ইরার কথা পর্ব – ৯

0
307

গল্প – ইরার কথা

পর্ব – ৯

: ইরা আমি দুঃখিত।
আমি রাতুলের স্পর্শ পাচ্ছি কিন্ত চুপ ছিলাম। এখন ওর আবেগী কথা শুনছি তবুও চুপ রইলাম। তাকিয়েও দেখলাম না। শুধু বুঝতে পারছি ও খুব কাছে।
নিকষ রাত্রির কোল ঘেষে বিরহী সুর বাজে। খুব চেনা সেই সুর। আমি শুনতে পাচ্ছি।
: প্লিজ, কথা বলো ইরা।
রাতুল অনুনয় করছে। এবং মাত্রাটা বেশী। ও কখন নরম হয় কখন এড়িয়ে চলে আমার মুখস্থ। একটু ভাবিয়ে তুললো। এখানে অনুযোগের চিহ্ন নাই।
আমার রাগ হলো খুব তার এই পরিবর্তিত রূপে।কিন্ত প্রকাশ করলাম না। বরং চট করে চেয়ার ছেড়ে স্লাইডিং এ হাত দিতেই জাপটে ধরল হাতটা। গাঢ় অন্ধকারে রাতুলের চোখে চোখ পড়ল। কি অশান্ত সমুদ্রের তোলপাড় করা ঢেউ।
আছড়ে পড়ছে বাধ ভেঙে। মনে হয় এক্ষুনি সব ভাসিয়ে নিবে।
: ছাড়ো আমায়।
: না।
সিগারেটের কড়া ঘ্রান মুখে। ভুরভুর বেরুচ্ছে সেই গন্ধ। রোজই এমন গন্ধ পাই। আজ মনে হয় একটু বেশী খেয়েছে। চেইন স্মোকার ও। মরার ভয় দেখিয়েছি অনেক। কিন্ত কাজ হয় নাই। উল্টা আরো বেশী টানে। বাসায় এলে কম খায়। যতটা আয়েশ করার বাইরে করে। এটা খুব বিশ্রী লাগে আমার। তবুও সহ্য করা লাগে।
নিরুপায় হয়ে।

: সরো তুমি। আমি আজ আরিয়ানের সাথে শোবো।
একটু গম্ভীর। একটু কড়া হতেই হয় সময় বিশেষে।
জল টলমল ওর দুচোখ জুড়ে। আহা রে কত প্রেম। টিশার্ট আর ট্রাউজারে রাতুলকে ভারী অন্যরকম লাগে। চোখ পড়ে গেলেও দেখি, না পড়লেও জানি।
এই কথা শুনে আরো শক্ত করে হাত টেনে ধরল। মুঠোয় ধরা হাতটা ছাড়াতে পারলাম না। জোর করবো কি করে। ধড়াম করে লক হয়ে যায় ডোর।
হাতটা ছেড়ে দিতেই পিছিয়ে সরে যাই। আলোছায়ার মাঝে রাতুলের অবাধ্য শরীর আমার নিকানো উঠোনকে দখল নিবে এখন। আমার কিছুই করার নাই আর।
আমি স্পষ্ট দেখছি রাতুলের ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার উন্মুক্ত অংশে। আমার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব না আর। এখন ক্রমশ আমি স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক হবো।
আবারও নীল আলোতে ওর চোখে মাতাল করা চাহনি দেখেছি এক ঝলক।
আর তাতেই এক জনমের প্রেম হাঁটু গেড়ে বসে।
আহা রে এক জনমের প্রেম।
কিন্ত অনুভুতির পায়ে শিকল পড়িয়ে প্রেম জাগালে কেমনে হয়। সবই হয়। সব হচ্ছে তো।
পুরুষের প্রেম মানেই শরীর, প্রলয় , ভাঙচুর, আর অতৃপ্ত ক্ষুধার লোল।

