এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৫

0
221

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৫
দিতি তার জেদে অনড় রইলো, সে এর শেষ দেখতে চায়! সমরেশও দিতিকেই সমর্থন করলেন, অর্ক বললো,

আমিও শেষ দেখতেই চাই, কিন্তু আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই! আমি পুলিশে অভিযোগ জানাতেও পারবো না! ঠিক আছে অরিন্দমের সঙ্গে কথা বলি একটু, দেখি ও কি সাজেশন দেয়!

অর্ক কলেজে বেরিয়ে গেলো, আসার সময় অরিন্দম কে সঙ্গে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করলো। গত দুদিন ধরে দুজনের মধ্যে সেভাবে কথা হচ্ছিলো না আর, তা সত্বেও বেরিয়ে যাবার সময় অদিতি সামনে এসে দাঁড়ালো। ওকে দেখে একটু হলেও মনে মনে খুশি হলো অর্ক, গুমোট পরিস্থিতিটা একটু একটু কাটছিলো।

ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পরে রুমা এবং সমরেশ দিতির মুখোমুখি হলেন, অদিতি কে সোফায় বসিয়ে সমরেশ বললেন,

তুই তো যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, আমি জানি তুই সব বুঝিস। তোদের দুজনের মধ্যেই যদি গন্ডগোল জিইয়ে রাখিস, তাহলে বাইরের লোক তো সুযোগ নেবেই, তাই না! আমার ছেলে কে আমি খুব ভালো করে চিনি, শুধু মাত্র জীবনটা কে সিরিয়াসলি না নিয়ে কলেজ ছাত্রদের মতো কাটিয়ে দেওয়ার জন্যেই এই সব অশান্তি! ওকে যে যা বোঝায় ও তাই বোঝে! ওর এখনো সাবালকত্ব আসেনি। ও কে অরিন্দম বললো বলে ও চুপ করে গেলো, একবারও ভাবলো না যে ওর চুপ করে থাকা আসলে আমাদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছবে!

আসলে ও অতো ভেবে কোনো কাজ করে না, ছোটো থেকেই এরকমই!

রুমা কে কড়া গলায় ধমকে থামিয়ে দিলেন সমরেশ,

চুপ করো! তুমি আর তোমার অপগণ্ড ছেলেকে সাপোর্ট করো না! একটা চাকরি করা ছেলে, সে ছোটো বেলায় যা ছিলো এখনও তাই থাকবে? নিজে বাবা হয়ে গেছে সে, এখনও যদি দায়িত্ব বোধ না আসে তবে আর কবে আসবে?

রুমা চুপ করে গেলেন, দিতি র দিকে তাকিয়ে সমরেশ বললেন,

তোকেও একটা কথা বলতে চাই। নিজের ওপর কনফিডেন্স রাখ, কেউ তোকে কিছু বললেই তুই বিশ্বাস করবি কেনো? আর তোকে আমি বাবা হয়েও বলছি, যদি মনের মধ্যে একফোঁটা সন্দেহও থাকে তোর, তাহলে এইভাবে একসঙ্গে না থাকাই ভালো। সারাজীবন তুই সন্দেহ নিয়ে বাঁচতে পারবি না, বাইরের কেউ লাগবে না, তোর সন্দেহই তোদের সম্পর্ক শেষ করে দেবে।

রুমা পাশ থেকে অবাক গলায় বললেন,

কি বলছো তুমি! কোথায় মিটমাট করার চেষ্টা করবে তা না করে উল্টে একসঙ্গে না থাকার পরামর্শ দিচ্ছ!

হ্যাঁ, দিচ্ছি! কারণ আমি মনে করি সম্পর্কে বিশ্বাস না থাকলে সেই সম্পর্ক কোনোদিনও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়! কাল ওদের দুজনের কথা শুনে মনে হয়েছে ওরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, দুজনেরই দুজনের সম্পর্কে অভিযোগের পাহাড় জমে আছে! আর কাল আমি অর্কর সামনে বলিনি, কিন্তু আমারও মনে হয়েছে যে দিতি র অহেতুক ছোটো খাটো ব্যাপারে বেশি রিয়েক্ট করার জন্যেই হয়ত সত্যিই ওকে মিথ্যে বলতে হয়। ও যে ফোন খুঁজে পাচ্ছিলো না, এই সাধারণ কথাটাও যদি দিতি বিশ্বাস না করে, তাহলে তো ও কিছু এক্সকিউজ খাড়া করবেই বাধ্য হয়েই! এই সমস্যার সমাধান হয়ত হবে, কিন্তু আবার কোনো নতুন কিছু আসবে, তখন কি হবে?

