#একটি_রূপকথার_গল্প’৬’
#জেরিন_আক্তার_নিপা
আরমান যে চলে গেছে এটা অথৈ জানতো না। সেদিন ফুপির বাড়িতেই রাতে থেকে গেছিল। লোকটা তার সব শর্ত মেনে তাকে বিয়ে করতে রাজি! কেন? বিয়েটা কি উনাকে করতেই হবে? কোন দায় আছে নাকি। বাবার ছাত্র বলে! অথৈর এলোমেলো ভাবনা গুলো ফুপি অনেকটা গুছিয়ে দিল।
~ ছেলেটার সাথে ওরকম ব্যবহার করা কি খুব দরকার ছিল?”
~ কোন রকম ব্যবহার! আমি আবার কী করেছি?”
~ আরমান আমাকে মা ডাকলে তোর তো কিছু কম পড়বে না। তোর জন্য আমার ভালোবাসা একইরকম থাকবে।”
~ তবুও ওই লোক কেন তোমাকে মা ডাকবে? ওর নিজের মা নেই। তুমি শুধু আমার ফুপি।”
মারজিয়া অথৈর পাশে বসল। অথৈর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে স্নেহের পরশ বোলাতে বোলাতে বলল,
~ তুই তো এখন বড় হয়েছিস। যা তোর তা তোরই থাকবে। কেউ চাইলেও তা এত সহজে তোর থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। আরমানের সম্পর্কে তুই কিছুই জানিস না। কেন রে? ছেলে হিসেবে ও কি কারো থেকে কম? সুদর্শন সুপুরুষ। আচার ব্যবহারে আভিজাত্যের ছাপ। একটা ভালো জবও আছে। তোর ওকে ভালো না লাগার কারণ কী?”
~ জানি না। কিন্তু উনি যেদিন থেকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছে ওইদিন থেকেই উনাকে আমার বিষের মত লাগে।”
মারজিয়া ভাইঝির কথা শুনে কিশোরীদের মত শব্দ করে হেসে ফেলল।
~ আচ্ছা, তোর ফুপাকে তোর কাছে কেমন লাগে?”
~ফুপা একজন চমৎকার মানুষ। আমার দেখা খুব কম সংখ্যক ভালো মানুষের মধ্যে ফুপাকে এক নাম্বারে ফেলা যায়।”
~ তোর এই চমৎকার মানুষটাকেও কিন্তু একসময় আমার একটুও ভালো লাগতো না। ও যখন আমার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে দিনের পর দিন আমার পেছনে ঘুরত, তখন আমার মনে হতো ওকে আমি খুন করে ফেলি। একটা মানুষ এতটা বেহায়া কেন হবে? আমার তো ওকে ভালো লাগে না। ওর আমাকে ভালো লাগলেই এভাবে আমার পেছন পেছন ঘুরতে হবে। আমি যে ওকে এত অপমান করি তাতেও ওর লজ্জা হবে না কেন? আমার উপর জেদ কাজ করবে না কেন?”
~ মাই গড ফুপি! ফুপাকে তুমি এভাবে অবহেলা করেছ! কেন?”
~ কেন সেই কারণ তো আমিও জানতাম না। কিন্তু তোর যেমন আরমানকে কোন কারণ ছাড়াই পছন্দ না। তেমনি আমারও তোর মতই কোন কারণ ছাড়াই তোর ফুপাকে পছন্দ হতো না।”
~ তাহলে তোমাদের বিয়েটা কীভাবে হলো?”
~ ওই চালাক লোক তোর দাদুকে হাত করে নিয়েছিল।”
~ যেমনটা আরমান করেছে!”
