#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৭

0
314

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৩৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________
এ কি করছে আয়েশী? পাপ করছে না তো? মৃদুলকে ভালোবেসে অন্য কাউকে স্পর্শ করতে আয়েশীর বুক কেঁপে উঠল না? ছিঃ! নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণাবোধ আয়েশীর মনের ভেতরের সমস্ত অনুভূতি দুমড়ে মুচড়ে দিল। আয়েশী ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিল। প্রচন্ড জোড়ে! আয়েশীর হঠাৎ ধাক্কায় ধ্রুব ছিটকে পড়ল মাটিতে। মাটিতে এক হাত ঠেসে ধ্রুব হতভম্ব হয়ে চাইল। আয়েশীর আচমকা ধাক্কা ধ্রুবর মস্তিষ্ক অচল করে দিল। ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে আছে। আয়েশীর এমন কঠিন সময়ে বিরক্ত করা ধ্রুবকে রাগিয়ে তুলছে। ধাক্কা দেয়ার সময় পেল না? ধ্রুব যখন আয়েশীর অধরে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে মেতে ছিল, তখনই ধাক্কাটা দিতে হল? রাবিশ মেয়ে!
আয়েশী রাগে কাঁপছে। তার নরম দেহের থরোথরো কাঁপুনি ধ্রুব স্পষ্ট দেখতে পারছে। ধ্রুব এগিয়ে আসতে চাইল। আয়েশী চিৎকার করল, ‘ এগুলে মেরে ফেলব একদম। ‘
ধ্রুব থেমে যায়। আয়েশী উন্মাদ হয়। দু হাতের তালু দ্বারা ঘষে ঠোঁট হতে ধ্রুবর স্পর্শ মুছে ফেলতে চায়। সম্ভব হলো কি? হলো না। আয়েশী পারল না ধ্রুবর স্পর্শ নিজের ঠোঁট হতে মুছে ফেলতে। এই তো, এখনো আয়েশী অনুভব করতে পারছে ধ্রুবর গরম গরম নিঃশ্বাস, ধ্রুবর অস্থির স্পর্শ, ধ্রুবর বেহায়া চঞ্চলতা! তবুও নাছোড়বান্দা আয়েশী বারবার ঘষতে লাগল ঠোঁট। এতে যদি ধ্রুবর স্পর্শ মুছে যায়!
ধ্রুব আয়েশীর পাগলামি দেখে রাগে ফেঁটে পড়ে। অথচ মুখশ্রী স্বাভাবিক করে আয়েশীর হাত আটকে ফেলে। আয়েশী রক্তলাল চোখে তাকায় ধ্রুবর দিকে। যেন এখনি ধ্রুবকে আস্ত চি’বিয়ে খেতে ফেলবে সে। ধ্রুব মৃদু স্বরে আয়েশীর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলে, ‘ আর ঘষবে না। ঠোঁট কেঁটে যাবে। ‘
আয়েশী ধ্রুবর কলার চেপে ধরে! ধ্রুব ঘাড় কাত করে কলারের দিকে চায়। ধ্রুব অতি শান্ত সুরে জানায়, ‘ আয়েশী, কলার ছাড়ো। ‘
আয়েশী ছাড়ে না। বরং চেঁচিয়ে উত্তর করে, ‘ ছাড়ব না। আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে স্পর্শ করার? ‘
ধ্রুব চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য, ধ্রুবর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রশংসনীয়! আয়েশীর কারণে ধ্রুব যতবার রাগ করেছে, অন্যান্য মেয়ের বেলায় ধ্রুব তার এক ফোঁটা রাগ করে নি। অন্যান্য মেয়েদের ধ্রুব তার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস দেয়নি। যে ধ্রুবর সামনে গলা উঁচু করেছে, সে নিজের প্রাণ হারিয়েছে। তবে আয়েশীর বেলায় তা ব্যতিক্রম। আয়েশী সেসব পেরেছে, যা অন্যান্য মেয়েরা পারে নি। ধ্রুব আয়েশীকে চাইলেও অন্যান্য মেয়েদের ন্যায় আঘাত করতে পারে না। ধ্রুবর ন্যায় ভয়ংকর পুরুষটি অত্যন্ত দুর্বল তার জীবনের প্রিয় নারীর ক্ষেত্রে!
ধ্রুব ঘুর্নাক্ষরে ভাবেনি, তার জীবনেও এমন নারী আসবে। যার সামনে ধ্রুব মাথা নত করবে, হেরে যাবে, দুর্বল হবে, ভালোবাসবে। তবে আজ? ধ্রুবর একটাই প্রার্থনা, আয়েশী, এ নারীর পায়ে যেন ধ্রুবর জীবন কুরবান হোক! এ কি সময়ের লীলাখেলা! সবাই বলে মানুষ রহস্যময়! তবে ধ্রুব আজ বলছে! মানুষ নয়, সময় হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচে রহস্যময়।
আজকের সময়, কাল পৌঁছে মুহূর্তেই মুখোশ বদলে ফেলে। কালকের সময় কেমন হবে, কেউ তার রহস্য ভেদ করতে পারে না। সময়কে ঘিরে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। যেদিন মানুষ সময়কে জয় করে নিয়ে পারবে, সেদিন মানুষ পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে ত্রাস চালাবে।