বিশ্বাস করো বাবা, আমি ওকে আগে কোনোদিনও সন্দেহ করিনি, এগুলো ওর ভুল ধারণা! ও ভাবে ফোন বন্ধ রাখলে, বা খুঁজে পাচ্ছে না বললে আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়! আমার আসলে প্রচণ্ড টেনশন হয়, মনে হয় ওর কোনো বিপদ হয়েছে। কিন্তু তারপর যখন ও বাড়ি এসে বলে ও ভুলে গিয়েছিলো অন করতে, বা খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন ঐ ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ টা দেখলেই আমার টেনশনটাই রাগে চেঞ্জ হয়ে যায়,
আর আমি রিয়েক্ট করে ফেলি,

হতাশ গলায় বললো অদিতি, সমরেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন, তারপর ধীর গলায় বললেন,

যার নয়ে হয়নি, তার নব্বইয়েও হবে না এটা তোকে ধরে নিতে হবে। এই ঘটনার পরেও ওর কিছু বদল হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। যদি হতো, তাহলে সবটা জানার পরে অশান্তির ভয়ে সেটাকে লুকিয়ে না রেখে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতো। কাল তুই চলে যেতে চেয়েছিলি, কিন্তু গিয়েও ভালো থাকবি কি? যার ফোন বন্ধ থাকলে টেনশন করিস, তার সঙ্গে সারাজীবনের মতো যোগাযোগ বন্ধ করে থাকতে পারবি তো?

অদিতি দু হাতে মুখ চাপা দিলো, কান্না ভেজা গলায় বললো,

ও ও সেটা জানে বাবা! তাই তো আমার সঙ্গে বারবার এরকম করে। ও বারবার ফোন বন্ধ রাখবে, হারিয়ে ফেলবে, আমি বাড়িতে এলে চিৎকার করবো, ও মিথ্যে কথা কিছু বানিয়ে বলবে, অশান্তি হবে, আমি চলে যাবার হুমকি দেবো, কিন্তু কোথাও যেতে পারবো না! আর তারপরেই ও চার বার করে সরি বলবে, আর আমাকে ম্যানেজ করে ফেলবে!

রুমা পিঠে হাত রাখলেন,

কাঁদিস না, এরই নাম সংসার বুঝলি তো! ছেড়ে যেতে চাইলেই কি আর যেতে পারি আমরা! হ্যাঁ, যেখানে ভালোবাসা থাকেনা, সেখানে কিছুতেই থাকা যায়না এটা ঠিক, কিন্তু তোর তো আর তা নয়! অর্ক তোকে যে ভালোবাসে খুব, এটা তুইও জানিস, তাই তো হাজার রাগ অভিমানের পরেও আবার থেকে যাস, তাই না? ওর শুধু একটাই দোষ, বড্ড ক্যাজুয়াল ও, সেটুকু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বাড়লেই আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে দেখিস!

সারা কলেজে রিয়াকেই খুঁজতে খুঁজতে ঢুকলো অর্ক, আজও আসেনি মেয়েটা! টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে মুচকি হাসলো অরিন্দম,

কি? স্পেশাল ছাত্রী কে খুঁজছিস নাকি!

অর্ক বিরক্ত হলো,

ইয়ার্কি মারিস না ভাই, তোর জন্যেই ফাঁসলাম আমি! তোর কথা শুনে ওই মেয়েটার কথা কাল চেপে যেতে গিয়েই কাল হলো, বাড়িতে পুরো একঘরে হয়ে গেছি! বিরাট চাপে আছি, দিতি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো কাল!

এবার অরিন্দম সিরিয়াস হলো,

বলিস কি! অদিতি চলে যাচ্ছিলো! না, আমি আসলে ভেবেছিলাম, আর কদিন পরেই তো ওরা চলে যাবে, তাই অহেতুক জটিলতা বাড়াতে চাই নি। এমনিতেই তো সমর দা যা ছড়িয়ে রেখেছে!

