্ডার করবেন না?
ওয়েটারের ডাকে আমার হুশ ফিরল।
পরিস্কার শুদ্ধ উচ্চারন ছেলেটার। কিন্ত মুখে হাসি নাই।
বেজার মুখে কথা বলছে। তার বেজার হয়ে থাকার কারনটা জানা দরকার। অন্য সময় হলে ঠিকই জানতে চাইতাম। কিন্ত আজ এই মুহুর্তে আমার আগ্রহ কম। মেজাজ আছে জঘন্য পর্যায়ে। কারনটা হল রাতুল। আমি দেখলাম লাল ক্যাপ পড়া ছেলেটার টিশার্টটাও লাল। ব্র্যান্ডের লোগো আটা টিশার্টে। ছিমছাম সুন্দর। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
তারপর গম্ভীর মুখে না করে দিলাম।
ছেলেটি হনহন করে চলে যাচ্ছে। কাউন্টারে গিয়ে অন্যজনকে কিছু বললো বোধহয়। ওরা কৌতুহল নিয়ে আমাকে দেখছে। এটা খেয়াল করেছি। কাউন্টারে আরো তিনজন ছেলে আছে। এদের মাঝে দুজন খুব ব্যস্ত। খাবার সার্ভ করার কাজে। সবার গায়ে একই ধরনের টিশার্ট।
ফোন বাজছে কিন্ত আমার খেয়াল নেই।
আমি রাতুলকে দেখছিলাম। কি সাবলীলভাবে ও মেয়েটার সাথে খাবার খেলো। হালকা বেগুনী রঙে ওকে বেশ মানায়। ইদানীং ওর বেগুনী রঙে আসক্তি বেড়েছে। আগে ছিল নীলে। বিষয়টা আজই মনে হল। আমি খেয়াল করলাম কিছুটা সময় পরপর ও ঘড়িতে সময় দেখছে। ব্র্যান্ডের ঘড়িও হাতে। কি জানি কিসের তাড়া। দুর থেকেই মেয়েটির চেহারা ছবি খুব আকর্ষনীয় লাগছে। যদিও বেশ উগ্র পোশাক আষাক গায়ে। তবুও অপূর্ব সুন্দরীই বলা যায়। এই মেয়ের পাশে বসে রাতুল মনে হয় বেশ তৃপ্ত। ওর খুশী খুশী ভাব সেটাই বলছে। মেয়েটা তার ফোন হাতে একটু পরপর একা একা সেলফি তুলছে। কি সব কায়দা করে। তখন রাতুল কেমন যেন বিব্রত হয়ে যায়।
এদিকে আমার। রাগ উঠছে চরমে। ইচ্ছে করছে কাছে গিয়ে রাতুলকে কিছু জিজ্ঞাস করি। জানতে চাই কেন এখানে এসেছে। কিন্ত অচেনা একটা মেয়ের সামনে যদি উলটা পাল্টা কিছু করে বসে তখন আমার মান থাকবে না। কারন এটা পাবলিক প্লেস। অতএব নিজেকে শান্ত রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই।

লাল টিশার্ট পড়া ওয়েটার যাচ্ছে একটু পরপর ওদের টেবিলে। অর্ডার নিচ্ছে আর খাবার সার্ভ চলছে। গল্পগুজব চলছে আর ফাঁকে চলছে খাওয়া। প্রচুর খেলো মেয়েটা। খাদক শ্রেনীর বোধহয়। এতগুলো খাবারের বিল রাতুলই দেবে।
উফ অসহ্য।
রাতুলের মুখে সেই সুন্দর হাসিটা লেগে আছে।
আমি শকড হইনি। কেবল ধরে নিলাম ওর পরিবর্তনের এই রূপটা আজ সামনে আসাটা খুব দরকার ছিল।
ফুডকোর্টে প্রচুর মানুষ। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশী। তাই ভিড়ের মাঝে রাতুলের নজরে পড়ার কোন সুযোগও নাই।