মারজিয়া হেসে বলল,
~ হ্যাঁ। কিছুটা এমনই। কিন্তু পুরোপুরি না। বিয়ের পর শুনেছি, তোর ফুপা নাকি আমার বাবার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমাকে ছাড়া ও বাঁচবে না। ওর জীবনে আমাকেই লাগবে। যতক্ষণ আব্বা রাজি না হয়েছে ততক্ষণ পা ধরে বসেই ছিল। ওকে মেয়েমানুষের মত কাঁদতে দেখে তোর দাদার মন গলে গেল। সেদিন রাতেই মৌলবি এসে আমাদের বিয়ে পড়াল। আমার বাবার বাড়িতেই আমাদের বাসরঘর সাজানো হলো। বিয়ের রাতেই ভদ্রলোককে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমি যে দরজা আটকে বসেছিলাম, তোর দাদুর উপর রাগ করে যাতে আর ওই লোকটাকেও দেখতে না হয়, টানা তিন দিন আর দরজা খুলিনি। এই তিনদিন তোর ফুপা এক সেকেন্ডের জন্য আমার ঘরের দরজার সামনে থেকে নড়েনি।”
অথৈ হতভম্ব হয়ে ফুপির কথা শুনছে। ওর মুখ হাঁ হয়ে গেছে। ফুপির পক্ষে ও তো এখনও কিছুই করেনি। তারও তো তাহলে তিনদিন ঘরের দরজা আটকে রেখে বাবাকে শায়েস্তা করা উচিত। কিন্তু ফুপির তো বিয়ে হয়ে গেছিল। তার তো এখনও হয়নি। ঠিক আছে, ওই লোকের সাথে বিয়ে হলে অথৈও এমনই করবে।
~ যেই মানুষটাকে পছন্দ না বলে আমি এতকিছু করেছি, আজ ত্রিশটা বছর ধরে ওই লোকের সাথেই সংসার করছি। আর সবথেকে মজার কথা কী জানিস অথৈ? বিয়ের রাতে যাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম, এই ত্রিশ বছরে একটা রাতও তাকে ছাড়া দূরে কোথাও গিয়ে থাকিনি৷ এমনকি নিজের বাবার বাড়িতেও না।”
অথৈর ফুপা ফুপির গল্প শুনে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। ফুপাকে দেখে বোঝা যায়, ফুপির জন্য কী পাগলামিই না করেছে তিনি! আর ফুপিও তো ফুপাকে কোন অংশে কম ভালোবাসে না।
~ আমাদের যাকে পছন্দ না একটা সময় সে-ই আমাদের খুব আপন হয়ে যায়। তাকে ছাড়া তখন থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে।”
~ ফুপা তোমার জন্য এতসব পাগলামি করেছে!”
~ ওর পাগলামি আরও কিছু নমুনা শুনলে তুই নিশ্চিত মানুষটাকে পাগল বলবি। কিন্তু আমার কাছে ওর এসব পাগলামিই আমার জন্য ওর ভালোবাসার প্রকাশ।”
~ ফুপাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না ফুপা এসব করতে পারে। বা করেছে।”
~ আরমানও তোর জন্য কী কী করে দেখতে পারবি। ওর চোখেও আমি ঠিক তোর ফুপার মতই পাগলামি দেখেছি। তোর ফুপা আমাকে যতটা ভালোবাসে ঠিক সেই একই রকম ভালোবাসা আমি আরমানের চোখে তোর জন্য দেখেছি।”
অথৈ কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইল না। ফুপি তাকে বিয়েতে রাজি করাতে এসব বলছে।
~ আরমানকে অবহেলা করে দূরে ঠেলে দিস না। ওর মত করে তোকে আর কেউ চাইবে না। ও তোর সব পাগলামি হাসি মুখে সহ্য করে নিবে।”
~ তুমি কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেলে!”
~ আরমানকে সারাজীবন আমি আমার ছেলে করে রাখতে চাই। ওর কেউ নাই রে অথৈ। বাবা মা ভাই বোন কেউ না। এই পৃথিবীতে ও সম্পূর্ণ একা। ওর জীবনে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন যে ওর মুখে হাসি ফুটানোর কারণ হবে। আমি জানি তুই সেই ব্যক্তি হতে পারবি।”
….
ফুপির কথাগুলো পুরো একটা সপ্তাহ মাথা থেকে বেরোয় নি। অথৈ যা-ই করেছে সারাক্ষণ শুধু ফুপির বলা কথাগুলোই কানে বেজেছে। লোকটা তাকে ভালোবাসে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের মাত্র দুই দিনই তো দেখা হয়েছে। এই একটু দেখাতে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? এক সপ্তাহ পর এক রাতে আরমানের কল আসে। নাম্বারটা সেভ করা ছিল না। তাই অথৈ চিনতে পারেনি। না চিনেই সে বলল,
~ কে?”
~ আমি আরমান।”
মানুষটার কন্ঠ শুনে অথৈর বুকের ভেতর কি কিছু হলো? কেমন একটা অনুভূতি। অথৈ ঠিক বুঝতে পারল না।
~ কেমন আছেন অথৈ?”
~ ভালো।” অথৈ এখনও ধাতস্থ হতে পারছে না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। ওপাশে আরমান অপেক্ষা করছে অথৈও তাকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু অথৈ করছে না দেখে সে-ই বলল,
~ কী করছিলেন?”