অর্ক অন্যমনস্ক হলো,

আচ্ছা, সমর দা বলেছিলেন না উনি টিউশনের স্টুডেন্টদের কাছ থেকে শুনেছেন!! কাল তিয়াসা মেয়েটা আমাকে বললো রিয়া ওদের বলেছে, দিতি খুব সন্দেহবাতিক, তাই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে!!

আচ্ছা, শান্তিনিকেতনে ওদের গ্রুপের কেউ ছিলো?

অরিন্দম একটু চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, অর্ক উত্তেজিত হলো,

কেউ ছিলো মানে! পুরো গ্রুপটাই তো ছিলো! দিতি ইনফ্যাক্ট আমাকে রিয়ার নামও বলেছিলো, আমিই ওকে তিয়াসা বলে শুধরে দিয়েছিলাম!! আমি শালা সত্যি বোকা রে, আমার একবারও এটা মাথায় আসেনি কেনো তখন! দিতি রিয়া নামটা কিভাবে জানলো এটা একটুও মনে হয়নি আমার!!

আর এক্সকার্সনে তো ছিলো নিশ্চয়ই?

আমার পাশেই তো বসে ছিলো! আমি এটা ভেবেই দেখিনি, যে দিতির সঙ্গে ফোনে আমার রাগারাগি হচ্ছে, এটা হোটেলের রুম থেকে আমাকে দেখতে পেলেও কথা শুনতে কেউ পাবে কিভাবে, যদি না সে আমার পাশেই বসে থাকে! নিজের বোকামির জন্যে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে এখন!!

শুধু তুই? আমি আর অদিতি? আমাদেরও তো কারোর মাথায় আসেনি যে অতদূর থেকে কথা শোনা কি করে সম্ভব!!

হতাশ গলায় বললো অরিন্দম, কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে উঠে দাঁড়ালো অর্ক,

নাহ! দিতি ঠিকই বলেছে, আমি না সত্যি খুব ক্যাজুয়াল! নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগছে এখন! শুধু আমার ব্যাপারটা কে সিরিয়াসলি না নেবার জন্যেই মেয়েটা এতটা সাহস পেলো! চল, মেয়েটা কে ধরতে হবে এবার, ব্যাপারটা সত্যি আর সাধারণ নেই! আর তুই একটু বাড়িতে চল আমার সঙ্গে, বাবাও তোকে ডেকেছে, হেল্প লাগবে তোর।

দুজনে এগিয়ে গিয়ে মাঠের কোনায় বসে থাকা গ্রুপটার সামনে পৌঁছালো, আজ ওখানে কোনো মেয়ে নেই। ওদের দেখেই সবাই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো, দু একজন হাতের সিগারেট লুকিয়ে ছুঁড়ে ফেললো, অনির্বাণ এগিয়ে এলো,

স্যার, কিছু বলবেন?

রিয়া কোথায়? আসেনি আজকে? আমার কাছ থেকে সেদিন ভুল করে একটা নোটস এর খাতা নিয়ে চলে গেছে মনে হয়, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!

সটান মিথ্যে বলে দিলো অর্ক, অনির্বাণ ঘাড় নাড়লো,

আসেনি স্যার! মেয়েরা কেউই আসে নি আজ! নেক্সট উইকেই এক্সাম তো! ফোন করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি,

অনির্বাণ কে পকেট থেকে মোবাইল বার করতে দেখেই তাড়াতাড়ি অরিন্দম এগিয়ে এলো,

ছাড়ো, পরীক্ষার সময় আর ফোন করে ডিস্টার্ব করতে হবে না! ও থাকে কোথায়? কাছে হলে গিয়েই নিয়ে নিতাম না হয়,

সামান্য নোটস এর জন্যে রিয়ার বাড়ি যাবে স্যারেরা এটা বোধহয় ওদের কারোরই বিশ্বাস হলো না, অনির্বাণ একটু অবাক গলায় বললো,

ভবানীপুরে থাকে স্যার, কিন্তু আমি ওর বাড়ি চিনি না। কৌশিক ওর সঙ্গে মেট্রো থেকে নামে, ও চেনে স্যার,

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কৌশিকের দিকে আঙুল দেখলো অনির্বাণ, কৌশিক এগিয়ে এলো,

জায়গাটা চিনি স্যার, জগুবাজারের কাছে, কিন্তু বাড়িতে কোনোদিনও যাই নি আমি, তাই ঠিক কোন বাড়িটা সেটা জানি না। তবে ওদের তিনতলা বাড়ি, সামনের গেটে সি সি টি ভি লাগানো আছে, এটা জানি,

অর্ক হতাশার হাসি হাসলো,

বাবার নামটা কি? সেটা জানো?