ধ্রুব চোখ উল্টে বিড়বিড় করে, ‘ আমি কিছু করতে চায়নি। তুমি বাধ্য করেছ। এখন যা হবে, তার জন্যে তুমি দায়ী। ‘
আয়েশী বুঝতে পারে না ধ্রুব কি বোঝাতে চাইছে। আপাতত সে রাগ পুষতে ব্যস্ত। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। ধ্রুব আয়েশীর রাগান্বিত চোখে একপল চেয়ে চট করে আয়েশীকে কোলে তুলে নেয়। আয়েশীর চোখ ছানাবড়া হয়। ধ্রুবর বুকের মধ্যে ক্রমাগত ঘুষি দেয়। অথচ ধ্রুব নির্বিকার। সে স্থির চিত্তে আয়েশীকে নিয়ে সেই পরিত্যাক্ত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
___________________________
হোটেলে ফিরে নিজেদের কক্ষে এসে ধ্রুব থামে। এতক্ষণে আয়েশী ধ্রুবকে পালাক্রমে আক্রমন করেছে। যার দরুন ধ্রুবর শক্তি কমে গেছে। ধ্রুব আয়েশীকে নিয়ে ধাম করে বিছানায় ফেলে দিল। আয়েশী ছাড়া পেয়ে উঠে বসল। চেঁতে উঠে ধ্রুবকে আঘাত করতে উদ্যত হল। তবে ধ্রুব সরে গেল। হাত ঘড়ি খুলতে ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘ যাও, শাওয়ার নিয়ে নাও। নোংরা জায়গা থেকে এসেছ। শরীর নোংরা হয়ে আছে। ‘
আয়েশীর চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ধ্রুবকে সে কখনোই হারাতে পারে না। কেন পারে না? ধ্রুব কেন আয়েশীর থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে থাকে?
‘ কারণ আমি ধ্রুব। ধ্রুব হচ্ছে চিতা বাঘের ন্যায়। যার মস্তিস্কের গতি তোমাদের মত ক্ষুদ্র মনুষ্য থেকে বহুদূর প্রসারিত। ‘
আয়েশী ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব আয়নায় নিজেকে দেখছে। শার্ট খুলে উদোম শরীরে মেডিসিন লাগাচ্ছে। আয়েশী একপল ধ্রুবর পেটানো দেহের দিকে চাইল। সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল আয়েশী। উপরওয়ালা কি নিজ হাতে ধ্রুবকে তৈরি করেছেন। মেধা, মনন, বুদ্ধি, সৌন্দর্য্য, কোনো কিছুতেই কি কার্পণ্য করেন নি? ধ্রুবর পেটানো, বলিষ্ট দেহ যে কোনো নারীর মন চুরি করে ফেলতে পারে। দু হাতের বাহু ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে। পিঠের অংশতে স্পষ্ট মাসেলসমূহ। ধ্রুবর পিঠে কয়েকটি স্থান জ’খম হয়ে আছে। বোধহয় আজ আয়েশীকে বাঁচাতে গিয়ে ধ্রুব আঘাত পেয়েছে। ধ্রুব সেই আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে মলম দিচ্ছে।
‘ আমার বডি দেখে কি ম্যাডামের রাগ ভ্যানিশ হয়ে গেছে? ‘
ধ্রুব আয়নার দিকে চেয়ে খানিকটা কৌতুক করে বলল। আয়েশী থতমত খেয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। ধ্রুব দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, চোখ সরু করে আয়েশীর দিকে চেয়ে আছে। আয়েশী কেন যেন লজ্জা পেয়ে গেল। লজ্জায় জমে গেল পা দুখানা। দ্রুত পালিয়ে গেল বাথরুমে। পেছন থেকে ধ্রুবর অট্টহাসি শুনে হৃদয়ে ঢেউ খেলে গেল। পায়ের মত হৃদয়ও বুঝি জমে গেল? ইশ!

