বিভীষিকা- পর্ব-3

0
170

-‘রাজনীতিবিদ আবেশ মুনতাসীর! তাহলে আপনিই সেই? ‘

সুনয়নার বিষ্ময়কর কন্ঠস্বর। তবুও আবেশের মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা দিলো না। সে আপন মনে পছন্দের পোশাক খুঁজতে ব্যস্ত। ভাবখানা এমন যেন শুনতেই পায় নি। ফোনটা অনবরত বাজতেই আছে। না কল কাটছে না রিসিভ করছে।
ওকে ভাবলেশহীন দেখে সুনয়না পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-‘আমি এখানে কেন?’

আবেশ নিশ্চুপ হয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিক করছে। শার্টের হাতা ভাঁজ করে ঘড়ির দিকে চোখ রাখল সে। হাতে একদমই সময় নেই। এক্ষুণি বের হতে হবে।
নয়তো মিটিংয়ে দেরী হয়ে যাবে। সেটা অনুচিতও হবে। সে এমন করলে বাকিরা লাই পাবে। তারাও ঢিলেমি করে কাজে ফাঁকি দিবে। এই সুযোগ সে কাউকে দেয় নি আর দিবেও না।
তাছাড়া আজকে মিটিংটা দলের জন্য খুব প্রয়োজন। সেটা কোনোভাবে হেয় করা যাবে না। নিজের কাজ সেরে আবেশ
সুনয়নাকে উপেক্ষা করে দ্রুত বেরিয়ে গেল। সুনয়না তখনো ভ্রু কুঁচকে আবেশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কথা গুরুত্বই দিলো না লোকটা, আশ্চর্য মানুষ তো! সুনয়না ঝট করে উঠে রুমের বাইরে এলো। কেউ নেই, কোথায় এনেছে তাকে? এই জায়গার নাম কি? এসব জানার কৌতুহল দমাতেও পারছে না সে। তাই আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বাড়িটির অবস্থান পরখ
করছে। অচেনা সবকিছু। আর আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে বাড়িটির আনাচে কানাচে। হবেই তো, তুখর রাজনীতিবিদের বাড়ি বলে কথা। অবৈধ টাকায় এমন বাড়ি বানানোই যায়। তবে বাড়িতে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আবেশকেও না। বিরক্তিতে ওর চোখ মুখ কুঁচকে গেল। মানুষটার সমস্যা কী? তার উদ্দেশ্যে খোলাসা করছে না কেন? এভাবে কতদিনই বা বন্দি করে রাখবে? সেও তো মানুষ! সুনয়না দো’তলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। এত বড় বাড়িতে সে একা। ভয় লাগছে না তবে বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ একটা পাখি এসে বসল ওর বাম কাঁধে। অদ্ভুত রকম সুন্দর দেখতে পাখিটি। পাখিটির নাম জানে না সুনয়না। পাখিটি হঠাৎ বুলি আউড়ালো,

-‘খেতে চলো! খেতে চলো! মুখ ধোঁও! খাবার খাও।’