কৌশিক মাথা নাড়লো, অনির্বাণ পাশ থেকে বলে উঠলো,

স্যার, ফোন করে দেখি বরং, যদি ওর কাছে নাই থাকে, তাহলে মিছিমিছি অতো খোঁজাখুঁজি করে বাড়ি গিয়ে লাভ কি?

অর্ক আর কিছু বলার আগেই অনির্বাণ রিয়া কে ফোন করে ফেললো, কথা বলে জানালো ওর কাছে কোনো খাতা নেই!

অরিন্দম ঘাড় নাড়লো, অর্কর দিকে তাকিয়ে বললো,

আর দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে!!নিজের বাড়িতে ভালো করে খোঁজ আগে, বাড়িতেই আছে নিশ্চয়ই! চল এগোই!

ছাত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা টিচার্স রুমে ফিরে এলো, এই মুহূর্তে আর কিছু করার ছিলো না, দুজনেরই ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছিলো, তাই আপাতত এই প্রসঙ্গ চাপা পড়লো। প্রায় বেলা দুটোর সময় অর্কর ক্লাস শেষ হলো, টিচার্স রুমে ঢুকে দেখলো অরিন্দম ওর জন্যেই বসে আছে। অর্ক অরিন্দম কে দেখেই বললো,

তোর ক্লাস শেষ হয়ে গেছে? চল, রিয়ার বাড়িটা ঘুরেই যাই তাহলে একবার, বেশিক্ষন লাগবে না। কৌশিকের কথা শুনে তো কাছেই মনে হলো,

অর্কর কথায় অরিন্দম একটু চিন্তিত মুখে তাকালো,

গিয়ে কিছু লাভ হবে? শুধু তিনতলা বাড়ি, আর সি সি টি ভি, এটা কোনো বাড়ির অ্যাড্রেস হলো? কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো নাকি! বাবার নামটা পর্যন্ত জানি না! কি অদ্ভুত মেয়েরে! তিন বছরে কোনো বন্ধু কে বাড়ির ঠিক মতো একটা অ্যাড্রেসও দেয় নি!

হ্যাঁ, আজ সারাদিন এটাই ভেবেছি জানিস! মেয়েটার যেনো সব কিছুই অদ্ভুত! এতো জায়গা থাকতে আমার পাশে বসেই ও এতো জোরে ফোনে কথা বলছিলো, যে দিতি বিরক্ত হয়েছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে ছিলাম, তখন আশেপাশে কেউ ছিলো না। মেয়েটা ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যে কখন আমার পাশে এসে বসেছে, আমি খেয়ালই করিনি!

তোর বাড়িতে কতো বার এসেছে?

কতো বার কোথায়? আগে একবার এসেছিলো, আর এবার টানা তিনদিন, সব মিলিয়ে চার বার!! অথচ দ্যাখ, দিতি কে কিরকম গল্প দিয়ে ফেলেছে, ও নাকি আমাকে অনেকবার কফি বানিয়ে খাইয়েছে! কি ভীষণ মিথ্যেবাদী রে!

কিন্তু কেনো বলতো?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না! চল ওর বাড়িতে গিয়েই দেখা যাক! ও হ্যাঁ, যেটা বলতে গিয়ে অন্য কথায় চলে গেলাম, আমার না কিরকম একটা স্ট্রাইক করছিলো! মেয়েটা বোধহয় ইচ্ছে করেই কাউকে ঠিক অ্যাড্রেস দেয়নি, ও চায় না যে ওর বাড়িতে কেউ যাক! তাই সুভাষ দা কে রিকোয়েস্ট করে মেয়েটার অ্যাড্রেস টা বার করিয়েছি, কাউকে বলিস না যে সুভাষ দা বার করে দিয়েছে।

একটু নিচু গলায় বললো অর্ক, অরিন্দম অবাক হলো,

সুভাষ দার কাছ থেকে পেলি! যাক এই একটা কাজের কাজ করেছিস! হ্যাঁ, এটা একদমই মাথায় আসেনি আমার! কলেজের খাতায় তো অবশ্যই অ্যাড্রেস থাকবেই! চল তাহলে, বেরিয়ে পড়ি!