টিশার্ট নেই রাতুলের শরীরে। কখন খুলে ফেলেছে খেয়াল করিনি। তার উন্মুক্ত মেদহীন একহারা ঝরঝরে
শরীরে আবেগী স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে।
আমার মুক্তি নেই এটা জেনে গেছি।
সময়টাও অবশ্য আমার দখলে। তাই কথাটা আবার উঠালাম।
: রাতুল আমায় কাজটা করতে দাও প্লিজ।
আমার শরীর বেয়ে তপ্ত নিঃশ্বাসের আলিঙন।
নীল আলোতে কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি।
: চুপ, এখন কোন কথা নয় ইরা।
আমি চুপ হয়ে রইলাম। আমার ঘর চুপ হয়ে রইল। আমার নিপাট বিছানা নীল আলো পূর্নিমার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে রাতুলের অশান্ত শরীরের সুখে। কেবল আমার শূন্যতায় জেগে থাকবে একলা এই মন। রাতুল রোজই সেই শূন্যতার আকাশটাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ফেলনা কাগজের মত।

ছয়টায় ঘুম ভাঙল আমার। কি শুনশান চারপাশে। নিরব নিথর এই শহরটা আর অল্প কিছু পরে পাল্টে যাবে। পাশ ফিরতেই দেখি রাতুল আমার হাতটা ধরে আছে। খুব সাবধানে ছাড়িয়ে উঠতে গিয়ে টান খাই। ওর মুখে দুনিয়ার শান্তি। মিটমিট হাসছে।
: উফ! আরেকটু থাকো না।
আবদারের দুষ্ট ইশারাও।
আমি চোখে না করে দিই।
রাতুল তবুও জেদ করে।
কোনরকমে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ি।
শাওয়ারের পানিতে ভিজছি তো ভিজছি। চোখ বন্ধ করে। সব যন্ত্রনা সব ক্লান্তি চুইয়ে চুইয়ে ঝরছে।

পরোটা ভাজতে ভাজতে টেবিল গুছিয়ে ফেললাম।
চিকেন ভুনা দমে বসিয়েছি। মিনু প্লেট গ্লাস ধুয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে।
: আরিয়ান টেবিলে এসো।
আমার চেচানো শুরু সবে।
: মা আমাকে পরোটা দিবে না।
: কেন রে?
: আমার তেল ভালো লাগে না।
আমি হেসে ফেলি। ছেলেটা আমার কি সুন্দর গুছিয়ে টেবিলে বসে পড়েছে। নিটোল গালগুলোয় টুপ করে চুমু খাই। অমনি দুহাতে আমাকে আদর করতে শুরু করে।
: উমম, বাবা হয়েছে।
ছেলেটা আমার খুব আদুরে। মা ছাড়া তার দুনিয়া অচল। আমারও তাই।
ভালবাসার দুনিয়াটা সবখানি কেবল আরিয়ান। ওর ফুটফুটে মুখখানায় একমাত্র শান্তি।

: আফা আইজ কি ভাইয়ার ইসকুল নাই?
আমি ওর রুটিতে চিকেন মাখিয়ে মুখে তুলে দিচ্ছি।
: কেন রে?
মিনু ঝিমঝাম থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।
: না এমনি।
: না নেই।
মুহুর্তে মিনুর চোখ চকচক করে উঠে। আমি জানি এটুকুতে মিনু অনেক খুশী। আজ ও আরিয়ানের সাথে খেলবে। মজা করবে। নিজের মত করে। এটার জন্য একটা ছুটির দিনের অপেক্ষায় থাকে সে। আমি মিনুর খুশীটা দেখি। বেশ লাগে। আসলে ফুরসত বিশ্রাম আর স্বাধীনতা সবাই চায়। সবারই লাগে।
যে যার জায়গা থেকে। তবে আমি শেষ কবে ফুরসত পেয়েছি মনে পড়ে নাতো।
আমার চাকরীতে ছুটি নেই। কারন মায়েদের কোন ছুটি হয় না। কখনও না। কেউ বলে না একটু ছুটি নাও। খানিকটা সময় বিশ্রাম করো।
কেউই বলে না।
এটুকু মানবিক আচরন কেউই পায় না।
এটাই নিয়ম। এভাবেই চলছে সংসার। সব মেয়ের সংসার। সকল মেয়েদের জীবন।