সুনয়না পাখির কথা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হলো। তবে প্রকাশ না করে পুনরায় ফিরে গেল। একেবারে ফ্রেশ হয়ে’ই আসল। পাখিটি উঠে এসে বসল ওর সামনের চেয়ারে। সুনয়না এক
পলক তাকিয়ে খাওয়াতে মন দিলো। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।হঠাৎ পায়ে কারো নিঃশ্বাস অনুভব করল। হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। পরক্ষণেই একটা ঘিয়ে রঙের কুকুর বেরিয়ে আসল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিদেশী জাতের।
সুনয়না জোরে ধমক দিয়ে কুকুরটাতে সরতে বলল।কুকুরটা সরলো না বরং জিহ্বা বের করে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল।
কুকুরটা বোধহয় কিছু বোঝাতে চাচ্ছে । সুনয়না বিরক্তমুখে পুনরায় খেতে বসল। কিন্তু বড়লোকি খাবারে ওর পোষাচ্ছে না। তাই উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। পরিপাটি সুন্দর রান্নাঘর। সে সময় নিয়ে সবকিছু খুঁজে, দেখে, খিচুড়ি আর ডিম ভেজে খেতে বসল। রান্নার তালে অনেকটা সময় কেটে গেছে তার খেয়ালই নেই। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। ওর একাকীত্বটা কিছু সময়ের জন্য কেটেছে। তবে সে যতক্ষণ রান্নাঘরে ছিল ওই পাখি আর কুকুরটি সেখানেই বসে ছিল। একদন্তও নড়ে নি। বরং যেতে বললেই মাথা নত করেছিল।
অর্থাৎ যাবে না। সুনয়না খিঁচুড়ি বেড়ে কেবল মুখে দিবে,ঠিক
তখনই লক খুলে আবেশ ভেতরে প্রবেশ করল। হাতে শপিং ব্যাগ। সুনয়না একবার তাকিয়ে খাওয়াতে মন দিলো। যেন কাউকে দেখেই নি সে। আবেশ কয়েক সিঁড়িতে গিয়ে পুনরায় ফিরে আসল।কোনো বাক্য ব্যয় না করে সুনয়নার প্লেট নিয়ে উপরে চলে গেল।সুনয়না এঁটো হাতে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।
কিছু বলার ইচ্ছে হলো না। তবে মনে লোকটা যে মারাত্মক অভদ্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তখনই উপর থেকে আবেশ ওকে উচ্চশব্দে ডাকতে লাগল।
থামাথামির নাম গন্ধ নেই। সমানে সুনয়না! সুনয়না! করেই যাচ্ছে। সুনয়না হাতটা ধুয়ে ধীর গতিতে উপরের রুমে গেল। আবেশ তখন বিছানায় বসে খিঁচুড়ি খাচ্ছিল। তাও খুব তৃপ্তি সহকারে। যেন অমৃত কিছু খাচ্ছে।ওকে দেখে আবেশ হাতের ইশারায় বসতে বলল। সুনয়না নিঃশব্দে বসে দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করল। এর মিনিট দু’য়েক পরে আবেশ মুখ খুললো,

-‘তোমার পরিবারকে আমি মারি নি তাই ঘৃণার দৃষ্টি ছুঁড়বে না আমায়। তোমার বাবার চালের গোডাউনে হিরোইন পাওয়া গেছে। উনি নেশাদ্রব্যের ব্যবসা করতেন। রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করো তাই এতদিন সামনে আসি নি। তবে এই না আমি
তোমাকে পেতে তোমার বাবাকে ফাঁসিয়েছি।’

এইটুকু বলে আবেশ একপলক সুনয়নার দিকে তাকাল। সে নিশ্চুপ হয়ে বসে মৃদু হাসল। আবেশ যা বলছে সবটা সত্যি।
এই নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ এ ব্যাপারটাতে সে জ্ঞাত। এই নিয়ে বাড়িতে বাবা মায়ের মধ্যে রোজ অশান্তি হতো। কোনো কথায় তার অজানা নয়। এছাড়া একটা প্রবাদ আছে, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।ওর বাবার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। তবে আবেশ হঠাৎ এসব বলছে কেন, তা বুঝছে না সে। হয়তো কারণ আছে। নয়তো মিঃ আবেশ এত বাক্য ব্যয় করার মানুষ নন। সুনয়নাকে অন্যমনস্ক দেখে আবেশ হাতের প্লেট’টা রেখে পুনরায় বলল,

-‘ এতকিছুর মধ্যে আরেকটা সত্যি হলো, আমি অকারণেই তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমাকে আমার হতে হবে, হোক সেটা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। ‘

-‘আর কিছু? ‘

-‘ আমাদের অপ্রিয় থেকে প্রিয় হওয়ার গল্পটা আজ থেকেই নাহয় শুরু হোক।’

একথা শুনে সুনয়না নিঃশব্দে হাসল। ওর হাসিতে তাচ্ছিল্য স্পষ্ট। আবেশও আর কথা বাড়াল না বরং বেরিয়ে গেল।