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেট্রোর উদ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, রাস্তায় যেতে যেতেই বাড়িতে ফোন করে দিলো দুজনেই, ফিরতে দেরি হবে জানালো। সমরেশ পাশেই বসে ছিলেন, দিতির কথা সবটাই শুনতে পাচ্ছিলেন, ফোন রাখার পর বললেন,

যাক! তাও ভালো! কিছুটা হলেও যে সিরিয়াস হয়েছে সেটা দেখেও ভালো লাগলো! দেখি কি হয় এবার!

দিতি ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, বাবা যা বলেছো!! ও যে দেরিতে হলেও কিছু উদ্যম নিয়েছে সেটাই বিরাট ব্যাপার! আর দেখলে, তোমরা ছিলে বলে মনে করে দেরি হবে জানালো, আমি একা থাকলে পরে বাড়ি ফিরে ভুলে গেছি বলে দিতো!

রুমা পাশ থেকে হাত তুললেন, হেসে বললেন,

হ্যাঁ, থাক থাক! আর দুজনে মিলে আমার ছেলেটার নিন্দে করতে বসিস না!

মেট্রো থেকে নেমে কৌশিকের কথা মতো জগু বাজারে পৌঁছে গেলো দুজনে, আশেপাশের বেশ কয়েকটা দোকানে জিজ্ঞেস করেও কোনো সুরাহা হলো না।

যতো টা সোজা মনে হয়েছিলো, ততো টা সোজা নয় রে! তিনতলা বাড়ি মানে মোটামুটি চওড়া রাস্তায় হবে বলেই তো ভেবেছিলাম!

খানিকটা হতাশ গলায় বললো অর্ক, অরিন্দমও হতাশ হয়ে পড়েছিলো,

কি করা যায় বলতো?

পি জি খুঁজছেন নাকি দাদা? লাগলে বলতে পারেন, মেট্রোর আশেপাশেই আছে,

দুজনকে প্রায় মাঝ রাস্তায় হতাশ মুখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় ছেলেটা এগিয়ে এলো, অর্ক তাড়াতাড়ি পার্স থেকে চিরকুট টা বার করলো,

না, ভাই, পি জি নয়, এই ঠিকানাটা খুঁজছি! একটু হেল্প করো না!

হাত বাড়িয়ে ঠিকানাটা নিয়ে চোখ বুলিয়েই ফেরত দিলো ছেলেটা,

কিনবেন নাকি? এটুকু বলতে পারি ভাড়াটে ওঠাতে পারবেন না!

অর্ক কিছু বলার আগেই অরিন্দম এগিয়ে এলো,

আরে না না! কিনবো না, বাড়িটা খুঁজছি, মালিকের সঙ্গে দরকার ছিলো একটু। তুমি তো চেনো মনে হচ্ছে বাড়িটা,

ছেলেটা ঘাড় নাড়লো, তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,

আরে হ্যাঁ, কে না চেনে! এই বাড়ির মালিকের কাছে তো লোকে একটা কারণেই আসে! অহেতুক মিথ্যে কেনো বলছেন দাদা, গত তিন চার বছর ধরেই তো পেপারে বিজ্ঞাপন দেয়, কতো লোক এলো গেলো! আপনারাও এসেছেন, তাতে কি হয়েছে! কিনতে তো পারবেন না কিছুতেই! নিচের তলায় দুটো, দোতলায় একটা, মোট তিনটে ভাড়াটে, মালিক তিনতলায় থাকে! ওই ভাড়াটে তুলতে জান কয়লা হয়ে যাবে দেখবেন, রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া জমা দেয় সবকটা! ওই সামনে বাঁদিকের গলিতে ঢুকেই চার নম্বর বাড়ি, মালিক মোটামুটি তিনতলার বারান্দায় বসেই থাকে সব সময়, যান ঘুরে আসুন একবার না হয়!