আমি আরিয়ানকে নিজে খেতে বলে কিচেনে ছুটে আসি। রাতুল চলে আসবে এখুনি।ওর খাবার আলাদা। দুইজন মানুষ তাতেই নাশতা দুই পদের করা লাগে।
অথচ আমার একটা হলেই চলে।
আমরা মেয়েরা এই একটা হলেই চলেতে মানিয়ে নেই।
না নিজের পছন্দ, না নিজের ভালো লাগা কিছুই আমলে আনি না। এতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই।
এই ট্র্যাডিশন যুগ থেকে যুগে একই রকম।
কোন পরিবর্তন হয়নি। কেউ বদলে দিতেও আসে না। প্রয়োজন নেই বলে।
আচ্ছা পুরুষরা কি কখনও বলেছে কোন মেয়েকে “কি তোমার পছন্দ ” বা ” আজ তোমার পছন্দে নাশতটা হোক”।
কখনো শুনি না প্রতিদিন তো এক নিয়মেই দিন শুরু করো আজ না হয় অন্যভাবে হোক।

প্রত্যাশা করি না কারো কাছে নিজের ইচ্ছেগুলো কেউ পূরন করুক। কারন সুখ বলি বা চাওয়া বলি নিজের পরিধি নিজেই ঠিক করে নেয়া উচিত। নিজের কাছে নিজেকে মূল্য দিয়ে একেকটা দিনকে সুন্দর করা উচিত।
কারন মেয়েরা কখনও পুরুষদের কাছে প্রয়োজনের বাইরে কিছু নয়।
এই যে আমরা আবেগ দিয়ে সংসার সাজাই, গুছাই,
যত্ন করি, সন্তান লালন করি কিসের জন্য। ভেবেছি কখনও যে সংসারের জন্য ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, স্বপ্ন দেখাই, তার বিনিময়ে পুরো জীবনে প্রাপ্তির খাতাটায় কি থাকে আমাদের। কিছুই না।
রোজকার রুটিন তেল নুনের ফর্দ, বেডশিট পাপোষের লিস্ট শোপিস সাজানোর কর্নার সবকিছুই তুচ্ছ কারন দিনশেষে একজন মেয়ে একজন নারীকে শুনতে হয় ” কি করো সারাদিন”

আসলে আমরা ইউজার পুরুষদের কাছে। তাই সময় থাকতে ঘর নয় নিজেকে গুছিয়ে নেয়াই আসল কাজ।

চুলা থেকে সেমাই নামিয়ে ঠান্ডা করলাম। গাজরের হালুয়া কাল করেছিলাম। ওটা ফ্রিজ থেকে নামানো হয়নি। কিচেন থেকে চেচিয়ে ডাকি।
: মিনু হালুয়ার বাটি টেবিলে রাখ।
: আফা নামাইছি।
মেয়েটা বড্ড লক্ষী। মোটামুটি অল্প দিনে আমার সব কাজ বুঝে নিয়েছে।
আমি এক ছুটে টেবিলে আসি। গাজরের হালুয়া সেমাই আর চিকেন ভুনা সব রেডী। পরোটা আর দুটো ভাজা বাকী। ওগুলো রাতুল এলে ভাজা হবে। আমি হালকা সেকা দিয়ে তুলে রেখেছি।
: মিনু যা তুই খেয়ে নে।
: আফা আমনেরা আগে খান।
মেয়েটা মিনমিন করে কথা বলে।
আমি ধমক দিতেই চলে গেলো।
ঠিক পা্চ মিনিটের মাথায় সে ডাইনিং এ হাজির।
: আফা পারাটা খামু না, বাত খামু।
তার দাঁতগুলো বের হয়ে আছে। কথা বললেই বের হয়।
আমি হাসতে হাসতে শেষ এটা শুনে।
: কি বললি, পারাটা?
মিনু পেচার মত মুখ লুকায়।
আরিয়ানও হাসছে।
: শোনো মিনু বুবু ওটা পারাটা না, পরোটা।
মিনু লজ্জায় শেষ।
: ঐ একটা অইলেই অয়।
আমিও দুষ্টামি করি।
: হুম অইলেই অয়।
মিনু আরো লজ্জা পায়।

