#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪১

0
332

#মৃত_কাঠগোলাপ – ৪১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই! রাতের আঁধারের সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধ্রুব এখনো বাড়ি ফেরেনি। আয়েশী ধ্রুবর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত! সারা গা আজ কেন যেন ম্যাজম্যাজ করছে। আয়েশী শাড়ির আঁচল টেনে বিছানা ছাড়ল। আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজল। আলমারির ভেতরের একদম কর্নারে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়েও গেল। আয়েশী আলমারি বন্ধ করে দিল। হাতে থাকা জিনিসটাকে যত্ন করে মুঠোয় পুড়ে বিছানায় এসে বসে। আয়েশী হাতের মুঠো খুলে জিনিসটার দিকে চায়। মৃদুলের একটু সুন্দর ছবি! এই এক বছরে আয়েশীর কাছে মৃদুলের যত স্মৃতি ছিল, সব ধ্রুব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। শুধুমাত্র এই ছবি আয়েশী অনেক লুকিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। ছবিতে মৃদুল কি সুন্দর করে হাসছে। আয়েশী যখন মৃদুলের এই হাসিমাখা ছবি দেখে, আয়েশীর চোখ ভিজে উঠে। মৃদুলের ছবিতে কতশত চুমু আঁকে। মৃদুলকে আয়েশী ভুলতে চেয়েছিল। অথচ কী দুর্ভাগ্যের কথা! আয়েশীর মনে এক বছর পরও মৃদুলের স্মৃতি এখনো পূর্বের ন্যায় তাজা, ফকফকা! আয়েশীর চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে ছবি ফ্রেমের উপর পড়ে। আয়েশী মৃদুলের ছবিতে আলতো হাত বুলায়। আঁখিতে অশ্রুর আগমন! কণ্ঠনালী কাঁপছে। আয়েশী বিড়বিড় করে শুধায়, ‘ কেন এমন করলি মৃদুল? ‘
হঠাৎ টুপ করে কোথা হতে ধ্রুব এসে আয়েশীর কোলে মাথা রাখে। আয়েশী হকচকিয়ে যায়। ছবিটি দ্রুত শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেলে। ততক্ষণে ধ্রুবর চোখে ছবিটি পড়ে যায়। ধ্রুব পাত্তা দেয়না। মৃদু হেসে আয়েশীর গাল টেনে বলে, ‘ মন খারাপ? ‘
আয়েশী হাতের পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ মুছে হাসার অভিনয় করে বলে, ‘ না! ‘
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আঙ্গুল উচুঁ করে আয়েশীর গাল থেকে অশ্রু বিন্দু ফেলে দেয়। আয়েশী বুঝে যায়, সে আবারও ধরা পড়ে গেছে। আয়েশী ইতি-অতি চেয়ে মুখশ্রী আড়াল করতে চায়। পারে না। ধ্রুব ততক্ষনে আয়েশীর থুতনি চেপে মুখ নিজের দিকে করে নিয়েছে। আয়েশী ব্যথা পায়। বলে, ‘ ছাড়ো, ব্যথা পাচ্ছি। ‘
ধ্রুব ছাড়ে না। বরং গমগমে সুরে বলে, ‘ মৃদুলকে আবারও মনে করেছ? ‘
আয়েশী কথা বলে না! ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধ্রুব চোখ বুজে নেয়। ক্লান্ত সুরে বলে, ‘ চুল টেনে দাও। বড্ড মাথা ধরেছে। ‘
আয়েশী হাত গলিয়ে দেয় ধ্রুবর চুলে। কি সিল্কি ধ্রুবর চুল! হাত যেন ফস্কে যায় বারবার! আয়েশী মনের সুখে ধ্রুবর চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব চোখ বুজে বলল, ‘ খেয়েছ কিছু? ‘
আয়েশী বলল, ‘ না! তুমি না এলে তো আবার খাওয়া যাবে না। ‘
ধ্রুব আয়েশীর কোল থেকে উঠে বসে। টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বলে, ‘ চলো। খেয়ে নেই। ‘
আয়েশী উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। আঁচল টেনে ঠিক করে ধ্রুবর সাথে বেরিয়ে যায়।
ধ্রুবর খাওয়া শেষ! আয়েশী তখনও খাচ্ছে। ধ্রুব সব কাজ অত্যন্ত দ্রুত করে। হাতের সাথে তার মস্তিষ্কের গতি যেন আস্ত চিতাবাঘ! ধ্রুব ঠিক বলে! সে আসলেই একটা চিতাবাঘ! যার লাগাম আয়েশী কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। ধ্রুব দৌঁড় আয়েশী থেকে পাঁচ কদম এগিয়ে।
আয়েশী খাবার গুছিয়ে কক্ষে আসে। কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে, আয়েশীর চোখ কপালে উঠে। ধ্রুবর হতে মৃদুলের সেই ছবিখানা! আয়েশীর বুক ধরাশ করে উঠে। দ্রুতপদে এগিয়ে যায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ততক্ষণে রাগে কাঁপছে। আয়েশী ধ্রুবর থেকে ছবির ফ্রেম ছিনিয়ে নিতে চায়। পারে না। ধ্রুব আগুন চোখে আয়েশীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আয়েশী ভয়ে সেঁটিয়ে যায়। ধ্রুবর রাগকে আয়েশীর ভীষন ভয় পায়। রাগ হলে ধ্রুব তখন মানুষ থাকে না। বনমানুষে পরিণত হয়। যা ইচ্ছে হয়, তাই করে। নিজেকে র’ক্তাক্ত করে, ঘরের জিনিসপত্র ভা’ঙচুর করে! তবে আয়েশীকে রা’গের বশে ধ্রুব এখন পর্যন্ত আঘাত করে নি। তবে ধ্রুব নিজেকে যখন আঘাত করে, আয়েশীর মনে হয় ধ্রুব যেন স্বয়ং আয়েশীকে আঘাত করেছে। ধ্রুবর শরীর থেকে যখন রক্ত ঝড়ে, আয়েশীর মনে যেন কেউ ছু’রি দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। আয়েশী অনুভব করে, ধ্রুবর ব্যথা, ধ্রুবর যন্ত্রণা! এ যেন এক আত্মা, দুই দেহ!