আর কথা বাড়ালো না দুজনেই, ঠিকানা যখন পাওয়া হয়েই গেছে, তখন আর মিছিমিছি নিজেদের সত্যি প্রমাণের দরকার কি! ছেলেটা নাহয় ওদের খদ্দেরই ভাবলো। ছেলেটা চলে যাবার পরে অর্ক মুখ খুললো,

যে বাড়িতে সি সি টি ভি বসানো থাকে, তার তলায় ভাড়াটে! চল দেখি মালিকের মেয়ে কি বলেন!

অরিন্দম হাসলো,

মালিকের মেয়ে! ভালো বলেছিস! মালিক যে কতো বড়লোক সেটা মনে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে!

না! পয়সা আছে তো নিশ্চয়ই, না হলে সি সি টি ভি থাকতো না! হয়ত এককালে ভাড়া দিয়েছিলো, এখন আর ওঠাতে পারছে না বলে বিক্রির চেষ্টা করছে!

গলির মুখটা থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই নম্বর মিলিয়ে তিনতলা, হলুদ রঙের বাড়িটা দেখতে পেলো ওরা। বাড়িটা যথেষ্টই পুরনো, খড়খড়ি দেওয়া জানলার সবুজ রংগুলো প্রায় হালকা হয়ে এসেছে, বেশ অনেক আগে শেষ রং হয়েছিলো বলে মনে হয়। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক সত্যিই তিনতলার ঘর লাগোয়া ছাদহীন বারান্দাতে একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে অর্ক ওপরের দিকে তাকালো,

আপনি কি সুবোধ বাবু?

ভদ্রলোক নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, ঘাড় নাড়লেন,

না, আমি রমেন মিত্র, সুবোধ নামে এখানে কেউ থাকে না!

বাড়ির নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো এতক্ষনে, অর্ক নম্বর বলে জিজ্ঞেস করলো,

এটাই বাড়ির নম্বর তো?

ভদ্রলোক সম্মতি জানালেন,

হ্যাঁ নম্বর এটাই! তবে সুবোধ নামে কেউ নেই!

এবার অরিন্দম এগিয়ে এলো,

আমরা রিয়া নামে কলেজে পড়ে এমন একটা মেয়েকে খুঁজছি, মানে ভালো নাম রিয়া, ডাক নামটা ঠিক জানি না।

আচ্ছা! বুঝলাম! নিচের বাঁদিকের বেলটা টিপে দেখুন একবার!

বাঁদিকের বেলটা বাজার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেলো, ভেতর থেকে একজন মধ্য বয়স্ক বিবাহিতা মহিলা বেরিয়ে এলেন, অর্ক হাত তুললো,

নমস্কার, আমরা রিয়া নামে একজন কে খুঁজছি,

ভদ্রমহিলা একটু অবাক চোখে তাকালেন,

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, কিন্তু ও তো বাড়িতে নেই, বেরিয়েছে, ফিরতে দেরি হবে, কিছু বলার ছিলো?

অর্ক মাথা হেলালো,

হ্যাঁ, আমি অর্ক মিত্র, ও আসলে আমাদের কলেজেরই ছাত্রী, গত পরশু আমার কাছে বাড়িতে ক্লাস করতে গিয়ে ভুল করে আমার একটা খাতা নিয়ে এসেছে। ওটা খুব জরুরি, ওদের তো আর কলেজ নেই, তাই ভাবলাম বাড়িতে এসেই একটু নিয়ে যাই!

ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন,

সরি, সরি, আমি একদম বুঝতে পারিনি! আপনার নাম আমি শুনেছি, ভেতরে আসুন না স্যার, আমি ওকে ফোন করে কোথায় খাতা আছে জেনে নিচ্ছি,

জুতো খুলে ভেতরে ঢুকে এলো দুজনে, ভদ্রমহিলা হাত দেখালেন,

বসুন স্যার, চা করি একটু,

ছোট্ট একটা ঘেরা বারান্দায়, ছোটো দুটো কাঠের সোফা, বসেই দুজনে দৃষ্টি বিনিময় করলো,

বড়লোক!
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here