একটি রূপকথার গল্প’ পর্ব-৩

0
365

#একটি_রূপকথার_গল্প’৩’
#জেরিন_আক্তার_নিপা

অথৈকে কেউ যেন আসমানের উপর থেকে জমিনে ছেড়ে দিল। সে টপ করে জমিনে পড়ে তব্দা খেয়ে আছে। বাবা কী খেয়ে এসে এমন আবোলতাবোল বলছে! লোকটা কী করে বিয়েতে রাজি হবে? আশরাফ হোসেন মেয়েকে লক্ষ করে দেখলেন। কোন একজন অচেনা মানুষকেও প্রথম বার দেখে মনের কথা বলে দিতে পারেন তিনি। আর অথৈ তো তার নিজের মেয়ে। বাইশটা বছর ধরে চোখের সামনে দেখে আসছেন। ওকে রগে রগে চেনা আছে। নিশ্চয় আরমানোর সাথে দেখা করতে গিয়ে এমন কিছু করে এসেছে যাতে আরমান নিজেই বিয়েতে না করে দেয়। কিন্তু আরমান না করার বদলে হ্যাঁ করেছে বলেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

~ মনে হচ্ছে তুমি ওর থেকে অন্য কোন উত্তর আশা করছিলে। ওর এই উত্তরে তুমি খুশি হতে পারছ না।”

~ তুমি চাও আমি এখন খুশিতে ধেইধেই করে নাচি?”

~ নাচবে কেন? কিন্তু মুখটাকে এমন করে রেখেছ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি খুব খারাপ একটা সংবাদ শুনলে।”

~ তোমার জন্য এটা সুসংবাদ হলেও আমার জন্য দুঃসংবাদই।”

অথৈ রেগে বোম হয়ে গটগট করে রুমে চলে গেল। আশরাফ হোসেন হেসে ফেললেন। অথৈর চাল তার উপরই ভারী পড়ে গেছে। ভেবেছিল নিজে কিছু না করে আরমানকে দিয়ে কাজ আদায় করে নিবে। কিন্তু ছেলেটার বুদ্ধি আছে।

~ আমার মেয়ের ফাঁদে পা না দিয়ে প্রথম পরীক্ষায় তুমি ফুল মার্কে পাস করে গেছ।”

রুমে এসে অথৈর ইচ্ছে করছে বাথটাব ভর্তি বরফ কুচি দিয়ে পুরো এক ঘন্টা শুয়ে থাকতে। সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলছে তার। লোকটা কী পরিমাণে অসভ্য! এত করে বলে আসার পরেও এরকম একটা বদমায়েশি করতে পারল! অথৈ পায়ে জোরে জোরে শব্দ করে ঘরময় পায়চারি করে যাচ্ছে।

~ লোকটা একটা ফাজিল। একটা অসভ্য। মানুষকে বাইরে দিয়ে দেখে ভেতরটা বোঝা যায় না। দেখতে সভ্য হলেও কাজকর্মে মীরজাফরের বংশধর। শালা হারামি করলোটা কী হ্যাঁ!”

বাবার স্টাডিতে এসে থমথমে মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। আশরাফ হোসেন মেয়েকে দেখে ডাকলেন। অথৈ ভেতরে এলো।

~ ওই লোকের ফোন নাম্বার দাও।”

আশরাফ হোসেন ঠিক বুঝতে পারলেন না অথৈ কোন লোকের কথা বলছে। কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে তিনি বললেন,

~কোন লোকের কথা বলছ?”

~নাটক কোরো না। তুমি জানো না কোন লোকের কথা বলছি? তোমার আদরের ছাত্রের।”

আশরাফ হোসেন তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে দেখলেন। আরমানের ফোন নাম্বার চাইছে কেন ও! কী করতে চাচ্ছে অথৈ? অথৈ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফ হোসেন মেয়েকে কোন প্রশ্ন করলেন না। আরমানের নাম্বার দিয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটাকে কল করে জানিয়ে দেওয়া উচিত। পরক্ষণে ভাবলেন, না থাক। অথৈকে ওর নিজেরই হ্যান্ডেল করতে দেওয়া উচিত। বাবার হাত থেকে ছোট্ট কাগজের টুকরোটা নিয়ে ওতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল অথৈ। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

~ ধন্যবাদ।”

সাথে সাথে ফিরে দাঁড়িয়ে যেতে লাগল অথৈ। আশরাফ হোসেন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে মেয়ের যাওয়ার দিকে দেখছেন। অথৈর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি ছিল! আরমানের সাথে কী করতে চাচ্ছে ও। এবার সত্যি সত্যিই চিন্তিত হলেন তিনি। মেয়েকে তিনি যতটা চিনেন তাতে অথৈ নিজের কথা মানানোর জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। আর পাগল মেয়ে ওসব উল্টাপাল্টা কাজ করার আগে একবার ভাববেও না।

রুমে এসে অথৈ থুতনি চুলকাতে চুলকাতে ভাবছে আগে কার সাথে কথা বলবে। ওই লোকটাকে আগে টাইট করবে? নাকি ফুপির সাথে কথা বলবে। ফুপিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে একবার হাত করতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। ফুপিই ব্যাটাকে দিনে তারা দেখিয়ে দিবে।
অথৈ প্রথমে আরমানের নাম্বারে ট্রাই করল। ফোন বিজি বলছে। চোখ মুখ কুঁচকে ফোনের দিকে দেখল সে।

~ কার সাথে কথা বলছে লোকটা!”

