একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-১১

0
234

#একটি_রূপকথার_গল্প’১১’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

আরমান খোলা সমুদ্রের দিক মুখ করে জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় বিশাল নীল জলরাশি। একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। আরমান প্রায় সমুদ্রে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটি দেখে। সমুদ্র জীবনে এই একটা জিনিসই তার ভীষণ প্রিয়। সমুদ্রের বুকে সন্ধ্যা নামতে দেখে তার মন শান্ত হয়। আজ তার মনট বিশেষ ভালো নেই। প্রিয় একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। আরমান ভাবে, আগেই তো ভালো ছিল। কোন পিছুটান ছিল না। বাড়ির কথা মনে পড়ে মন খারাপ হতো না। তখন পুরো বছরটাও সমুদ্রে কাটিয়ে দিতে পারত সে। কারণ তীরে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই এটা জানত সে। এখন গল্পটা একটু ভিন্ন। সারাদিন এই কয়েকটা চেনা মুখ দেখেও মনের পর্দায় আরও কয়েকটা প্রিয় মুখ ভেসে উঠে। দিন শেষে ওই মানুষ গুলোর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সামনে থেকে দু’টি চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে। আরমানের খুব শখ অথৈকে একদিন সমুদ্রে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা দেখাবে। নিজের ভালোলাগা গুলো প্রিয়জনের সাথে ভাগ করে নিলে সেই ভালো লাগা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আরমান অথৈকে পাশে নিয়ে সমুদ্রে দীর্ঘ একটা পথ পারি দিবে। কিন্তু তার প্রিয়তমা তো পাহাড় প্রেমী। সমুদ্র নাকি তাকে টানে না। আরমান হাসল। এইবার ফেরার পর তার মধ্যে বিশাল পরিবর্তনটা সবার চোখে পড়েছে। ইতোমধ্যে বন্ধুরা মজা করতে শুরু করে দিয়েছে। উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভেসে চলছে আজ চার দিন। চার দিন আগেই ফিরেছে সে। সেই রাতে তার করা প্রশ্নে অথৈর উত্তর শুনে আর কোন সংশয় রইল না তার মনে। আরমান এখন জানে অথৈও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা ভালোবাসার কথা মুখে বলতে চায় না কেন? আরমান মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল অথৈ যদি সত্যিই তাকে পছন্দ না করে তাহলে বিয়েটা ভেঙে দিবে সে। অথৈকে জোর করে কোন সম্পর্কে বাঁধবে না। কিন্তু অথৈ সেদিন উত্তর দিয়েছিল,

“আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমি।”

তার প্রশ্নের এটা তো উত্তর হতে পারে না। আরমান তখন না বুঝলেও পরে স্যারের কথা শুনে অথৈর উত্তরটা ঠিকই বুঝেছিল। স্যার চাইছে না বিয়েটা এইবার হোক। অথৈও অসুস্থ। আরমানের ছুটির বেশি দিন নেই। তাই তারা বিয়ে পিছিয়ে দেওয়াই ঠিক মনে করল। অথৈ এইজন্যই বলেছে, ‘আপনার জন্য অপেক্ষা করব আমি।’
…..
আরমানকে কি সে ভালোবাসে? এটাকে ভালোবাসা বলে? কে জানে। সে তো কখনও কাউকে ভালোবাসেনি। তাহলে কীভাবে বুঝবে এটাই যে ভালোবাসা। অথৈ না বুঝলেও বাকি সবাই বুঝতে পারছে অথৈ আগের মত নেই। মারজিয়া তো সেদিন বলেই ফেলল,

~ তোর কী হয়েছে আমাকে বল তো বুলবুলি।’

অথৈ ফুপির কথায় অবাক হয়ে বলেছে,

~ আমার আবার কী হবে!’

~ সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।’

~ কিছুই হয়নি।’

~ কাকে বোকা বানাচ্ছিস? নিজেকে নাকি আমাদেরকে?’