~ কিছু না। আপনি এখন কোথায় আছেন?” কথাটা জিজ্ঞেস করেও অথৈ ভাবল, দূর কী দরকার ছিল এটা জিজ্ঞেস করার। আরমান এপাশে নিঃশব্দে হাসল।
~ জাহাজে। সমুদ্রের বুকে। সমুদ্র আপনার কেমন লাগে অথৈ?”
~ সমুদ্র আমাকে তেমন টানে না। আমি পাহাড় প্রেমী। পাহাড় আমাকে সবসময় দু’হাত বাড়িয়ে ডাকে। আমার মাঝে মাঝে পাহাড়ের বুকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।”
আরমান ভেবেছিল আজও হয়তো অথৈ তার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু না, অথৈ সেই প্রথম দেখার মত আজও বেশ সহজ ভাবে কথা বলছে তার সাথে। তাহলে কি অথৈ তার ব্যাপারে নিজের মতামত চেঞ্জ করেছে! বিয়েটা করবে ও!
অনেকটা সময় দু’জন নীরব থাকল। বলার মতো কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আরমান অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না।
~ রাখি অথৈ, পরে কথা হবে।”
…..
আরমান ঠিক তিন মাস পরে ফিরল। এই তিন মাসে অনেকবারই অথৈর সাথে তার কথা হয়েছে। কিন্তু অথৈ তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। কোনদিনও কেমন আছেন, কী করছেন, খেয়েছেন? এর পরে আর কথা এগোয়নি। আরমান ফিরে এসে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে না গিয়ে সোজা অথৈদের বাসায় চলে এসেছে। এসে জানতে পারল অথৈ বাড়ি নেই। তার ফ্রেন্ড মিনহার বাসায় গেছে। আশরাফ হোসেন আরমানকে দেখে ঠিক বুঝতে পারলেন ছেলেটা এখনও বাড়ি যায়নি। ফ্রেশ হয়নি এমনকি কিছু খায়ওনি। এই পাগল ছেলে কি তার মেয়েকে দেখার জন্য ছুটে এসেছে!
~ আমি তোমার কাপড়ের ব্যবস্থা করছি। তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও।”
আরমান ফাঁসির আসামির মত অপরাধী মুখে স্যারের চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল,
~ আমি বরং চলে যাই স্যার। পরে একদিন আসব।”
এখানে আসার আগে সে কিছুই ভাবেনি। কিন্তু এসে এখন লজ্জা লাগছে। স্যার তার সম্পর্কে কী ভাবছেন কে জানে! আশরাফ হোসেন প্রিয় ছাত্রের ক্লান্তিমাখা মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বললেন,
~ আমার মেয়ের জন্য এরকম একটা পাগলই আমি চেয়েছিলাম। যা পেয়েও গেলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার মেয়েটাকে সুবুদ্ধি দান করুক। অথৈ যেন এই হীরের টুকরোর মূল্য বুঝতে পারে।”
~ আমি আজ চলে যাই স্যার।”
আশরাফ হোসেন এবার খানিকটা শক্ত গলায় বললেন,
~ আমি তোমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি?”
আরমান বেচারা লজ্জায় এবার কেঁদে ফেলবে মনে হয়। স্যার হয়তো ভাবছে, এ কেমন নির্লজ্জ ছেলে! এখনও বিয়ে ঠিক হয়নি আর এই ছেলে আমার বাড়িকে অলরেডি শ্বশুরবাড়ি ভেবে বসে আছে। বিয়ের কথা উঠেছিল, সে রাজি হলেও অথৈ অমত জানিয়েছে। এই তিন মাসে স্যার কিন্তু একবার বলেনি, তুমি এলে বিয়ের ডেট ঠিক করব। স্যার হয়তো মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে চাচ্ছে না। না, আজ এখানে আসাটা তার উচিত হয়নি। আশরাফ হোসেন ফোনে অথৈকে বাড়ি ফিরতে বললে অথৈ রেগেমেগে আগুন হয়ে গেল।
~ বাড়ি ফিরব মানে কী? আমি তোমাকে বলে আসিনি আজ মিনহাদের বাড়িতে থাকব! ওর জন্মদিন আজ। বাড়িতে কী এমন জরুরি কাজ পড়েছে যে আমাকে আমার বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি ফেলে যেতে হবে।”
~ আরমান এসেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
~ হ্যাঁ! কে এসেছে?”
চলবে…
গ্রুপ লিংক
https://facebook.com/groups/928548141001685/