গল্প – ইরার কথা
পর্ব – ২
শেষ বিকেলে ঘুম ভেঙেছে আমার। ঘুম ঘুম চোখে আমি কোথায় আছি বুঝতে কয়েক ডেকেন্ড লাগল। চারপাশে আলো কম। শব্দ টব্দ নাই ঘরে। বিষয়টা কি।
বিছানায় আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠি। তারপর তাকালাম ঘড়ির দিকে। চোখ কচলে দেখি পাঁচটা ত্রিশ।
আরে এতটা বাজে আর আমি টেরই পাইনি। আরিয়ানের কোন শব্দ পাচ্ছি না। মিনুর কিচেনে ছোটাছুটির আওয়াজও নেই। যদিও খুব ফুরফুরে লাগছে।এতটা সময় ধরে ঘুমিয়ে। ঝরঝরে শরীর নিয়ে চাদর সরিয়ে উঠে বসতেই এক ঝটকায় মনে পড়ল সন্ধ্যায় প্রোগ্রামের কথা।
ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করি। নাহ! কোন মেসেজ নাই। এমন কি কোন কলও আসেনি।
রাতুল কি সব ভুলে বসে আছে সব? নাকি আমাকে ইগনোর করে যাচ্ছে।
যেমনটা করেছিল গত দু সপ্তাহ আগে।
সেদিন তিতলীর বাসায় বার্থ ডে প্রোগ্রাম ছিল। তিতলী আমার ব্যাচমেট। সিঙ্গেল মাদার। ওর ছেলে আয়ুশের সাথে আরিয়ানের ফ্রেন্ডশীপ খুব গাঢ়। আমরা একই এলাকার মানুষ। সম্পর্কে ভালো বন্ধু। সেই প্রোগ্রামে আমরা পুরো ফ্যামিলি গিয়েছিলাম।
সেদিন রাতুল খুব করে আড্ডা দিচ্ছিল সবার সাথে। এর মাঝে তিতলীর সাথে রাতুলের বেশ ভালো হৈ চৈ চোখে পড়েছে। একসাথে ফটোশেসান হল। অবশ্য গ্রুপ করে। কিন্ত রাতুল একবারও আমাকে ওর সাথে জয়েন করতে ডাকেনি। আমি আরো অনেক অতিথির সাথে নরমালভাবে মিশেছি। কথা বলেছি। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি।
আলো ঝলমলে সেই অনুষ্ঠানে তিতলীকে খুব বেশী প্রাণবন্ত মনে হয়েছিল। এমনিতে ও ভীষন সুন্দর। তার উপর কালো জর্জেট শাড়ি আর গর্জিয়াস পার্টি লুকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। তিতলী জব করে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে। একা মানুষ। ছেলে আয়ুশকে নিয়ে পুরো ২০০০ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাটে আয়েশী জীবন যাপন করে। খুব ফুর্তিবাজ। দুমদাম পার্টি দিয়ে সবাইকে ডেকে ডেকে আনে।মজা করে। গান নাচে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। সেই অনুষ্ঠানে রাতুল কেমন জানি দুরে দুরে ছিল আমার থেকে। আরিয়ানও আমাকে ছাড়া এক চুল নড়ে না। কেক কাটা ফটোশেসান, গান নাচে আরিয়ান সারাক্ষন আমার পাশে ছিল। কিন্ত রাতুল ওর বন্ধুদের নিয়ে এক তরফা হৈ চৈ করেছে। এর মাঝে তিতলী এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় গ্রুপ পিক তোলার জন্য। তখন দেখি রাতুল নাই। যাহোক পুরো সময়টা কি করে যে শেষ হলো বুঝতেই পারিনি।
শেষ মুহুর্তে আমি আরিয়ানের অনেকগুলো পিক তুলি। এর মাঝে তিতলী কোথা থেকে এসে রাতুলের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। ওদের আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে গেলো। আর শিরশিরানিটা আমার শরীর বেয়ে নেমে গেছে এক ঝলকে। রাতুল হেসেই শেষ তিতলীর কান্ডে। আমি বুঝলাম না ওর এত খুশী হবার কারন কি।
