#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ২৬

0
450

#যে_গল্পের_নাম_ছিলনা পর্ব ২৬
-Farhina Jannat

২৬.
পায়ের নিচের দিকে কাটেনি বলে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছেনা সিদ্রার, যোহরের ওয়াক্ত হতেই তাই উঠে চলে এল নিজের ঘরে। আসরের নামাজের পর খালা এল ওর কাছে, কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইল। সিদ্রা মাথা নাড়ল, খালা চলে না গিয়ে বসল ওর পাশে। ওড়না খুলে চুল আঁচড়ে দিতে লাগল। সিদ্রা বাধা দিল, লোকটা যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ঘরে ঘুমাচ্ছে উনি, আশ্বস্ত করল ওকে খালা।

চুল আঁচড়ে বেণী গেঁথে খালা ওর মুখোমুখি বসল। ওর হাতদুটো নিয়ে নিজের কোলে রাখল। ইশারায় কি যেন জিজ্ঞেস করল ওকে, বুঝতে পারলোনা সিদ্রা। খালা আবার বোঝাল, তাও বুঝলোনা ও। কয়েকবার চেষ্টার পর বুঝতে পারল সিদ্রা।

“আপনি জিজ্ঞেস করছেন, আমি উনাকে বিয়ে করতে কেন রাজি হলাম না?”

মাথা ঝাঁকাল খালা। হতভম্ব হয়ে গেল সিদ্রা।

“খালা, আপনি আমাকে এ কথা কিভাবে জিজ্ঞেস করতে পারছেন? উনি আমার সাথে যা যা করেছেন এবং করছেন, এরপর আপনি ভাবছেন কি করে যে আমি উনাকে বিয়ে করতে পারি!”

এর উত্তরে খালা যা বোঝাতে চাইলো তা হল, বিয়েই সবথেকে ভাল সমাধান। লোকটা তো কোনদিন ওকে এখান থেকে মুক্তি দিবেনা, সেক্ষেত্রে ওর একটা সত্যিকারের পরিচয় হয়ে যাবে। আর উনি আসলে অনেক ভাল মনের একজন মানুষ, এখন যা করছে সব রাগ থেকে করছে। এক সময় খালার মত উনিও ওকে ঠিক ভালবেসে ফেলবে, তখন আর ওর কোন কষ্ট থাকবেনা।
মনযোগ দিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল সিদ্রা। খালা একদিক দিয়ে ঠিকই বলেছে, এভাবে প্রতিদিন পর্দার খেলাফ হয়ে যে গুনাহ হচ্ছে, অন্তত সেটা থেকে তো বাঁচা যেত! কিন্তু না, শুধু সেই কারণে ও এই লোককে বিয়ে করতে কিছুতেই পারবেনা। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লো ও।

“খালা, উনি বুবুর সামনে যে কথাগুলো বলেছেন, বানিয়ে বললেও সেগুলোই সত্যি। আমি আমার হাজবেন্ড হিসেবে একজন হাফেজ আলেমকেই আশা করি। যদি হাফেজ আলেম নাও হয়, অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়া, নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করা, সুন্নাতি দাড়ি রাখা, পায়জামা পাঞ্জাবি নাইবা পরলো, কিন্তু টাখনুর ওপরে পোশাক পরা ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক জিনিসগুলো তাকে মেনে চলতে হবে। কিন্তু উনার মধ্যে তো আমি এসবের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনা খালা।“ একটু থামল সিদ্রা।