মোড়ল সাহেবের সঙ্গে এক পুলিশের গোপন আলাপ চলছে।
এটা প্রায়ই হয়ে থাকে। তবে মোড়লের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু। অভিরাজ সেটা খেয়াল করে ভেতরে প্রবেশ করল না। বরং ভৃত্যদেরও যেতে নিষেধ করল। নতুবা
মোড়ল সাহেব রেগে যেতে পারেন। উনার রাগ মানে ভাংচুর নয়তো…! অভিরাজ বাইরে বেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে প্রাসাদটা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রাসাদটা নিয়ে অনেকের অনেক কৌতুহল। হয়তো এর কারণ আছে।
তাছাড়া, প্রথম প্রথম গ্রামের অনেকে সুনয়না দেখে খুব ভয় পেতো। কারণ সুনয়না রাতের বেলা আলগা চুলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। এই দৃশ্যটা সন্ধ্যায় অথবা রাতে দেখা যেতো। এই নিয়ে অনেকের মনে ভুল ধারণারও সৃষ্টি হয়েছে। জমিদারদের পরিত্যক্ত বাড়ি তাই অনেকে ভাবত, সে কারো অতৃপ্ত আত্মা। পরে ধীরে ধীরে অনেকে সুনয়নাকে দেখেছে।
পুরো গ্রামে ওর কথা ছড়িয়ে গেছে।কানাকানিও হয়েছে খুব।তবে সে কে? কেউ’ই সরাসরি মোড়লকে জিজ্ঞাসা করে নি। একদিন মোড়লই স্ব-ইচ্ছায় গ্রামবাসীকে জানিয়েছেন, ওই মেয়েটি উনার আত্নীয়। তাকে যেন কেউ বিরক্ত করার চেষ্টা না করে। মোড়লের নিষেধাজ্ঞা আছে তাই কেউ সেই সাহস দেখায় নি। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

অভিরাজ নিজেও সুনয়নাকে দেখে খুব অবাক হতো। যেমন দেখতে তেমন তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। তাছাড়াও ওর চোখজোড়ায় কিছু একটা আছে। বেশ আকর্ষণ করে। মুখ্য কথা, মেয়েটি চাইলেই পালাতে পারত। একবার না বহুবার। মোড়লের এক ভৃত্য তাকে পালাতে সাহায্য করতেও চেয়েছিল। যদিও সেই ভৃত্যকে মোড়লই পাঠিয়েছিলেন। তবে সুনয়না পালায় নি।
শুধু প্রাসাদের গোপন দরজার কথা জানতে চেয়েছিল। আর
মোড়ল নিজ স্বার্থে ওকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুনয়না উনার পুরো পরিকল্পনায় ভেস্তে দিয়েছে। সে যায় নি, বরং যাওয়ার কথা পুনরায় বললেই আবেশকে জানানোর হুমকি দিয়েছিল। এছাড়া অভিরাজের কথাও সে জানতো।
যদিও ওর কুকীর্তির কথা গ্রামবাসী এখনো জানে না। সে এতদিন বিদেশে নয় জেলে ছিলো। একজনকে খুনের দায়ে তার আড়াই বছরের জেল হয়েছিল। পুলিশকে টাকা খাইয়ে মাঝে মাঝে বাইরে বের হতো। অথচ মোড়ল সেকথা গোপন করে মিথ্যা রটিয়েছেন। ভাবনা ছেড়ে অভিরাজ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বিরবির করল,

-‘পাপ এবং পাপীতে চারপাশটা গিজগিজ করছে। সেখানে আমি ভালো হয়ে কী করব!

সুনয়নাকে না পেয়ে আবেশ পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল।
কোথায় নেই সে। আকাশটা কালো মেঘে ঘণিভূত। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। যেকোনো সময়ে বৃষ্টি নামতে পারে। এই অসময়ে কোথায় গেল সে? আবেশ উপায়ন্তর না পেয়ে ওর রুমে গেল। সেখানে একটা সাদা কাগজ ভাঁজ করে রাখা।
আবেশ সেটা খুলে দেখে,

শব্দকলির শঙ্খরাজ
স্বপ্নচারির ভাঙা তাজ।
বিভাবরীর সেই রঙ্গশালা
ক্ষরণ ঘটিয়ে ক্ষান্ত তারা।

-‘বিভীষিকা’-
-‘নূরজাহান আক্তার আলো’-
[০৪]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here