: আরে রাতুল ভাই ইরার পাশে গিয়ে দাঁড়ান তো।
রাতুল পাশে দাঁড়ায়। তবে কেমন অনীহা নিয়ে। আমি সালোয়ার কামিজ পড়েছি। শাড়ি টারিতে আগ্রহ কম। ঝামেলা লাগে। প্যাচ কষো কুচি করো। বাবা রে বাবা। কি তান্ডব। তার উপর ব্লাউজের ম্যাচিং। গহনার কম্বিনেশান আরেক উটকো ঝামেলা। এর চেয়ে কলাপাতা রঙের সিল্কের কামিজে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। বরং রাতুল খুশী নয়। কেন খুশী নয় আন্দাজ করা যায়নি।
আমরা হাসি হাসি মুখে পিক তুলি। এরপর তিতলীর সাথে রাতুলও পোজ দেয়। নানা ভঙিমায়। ওর কায়দাগুলো মডেলদের মত। দুর্দান্ত স্মার্ট আর চৌকস।
পুরো অনুষ্ঠানে সকল অতিথিদের সাথে তিতলী এভাবেই স্মার্টলি বিহেভ করেছে। কাউকে দেখলাম জড়িয়েও ধরেছে। মর্ডান কায়দায় সেলফি তুললো।
প্রচুর ইয়াং ছেলেরা ওর বন্ধুবান্ধব।
খাওয়া দাওয়া হলো। হঠাৎ দেখি রাতুল স্টেজে হাতে মাইক্রোফোন। পাশেই তিতলী। ওরা কি যেন আলাপ করলো নিচু গলায়। তারপর খুনসুটি চললো।
ওর হাসিমুখে রঙের ফোয়ার। চমক দিচ্ছে।
তিতলী কাছে এসে রাতুলকে টোকা দিয়ে কি একটা বললো।
ওদের দুষ্টমি খুনসুটি দেখে বোকার মত হয়ে গেলাম।
এর মাঝে তিতলী এসে আমাকে জোরাজুরি করল ওদের সাথে ডান্স করতে। বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি। আমি আপত্তি করলাম।
তিতলী এতেই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
: এ্যাই ইরা তুমি এত হেজিটেড করছো কেন, কাম অন প্লিজ।
স্লিভলেস ব্লাউজে ওর হাতের খোলা অংশটুকু কি ধবধবে ফর্সা। অদ্ভুত একটা ট্যাটু আঁকা সেই অংশে। তিতলীর ফিনফিনে পাতলা জর্জেট শাড়িতে ঘোর আকর্ষন। নিষিদ্ধ আকর্ষন। ইশান নামের এক ছেলে সবার মাঝে তিতলীকে জড়িয়ে ধরে। চারপাশে হাততালি হাসি ঠাট্টায় আমি খেই হারিয়ে ফেলি। রাতুলকে খু্ঁজছি। নেই কোথাও। আলো আঁধারীর মাঝে রাতুল কোথায় যেন হারিয়ে গেলো দুম করে এবং ফিরলো অনেকটা সময় পর। কোথায় ছিল কেউ সাথে ছিল কিনা জানা হয়নি।
মনের ভেতর খচখচ টের পেয়েছি কিন্ত নিরুপায় হয়ে থাকলাম।
আমার আহত মন ঝলসানো রূপের পসরায় নিজেকে বুঝিয়েছে এটাই বাস্তবতা। সময়কে মেনে নিতে হয়। যেমনটা মেনে নেয় সবাই।
সেদিন বাসায় ফিরে আসার পর রাতে খুব একটা কথা হয়নি রাতুলের সাথে।
তবে সোশাল মিডিয়াতে তিতলীর আপলোড করা পিকগুলোতে খেয়াল করলাম রাতুল পার্টিতে আসা গেস্টদের সাথে খুব আন্তরিকভাবে ফটোশেসান করেছে আমি ছাড়া।
এমন কি তিতলীর সাথে ওর পিকগুলোতে কেমন জৌলুসের ছড়াছড়ি ছিল।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত রাতুল ল্যাপটপে কাজ করেছে। এমনটা প্রায় করে। তখন আমি জেগে থাকি না। আরিয়ানকে নিয়ে শুয়ে পড়ি। একা একা মন খারাপ হয়। সারাদিনের পর রাতুলকে একটু কাছে চাইবার তীব্র ইচ্ছেটা প্রকট হতে থাকে। শরীর মনের ভালবাসা অপেক্ষার দোরে কতক্ষন থাকতে পারে। এক সময় অভিমানের ঢেউ এসে লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। বুকের ভেতর হাহাকারের চাওয়াটা সমুদ্রে ডুবে যায়। ঝড়ের তান্ডবে বাধঁ ভাঙে সীমানার।