ফোন এলো। তাকিয়ে দেখি শেহনাজের কল । মুড অফ হয়ে আছে এমনিতে। কথা বলার অবস্থায় নাই।
তবুও কথা বললাম একেবারে নিরুপায় হয়ে।

: শেহনাজ কোথায় তুমি?
আমি খুব উৎফুল্ল হয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি কিন্ত আমার গলাটা কান্নার মত শোনালো।
আমার ভাঙা আওয়াজে শেহনাজ কি অবাক হচ্ছে।
: আছি আমি।
এখন আমি উল্টো অবাক হলাম। শেহনাজ অনেকক্ষন আগে বলেছিলো সে নিচে আছে। তবে লিফটে করে সাততলায় আসতে এতটা দেরী হবার কথা নয়। আমি জানতে চাইলাম দেরী হবার কারন।
: এ্যাই তুমি এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছো না?
ওপাশে কেমন অনীহা নিয়ে কথা বলছে শেহনাজ।
: ইরা আমি একটু আটকে গেছি।একটা জরুরী কল এসেছে হসপিটাল থেকে। আমি ফিরে যাচ্ছি।
প্লিজ কিছু মনে করো না।
আমি নিশ্চুপ থেকে বললাম ওকে।

শেহনাজ চলে গেছে এতে আমার মন খারাপ হয়নি এটা সত্য।
বরং ও এলে আরো মন খারাপ হত। রাতুলের বিষয়টা ভেতরে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এটা সহ্য করে শেহনাজের সাথে সুখময় সময় পার করা অসম্ভব ছিল। তারচেয়ে এটা মন্দের ভালো হয়েছে ওর চলে যাওয়াতে।
শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে সোজা নেমে এলাম আট তলা থেকে।
চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছি। একটা একটা ফ্লোর ভেঙে। প্রচুর মানুষ প্রতিটা ফ্লোরে। ঘুরতে এসেছে। খুব সুখী সুখী মুখ। কিন্ত তাদের সুখী উৎফুল্ল মুখগুলো দেখতে কেন জানি আমার ভালো লাগছে না।

সারাটা পথ চুপচাপে এসেছি। পড়ন্ড বেলার রোদ গায়ে মেখে মলিন হয়ে আছি। সুন্দর একটা বাতাস বইছে। কিন্ত আমার উল্টো মন খারাপ হচ্ছে। প্রচন্ড মন খারাপ। এই সময়ে বৃষ্টি এলে ভালো হত। ভিজতে পারতাম। কিন্ত আকাশে তো কোন মেঘ নেই। ঘনকালো মেঘের আভাসও নেই। তাহলে বৃষ্টি আসবে কোথা থেকে। আকাশে চোখ রাখলাম। আমার দৃষ্টির সীমানায় ধুসর ম্লান একটা আকাশ। যেখানে আলোর শরীর বেয়ে সন্ধ্যের ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে।

কলিংবেল বাজালাম। দরজা খুলে মিনু এক গাল হেসে ব্যাগগুলো টেনে নেয়। ওর পেছনে ছোট ছোট পা ফেলে আরিয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। ওর নিষ্পাপ মুখে নিখাদ ভালবাসা ডুবে আছে। । আমিও কি এক ঘোরের মাঝে আছি জানি না। কেবল মনে হল ওকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন থাকতে পারলে মনটা শান্ত হত।
আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরলাম। বুকটা ভেঙে আসছে কান্নায়। আমি সেই কান্না লুকাতে পারছি না। খুব চেষ্টা করছি আটকানোর জন্য। যাতে ছেলেটা কিছু বুঝতে না পারে।