আরিয়ান খাওয়া শেষ করে রুমে যেতেই রাতুল ডাকতে থাকে।
আমি মিনুকে টেবিল সাফ করতে দিয়ে ছুটে গেলাম রুমে।
চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে আমার। আচড়াইনি । চিরুনি দিবো কখন। সময় কই।
দেখলাম রাতুল আয়নার সামনে। চুল আজ ব্যাক ব্রাশ করা। ভায়োলেট রঙের শার্ট আর কালো প্যান্টে একটু বেশী ভালো লাগছে। সুন্দরও লাগছে। তবে বলা যাবে না। বললেও বিপত্তি।
: ইরা তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
রাতুল পারফিউম স্প্রে করছে।
আমি অপ্রস্তুত হচ্ছি কারন রাশভারী কন্ঠটা রাতুলের সবসময় শুনি না। তবুও আমি শান্ত থাকলাম।
: চলো নাশতা খেয়ে নিবে।
রাতুল কেমন অদ্ভুত চোখে এক নজর দেখল আমায়।
: সিয়াম আমাকে কল করেছিল।
তুমি কি শেহনাজ ভাবীকে কিছু বলেছো?

বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। কি হলো আবার।
আমি তো শেহনাজকে শুধু রাতুলের একগুঁয়েমির কথা জানায়েছি। কিন্ত এর বাইরে তাশরিফকে নিয়ে আর কোন কথা হয়নি।
: হুম শেহনাজের সাথে আমার কথা হয়েছে।
রাতুল ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর ফোন হাতে। স্ক্রিনে কিছু পিক দেখলাম। তবে কার পিক বুঝতে পারলাম না।
: ঐ ছেলেটার কি যেন নাম,, ওহো তাশরিফ না?
রাতুলের চোখে কিছু একটা দেখলাম। আমি থ মেরে গেছি। তবুও চুপ থেকে হুম করলাম।

: ঐ ছেলেটার সাথে সিয়ামের কথা হয়েছে ও তো তোমার বিষয়ে অনেক কিছু বললো।

আমি ঢোক গিলছি। কি বলবে আমার বিষয়ে। আল্লাহ জানেন। কিছুটা শংকা ছিল সিয়াম ভাইকে নিয়ে। কারন শেহনাজের সাথে যা বলব তার সবটাই সিয়াম ভাই জানবে। কিন্ত জানলেই কি সিয়াম ভাই শেহনাজ ভাবীকে খুব সাপোর্ট দেন।
কিন্ত রাতুল তার উল্টো।
ঠিক এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠে।
আমি ছুটে রিসিভ করার আগে দেখি তাশরিফের কল।
বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ। আনন্দ উত্তেজনায়।
রাতুল সরু চোখে আমাকে ইশারা করল।
: কি ধরো ফোনটা।
আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করব এখন। কাল রাতেই সব ফাইনাল হয়েছে। রিহার্সেল রেকর্ডিং এর সময়। কিন্ত রাতুলকে কিছুই জানাইনি। জানাবোও না। কিন্ত এখন কথা বললেই তো সব জেনে যাবে। আমি ঘেমে যাচ্ছি,,

বি:দ্র- আজকের পর্বটা ছোট করার জন্য দুঃখিত। আশা করি সবাই ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন। তবে পরের পর্বে তা শুধরে দিবো,,,
আবারও সবার সহযোগিতা চাই।
প্লিজ পাশে থাকুন অসীম ভালবাসা নিয়ে ❤️🥰❤️

…. তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here