“এরকম কাউকে বিয়ে করার জন্য কি প্রতিদিন মোনাজাতে “রব্বানা হাবলানা মিন আঝওয়াজিনা, ওয়া জুররিয়্যাতিনা, ক্বুররতা আ’য়ুনিও ওয়াজয়া’লনা লিলমুত্তাক্বীনা ইমামা(উত্তম জীবনসঙ্গী ও সন্তান লাভের দোয়া)” পাঠ করি? না খালা, এটা সম্ভব না। আমি যাকে চাই, তাকে শুধু দুনিয়ার জন্য না, দুনিয়া আখিরাত উভয়ের জন্য চাই। হ্যাঁ, আমার ভাগ্যে কি আছে, সেটা আমি জানিনা, কিন্তু আল্লাহ্‌ তো আর চাইতে নিষেধ করেননি। আমি চাওয়ার কাজ চাবো, দেয়ার মালিক আল্লাহ্‌। অবশ্য এখন যে অবস্থার মধ্যে পড়ে আছি, তাতে এসব বড্ড হাস্যকর শোনাচ্ছে জানি। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করি, তিনি যা করবেন, মঙ্গলের জন্যই করবেন। আর তেমন না মিললে বরং আমি রাবেয়া বসরির মত বিয়ে না করেই জীবন পার করে দিতে চাই! আল্লাহ্‌ আমাকে জান্নাতে আমার কাঙ্ক্ষিত জীবনসঙ্গী মিলিয়ে দিবেন, ইন শা আল্লাহ্‌”

একসাথে এতগুলো কথা বলে দম নিল সিদ্রা। খালা পুরো হা হয়ে ওর কথা শুনছিল, আর কোন উত্তর নেই উনার কাছে।

“আর তাছাড়া…….. উনিও তো আমাকে ঘৃণা করেন। আমাকে নিজ ভাইয়ের হত্যাকারী বলে মনে করেন। এতদিনে যেটুকু বুঝেছি, উনি যদি চান তাহলে মেয়েদের লাইন লেগে যাবে উনাকে বিয়ে করার জন্য। সেখানে শুধু শুধু প্রতিশোধের নেশায় আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করতে যাবেন! নিজের সুখের আশায় উনার জীবনটা তো আমি নষ্ট করে দিতে পারিনা খালা”

খালার সাথে আরো একজন দরজার বাইরে স্তম্ভিত হয়ে সিদ্রার কথাগুলো গিলছিল। ঘুম ভেঙে পানির গ্লাস খালি পেয়ে পানি নিতে উঠে এসেছিল রাইয়্যান, আর সিদ্রার গলার আওয়াজ শুনে আটকে গেছে ওর ঘরের সামনে। মনের ভেতর থেকে একটা কন্ঠ যেন বলে উঠলো, এখনো কি তুমি ওকে খারাপ, ছলনাময়ী মেয়ে বলবে?

***
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে সিদ্রা, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সারাদিনে এতকিছু ঘটে গেল, মাথায় চিন্তা গিজগিজ করছে, ওর মনে হচ্ছে ও পাগল হয়ে যাবে। চিন্তা দূর করতে হলে অন্য কিছু করতে হবে, কিন্তু এই রাতের বেলা আর কি করব! বই পড়ে দেখি। লাইট জ্বালিয়ে ঘরের কোথাও যে বইটা পড়ছিলো, সেটা দেখতে পেলনা। কোথায় রাখলাম বইটা? মনে পড়ল, ভোরে বাগানে নিয়েছিলাম পড়তে, তারপর…… মনে পড়েছে, ড্রয়িংরুমের সাইড টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। যাই, নিয়ে আসি।

সাবধানে বেড়ালের মত সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্ধকারেই আন্দাজে হাতড়ে বইটা নিল সিদ্রা, ফিরে আসবে কিন্তু থমকে গেল লোকটার গলার আওয়াজ শুনে, বাগান থেকে আসছে মনে হচ্ছে। এত রাতে উনি বাগানে কার সাথে কথা বলছেন, দেখিতো। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল সিদ্রা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে বাগান, অপার্থিব সুন্দর লাগছে দেখতে। লোকটা বসে আছে দোলনায়, একদম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে, অথচ আমার মনের আকাশ জুড়ে ঘোর অমাবস্যা! লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সিদ্রা।

***
বিকেলে সিদ্রার কথাগুলো শোনার পর থেকে মনটা বড্ড চঞ্চল হয়ে আছে রাইয়্যানের। মনের যে অংশটা সবসময় বলে তুমি ভুল করছো, সেটা আজকে যেন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কিচ্ছু ভাল লাগছেনা ওর। বাগানে পায়চারী করে মন শান্ত করার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু সে আর হচ্ছে কই!