এক সময় শান্ত হই। নিজেকে বোঝাই। সবকিছুকে এত নিজের করে চাইবার সময়গুলো ফুরিয়ে গেছে বোধহয়।
আরিয়ানের রুম থেকে খুটখাট শুনেছি রাতুল ফ্রিজ খুলেছে। ওর স্লিপার জোড়ার আওয়াজ পাই। কেমন চাতকের মত চেয়ে থাকি। ওর বডি স্প্রের ঘ্রান লাগে নাকে। তারপর আবার সব চুপ।
পিনপতন নিরব কয়েক মিনিট। নাহ! রাতুল ফিরে গেছে তার নিজস্ব জগতে। তার অভিধানের পাতায় এই মুহুর্তে আমি নেই।
আরিয়ান ঘুমে কাতর। ছেলেটাকে সরিয়ে বেড থেকে নামি। সবুজ বাতিটা অন করি। ডোর খোলা পুরোটাই। বেরিয়ে যাবার আগে আবার পিছু ফিরে দেখি। কি নিষ্পাপ একটা মুখ। আলতো হাসিটা অজান্তে ঠোঁটের কোনে এসে জড়ো হয়। মায়া মায়া মায়া। এই মায়ার জীবনে এটাই কি একমাত্র সুখ? হয়তো। সব মেয়েরাই এমন মায়ার জীবনে সন্তানের বাঁধনে আটকে যায় সব ভুলে। আমিও কি সেই দলে?
ওড়নাটা জড়িয়ে ওর স্টাডি রুমে যেতে গিয়েও ফিরে আসি। থাক। অহেতুক বিশ্রী কান্ড হবে। এমন সময় খুট করে শব্দ। স্লাইডিং লক করলো কেউ। লক্ষ্য করি ওটা রাতুলের রুমের। তারপর মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে।
আমি ফিরে যাই। ডাইনিং এ পানি খেতে গিয়ে শুনি রাতুল কারোর সাথে কথা বলছে। রাতদুপুরের আড্ডা মনে হল। অনেক উচ্ছসিত কথাবার্তা। আমি পানির গ্লাসটা রাখতে গিয়ে বেশ শব্দ হয়। আলোটা নিভিয়ে রুমে চলে আসছিলাম কিন্ত কোথা থেকে রাতুল পথ আগলে দাঁড়ায়। আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
ওর চোখে প্রচন্ড রাগ। আঁধারে কেমন ভয়ংকর দেখাচ্ছে।কেমন যেন ভয় লাগল।
অচেনা এক মানুষের রূপ ওর মাঝে।
: এত রাতে এখানে কি ইরা?
: মানে কি বলছো এসব?
রাতুল আরো রেগে গেলো।
: সহজ কথাটা ঘুরিয়ে না বললে ভালো লাগে না?
আমি মাঝরাতের অভিমানকে লুকাতে পারলাম না। তাই তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে। কারন চোখের ভাষা কঠিন জিনিস। আড়াল করা যায় না।
: পিপাসা লেগেছিল তাই এসেছিলাম।
: বাজে কথা, তুমি আমাকে ফলো করতে এখানে এসেছো?
গনগনে সূর্যির আগুন জ্বলে রাত দুপুরে। সেই উত্তাপের আঁচে আমি নিশ্চুপ থাকি।
নিশ্চুপ থাকতে হয়। কারন সংসার হলো এক সমুদ্র। যার ঢেউয়ের তান্ডবে এখানে জোয়ার ভাটার খেলা চলে। কখনও ফুলে ফেঁপে উঠে। কখনও ডুবে যায়। কখনও তছনছ করে দেয় সব।
: না, তুমি ভুল বলছো রাতুল। আমার সম্পর্কে এত মিথ্যে ধারনা নিয়ে বসে থেকো না।
তর্ক করতে চাইলাম না। নোংরামি হবে বলে।
রাত দুইটার এলার্ম বাজে। রাতুল ঝড়ের বেগে স্টাডি রুমে ফিরে যায়। আমার সীমানায় তখন সমঝোতার দেয়ালগুলো আছড়ে পড়ছে আরিয়ান সমাজ আর সংস্কারের পরত হয়ে।
নত হলাম প্রথমবার। নত হলাম পরাধীনতার সামনে। মেনে নিলাম ভুলগুলো। মেনে নিলাম আবার শুধরে নেবো বলে।
রাতুলকেও শুধরে নেবো সময়টা আসুক।
: আফা অতক্ষনে উঠছেন?