~ দূর ফুপি, কথা পেঁচিও না তো।’

~ বিয়েটা তো আমরা ভেঙে দিইনি। শুধু সময়টা পিছিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে তা করেও ভুল করেছি। তুই তো বিরহে বেদনায় দেবদাসের ফিমেল ভার্সন দেবদাসী, দেবদাসী হবে নাকি দেবদাসনী শিওর না অবশ্য। তবুও সেটাই হয়ে গেছিস।’

ফুপির কথায় অথৈ ঘোর প্রতিবাদ জানাল। বলল,

~ ইশ! কী ধারণা তোমার! ওই লোককে বিয়ে করার জন্য যেন আমি মরে যাচ্ছি! তোমার পাতানো ছেলে এতটাও রসগোল্লা না। ওকে কে বিয়ে করবে? বিয়েটা না পিছিয়ে একেবারে ভেঙে দিলেই ভালো হতো। ওরকম হ্যাংলা ছেলেকে আমার বর হিসেবে লাগবে না। এখানে থাকতে সারাদিন আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকত। ঘর জামাই হওয়ার মনে হয় অনেক শখ।’

মারজিয়া অথৈর কথা শুনে হাসে। কিছু বলে না। মেয়েটা এমন কেন? ভাঙবে তবুও মচকাবে না টাইপ। মেয়েরা হবে সহজসরল তুলোর মত নরম। এই মেয়ে সবার থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্য যত উদ্ভট কাণ্ড করে। আরমানকে যে ও মনে মনে কতটা চায় তা কেউ না বুঝলেও মারজিয়া ঠিকই বুঝে।

আরমানের সাথে অথৈর খুব কম কথা হয়৷ মাঝে মধ্যে এক দু’দিন। সেটাও তিন চার মিনিটের বেশি না। লোকটার সাথে কথা বলার পর তার আর কোনকিছু ভালো লাগে না। কোন কিছুতেই মন বসতে চায় না। কারণ ছাড়া মনটা কেমন বিষণ্ণ লাগে। তখন তার সবথেকে প্রিয় কাজ যেটা সেটাও করতে ইচ্ছে করে না। তাই অথৈ ঠিক করেছে এই দু-একদিন তিন চার মিনিটের কথা বলাও বন্ধ করে দিবে। একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। একটা মানুষ যে তার থেকে কতশত মাইল দূরে বসে আছে তার কথা মনে পড়ে নাকি অথৈর দিনটা বিষন্ন যায়৷ রোজকার রুটিন পাল্টে যায়৷ কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার!
….
ক’দিন বাদে অথৈর পরীক্ষা। তৃতীয় বছর শেষ করে চতুর্থ বর্ষে উঠবে৷ এটাই ফাইনাল ইয়ার৷ তারপর ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাবে। এই কয়দিন পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। আরমানের ভাবনা মাথায় এলেও জোর করে তাড়িয়ে দিয়ে পড়াশোনার কথা ভাবতে লাগল। আরমান নিয়ম করে তাকে কল দেয়। অথৈ মাঝে মাঝে তুলে মাঝে মাঝে দেখেও এড়িয়ে যায়। লোকটা সত্যিই জাদু জানে। প্রথমে তার বাবা পরে তার ফুপি৷ আর এখন তার উপরও লোকটার জাদুর প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে।

~ আপনি যত বড় জাদুকরই হোন না কেন, অথৈ আশরাফও কঠিন চিজ।’

অথৈর পরীক্ষা বেশ ভালো হলো। শেষ পরীক্ষার দিন বন্ধুদের সাথে খেতে গেল। সেখানে গিয়েও শান্তি নেই ওর। সবার মুখে আরমানের কথা। সে যে লোকটাকে ভুলে থাকতে চায় তাকেই সবাই তার কথা মনে করিয়ে দেয়।

~ কিরে অথৈ, আমাদের জামাই বাবা জীবনের খবর কী?’

~ নাম্বার নিয়ে নিজেই জেনে নে।’

~ এরকম চেতে উঠছিস কেন? ঝগড়া টগড়া হয়েছে নাকি?’

প্রাপ্তি ফোনে মনোযোগ রেখে অথৈকে বলল,

~ এই তোর জামাইয়ের ফেসবুক আইডি দে তো। ফ্রেন্ড রিকু পাঠাই।’

প্রাপ্তির গালে ঠাস করে এক চড় দিতে ইচ্ছে হলো অথৈর। ওদের বিয়ে কবে হয়েছিল সে যে মানুষটাকে তার জামাই বানিয়ে ফেলেছে৷ কিন্তু অথৈ কিছু বলার আগেই মিনহা বলল,

~ জামাই আর হলো কই! বিয়েটাই তো পিছিয়ে গেল। তোর জ্বর হওয়ার আর সময় পেল না। আমাদের সব প্ল্যান বরবাদ হলো। কই ভেবেছিলাম সেজেগুজে তোর বিয়েতে গিয়ে ছেলে পটাব। সেখানে কী হলো? ফল-ফলান্তি নিয়ে রোজ রোগী দেখতে হাসপাতালে গেছি।’