আজকে যা যা ঘটেছে, তার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল রাইয়্যান। এমনি এমনি কি আর এত সফলতার সাথে বিজনেস ওয়ার্ল্ডে রাজত্ব করছে। প্রেডিকশন ক্ষমতা অনেক ভাল ওর। ও ভাল করেই জানতো, বাংলোয় সিদ্রাকে আনলে একদিন না একদিন কারো না কারো চোখে পড়বেই। তখন ওর পরিচয় কি দিবে সেটা নিয়ে অনেক ভেবে এটাই বেস্ট মনে হয়েছে ওর। বোন বলা যাবেনা, বুবু কাছের দূরের সব আত্মীয়-স্বজনদের চিনে। বান্ধবী বললে এতদিন ধরে এখানে থাকায় সবার মনে প্রশ্ন উঠবে। শুধুমাত্র ওয়াইফ পরিচয় দিলেই সেই সমস্যা আর থাকবেনা। আর তাছাড়া, মেয়েদের প্রতি আগ্রহ ওর কোনকালেই ছিলনা, বিয়ে শাদী তো দুরের কথা। সবসময় ভাবতো, একটা ভাইয়ের আবদারই রক্ষা করতে পারিনা, সাথে বউ-বাচ্চা জুটলে তো ব্যবসাপাতি লাটে উঠবে। আর এখন ফারহান চলে যাবার পর নতুন কোন পিছুটানের তো প্রশ্নই উঠেনা। অনেক হারিয়েছি আমি, আর কিছু হারানোর রিস্ক নিতে পারবোনা, সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।

আজকে বুবুকে যা যা বলেছে, সেসব মনে মনে অনেক বার প্র‍্যাক্টিস করা ছিল, নাহলে কি আর এত অবলীলায় বলতে পারতো! এর পেছনে ফারহানেরও কিছুটা অবদান আছে। ওর পছন্দ ছিল রোমান্টিক মুভি আর রাইয়্যানের একশন। কিন্তু একসাথে মুভি দেখতে বসলে ফারহানের প্যাঁচে পড়ে ওকেও ওইসব অখাদ্য গিলতে হতো। এখন এই গল্প বানাতে সেসব কাজে লেগেছে আর ভবিষ্যতেও লাগবে, সেটা খুব ভাল করে বুঝতে পারছে।

কিন্তু, আমি কি সত্যিই খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি! একটা মেয়ের সারা জীবন নষ্ট করে দিচ্ছি আমি। লঘু পাপে গুরুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে নাতো? কিসের লঘুপাপ? খুন করেছে ও আমার ভাইকে। কিন্তু ও যে সবকিছু অস্বীকার করে? ওসব তো নাটক, নিজের পাপ স্বীকার করার মত সৎসাহসও নেই ওই মেয়ের। কিন্তু আজকে যে বলল, আমাকে বিয়ে করে আমার জীবন নষ্ট করতে চায়না, খারাপ মেয়ে হলে তো নিজের স্বার্থই আগে দেখতো। হুহ! আমার জীবন না ছাই, নিজে যে রাজপুত্রের আশায় বসে আছে, আমি তো তার ধারেকাছে দিয়েও যাইনা, সেটাই আসল কারণ। পাওয়াচ্ছি তোকে রাজপুত্র আমি! এভাবেই ওর মনের মধ্যে দুপক্ষের দ্বন্দ্ব চলছে, কিছুতেই থামাতে পারছেনা রাইয়্যান।

হঠাৎ খেয়াল করল, কখন যেন খালা এসে দাঁড়িয়েছে। পায়চারী থামিয়ে দোলনায় বসল রাইয়্যান।

“খালা, প্লিজ একটু বসোনা, কথা বলি তোমার সাথে!” খালা একটা বেতের চেয়ার টেনে বসল।
“তুমিও আমাকে খুব খারাপ ভাবছো, তাইনা খালা? আজকাল তোমার দৃষ্টিতে আগের সেই ভালবাসা দেখতে পাইনা, হতাশা আর করুণা দেখতে পাই। মনে হয়, তুমিও আমাকে ভুল বুঝছো, কষ্ট পাচ্ছো আমার কাজেকর্মে। এটা কি সত্যি খালা? তোমারও কি মনে হচ্ছে আমি ভুল করছি?”