মিনুর হাতে কফির মগ। ধোয়া উঠছে। কি সুন্দর ঘ্রান। উফ!
জল শিশিরের ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু সঞ্চিত হয়। তারপর চিকচিক করে সুর্যের আলোয়। আমি শিশিরের বিন্দুকে চোখের আলোতেই ঠায় দিলাম। জ্বলতে দিলাম নিজের মত করে।
: নারে, অনেকক্ষণ আগেই উঠেছি। আরিয়ান কই রে মিনু?
: ভাইয়া তো খেলে।
মিনু ট্রে রেখে যায়। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত আসে।
কফিতে চুমুক দিয়ে আমি জিজ্ঞাস করি।
: কিছু বলবি?
: আফা বাড়ির কতা মনে অয়।
ছলছল চোখ মিনুর। আহা রে।
: ফোন দিচ্ছি কথা বল, দেখবি ভালো লাগবে।
আমি মোবাইলে কল দিলাম ওর বাড়িতে। রিং হচ্ছে। মিনু বারবার তাকায় ফোনের দিকে। ওর দুচোখে আনন্দের ঢেউ। আমার এটা দেখতেই ভালো লাগল। ওর জগতে চাওয়ার পরিধি ছোট। তাই পাবার আশাটাও বড় নয়। সামান্য কিছুতে এরা তাই খুশী। সন্তষ্ট। কেবল আমাদের চাওয়ার পরিধি সীমাহীন। পৃথিবীর সব হাতে পেলেও আমরা সুখী হবো না। সুখী হইও না। তাইতো অসুখের ঘর আজ আমাদের মনের গভীরে বিস্তৃত হয়েছে।
এটাই আমাদের ধাঁচ।
মিনুর কল রিসিভ হয়েছে। সে কলকল সুরে কথা বলছে। সীমাহীন উত্তেজনায় হাসছে। তার পৃথিবীর অসীম আনন্দটুকু আমায় খুব নাড়া দিলো।
আমায় ভাবালো। এতটুকুন একটা মেয়ে। যার এখনও মা বাবার কোলে থাকার কথা। শুধুমাত্র জীবনের তাগিদে আজ সে পরিশ্রমের বিনিময়ে সুখ পেতে এখন এই অমানবিক কাজ করছে।
মাসকাবারী বেতনর নিশ্চয়তা তাকে ভালো রাখবে। এটুকু আত্নবিশ্বাস এই বয়সেই অর্জন করা অনেক কঠিন কাজ।
এবং এই কঠিন কাজটাই সে করেছে।
মিনু ভালো থাকার জন্য অভিনয় করছে এবং সে ভালো আছে।
সবারই এই বোধটুকু থাকা উচিত। ভালো থাকতে হবে শুধু নিজের জন্য।
বল হাতে আরিয়ান ছুটে আসে রুমে।
: মা তুমি আজ ছাদে গেলে না কেন?
তিয়াস পার্থ আয়ান ওরা আমায় ডাকছিল ব্যালকনি থেকে।
আরিয়ান মনে হয় রাগ করেছে। মুখ কালো করে বল ছুড়ছে।
আমি চট করে ওর হাতটা ধরে ফেলি।
: তুমি জানো আজ আমাদের একটা স্পেশাল ডে ছিল?
আমি তাজ্জব হলাম ছেলেটার কথা শুনে।
: বাবা সরি, মা আজ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে কাল যাবো।
কিসের স্পেশাল ডে সেটা তো বলো?
: আজ ফ্রেন্ডশীপ ডে, বুঝছো?
আরিয়ান তবুও মুখ কালো করে আছে। কিছু বলল না। বুঝলাম সে চটে আছে। এরপর আর কি কি করবে বুঝতে পারছি। সে এখন মনে মনে লিস্ট করছে। তার বায়নার খাতায় টাকার অংকের হিসাবটাও আমি করে যাচ্ছি। তবে ছেলেটা আমার খুব লক্ষী। মায়ের কথা শুনে।
: তাহলে তুমি আমায় একটা সুন্দর একটা কলম কিনে দিও।
আমি আহ্লাদিত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি।
: আচ্ছা বাবা।
আড়চোখে দেখি মিনুর চোখে পানি। কেবল ছলকে পড়া বাকী। ওর কি বেশী মন খারাপ হলো আমাদের এই মা ছেলেকে দেখে। এটা প্রায় আমি খেয়াল করি।
আরিয়ান এক ছুটে গিয়ে মিনুকে হাত ধরে টেনে ধরে।
: তোমার মন খারাপ কেন?