কাঁচ ভাঙার শব্দ আয়েশীর ধ্যান ভাঙে। আয়েশী চকিতে মাটিতে তাকায়। মৃদুলের শেষ চিন্হটুকুও ধ্রুব নিঃশেষ করে দিয়েছে। আয়েশীর চোখ ভিজে। ধ্রুব আয়েশীর হাত চেপে ধরে। আয়েশী চোখ মেলে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব রাগে গড়গড় করে বলে, ‘ মৃদুলকে ভুলতে পারছ না, আমাকে আপন করতে পারছ না! কি, চাইছটা কি তুমি? ‘
আয়েশী কেঁদে বলে, ‘ আমি ব্যথা পাচ্ছি, ধ্রুব। ‘
‘ ওহ, ড্যাম! একটু ছুঁলেই ব্যথায় শেষ হয়ে যাও। অথচ আমার বুকে প্রতিনিয়ত ব্যথা দিচ্ছ, সেসব? ‘
ধ্রুব আয়েশীর হাত ছেড়ে দেয়। আয়েশী হাত ঘষে ধ্রুবর দিকে চায়। ধ্রুব তখন রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। ধ্রুব মাটিতে থাকা ভাঙা কাঁচের উপর হেঁটে বারান্দায় চলে যায়। ধ্রুবর পায়ের কাঁচ ফুটে র’ক্ত ঝড়ছে। তরল র’ক্তে মাটির কার্পেট ভিজে গেছে। কার্পেটে লাল ছোপ ছোপ র’ক্ত দেখে আয়েশী আঁতকে উঠে। দৌঁড়ে বারান্দায় যায় সে। ধ্রুব ইজি চেয়ারে বসে দুলছে। দু চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে।
আয়েশী ধ্রুবর পায়ের কাছে বসে। ধ্রুবর পা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে অস্থির চিত্তে বলে, ‘ ধ্রুব, চলো। ব্যান্ডেজ করবে। তোমার পা অনেক কেটে গেছে। ‘
ধ্রুব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ‘ ওহ, আমার কষ্ট তোমার চোখে পড়ে তাহলে? ‘
আয়েশী অবাক কণ্ঠে বলে, ‘ ধ্রুব, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এমন কথা কেন বলছ তুমি? ‘
ধ্রুব এবার আয়েশীর দিকে ঝুঁকে, আয়েশীর থুতনি দু আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে। হিড়হিড় করে বলে,
‘ আমাকে ভালবাসো? তবে মৃদুলের জন্যে এখনো কেন চোখের জল ফেলছ? তোমার আর মৃদুলের মাঝখানে আমি কোথায় আয়েশী? বলো, কোথায় আমি? আয়েশী, আমি কি করে মেনে নিব, যাকে আমি ভালোবাসি, সে অন্য পুরুষের জন্য চোখের পানি ফেলছে। আ’ম হেল্পলেস আয়েশী! প্লিজ, আমাকে এভাবে তিলে তিলে মেরে ফেলো না। ‘
আয়েশী ভেজা চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে থাকে। ধ্রুব কষ্ট দেখে আয়েশীর বুক ফেঁটে চৌঁচির হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি আয়েশী ধ্রুবকে তার আচরণ দিয়ে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে?
ধ্রুব এবার উন্মাদের ন্যায় চেয়ার উঠে উঠে। আবার কাঁচের উপর হেঁটে ড্রয়ার থেকে ছু’রি নিয়ে আয়েশীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ নাও, নিজের হাতে আমায় একেবারে মে’রে ফেলো। তারপর মৃদুলকে মনে করে যত ইচ্ছে কেঁদো। কিন্তু প্লিজ, আয়েশী! আমার সামনে অন্য পুরুষের জন্য চোখের জল ফেল না। আমার বুকে কষ্ট হয়। ভীষন কষ্ট! ‘

