#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব৪

1
542

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব৪
-Farhina Jannat

৪.
খাওয়া শেষ হতেই লোকটা খালার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই খালা বের হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই হাতে করে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ঢুকলে লোকটা বলল, “মেঝেটা পরিষ্কার কর। এবারের মত শাস্তি মাফ করলাম। এরপর সময়মত না খেলে আর কথা না শুনলে তোর কপালে বহুত দুঃখ আছে।”

এমনিতে যেন কত সুখে আছি! ভাবল সিদ্রা। তর্ক করতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু চড়-থাপ্পড়্গুলোর কথা মনে পড়তেই চুপচাপ ন্যাকড়াটা নিয়ে মেঝেটা মুছে দিল। লোকটা আবার ওর গায়ে হাত দেক, চায়না ও। মুছার পর খালা ন্যাকড়াটা নিয়ে চলে গেল। লোকটা উঠে দাঁড়াল।

“আজকের মত তোর শাস্তি এটুকুই। রাতে খাবার দিবে, খেয়ে নিবি। কাল থেকে শুরু হবে তোর নতুন জীবন!”

দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠল সিদ্রা। কাঁদতে কাঁদতে ওই বেশেই সেজদায় পড়ে গেল, আর আল্লাহর কাছে কাঁদতে শুরু করল। এটা ওর বহুদিনের অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই ও একটু চাপা স্বভাবের। সবার সাথে তেমন মিশতে পারেনা বলে বন্ধুত্ব্বও হতনা সহজে। এমনকি আপন বোনের সাথেও মন খুলে কথা বলতে পারতো না, কারণ দুইজনের প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। তখন থেকেই মনের কথা আল্লাহর সাথে শেয়ার করা শুরু। মাদ্রাসায় কিংবা অন্য কোথাও, কেউ কিছু বললে বা করলে তখনকার মত নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় এসে সোজা জায়নামাজ নিয়ে বসে যেত। কখনো মোনাজাতে কখনো সেজদায়, কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ্‌র কাছে বিচার দিত। এজন্য বোনের কাছে কাঁদুনি বুড়ি উপাধি পেয়েছে।

যখন বুঝতে শিখল যে কারো খারাপ চাইতে নেই, তখন থেকে শুধু নিজের কষ্টগুলোই বলতো, অভিযোগ করতো না। আর যে ওকে কষ্ট দিয়েছে, তার হেদায়াতের জন্য দোয়া করতো। কারণ একবার আল্লাহকে সবকিছু খুলে বলার পর আর কোন কষ্টই যেন থাকতো না। বড় হয়ে কয়েকটা বান্ধবী হলেও আল্লাহর সাথে কথা বলার এই অভ্যাস ওর থেকেই গেছে।

হঠাৎ খেয়াল হল সিদ্রার, নামাজ! কালকে থেকে পুরো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অলরেডি কাজা হয়ে গেছে। জানালার আলো অনেক কমে গেছে, তার মানে আর দেরী করলে আজকের যোহরও কাজা হয়ে যাবে। তলপেটেও চাপ অনুভব করল, বাথরুমে যাওয়াও দেখি ফরজ, ভাবল ও।

আবার দরজা ধাক্কানো শুরু করল সিদ্রা। “খালা, আমি বাথরুমে যাবো, দরজা খুলেন। খালা, ও খালা!”
দরজা খুলে যেতেই উঠে দাঁড়াল সিদ্রা। খালা ওর দিকে তাকিয়ে যেন বুঝার চেষ্টা করল, ও নাটক করছে নাকি সত্যি বলছে। কিন্তু সিদ্রার ঠোঁট কামড়ে বাথরুম চেপে রাখার চেষ্টা দেখে যেন বিশ্বাস করল, হাত শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে আসল ওকে।

ঘরের বাইরে একটা বারান্দার মত। একপাশে চালা আর কাঠ দিয়ে ঘেরা। সেখানে চুলা আর হাঁড়ি-পাতিলসহ রান্নার জিনিসপত্র রাখা। আর ও যে ঘরে ছিল তার পাশে আরেকটা ঘর। এছাড়া আশেপাশে আর কোন ঘর নেই। চারদিকে তাকিয়ে ঘন গাছপালা ছাড়া কিছুই দেখতে পেলনা সিদ্রা। এমনকি সূর্যের আলোটাও ঠিকমতো আসছেনা। কোথায় আছি আমি? ঢাকায় থাকার কোন সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিনা। গাজীপুর কি, নাকি আরো দূরে কোথাও!

মহিলা ওকে নিয়ে আসল চালার পেছনদিকে। সেখানে চালার তৈরি আরেকটা ছোট ঘর দেখা গেল। ভেতরে ওকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল মহিলা। এত ছোট আর নোংরা বাথরুম কোনদিন দেখেনি সিদ্রা। একটু আগে খাওয়া টক পান্তা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কোনমতে সামলাল ও নিজেকে। একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ রাখা। কোনমতে নিজের কাজ শেষ করে বাইরে এসে বুকভরে দম নিল ও।

মহিলাকে বলল, “আমি অজু করব, ভাল পানি কোথায় পাবো?”

মহিলা ওর কথা শুনে একটা তাচ্ছিল্যমার্কা হাসি দিয়ে ওকে রান্নার জায়গায় টেনে আনল। সেখানে রাখা ড্রাম থেকে পানি দিল ওকে। একজন গায়রে মাহরাম (যাদের সাথে পর্দা ফরজ) ওর গায়ে হাত দিয়েছে ভেবেই গা কেমন ঘিনঘিন করছিল সিদ্রার। গোসল করলে ভাল হত। কিন্তু ড্রামে পানির পরিমাণ দেখে, আর নামাজের কথা ভেবে বাদ দিল গোসলের চিন্তা। অজু করা শেষে পশ্চিম কোনদিকে জিজ্ঞেস করল ও। মহিলা আবার সেই একই রকম হাসি দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। মহিলার বিরক্তি আর তাচ্ছিল্য দেখে আবার জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হল,
“আপনারা কি চান বলেনতো? আমি বুঝতে পারছিনা, এমন কেন করছেন আপনারা আমার সাথে? আমি কি একটা ক্রিমিনাল নাকি!” মহিলা কিছু বললনা, কিন্তু চোখের দৃষ্টি এত ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে ভয় পেল সিদ্রা। মহিলা ওর হাত ধরে জোরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর যথারীতি দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।

বাপরে বাপ! এই বয়সেও মহিলার গায়ে কি জোর, কি খায় কে জানে। নিজের চিন্তার ধরণ দেখে মনে মনে হাসল সিদ্রা। বন্দীখানায় বসে, যে ওকে বন্দী করে রেখেছে তার খাওয়ার কথা চিন্তা করছে! এও সম্ভব!!

যাকগে, আগে নামাজটাতো পড়ি, ভাবল ও। বোরকা খুলে স্কার্ফটা মাথায় পেঁচিয়ে খালি মেঝেতেই দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে যোহর, আর তারপর সিরিয়ালি কাজা নামাজগুলো আদায় করল। তারপর হৃদয়ের সমস্ত আকুতি নিয়ে এ বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করল সিদ্রা। মোনাজাত শেষে সবসময়ের মত এত হালকা লাগল ওর, মনে হল আল্লাহ্‌ ওর সব সমস্যা দূর করে দিবেন। কিন্তু বেচারি সিদ্রা! ও জানেনা, আল্লাহ্‌র পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা!!

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here