#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_৩

0
546

#৫ম_তলার_মেয়েটাপর্ব_৩

পরশের রুমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার সিঙ্গেল খাটটা।এই খাটে দুইজন কিভাবে ঘুমাবে ভাবতে লাগল সিমি। তবুও তো এতক্ষণে থাকার একটা ব্যবস্থা হলো,বাসা থেকে বের যে করে দেয় নি এটাই তো অনেক।পরশ দরজা লাগিয়ে দেয়ার পরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সিমির।পরশ বিভিন্ন বাহানায় যতই কাছে আসতে চাইছে সিমি ততই দুরে সরে যাচ্ছে।এক সময় সিমির পিঠ দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলো।পরশের দুই হাত সিমিকে মাঝে রেখে দেয়ালে গিয়ে ধরলো।
সিমির চোখে জড়তা এবং উচ্ছাস আর পরশের চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে।
এমন সময় দরজায় নক হলো।
দুলি দাঁড়িয়ে আছে।
—এই যে আপুর ড্রেস। তোমার বৌ তো কোন কাপড় নিয়ে আসেনি, তাকে আপুর ড্রেস পরতে দিল।
কাপড়গুলো পরশের হাতে দিয়েই চলে গেলো দুলি।

এর মধ্যে সিমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।আজকের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা।বাতাসটাও অনেক ভারি,থমথমে। চারিদিক যেন একটু বেশিই নীরব।একটা অস্থির আর মন খারাপ করা পরিবেশ। হঠাৎ কেন জানি সিমি খুব কান্না পাচ্ছে।
এমনিভাবে বিয়ে সে তো কখনো চায়নি, কখনো ভাবনাতেও আসেনি। সুন্দর করে বৌ সেজে ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে থাকবে আর ,ফুলের মিষ্টি সুবাসে মন পাগল হয়ে উঠবে এমনটাই বার বার কল্পনায় ভাসতো। হঠাৎ কি থেকে যে কি হয়ে গেল!

পরশ এসে কখন পাশে টের পেলো না সিমি।দুই হাত দিয়ে সিমির কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনতেই দেখলো সিমির চোখে পানি।
—আরে কাঁদছ কেন?
পরশের মুখে তুমি শুনে কান্নার মাঝেও হাসি পেলো সিমির।সে ফিক করে হেসে উঠলো।

পরশ সিমিকে ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
—কি ব্যপার হাসছ কেন?এই কান্নার মাঝে হাসি।পাগল হয়ে গেলে নাকি?
—তোর মুখে তুমি শুনে খুব হাসি পাচ্ছে।
—আরে আমরা এখন হাসব্যান্ড-ওয়াইফ না?আগের মতো তুই তুই বললে হবে?
—আমার কিন্তু সময় লাগবে। হঠাৎ করে তুমিতে আসতে পারবো না।
— পরেরটা পরে দেখা যাবে। এবার বল কাঁদছিলে কেন?
—এমনিই হঠাৎ মন খারাপ লাগছিলো।
পরশ চুপ হয়ে গেলো।সে ভাবলো সিমি তার বাসার সবার জন্য মন খারাপ করছে।তার নিজের ও অনেক খারাপ লাগছে,মা এখনো তার সাথে কথা বলে নি।একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

এবার সিমি আর একটু কাছে এসে বলল-
—এখন আবার তোর কি হলো?সরি সরি পতি দেব, আপনার কি হলো?বলতে বলতে হাসতে‌ লাগলো সিমি।
—আপনি ভেতরে চলেন । আমি পতিদেব, না? আচ্ছা বোঝচ্ছি পতিদেব কাকে বলে।