খালা কোন উত্তর দিলনা, মাথা নিচু করে বসে রইল।

“নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ। সবাই আমাকে খারাপ ভাবছে, সবাই! ওই মেয়েটার জীবনে তো আমার থেকে ঘৃণিত কেউ নেই আর এখন তুমিও!! আমার কথা তো ভাবছোনা!!! এ বিশাল পৃথিবীতে নিজের বলতে শুধু আমার ভাইটা ছিল, ওকে যে এই অসময়ে আমার থেকে কেড়ে নিল, সেটা তো দেখছোনা। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত ভাই হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমি, আমার কষ্টটা তো বুঝছোনা। কেন খালা, কেন? আমার ভাইকে আমি ওই মেয়েটার জন্য হারিয়েছি খালা, ওই মেয়েটার জন্য! তবু তুমি ওই মেয়েটার কষ্ট দেখছো খালা, আমারটা না?”

করুণ আর্তনাদের মত শোনাল কন্ঠটা, জানালার ওপাশে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো সিদ্রার।

“এ বাসার প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা জিনিসে ফারহানের স্মৃতি। এই দোলনাটার কথা মনে আছে তোমার খালা? আগে এটা একজনের বসার মত ছিল, আমার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল বাবা। কিন্তু ফারহান হওয়ার পর দুজনে মিলে দোলনায় বসা নিয়ে ঝগড়া করতাম বলে ওইটা সরিয়ে এ দোলনাটা বসিয়েছিল, যাতে দুজনেই বসে দোল খেতে পারি”

তাহলে উনার ভাইয়ের নাম ফারহান, কখনো ভুলেও কি মুনিরা উচ্চারণ করেছে নামটা? নাহ! করেনি, মনে পড়ছেনা আমার, ভাবল সিদ্রা।

“আর ওই যে মাটির চুলাটা, আগে যখন তুমি এটাতে পিঠা বানাতা, দুই ভাই মিলে অপেক্ষা করতাম, পিঠা কখন উঠবে, তারপর প্রথম পিঠাটা নিয়ে লাগাতাম কাড়াকাড়ি। যদিও আমি যথেষ্ট বড় ছিলাম, কিন্তু ফারহানকে জ্বালিয়ে কাঁদাতে খুব মজা লাগতো আমার। যদি জানতাম যে ও এমন অকালে চলে যাবে, এক ফোটাও জ্বালাতাম না ওকে আমি, বিশ্বাস কর খালা, যা যা চেয়েছিল সব এক বাক্যে দিয়ে দিতাম। একটুও কাঁদাতাম না ওকে, একটুওনা” কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে এল কথাগুলো।

“আমি কি দোষ করেছি খালা? শুধু যে আমার ভাইকে কেড়ে নিয়েছে, তাকে নিজের মতো করে শাস্তি দিচ্ছি। আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে পারিনি, এটাই কি আমার অপরাধ? আমি কি করব বলো? আমি যে ফারহানের এই অকাল মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছিনা খালা, কিছুতেই না” এবারের কথাগুলো কান্নার সাথেই বেরিয়ে আসলো ওর। খালা উঠে এসে রাইয়্যানের মাথায় হাত রেখে ওর পাশে বসল। রাইয়্যান খালার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে গেল দোলনার ওপর আর খালা চোখ মুছে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।

জানালার পাশে ঠাঁই দাঁড়িয়ে এসব কিছু দেখল আর শুনল সিদ্রা। লোকটা কাঁদছে, স্পষ্ট বুঝতে পারছে ও। খেয়াল করল, কখন কখন দুচোখ দিয়ে পানি পড়ে বুকের কাছের জামা ওড়না ভিজে গেছে।

“মুনিরা রে, কি করলি তুই এটা! কয়দিনের একটা মজার জন্য দুই দুইটা জীবন নষ্ট করে দিলি!!” বিড়বিড় করে বলল সিদ্রা, “না, দুইটা নাতো, তিনটা! নিজেকে কেন বাদ দিচ্ছি আমি?”
সারাদিনের সব রাগ যেন চোখের জলে ধুয়ে গেল, চোখ মুছে ওখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সিদ্রা, আরো কিছু শোনার অপেক্ষায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here