ব্যালকনির সন্ধ্যেটা আজ নিথর নিরব। কফির ধোয়া নেই। গুনগুন সুর নেই।
দৌপদী কাহনের তার বেয়ে
বেসুরে জীবনটা নেতিয়ে পড়ছে।
ফড়িং এর ডানায় সবুজের স্পর্শে কবিতারা কথা বলত রোজ আমার সাথে। গাছগুলো আমার প্রান। কত বায়না ধরতাম এই গাছের জন্য একসময়। নার্সারিতে ঘুরে ঘুরে নানা জাতের ফুলের গাছ কিনেছি। নতুন ধরনের টবের বাহার আমার ব্যলকনিতে। কাঠগোলাপ ফুটেছে আজ। এতক্ষনে দেখলাম।ইশ! কি সুন্দর দেখতে ।
চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিন্ত আজ মন ভালো নেই।
অবেলার বৃষ্টিতে ভিজে একাকার উঠোন বাড়ি।
বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। কতটা দিন কথা হয় না। দেখাও হয় না।
কর্তব্যের জমিনে নিড়ানি দিতে দিতে শেকড়কে ভুলে গেছি। আমারও একটা বাড়ি ছিল। সেটাও ভুলে গেছি। প্রিয় কতগুলো মুখ, প্রিয় জিনিস পছন্দের জায়গা সব সব ছেড়ে দিয়ে এসেছি । নিয়ম সমাজ আর প্রথাগত কারনে।
” বাবা ” অস্ফুট ডাকটা বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে দু চোখের পাতা বেয়ে অঝোর মেঘের কাঁপন।
ওড়নার আচঁলে জলের ছায়া। ঝাপসা একটা মুখ। কত আপন। কত মায়ার।
সব ফেলে একদিন চলে আসতে হয় মায়ার বাঁধন কাটিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে আলগা হতে থাকে নিবিড় বাঁধনের গেড়ো।
ফোন হাতে নাড়াচাড়া করছি। সারাদিন রাতুল কোন কল দেয়নি আজ। নাই টেক্সটও । শুধু তাশরিফের কতগুলো টেক্সট। কাল রিহার্সেল। মনে দ্বিধা অনেক। যাবো কি যাবো না। কোথাও একটা খেই হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত বাস্তব হল মানাতে হবে সবকিছুর সাথে। মানাতে হয়।
আমি চোখ বন্ধ করে দোল খাচ্ছি। টি টেবিলে কফি পড়ে আছে। ছু্য়েও দেখিনি। মিনু একবার এসে ঘুরে গেছে।
আরিয়ান কয়েকবার এসেছে। ছেলেটা এসেই আকঁড়ে ধরে আমাকে। কি মিষ্টি ঘ্রান ওর গায়ে।
: মা তুমি এখানে চুপ করে বসে আছো কেন?
আমি জোর করে হেসে ফেলি। ছেলেটা দিনদিন কি বড় হয়ে যাচ্ছে?
: এখানে কত সবুজ দেখেছো বাবা। আমার ভালো লাগছে বসে থাকতে।
আরিয়ান বড় বড় চোখে আমাকে খেয়াল করল। ওর চোখে অনেক প্রশ্ন। আমি সব পড়তে পারি।
: মা আমিও বসি?
পাশের চেয়ারটায় আরিয়ান পা দুলিয়ে কলকল করে কত কথা বলছে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি।
ছেলেটা অবিকল তার দাদীর মত হয়েছে। গায়ের রঙ চেহারা সব। এমনকি হাসলেও উনার মত দেখায়। আমার বা রাতুলের মত নয় দেখতে।
আমার শাশুড়ি এতে খুব খুশী।
আরিয়ানকে অসম্ভব আদর করে। সবাইকে ডেকে ডেকে বলে, দেখছো আমার নাতি ঠিক আমার মত হয়েছে।
তার গর্বের শেষ নাই এই নিয়ে।
বংশধর। বংশ রক্ষার আচার নিয়মগুলো।আসলেই একই রকম। এই যে যুগের পরিবর্তন হয়। এতকিছু বদলে যাচ্ছে কিন্ত এই ধারার বিষয়গুলোয় এখনও আমরা সেকেলে, পুরোনো।
কিছু কিছু জিনিস পুরানো সেকেলে থাকাই ভালো।
সবই যদি আধুনিকায়ন হয়ে যেত তবে আমাদের সম্পর্কের শেকড় বা ভিত কবেই নড়বড়ে হয়ে যেত।
এই যে আমরা মেয়েরা যতই আধুনিক হচ্ছি মনের দিক থেকে আমরা কিন্ত সংসার বা হাসব্যান্ডের বেলায় সেই চিরায়ত প্রথার বাইরে যেতে পারি না।