কেউ বকেছে তোমায়?
মিনু জোর করে হাসল।
: না কেডা বকা দিবো?
আরিয়ানের চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
: তাহলে তুমি কাঁদছিলে কেন?
মাথা নুয়ে আছে মিনু। আড়াল করতে চাইছে তার দুঃখবোধ।
ওদের আলাপের মাঝে বিছানা ছেড়ে আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। খুব অল্প সময়ে ফ্রেশ হলাম। ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে আয়নায় চোখ রাখি। নিজেকে দেখি। খুব মন দিয়ে দেখি। নতুন করে দেখি।
হঠাৎ দেখি আয়নার মানুষটা হাসছে। অপরূপ ভঙিতে হাসছে। মেয়েটির ঠোঁটে ঝিলিক লাগা রঙ।
আশ্বর্য এত সুন্দর কেনো হাসিটা। বাহ। এমন করে যদি সত্যিই হাসতে পারতাম। হাসি হলো মন জয়ের প্রথম ধাপ। মনজয়ী কৌশলটা রপ্ত করা চাই।
আমি হুট করে আয়নার সাথে কথা বলা শুরু করলাম।
: এ্যাই মেয়ে কি নাম তোমার?
আয়না বলছে।
: ইরা।
আরে এতো আমার নাম।
: তুমি অনেক সুন্দর করে হাসো তো?
আয়নার মেয়েটি সত্যিই হাসল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি।
আয়নার মেয়েটি ছলকে কথা বলছে। ঘোর লাগা বিষয়। কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি।
আমি শুনতে পেলাম আয়নার মানুষটি বলছে।
“ইরা তুমি সুন্দর তোমার নিজস্বতায়। তুমি পরিপূর্ন তোমার চিন্তায়। তুমি হাসো ইরা। তুমি হাসো।”
আমার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।
আয়না আবারও বলছে ” হাসো ইরা, হাসো, বাঁচতে শিখো এভাবেই নিজেকে নিয়ে ”
“এক সময় তো ভাবতে। কত কিছু করবে বলে বাজীও ধরেছো। স্কুল কলেজ ভার্সিটির গন্ডিতে নিজেকে মেলে ধরতে। নাচ করেছো গান গেয়েছো। তোমার গুণমুগ্ধ শ্রোতা কম তো ছিল না।
কেন হারিয়ে ফেললে সব। একেবারেই। ”
চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। কি অসীম একটা শক্তি ভেতরের আমিটাকে জড়িয়ে ধরল। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম নিজেকে পরিপূর্নতায় ভালবাসা যায়, নিজেকে চেনা যায় ইচ্ছে করলেই।
অসংখ্য গানের সুর বেজে উঠছে। আমার সত্বায় এগুলো প্রান পেত। কত গাইতাম, কতবার গেয়েছি।
” দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়, তোমার আপন হাতের দোলে ”
গুনগুন করে কলির সুরে টান দিলাম। অনেক দিন পর আত্নার শান্তিতে তৃপ্ত মন প্রান সব। আহা কি মধুর দিন ছিল। মনের কথা বলার। মনের সাধ মেটাবার।
আয়নার ইরা কথা বলেনি। কথা বলেছি আমি ইরা। আমার প্রতিচ্ছবি আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে। আয়নার ইরা হাসেনি। হেসেছি আমি।
” ইশ! তুই কিন্ত হাসি দিয়ে সব বাজিমাত করবি ইরা”।
সব কি ফুরিয়ে গেলো। সানজানার কথাগুলো মনে পড়ছে। খুব বেশী মনে পড়ছে।
ওয়াশরুমে টোকা পড়ছে। দুম করে খুলে বেরিয়ে আসি।
দেখি মিনুর হাতে ফোন।
ওর বিধ্বস্ত মুখে হাসি উধাও।
: আফা আফনের ফোন বাজে।
: ওহ।
তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি রাতুলের কল, মেসেজ। কতগুলো বিরক্তিকর ইমোজি।
এসব দেখে ঠোঁট টিপে হাসছি।
ফোনটা রেখে আলমারী খুলি।
: আফা ভাইয়ার সাথে খেলমু?
