#একটি_রূপকথার_গল্প’১০’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
বাড়িতে ডাক্তার এসেছে। অথৈর জ্বর মেপে ওর জ্বর কমানোর জন্য ঔষধ দেওয়া হয়েছে। অথৈর জ্ঞান ফিরলেও জ্বরের ঘোরে কাউকে চিনল না সে৷ চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে রইল। আশরাফ হোসেন মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনেই স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন। মারজিয়া বুঝতে পারছে না হঠাৎ মেয়েটার এত জ্বর আসার কারণ কী! আরমান নিজেও অথৈর মাথার কাছে বসে আছে। সবকিছুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী করছে। সারাটা দিন আরমান অথৈদের বাড়িতে কাটাল। ঔষধের প্রভাবে বিকেলের দিকে অথৈর জ্বর কিছুটা কমেছে। সে দুর্বল শরীরে উঠতে চাইলে আরমান বারণ করল। অথৈ মানুষটাকে দেখল। এক দুপুরে কী হাল করেছে নিজের! সব সময় পরিপাটি থাকা লোকটাকে এখন কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অথৈ দুর্বল ঠোঁটে হাসল। জিজ্ঞেস করল,
~ বাবা কোথায়?’
~ এই ঘর থেকে মাত্র গেল।’
~ ফুপি?’
~ তিনি স্যারকে নিয়ে গেছেন। আপনার চিন্তায় স্যার নিজেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন।’
~ আপনি এখনও যাননি কেন?’
আরমান অথৈর চোখের দিকে চেয়ে দ্বিধাজড়িত গলায় বলল,
~ আপনার জাগার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন চলে যাব।’
~ হ্যাঁ যান।’ অথৈর মনে মনে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। মানুষ কাউকে ভালোবাসলে তার সামনে এসে এতটা অসহায় হয়ে যায় কেন?
~ যাব।’ আরমান মুখে যাব বললেও যাওয়ার কোন আগ্রহই দেখা গেল না তার মাঝে। সে আগের মতই বসে রইল। অথৈ বলল,
~ আপনাকে না নিষেধ করেছিলাম আমাদের বাড়িতে আসতে। তবুও আপনি এলেন যে!’
~ আমি না এলে আপনাকে কে নিয়ে আসত! আপনার যে জ্বর তা আমাকে জানাননি কেন অথৈ?’
~ জ্বর যে বুঝতে পারিনি। সামান্য গা গরম মনে হয়েছে।’
~ সামান্য গা গরম! সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। নিজেকে নিয়ে এতটা উদাসীনতা কেন অথৈ? আপনি জানেন যতক্ষন আপনার জ্ঞান ছিল না আপনার ফুপি কেমন ছটফট করেছে। আপনার বাবা নিজেও অসুস্থ হবার পথে। এই মানুষ গুলোকে কেন দুঃশ্চিন্তায় ফেলেন? এদের জন্য হলেও আপনার নিজের খেয়াল রাখা উচিত।’
অথৈ আরমানের দিকে চেয়ে মনে মনে বলল,
~ এখন থেকে আমার খেয়াল রাখার জন্য আপনি আছেন তো।’
অথৈকে রেখে আরমানের যেতে ইচ্ছে না করলেও কোন উপায় নেই৷ এখনও তাদের বিয়ে হয়নি। এটা এখনও তার শ্বশুরবাড়ি হয়নি যে আজ সে এখানে থেকে যেতে পারবে।
…..