~ আরমান কবে আসবে রে অথৈ? আর তো অপেক্ষা সহ্য হয় না। তোর বিয়ের জন্য যে শপিং গুলো করেছিলাম তা আলমারিতে ইঁদুরে খাচ্ছে হয়তো।’

অপেক্ষা! অথৈ সে রাতে আরমানের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু তার অপেক্ষা যে এতটা দীর্ঘ হবে তা কে জানতো। ছয় মাস কেটে গেছে। এখনও তার অপেক্ষা শেষ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। লোকটা কি ইচ্ছে করে তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে? নিক। সে-ও তো কম যাচ্ছে না। মাসে একদিন কল তুলে। তবুও কত ব্যস্ততা দেখায়। শোধ তো সে-ও নিচ্ছে।
প্রাপ্তি বিরক্তি মাখা গলায় বলে যাচ্ছে,

~ ছাতা এজন্যই আমি ঠিক করেছি বিয়ে করলে বেকার একটা ছেলেকেই করব। কালেভদ্রে জামাইকেই যদি কাছে না পাই তাইলে টাকা দিয়ে কী করব! বাবা সেদিন বলছিল, কেমন ছেলে আমার পছন্দ। আমিও বলে দিয়েছি, আমার জন্য কোন বেকার ছেলে খোঁজ। যার কোন কাজকর্ম থাকবে না। সারাদিন বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরবে।’

প্রাপ্তির কথা শুনে মিনহা হো হো করে হাসছে। ওকে হাসতে দেখে প্রাপ্তি রেগে বলল,

~ ছাগলের মত হাসছিস কেন? ভুল কিছু বলেছি নাকি আমি! আরমানকেই দেখ না। বেচারা সেই যে গেল, মাঝে অথৈর জন্মদিন গেল আসতে পেরেছে সে?’

অথৈ অন্যমনস্ক ছিল। প্রাপ্তির শেষের কথাগুলো শুনে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
প্রাপ্তির কথাগুলো এখনও কানে বাজছে অথৈর। বাবা তাকে অনেকবার খাওয়ার জন্য ডেকেছে। অথৈ ডাইনিংয়ে যায়নি। বাবাকে আজ একাই খেয়ে নিতে বলেছে। তার মাথা ব্যথা করছে শুনে বাবা ঘরে এসে দেখে গেছে। ঘরটর অন্ধকার করে বসে আছে সে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার। অনেকক্ষণ বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু আগে শুতে গেল। কাজের মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দরজার কপাটে বারি খেল।

~ অথৈ আপা! ও আপা…

বিরক্ত হলো অথৈ। এই মেয়েটাকে কোনদিন যেন ঘাড় ধরে বিদায় করে দেয় অথৈ। মেয়েটা তার সব কথাই শুনে। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে! এইযে ঘোড়ার মত এসে দরজায় বারি খেলি ব্যথাটা কে পেয়েছে?

~ তোর সমস্যা কি টিয়া! জানের উপর থেকে মায়া উঠে গেছে তোর?’

~ আপা ভাইজান আইছে।’

ভাইজান! অথৈর বুকটা চিনচিন করে উঠল। এই মেয়ের ভাইজান মানেই তো আরমান। তাহলে কি আরমান এসেছে! কিন্তু এত রাতে, আর ও যে আসবে এটাও তো অথৈকে বলেনি। অথৈ খুব করে চাচ্ছে মানুষটা যেন আরমানই হয়। তবুও টিয়ার কাছে জানতে চাইল,

~ কোন ভাইজান?’

~ দুলা ভাইজান। নিচে গিয়া দেহেন। আমার মনে হয় ভাইজান আপনারেই দেখতে আইছে। তাড়াতাড়ি যান।’

অথৈর ইচ্ছে করছিল এক ছুটে আরমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু মনের সব আগ্রহ কৌতূহল খুশি চেপে রেখে টিয়ার সামনে এমন একটা ভাব করল যেন এত রাতে আরমানের এখানে আসাতে ভারি বিরক্ত হয়েছে সে। অথৈ শোয়া থেকে উঠে ওড়নাটা টেনে নিয়ে কোনরকম চঞ্চলতা না দেখিয়ে টিয়ার আগে আগে হাঁটছে। তার মনের ভেতর যে খুশির জোয়ার কী ভীষণ বেগে বইছে তা শুধু সে আর তার আল্লাহই জানেন। কতগুলো মাস পর মানুষটাকে চোখের সামনে দেখবে অথৈ!

চলবে_
গ্রুপ লিংক
https://facebook.com/groups/928548141001685/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here