পাশের মানুষটার দোষগুন যাই থাকুক। মন থেকে সময়ে মেয়েরা ভুলেও যায়।

আরিয়ান চলে গেছে। অশান্ত মনটাকে সামলাতে চাইছি। উথাল পাথাল ঢেউয়ের মাঝে দুলছি। কত বাজে চিন্তা কত নোংরা বিষয় ঘুরে ফিরে এসে দা্ঁড়াচ্ছে। আচ্ছা রাতুল কি সত্যি সত্যি সংসারের বাঁধন থেকে ছিটকে যাচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনের রঙ মুছে ফেলতে চাইছে। কারন ওর চলাফেরা আগের মত নেই। বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়া কিংবা আমাকে এড়িয়ে চলা এসবের কি আসলেই কোন কারন আছে?
নাকি সবটাই আমার মনগড়া ব্যাখ্যা। আমার চিন্তার ফল। এমনও হতে পারে মেয়েটা রাতুলের অফিসের গেস্ট। কাজের খাতিরে এই লাঞ্চ করা। নয়তো অনেক বড় কাজের জন্য দুপক্ষের মাঝে বোঝাপড়া চলছে।
আর দুর থেকে দেখা ঘটনার সবই যে সত্য এটার কোন ভিত্তি নেই।

ঝিম ধরা ক্ষনে এলোমেলো চিন্তা মাথাটা ভার করে দিচ্ছে। আরিয়ানের হুড়োহুড়ি চলছে। কানে আসছে সব। অন্যান্য দিন হলে ছেলেটার সাথে এসময়টা কাটাতাম।
ফোনটা বাজছে অনেকক্ষন।
হাতে নিতেই দেখি অচেনা নাম্বার। একটু বিরক্ত হলাম।
মন না চাইলেও রিসিভ করতে হলো।
: কেমন আছিস ইরা?
আমার কান্না আসছে প্রচন্ডরকম।
কোনভাবে আটকিয়ে কথা বললাম।
: ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?
বাবা হাসলেন। আমি চোখটা বন্ধ করে ফেলি। পরিস্কার দেখতে পেলাম সেই হাসিটা।
আশ্চর্য রকম শান্ত একটা মানুষ। বয়সের ভারে হোক বা স্বভাবজাতে হোক এতটা ধীর স্থির মানুষ বাবার মত কাউকে দেখিনি।

: আমি ভালো আছি রে।
ইরা শোন না। আজ কদিন হলো তোর কথা খুব মনে পড়ছে, জানি না কেন।
আচ্ছা তোর মনটা কি সত্যিই ভালো আছে রে?
খুব সত্য কথা। খুব বেশী সত্য। কিন্ত আমি চমকে যাই। এতটা সত্যি মায়েরা কেমনে বোঝে। বাবারা কি করে টের পায়?
নাকি সবটাই মনস্তাত্ত্বিক।

আমি চুপ করে বাবার কথা শুনছি। এতটা প্রখর সন্মোহনী শক্তি কেন থাকে বাবা কিংবা মার।
সন্তানের ভালো থাকা খারাপ থাকা এতটা টের পায় কি করে বুঝি না।
আজ কতটা ভেঙে যাচ্ছি একা একা এটা কাউকে যে বলতেই পারছি না। কাউকে না।

: ইরা বাসায় আসবি?
কয়েকদিন থেকে যা আরিয়ানকে নিয়ে।
আমার মন।খুশীতে চঞ্চল হয়ে উঠে।
: বাবা, আমি এখনই আসবো। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