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অথৈ ভালোই ছিল। কিন্তু রাতে আবার তার গা কাঁপানো জ্বর উঠল। জ্বরের তোপে অথৈ অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। দাঁতে দাঁত ঠকঠক করে বারি খাচ্ছে ওর। আশরাফ হোসেন, মারজিয়া দিশাহীন হয়ে পড়লেন। রাতেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আরমানও খবর পেয়ে চলে এসেছে।
বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে কিন্তু অথৈর সুস্থ হবার নাম নেই। ওর জ্বর কোনভাবেই ভালো হচ্ছে না। আজ পঞ্চম দিন সে হাসপাতালে ভর্তি আছে। আশরাফ হোসেন মেয়েকে কষ্ট পেতে দেখে এতটাই ভেঙে পড়েছেন তারও প্রেশার, ডায়াবেটিস কমে গিয়ে মেয়ের থেকে করুণ দশা। অথৈর যখন জ্বর ছাড়ে তখন তাকে দেখে সুস্থ মনে হয়। সে নিজেই সবাইকে বলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরেই আবার জ্বরে অচেতন হয়ে কাউকেই চিনে না। আরমান এই পাঁচ দিন হাসপাতালেই অথৈর পাশে কাটিয়েছে। অথৈর প্রতি ছেলেটার টান দেখে মারজিয়া আশ্চর্য হয়।
আরমান না ঘুমিয়ে পুরো রাত অথৈর খেয়াল রাখে। কখন ওর ঘুম ভেঙে যায়। মারজিয়া ছেলেটার মাথায় হাত রেখে স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন,
~ এবার তুমি রেস্ট নাও বাবা। নইলে তোমারও অসুস্থ হয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। তুমিও রোগী হয়ে গেলে আমি একা কীভাবে সবাইকে সামলাবো বলো।’
~ আমি ঠিক আছি মা।’
~ ঠিক আছো! এই কয়দিনে নিজের মুখটা আয়নায় দেখেছ একবার? দেখলে বুঝতে কী হাল করেছ নিজের। ঠিকমতো খাওয়া নেই। ঘুম নেই। বাড়ি যাও না। মাথার চুল, দাঁড়ি গোঁফে মুখের অবস্থা বেহাল অবস্থা হয়েছে। আজকের রাতটা আমি অথৈর কাছে থাকি৷ তুমি বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হও। ভালো করে খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দাও৷ কোন কিছুর দরকার হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব।’
আরমান অথৈকে রেখে যেতে নারাজ। নিজে যথেষ্ট শক্ত আছে সে৷ কয়টা দিন খাওয়া ঘুম বাদ দিলেও কিছু হবে না ওর। আরমান অনুরোধে গলায় বলল,
~ আজকের দিনটা আমি অথৈর কাছে থাকি মা, প্লিজ।’
~ না। তোমাকে আমি যা বলেছি তা করো। মায়ের অবাধ্য হতে নেই। শরীরটার একটু রেস্ট দরকার।’
না চাইতেও মারজিয়ার কথা রাখতে আরমান নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলো। সেই রাতে অথৈ একদম সুস্থ মানুষের মত উঠে ফুপিকে তার পাশে বসে ঘুমোতে দেখে ডাকল।
~ ফুপি। ফুপি।’
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল মারজিয়া। অথৈকে বসে থাকতে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেলল।
~ তুই আমাকে চিনতে পারছিস বুলবুলি! আমাকে ডাকছিস!’
অথৈ দুর্বল ভাবে হেসে বলল,
~ তোমাকে চিনব না কেন? আমার কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে?’
~ কয়টা দিন কী ভীষণ জ্বরে ভুগেছিস তুই জানিস না রে মা। আমাদের জান বের করে দিয়েছিলি। এরকম ভাবে কেন ভয় দেখালি আমাদের। তোর বাবা কান্নাকাটি করে আমার মেজাজ খারাপ করে দিত।’
~ আমি তোমাদের খুব কষ্ট দিয়েছি তাই না ফুপি?’
মারজিয়া অথৈর মাথায় চুমু খেয়ে ওকে বুকে টেনে নিল।
~ তুই আমাদের জান। তোর কিছু হলে আমরা কীভাবে বাঁচতাম বল তো!’
~ সরি ফুপি।’ অথৈর চোখ একজনকে খুঁজছে। মানুষটাকে দেখার জন্য তার চোখজোড়া তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। পুরো ঘর খুঁজে আরমানকে দেখতে পেল না সে। ক্ষীণ গলায় অথৈ জিজ্ঞেস করল,
~ আরমান কোথায় ফুপি?’