সিমির ঘুম ভেঙে গেল।কয়টা বাজে বুঝতে পারলো না। গায়ের উপর থেকে পরশের হাত সরিয়ে দিল।ঝিমি আর সিমি এক বিছানায় ঘুমাতো।মাঝে মাঝে ঝিমির হাত,পা সিমির গায়ের উপর উঠিয়ে দিত আর তখনই সিমির ঘুম ভেঙে যেতো।সিমি উঠে বসে ঝিমিকে ঠিক করে শুইয়ে আবার ঘুমাতো।আজ তার বিয়ে হয়েছে জীবনের একটা অধ্যায় থেকে সম্পূর্ণ নতুন অচেনা একটা অধ্যায় শুরু হলো।

পরশের খাট ছোট তাই পরশ নীচে বড় করে বিছানা করেছে তোশক আর কাঁথা বিছিয়ে।এই যে এত দিনের চেনা মানুষকে পাওয়ার যে এত আকুলতা ছিল এখন সে তার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।
তার সমস্ত মন,প্রাণ, শরীরে ছড়িয়ে দিয়েছে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণ।
এই সব কিছু এভাবে হোক এটা সিমি চায়নি।

আজ সকাল এবং রাতের মাঝে কতটা পার্থক্য জীবনে।
সকালে যখন রিকশা ভাড়া নিতে মায়ের রুমে যাচ্ছিল তখন , ভেতরে না ঢুকে দাঁড়িয়ে গেলো সিমি,আসলে তার পা আর সামনে এগুতে পারছিল না।শফিক বলছেন-
—আমি যা বলছি তাই হবে।টাকা কি গাছে ধরে? এই সব আলতু ফালতু খরচ করার জন্য আমি টাকা দিতে পারবো না।
মেয়েদের খোঁজ খবর রাখ।ওদের দিকে নজর দাও। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলেই সিমিকে বিয়ে দিয়ে দেব।
পারু কি বললেন,বোঝতে পারলো না সিমি। কিন্তু ঠাস করে একটা থাপ্পরের শব্দ ঠিকই শুনতে পেলো।এই সব নতুন কিছু না। তার মাকে কি পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করতে হয় এটা তিন ভাইবোনই জানে।
আজ যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। সোজা রুমে ঢুকে যায় সে।পারু বিছানায় বসে কাঁদছেন।শফিক , সিমিকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন-
—কি চাই?
সিমি শুধু কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল একটা কথাও বলল না।মায়ের পাশে গিয়ে বসল সে।
পারু নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বললেন-
—তোর দেরি হয়ে যাবে তো। সকালে হাঁটতে গিয়ে একটু দেরি হলো তো, মর্জিনা নাস্তা বানাতে দেরি করেছে তাই তোর বাবা একটু রাগ করেছে।তেমন কিছু না।
এর পর শফিককে বললেন-
—সিমির ভাড়াটা দাও তো।
শফিক টাকাটা দিতে হাত বাড়ালে সিমি অন্যদিকে তাকিয়ে হাতে নিল।

তিন ভাইবোনের প্রতিদিনের খরচ শফিক সকালেই গুনে গুনে ভাঁজ করে রাখেন।এক টাকাও যেন বেশি না রায় তাই বার বার গুনেন।তেই টাকা তাদের দেয়া হয় তা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে খুব অল্পই থাকে,যা দেয়া হয় কিছু খাবার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন তো সমান না,মাঝে মাঝে ভাড়ায় বেশি চলে যায়।এটা শফিক বুঝেন না।টাকা না থাকলে বা টানাটানি থাকলে একটা কথা ছিল।এই ব্যপারটাতে ওদের তিনজনই আপত্তি ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।একটা টিউশনি করবে সেটাও অনুমতি নেই।
তবে শাওন বাবাকে না জানিয়ে একটা টিউশনি করে।ও ছেলে বলেই না পারে। সন্ধ্যার পরে আসলেও সমস্যা নেই।