ইন্দিরা রোড থেকে মিরপুর।
খুব সামান্য রাস্তা। উবারে করে চলে এলাম। আরিয়ান তো মহাখুশী। আনন্দে শুধু ছোটাছুটি করল। মিনুর চোখও

ঝিলমিল করে। আমি শুধু তাকিয়ে দেখি।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল মিরপুর আসতে।
ভর সন্ধ্যেয় মানুষে মানুষ সয়লাব রাস্তা। অফিস ছুটি হয়েছে। সব ঘর ফেরত মানুষ। ঢল নেমেছে।
কেবল আমার শূন্যতার পথ জুড়ে স্তব্ধ কোলাহল কেমন ভিন্ন রূপে ফিরে আসে। আমি না চাইলেও।

মিরপুরে গিয়ে রাতুলকে আর টেক্সট করিনি। প্রয়োজন মনে করিনি।
ঠিক দশটায় একটা মেসেজ এলো।
” ইরা আরিয়ানকে নিয়ে কোথায় গেছো? ”
” বাবার বাসায় “।
” কবে আসবা?
” জানি না “।
এটুকু বলে ফোন রেখে দিই।
কিন্ত পরমুহুর্তে রাতুল কল দেয়। বাবার সাথে কথা বলল অনেকক্ষন। আরিয়ানের সাথেও কথা বলেছে।
আরিয়ান রাতুলকে ফোনে পেয়ে ভীষন উচ্ছসিত।
: বাবা আমি নানুর বাসায় থাকব কয়েকদিন।
ওপাশে রাতুল কি কি বলল শুনিনি।
প্রায় দশ মিনিট পর আরিয়ান ফোন রেখে খেলতে চলে যায়।

রাতের খাবারের পর শুয়ে আছি। এমন সময় ভাবী এল। ছোট ভাইয়ের বউ। নাতাশা নাম। ঢাকার মেয়ে। খুব সাধারন পরিবারের হলেও সবার পছন্দে সে এই বাড়ির বউ হয়েছে।
ছোট ভাই সাদাব। ব্যাংকার। নাতাশাও ব্যাংকার।
তার একটাই মেয়ে রিদিতা।
আরিয়ানের চেয়ে দুই বছরের ছোট।
লম্বা গড়ন ফর্সা ধবধবে নাতাশাকে আমার বেশ পছন্দ।
মেয়েটা বেশ সপ্রতিভ। চলনে কথায়।

:ননদিনী কি খবর এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল?
বিছানায় পা তুলে বসল নাতাশা।
চুলগুলো ভেজা। টপটপ পানি ঝরছে।
: আর বলো না সময় কই। রাতুলের ট্যুর হলো বলেই না আসতে পারলাম।
ভাবী মুচকি হেসে বলল।
: শোনো কয়েকটা দিন থাকো।
দেখো ভালো লাগবে।
: তুমি এই সময় শাওয়ার নিয়েছো যে?
নাতাশা চুল ঝাড়ছে হাত দিয়ে।
: রোজই তো নিই, অফিস থেকে ফিরে নিতেই হয় গো।
অফিসের কথা বলতেই ভেতরে একটা ধক করে উঠে আমার।
নাতাশা কি সুন্দর সংসার সামলিয়ে বাইরেও কাজ করছে। ওকে দেখলে নিজেকে মেলাতে পারি না।
কি করলাম আমি। পড়াশুনা বাদে ঘরেই বসে রইলাম।
মনটা দমে গেলো।
:এ্যাই ইরা সেদিন দেখলাম তুমি গান করছো। বেশ তো গাও। ছাড়লে কেন এটা?
আমি অবাক হয়ে যাই।
: কই দেখলে?
: ওমা সোশ্যাল মিডিয়াতে।
আমি মুখ টিপে হাসি।
: কি যে বলো তুমি?
: সত্যি বলছি তুমি কিন্ত ভালো গেয়েছো, শোনো কিছু জিনিস ছাড়তে হয় না বুঝছো?
আমি উল্টো প্রশ্ন করলাম।
: কি রকম?
:যেগুলো তোমার সম্পদ। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গুন হচ্ছে সম্পদ। এগুলো ছাড়তে নেই। এসব ধরে রাখা লাগে। সবার কি তা থাকে বলো?