~ ওই পাগলের কথা জিজ্ঞেস করছিস! আরমান তো তোর বাবার থেকেও বেশি পাগল রে অথৈ। ও তোর ফুপাকেও পেছনে ফেলেছে। তোর কি কিছু মনে নেই? পাঁচ দিন ধরে এখানে আসিস তুই। এই পাঁচ দিনে পাঁচ মিনিটের জন্য আরমান তোকে ছেড়ে নড়েনি। রাতে যদি ওর চোখ লেগেছেও তুই কুঁই শব্দ করলেই হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠেছে। আজ আমি জোর করে ওকে বাড়ি পাঠিয়েছি। না ঘুমিয়ে, না খেয়ে থেকে নিজেও অসুস্থ হয়ে যেত। তুই ভীষণ ভাগ্যবতী রে বুলবুলি। আরমানের মত লাইফ পার্টনার যার হবে তার দুনিয়াই জান্নাত। তোর গাধা বাপটা মেয়ের জামাই বাছতে ভুল করেনি৷ ছেলেটা হীরের টুকরা। তোকে নিয়ে আমাদের আর কোন চিন্তা রইল না। তুই সঠিক মানুষের হাতেই পড়েছিস।’
….
আরও দু’দিন পর অথৈ বাড়ি ফিরল। পুরো সাতটা দিন হাসপাতালে কাটিয়েছে সে। অথৈর শরীর এখনও যথেষ্ট দুর্বল। একা একা হাঁটতে পারে না সে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মাথা ঘুরে যায়। অথৈকে কখনো ডায়েট করতে হয়নি। সে আগে থেকেই রোগা ছিল। এই জ্বরে তাকে আরও রোগা করে দিয়ে গেছে। সব গুলো জামা কেমন ঢোলা লাগছে। তার উজ্জ্বল গায়ের রঙ মলিন হয়ে গেছে। সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়া নেতিয়ে গেছে যেন। এবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সময় লাগবে অনেক।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অথৈর মাথাটা চক্কর দিয়ে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। আরমান তার পাশেই ছিল। ক্ষীণ গলায় অথৈ বলল,
~ বাবার প্রিয় ছাত্র, আমার হাতটা ধরবেন একটু?’
যে মেয়ে নিজের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না দু’দিন পর সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে কীভাবে?
অথচ নির্ধারিত ডেট অনুযায়ী দু’দিন পর অথৈর বিয়ে হবার কথা। সে অনুযায়ীই সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আজ কাল মেহেন্দি, হলুদ হবার কথা ছিল। কিন্তু অথৈর অসুস্থতায় সেসবের কিছুই হলো না। আশরাফ হোসেন ভাবছেন বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দিবেন। কার্ড বিলি করা হয়ে গেছে তাতে কী হয়েছে? আগে মেয়ের সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য। জীবনে একবারই বিয়ে হবে। এই বিয়েও কি অথৈ শুয়ে শুয়ে করবে নাকি! আরমানের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
আরমান প্রতিদিন নিয়ম করে অথৈকে দেখতে এলে অথৈ উপরে উপরে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেও আরমান একদিন না এলে মনে মনে সে কতটা অস্থির হয় তা শুধু সে-ই জানে।
~ এইযে ভালো ছাত্র, বাবা আপনার খোঁজ করছিলেন। আজ আসতে এত দেরি হলো কেন?’
~ কিছু কাজ ছিল।’
~ আপনি ব্যস্ত মানুষ। কাজ তো থাকবেই। আমিই শুধু বেকার। বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
~ স্যার কেন খোঁজ করছিলেন?’
~ দেখুন গিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিতে চাচ্ছে নাকি। বাবা ফুপিকে ওরকমই কিছু আলাপ করতে শুনলাম।’
আরমান ফ্যালফ্যাল চোখে অথৈর দিকে তাকাল। কথাগুলো কত সহজ ভাবে বলছে অথৈ। আরমান কি এখনও ওর মনে জায়গা করে নিতে পারেনি? আরমান বেশ গম্ভীর হয়ে অথৈর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,
~ এই বিয়েটা নিয়ে আপনার মতামত কি অথৈ? আমি স্যার বা মা’র কথা জানতে চাচ্ছি না। আমি আপনার সিদ্ধান্ত জানতে চাচ্ছি। আপনি যদি এখনও বিয়েটা করতে না করেন তাহলে এই মুহূর্তে আমি বিয়ে ভেঙে দেব। এবং এজন্য আপনার উপর মোটেও রাগ করব না। স্যারকেও যা বলার আমিই বলব। কারো কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না। আমার কথা বা কারো কথা ভাববেন না। আপনি শুধু এটা ভেবে উত্তর দিন, আমার সাথে কি বাকিটা জীবন কাটাতে চান আপনি? প্লিজ অথৈ, আপনার উত্তরের উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে।’
চলবে_
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/928548141001685/