: মিনু তুই গিয়ে আরিয়ানকে পাঠিয়ে দে এখানে, আর তুই চট করে রেডী হ।
মিনু আকাশ থেকে পড়ল।
: কই যামু?
আমি শাড়িগুলো এক এক করে দেখছি। কত দিন হলো এগুলো ছু্ঁয়ে দেখি না।
: পরে বলবো। আগে তুই রেডী হ।
টুং টাং মেসেজ এলো।
” আমি আসবো না বাসায়, গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি তুমি আরিয়ানকে সিয়ামের বাসায় নিয়ে চলে যেও। আমি অফিস থেকেই চলে যাবো ওর বাসায় ”
আরিয়ানকে চমৎকার তৈরী করে দিলাম। এর মধ্যে মিনুও এসে হাজির। গত ঈদের লাল থ্রিপিসটা খুব যত্ন করে পড়েছে। লাল চুড়িতে হাত ভর্তি। ঝনঝন শব্দগুলো ঝরনার মত ঝরে ঝরে পড়ে। মন ছুঁয়ে। মন কেড়ে নিয়ে।
:আরিয়ান মিনুকে দেখে লাফালাফি করছে।
: মা দেখো ওকে কি সুন্দর লাগে তাই না?
মিনুর মুখে লাজ রঙা।
: হুম, খুব সুন্দর।
: মিনু তুই আরিয়ানকে নিয়ে ড্রইং রুমে যা আমি রেডী হবো।
শাড়ি বাছাই করলাম। অনেক সময় নিয়ে।
অজস্র শাড়ি আমার। যতনে অযতনে ছয়টি বছর ধরে পড়ে আছে। কবে শেষ পড়েছিলাম মনে করতে পারছি না।
সবুজ কাতানটা আম্মার দেয়া। খুব সুন্দর জমিনের কাজটা। অনেকক্ষন উলটে পাল্টে দেখলাম। নাহ এটা নয়।
কালো নেটের শাড়িটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়াই।
বাহ! অদ্ভুত তো। পুরো শাড়িতে চুমকির কাজ। ব্লাউজটা নামালাম। কালো নেটের। স্লিভের নিচে ফুলেল কুচির ডিজাইন করা। এটা গত ঈদে কেনা। কালো খুব পছন্দের রঙ। শখ করে কালো কেনা হয়েছে অনেক। শখ করে পড়িনি। তবে আজ পড়ব।
শাড়িটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই এক ঝলক আনন্দ ছুঁয়ে গেলো। নিজেকে দেখে মুগ্ধ হবার অবস্থা। কতদিন পর এভাবে নিজেকে দেখছি।
খুব গর্জিয়াস পার্টি লুক নিলাম। বেস হালকা করে আই মেকআপটা করলাম পুরাই স্মোকিতে।
আইল্যাশে মাসকারা বুলিয়ে ডীপ ম্যাজেন্টা লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো শেষ।
কোমর পর্যন্ত চুলে কার্লি লুকটা দেবার খুব ইচ্ছে হল। দিলামও।
ডায়মন্ডের দুল আর আংটিটা পড়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে নিজেকে দেখি। আরে এটা কে? চেনাই তো যাচ্ছে না আমাকে। আচ্ছা রাতুলও কি ভুল করবে আমায় চিনতে? ঠোঁট ছুঁয়ে মিষ্টি হাসিটা আবারও পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।
নিচে গাড়ির হর্ন পাচ্ছি। ড্রাইভার আনিস চলে এসেছে। ঘড়িতে সময় কাটাঁয় কাঁটায় ঠিক সাতটা।
….. তামান্না হাসান
বি:দ্র- এই গল্পটার জন্য পাঠকের ভালবাসা পেয়ে আমি সত্যিই অভিভূত। সবার জন্য আমার আন্তরিক ভালবাসা। আমি কৃতজ্ঞ এমন ভালবাসা পেয়ে। সবার অতি সাপোর্ট পেয়ে দ্বিতীয় পর্ব লিখলাম। জানি না ভালো হলো কিনা,,আবারও তাই অপেক্ষা ভালবাসার সমুদ্রে ডুবে যাবার জন্য❤️❤️❤️।