জটিল কথা তো। নাতাশা আরো কিছুক্ষন থাকল। অনেক আলাপ করলাম। ননদ ভাবীর দুষ্টমি ও চলেছে। শরীরটা ভালো লাগছে সাথে মনটাও। প্রিয়জন মানেই কি আসলে ভালো থাকা। বোধহয়। কারন বেঁচে থাকা বাঁচিয়ে রাখার এক একটা মুহুর্ত প্রিয় মানুষগুলোই তৈরী করে। তাহলে রাতুল কেন আমার ভালো লাগার সময়কে মেনে নিতে পারছে না। কেন আমার ইচ্ছেগুলোকে দমিয়ে রাখতে চাইছে। প্রিয়জন তো সেও।

নাতাশা চলে যেতেই মাথাটা ফুরফুরে লাগল।
সত্যিই তো।
এভাবে কেউ বলেনি কেউ।
রাতুলও না।
মন ভালো হয়ে গেছে আমার পুরোপুরি। সিদ্ধান্ত নিলাম কাল রিহার্সেলে যাবো। আর যে কয়দিন বাইরে যেতে হবে এখানেই থাকব।
রাতুলের কাছে থাকলে রিহার্সেল নিয়ে ঝামেলা হবে।
কারন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শেহনাজের সাথে রাতুলের কোন একটা যোগাযোগ আছে।
শেহনাজ সেদিনের পর থেকে আমার সাথে তেমন কথাও বলছে না। আজ দেখা হবার কথা ছিল সেটাও বাতিল হল।
আচ্ছা ও কি আমাকে এড়িয়ে চলছে নাকি আমাকে সহ্য করতে পারছে না।

পরের দিন।
আমি রিহার্সেলে গেলাম তিনটার ভেতরে। কলাবাগানে রিশাদের স্টুডিও। মিরপুর থেকে কলাবাগানের দূরত্ব কম।
আমারই সুবিধা হল।
ওখানে গিয়ে , আবিদ আর রিশাদের সাথে পরিচয় হলো। নতুন করে। সেদিন বেইলি রোডে ফর্মাল ব্যাপার ছিল। তাই সহজ হতে সময় লেগেছে।
আজ স্টুডিও তে বসে বিশদ আলোচনা হল।
রিশাদ আর আবিদ দুজনেই বেশ আন্তরিক।
তাশরিফ ছেলেটা খুব বেশী দায়িত্ববান।
সেও আমাকে এ টু জেড কঠিন পরীক্ষায় রেখেছে।
আমিও আমার সাধ্যমত চেষ্টা করলাম।
গানটা তুললাম। সুরটাও দারুন। তাশরিফের গলা অসাধারন। নিঁখুত বুনন ওর কন্ঠে।
আমরা দুজন সর্বোচ্চ ভালো দেবার চেষ্টায় আছি। ওরা খুব খুশী।
পর পর দুদিন কাজ শেষ করলাম।

এই দুদিন রাতুল কয়েকবার ফোন দিয়েছে।
তার ট্যুর শেষ করে আজ রাতে বাসায় ফিরবে। এটুকু শেষ খবর ছিল।
তবে শেহনাজের সাথে আর তেমন কথা হয়নি।
সে হসপিটাল নিয়ে খুবই ব্যস্ত।

কাল রেকর্ডিং। আমার উত্তেজনার শেষ নাই। টেনশান
রাত দশটা বাজে। আরিয়ানকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। বাবাও শুয়ে পড়েছে।
আজ সাদাবের সাথে অনেকক্ষন কথা হল।
ওকে।গানের প্রসঙ্গে বললাম। খুব উৎসাহ দিলো।
: আপা তাহলে তুই গানটা করছিস?
আমি লজ্জা পেয়ে যাই।
: সাদাব ছোটবেলায় তুই এই গান নিয়ে কত ক্ষেপাতি আমায় মনে আছে?