টাকাটা নিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল সিমি।মনে মনে ভাবলো আর এই বাসায় ফিরবো না।আর যেখানেই থাকা হোক না কেন,এখানে আর না।
পরশকে বিয়ের কথা বলাতে খুব অবাক হলো।এই অবস্থায় বিয়ে সেটা তো অসম্ভব।সিমি বলল,তাহলে আর যেন ওর সাথে সম্পর্ক না রাখে পরশ।
পরশ অনেকভাবে বুঝিয়েও লাভ হলো না।সাক্ষী হিসাবে আহনাফ আর নুরিকে নিয়ে গেল ওরা কাজী অফিসে।
আহনাফ হাসতে হাসতে বলেছিল,’কয়েকদিন পরে আমাদের বিয়ের সময় তোদের সাক্ষী হিসেবে আনবো,রেডি থাকিস।’

সিমি ভাবতে লাগল যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ঠিক হলো কিনা চিন্তা করে লাভ কি? নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিলেও তার মন কেমন করছে।শত যুক্তি দিয়েও মনটা শান্ত হচ্ছিল না।

দোতলার সিঁড়িতে নওমির সাথে দেখা হয়ে গেল বাড়িওয়ালা তোফাজ্জল হোসেনের সাথে।নওমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
—আঙ্কেল কেমন আছেন?
তোফাজ্জল হোসেন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।
—ভালো আছি।তুমি কেমন আছ মা?
—জ্বী ভালো আছি।
—তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?কোন সমস্যা হলে নিঃসংকোচে বলবে।আমি না থাকলে তোমার আন্টিকে বলবে।
উনাকে দেখলেই নওমির মনে হয় দরজায় নক করার ব্যপারটা বলে কিন্তু আবার মনে হয় নিজের বোন জামাইয়ের কথা কি বিশ্বাস করবে? উল্টো তাকেই হয়তো খারাপ মনে করে বাসা ছেড়ে দিতে বলবে।
তোফাজ্জল কে দেখলে নওমির খুব ভালো মানুষ মনে হয়।
উনি বারবার নওমিকে বাসায় যেতে বললেন।

মাসে একবার শুধু ভাড়া দেওয়ার সময় বাড়িওয়ালার বাসায় যায় নওমি।বিল্ডিংয়ের সব ভাড়া বাড়িওয়ালার স্ত্রী হাজেরার কাছে দিতে হয়।হাজেরা সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করেন কিন্তু অহংকার তাঁকে ঘিরে থাকে।সেটা ভেদ করে কেউ কাছে যেতে পারে না। প্রত্যেককে বসিয়ে বসিয়ে দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দেন। তার বেশীর ভাগই থাকে তাঁদের নিজেদের,আত্নীয়দের কার কি আছে,কার কত টাকা আছে।একই কথা বার বার বলেন।শ্রোতা যে অসহ্য হয়ে যাচ্ছে সেই খেয়াল নেই।
নওমির কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয় হাজেরাকে।
দেখা হলে নওমিকে জিজ্ঞেস করেন নাম যেন কি তোমার?কয় তলায় যেন থাক?
প্রতিবার তিনি নওমির নাম ভুলে যান।
তোফাজ্জল আর হাজেরাকে দুই ভুবনের বাসিন্দা মনে হয় নওমির কাছে।তাই উনাদের বাসায় যেতেই ইচ্ছে করে না।ভাড়া দিতে যেতে হয় বাধ্য হয়ে।

একটা রিকশায় চেপে বসলো নওমি। রিংটোন শুনতেই খুব বিরক্ত লাগলো,কে আবার কল দিল এই সময়ে?
মোবাইল স্ক্রিনে দেখলো অপরিচিত নাম্বার।
রিসিভ করতেই-চিনতে পারলো-
—আপনাকে না বলেছি আমাকে কল দিবেন না, এখন আননোন নাম্বার থেকে কল শুরু করেছেন?
—কি করবো বল,তুমি যে কল রিসিভ কর না।

চলবে…

#ফাহমিদা_লাইজু

২য় পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1273047656543592/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here