আয়েশী আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। পরিষ্কার ফকফকা আয়নায় নিজেকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করল। হঠাৎ করে ও উপলব্ধি করল, এই যে আয়নার সামনে যে আয়েশী দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আয়েশী চেনে না। এ এক অন্য আয়েশী! এই আয়েশী মৃদুলকে ঘৃনা করে। তার অবচেতন মনে ধ্রুবকে নিয়ে ভাবে। আয়েশী কি ধ্রুবকে পছন্দ করে? ছিঃ,ছিঃ! ভাবলে আয়েশীর গা গুলায়। সে আর ধ্রুব, হতেই পারে না। কিন্তু কেন হতে পারে না? ধ্রুব আয়েশীকে পছন্দ করে। আয়েশী কি একবার চেষ্টা করবে ধ্রুবকে পছন্দ করার? কি লাভ মৃদুলকে ভেবে আয়েশীর কাঁটা ঘাঁয়ে নুনের ছিঁটে দেবার। মৃদুল তো আয়েশীকে কখনো ভালোবাসতো না। আয়েশী মৃদুলের কাছে শুধু এক মরীচিকা ছিল। একজন ভুল মানুষকে ভেবে, আয়েশীর সারাজনম আফসোস কেন করবে ? কেন ধ্রুবর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে? যে ঘৃনা করেছে তাকে ভেবে, যে ভালোবেসেছে তাকে অবহেলা করার কি প্রয়োজন? বরং যে ভালোবেসেছে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচাটাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? অবশ্যই!
আয়েশী বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ তার! ধ্রুব, মৃদুল! ধ্রুব, মৃদুল! এই দুই পুরুষের দ্বন্ধে আয়েশী পিষে! আয়েশী অনেকক্ষণ নিয়ে চোখে মুছে পানি ছেটালো। ওড়না গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। ধ্রুব তখন বারান্দায়। ইজি চেয়ারে দুলছে। চোখ দুখানা বন্ধ! এই প্রথম আয়েশী লক্ষ্য করল, ধ্রুব দেখতে ভয়ংকর সুপুরুষ! ধ্রুবর দিকে একবার চাইলে চোখ ফেরানো মুশকিল! এই যে আয়েশী এখন চোখ ফেরাতে পারছে না, কেন পারছে না? তার কারণ, ধ্রুবর ঘন পাঁপড়ি, তার বুজে থাকা চোখ, চাপা মুখ, গলার মধ্যখানে উঁচু হয়ে থাকা অংশ! সবকিছু আয়েশীকে ভীষন রকম টানছে।

‘ এভাবে না দেখে, কাছে এসে বসলেও তো পারো। ‘
ধ্রুব চোখ বুজে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল। ধ্রুব তো চোখ বুজে আছে। তাহলে সে বুঝল কি করে আয়েশী তাকে দেখছিল! ধ্রুবর কি মাথার পেছনে আরো দুখানা চোখ আছে? হবে হয়তো! ধ্রুবর জন্য অসম্ভব কিছু না। আয়েশী পা টিপে টিপে ধ্রুবর পাশের চেয়ারে বসল।
ধ্রুব এবার চোখ খুলে তাকাল। আয়েশীকে আপদমস্তক গভীর ভাবে দেখে বলল, ‘ শাওয়ার নাও নি? ‘
আয়েশী মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিল। আয়েশী উশখুশ করছে। হাত দুখানা একসাথে বেঁধে ঘষছে। ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে আয়েশীর হাত নাড়ানো দেখল। অতঃপর নেশাকণ্ঠে বলল, ‘কিছু বলবে? ‘
আয়েশী দম ফেলল। মনে হল, ভেতরে এক টন নিঃশ্বাস আটকে আছে। আয়েশী যেন মাত্রই তাদের মুক্ত করল। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে আয়েশীর দিকে।। আয়েশী এবার ধ্রুবর চোখে চোখ রাখল। অতঃপর বলল,
‘ আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। আমি চাই, আপনি আমার মন থেকে মৃদুল নামক অভিশাপকে চিরতরে মুছে ফেলুন। আমাকে এমন ভালোবাসুন, যেন আমি ভুলে যাই আমার অতীতের সমস্ত জঘন্য স্মৃতি! আমি চাই, আপনি আমার দেওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগান। আমার মন ভাঙার কারণ না হোন। একবার আমি হেরেছি, বারবার হারতে পারবো না। আমার মধ্যে সে শক্তি আর নেই। অনেক কষ্টে আমি নিজের মনকে বুঝিয়েছি। দয়া করে আমার মনকে আবার ভেঙে ফেলবেন না। আমি মরে যাব তবে! ‘

আয়েশী কাদঁছে। ধ্রুব অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আয়েশীর দিকে চেয়ে। সে কি ঠিক শুনছে? তার কান তার সাথে কি বে’ইমানি করছে? যে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে সে এতদিন যন্ত্রণায় ছটফট করেছে, নীচু থেকে নীচু স্তরে নেমেছে, খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে, সে ভালোবাসা তাকে এখন হাত নেড়ে ডাকছে। ধ্রুবর শকুনি মস্তিষ্ক অচল হয়ে রইল। কিছু মাথায় প্রবেশ করছে না! মাথা ভনভন করছে!

#চলবে ( শব্দসংখ্যা – ১২০০+)
সাইলেন্ট এবং এক্টিভ উভয় পাঠক প্লিজ রেসপন্স করবেন। এতে করে বাকি পাঠকদের নিউজফিডে গল্প পৌঁছে যাবে। হ্যাপি রিডিং!

গত পর্বের কমেন্ট বিজয়ী,
@miftahul mun
@farahana tabassum
@reha zaman
@এলোমেলো স্বপ্নকন্যা

লেখিকার গ্রুপের নাম,
কল্পনা-কলমে ~ ‘আভা ইসলাম রাত্রি’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here