দুজন হাসতে হাসতে শেষ।
সাদাব চলে যেতেই আমি ব্যলকনিতে গিয়ে বসি। খুব স্বস্থিতে আছি। স্বপ্নটা ছুঁয়ে যাবার মাহেন্দ্রক্ষণ এলো বলে। আমি বাতাসে আজ কবিতার ঘ্রান পাচ্ছি। অনন্তকাল অপেক্ষার পর। নির্মেঘ আকাশে নক্ষত্রের মেলা। জোছনার আলোটাও হারিয়ে যাবার মত। বিরতিহীন যাত্রার এক অধ্যায়ের জন্য এমন রাতগুলো খুব কমই আসে।

রাত বাড়ছে। টুংটাং করে মেসেজ আসছে।
অনেক বিরক্তি লাগে এটা। সারাদিন এত এত মেসেজ আসে।
এর একটু পর রাতুলের কল। রিসিভ করলাম।
: জান কি করো তুমি?
আমি কেমন যেন একটা ধাক্কা খেলাম।
রাতুলের গলার স্বরে কেমন থই থই প্রেম। মানে কি?

: কিছু না। হঠাৎ ফোন দিলে যে?
: কারন আজ রাতে তোমাকে ছাড়া চলবে না ইরা। চলে এসো। খুব এনজয় করবো প্লিজ।
রাতুল অনুনয় করছে। ও এমনই। শরীরি বিষয়গুলোতে সে দিশেহারা থাকে। কিন্ত আমি বিভ্রান্ত হচ্ছি। কি করি এখন।
আমার চুপ থাকা দেখে রাতুল রাগ করছে বোধহয়।
: ইরা আমি চলে এসেছি বাসায়।
আমি আতঁকে উঠলাম। কি বলছে ও
: না আজ না।
: মানে কি?
আমি কোন কথা বলছি না।
ওর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সপে দেয়া, শরীর বিলিয়ে দেয়া সবসময় একতরফা কেন?
আমারও মন আছে। সব সময় সায় দেয়া না দেয়ার অধিকার আমারও আছে। এটা খুব যন্ত্রনার।

: কাল জাস্ট বিকেল পাঁচটায় তোমাকে পিক করতে চলে আসবো। তুমি রেডী থেকো ডিয়ার। কাল আমরা সেলিব্রেট করব । বিশ্বাস করো আমি সত্যিই আর পারছি না। টানা তিনটা দিন তোমাকে ছাড়া,,

কথা শেষ করে রাতুল ফোন রাখল।
আর আমি তো পুরাই মুর্তির মত বসে আছি। কয়েক মিনিট। কি হল এটা। এখন কিইবা করার আছে আমার। কাল ঠিক চারটায় ফাইনাল রেকর্ডিং। সবকিছুর প্রস্ততি শেষ। সব করেছি রাতুলকে না জানিয়ে। ওকে জানালে কি হত। কিছুই হত না। মাঝখান থেকে সম্পর্কটা আরো খারাপ হত কি? উফ! আমি আর ভাবতে পারছি না। এখন কে আমায় একটু সাহায্য করবে। কেউই তো নেই। শেহনাজকে একটা কল দিই?

নাহন! এতটা ছোট হতে পারব না। কারন শেহনাজ আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে এটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

তাহলে কি করব আমি। কি করব।

আকাশে এখন সাদা জোছনা নেই। চাঁদের শরীরে মেঘের ছায়া ভর করেছে। ঘোর কালো ছায়া। চাঁদটা ডুবে যাচ্ছে সেই মেঘে। আমি দেখতে পাচ্ছি। আর তা দেখতে দেখতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।

……. তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here