আয়েশী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রয়। ধ্রুব আবার বলে, ‘ মা’রো আমাকে! ‘
ধ্রুবর চিৎকারে আয়েশী দেহ কম্পিত হয়। আয়েশী ধপ করে হাত থেকে ছু’রি ফেলে দেয়। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধ্রুবকে। ধ্রুব আয়েশীর পিঠে হাত গলিয়ে আয়েশীর ঘাড়ে মুখ ডুবায়। আয়েশী ধ্রুবর পিঠ খামচে ধরে কেঁদে বলে,
‘ এমন করে বলো না, ধ্রুব। আমি তোমাকে মারতে পারবো না। একজনকে হারিয়েছি। অপরজনকে হারানোর শক্তি আমার নেই। তোমাকে হারানোর কথা ভাবলেও আমার বুক কাঁপে, ধ্রুব। ‘
ধ্রুব মিহি হাসে। আয়েশীর পিঠে হাত বুলিয়ে মন খারাপের অভিনয় করে বলে, ‘ মৃদুলকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাও, আয়েশী। ‘
আয়েশী ধ্রুবর পিঠের শার্ট মুচড়ে ধরে। কেঁদে বলে, ‘ আজ থেকে মৃদুলকে আমি ভুলে গেছি। ভুলে গেছি আমি মৃদুলের সকল স্মৃতি! ‘
ধ্রুব মুচকি হাসে। বিড়বিড় করে শুধায়, ‘ আহারে, ইমোশনাল ফুল গার্ল! ‘
ধ্রুব আয়েশীর কানের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আয়েশী কেঁপে উঠে। ধ্রুব আয়েশীর কানে ঠোঁট ঠেসে রেখে হিড়হিড় কণ্ঠে আবদার করে,
‘ আজ রাতে আমার আবার তোমাকে চাই, রক্তজবা! আবার তোমার শরীরে উষ্ণ চুম্বন এঁকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই। তোমার ঠোঁটের ভাজে ঠোঁট রেখে ভুলে যেতে চাই সকল কষ্ট! কাঠগোলাপ হয়ে নামতে চাই তোমার মনের বাগানে! ‘
ধ্রুবর কথা শুনে আয়েশীর বুক ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠে। আয়েশী ধ্রুবর ঘাড় থেকে মুখ সরায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ কিন্তু ধ্রুব! তোমার পা? ‘
ধ্রুব আয়েশীকে কোলে তুলে নেয়। আয়েশী নাকে নাক ঘষে হুইস্কি কণ্ঠে বলে, ‘ তোমার ছোঁয়ায় আমার সকল ব্যথা সুখ হয়ে যায়। তুমি আমার সুখ হবে, রক্তজবা? কথা দিচ্ছি, আমার সুখের রাজ্যে রানী করে রাখব তোমায়! ‘
আয়েশী মৃদু হাসে। পূর্বের সমস্ত মন খারাপ হু হু করে পালিয়ে যায়। ঠোঁট টেনে হেসে বলে, ‘ পাগল! ‘
ধ্রুব আয়েশীকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আয়েশীর গলায় মুখ গুঁজে মৃদু স্বরে বলে ‘ তোমার জন্যে! ‘
আয়েশী ধ্রুবর চুলে হাত গুঁজে দেয়। ধ্রুব তখন আয়েশীর গলায় মুখ গুঁজে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিতে ব্যস্ত! আয়েশীর কথা তার কানে প্রবেশ করেনি। আয়েশী অনুভব করছে, ধ্রুবর অস্থির আচরণ, বেপরোয়া ভালোবাসা, বেহায়া হাতের স্পর্শ! ইশ, আয়েশী যে সুখে আজ ম’রেই যাবে। প্রতিবার এমন কেন হয়? যতবার ধ্রুব আয়েশীকে ছুঁয়ে দেয়, আয়েশীর ততবার ধ্রুবর স্পর্শ নতুন মনে হয়। ধ্রুবর অস্থিরতা আয়েশীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মাদকতার অন্যন্য পর্যায়ে! ধ্রুব যখন ভালোবেসে, আয়েশীর কি যে সুখ লাগে। ইশ, ভালোবাসা কি ভীষন সুখের! তবে এই সুখ একদিন দুঃখে পরিণত হবে। আফসোস, সুখের নেশায় ডুবে থাকা আয়েশী সে সম্পর্কে অজ্ঞতই থেকে গেল!

#চলবে
গল্পটা পড়ে রেসপন্স করবেন প্লিজ। গল্প লিখি আপকাদের জন্যেই, আপনারা নিজেদের রিয়েক্ট, কমেন্ট না করলে, গল্প লেখার আগ্রহ থাকে না।
গত পর্বের কমেন্ট বিজয়ী,
@এলোমেলো স্বপ্নকন্যা
@miftahul mun
@farhana tabassum
@maksuda ratna
@triyasha roy sreya
@reha zaman
@arisha imroj mishra
@sumaiya akter
@fatema ayesha marium
@আফরা ইবনাত হীর
@আফরিন ঐশী

লেখিকার গ্রুপ,
কল্পনা-কলমে ~ ‘আভা ইসলাম রাত্রি’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here