পরপর কয়েকবার কল দিতেই থাকল। যতক্ষণ না ধরবে ততক্ষণ দিতে থাকবে। আজ ফোনেই একটা দফারফা করে ছাড়বে। অসভ্য বদমাশ লোক তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে! কত বড় সাহস।

~ আমাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিস, না? আমি তোকে এমন শাদীকা লাড্ডু খাওয়াব, ডায়েবিটিস হয়ে মরবি তুই শালা হারামি।”
……
আরমনা তার বন্ধু রাশেদের সাথে কথা বলছিল। অননোন নাম্বার থেকে কল আসছে দেখেও সে তেমন একটা পাত্তা দিল না। আজকের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোই রাশেদকে বলছে। রাশেদ ফোনের ওপাশে আগ্রহে ফেটে পড়ছে।

~ তারপর কী করলি তুই?”

আরমান ফোঁস করে দম ফেলল। বলল,

~ কী আর করব! অথৈকে পছন্দ না হলেও আমি স্যারকে মানা করতে পারতাম না।”

~ কিন্তু মেয়েটা তোকে মুখের উপর বলেছে তোকে ও বিয়ে করবে না।”

~ তা বলেছে। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করার মত কোন কারণ নেই ওর কাছে। অথৈ আমাকে না, ও এই মুহূর্তে কাউকেই বিয়ে করবে না।”

~ যাক দোস্ত শেষ পর্যন্ত তাহলে তোরও একটা গতি হয়ে গেল।”

আরমান বাম হাতের উপর মাথা রেখে সিলিঙের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। আজ সকালে স্যার জানিয়েছে বিয়ের আগে অথৈর সাথে যেন একবার দেখা করে নেয়। বিয়েটা সারা জীবনের ব্যাপার। বিয়ে দু’জন মানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে। অথৈকে তার জেনে নেওয়া প্রয়োজন। দু’জনের মতের মিল হলে তবেই রাজি হওয়া উচিত। আরমান স্যারের কথা মতই দুপুরে অথৈর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সে নির্ধারিত সময়েই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু অথৈর আসার নামগন্ধ নেই। দশ মিনিট থেকে বিশ মিনিট তারপর আধা ঘণ্টা কেটে গেল। তবুও অথৈ আসছে না দেখে আরমান উঠে পড়ার কথা ভাবছিল। অথৈ হয়তো আসবে না। কিন্তু তখনই সে একটা মেয়েকে রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে। সে এতক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করছে এই মেয়েই সেই মেয়ে কিনা তার জানা নেই। কিন্তু মেয়েটার দিকে সে তাকিয়েই রইল। চোখ সরাতে পারল না। অথৈর হাত থেকে পার্স পড়ে গেলে সে ঝুঁকে তুলে নেওয়ার সময় একগোছা চুল অবাধ্য হয়ে মুখের উপর এসে পড়ে। সোজা হতে হতে ডান হাতের আঙুল গুলো চিরুনীর মত চালিয়ে চুলগুলোকে পিছনে নিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে সবগুলো টেবিলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছে মেয়েটা। আরমান ভাবল এটাই হয়তো সে মেয়ে যার জন্য অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু শিওর হতে পারল না সে। অথৈ ঠোঁট কামড়ে লোকটাকে খুঁজছে। এখানে আসবে শুনে বাবা তাকে লোকটার ছবি সেন্ড করেছিল। হ্যাঁ ওই তো লোকটা। কোনার একটা টেবিলে বসে আছে। লোকটাও তাকেই দেখছে। অথৈ সোজা এই টেবিলে চলে এলো। আরমানের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল,

~ আপনিই কি মিস্টার আরমান আবরার?”

~ জি।”

~ আমি অথৈ আশরাফ।” বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসে পড়ল অথৈ। পার্স থেকে ছোট্ট একটা ক্লিপ বের করে সামনের ছোট চুলগুলোকে পেছনে নিয়ে আলগা করে আটকে দিল। ওই মুহূর্তেই আরমান কাত হয়ে গেল। এই বিয়েতে না করার কোন প্রশ্নই আসে না। যে মেয়েকে সে প্রথম দেখায় মন দিয়েছে সারাজীবন তাকেই পাশে পেতে চায়। অথৈ যখন বলছিল, আপনাকে আমার পছন্দ না। তখন তার ভেতরে কেমন যেন একটা খারাপ লাগা শুরু হয়েছিল। কিন্তু যখন বুঝল, অথৈ তাকে কেন কাউকেই বিয়ে করবে না। বিয়েতে না করার একটাই কারণ পড়াশোনা শেষ না করে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। তখন খারাপ লাগাটা কিছুটা কমলেও মনটা পুরোপুরি শান্ত হয়নি।

চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরমান।

~আপনাকে আমি প্রথম দেখাতেই মন দিয়েছি। আপনি কি আমাকে ভালোবাসার চেষ্টাটুকুও করবেন না অথৈ? আপনার কি সেরকম পছন্দের মানুষ কেউ আছে?”
……
অথৈর বড় ফুপি মারজিয়া ইসলাম। পেশায় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। ফুপি বাবার বড় হওয়ায় ফুপির কথার উপর আজ পর্যন্ত কোন কথা বলতে পারেনি বাবা। আর বললেও ফুপি তা শুনবে কেন? ফুপি এমন একজন মানুষ যে সব কাজে নিজের মতামতকে উপরে রাখে। নিজের যা ঠিক মনে হবে সেটাই করবে। এতে কেউ সঙ্গ দেক বা না দেক। ফুপা ব্যবসায়ী মানুষ। বলা যায় ফুপা যে জিনিসে হাত লাগায় তা-ই সোনা হয়ে যায়। বিজনেসে ফুপার লাক ভীষণ ভালো। ঠিক দাদুর মতন। অথৈর দাদু ছিলেন হাড় কিপ্টে মানুষ। জীবনে শুধু দু’হাতে অর্জন করে গেছেন। কোনকিছুই ভোগ করে যেতে পারেননি। বাবা শিক্ষক মানুষ বিজনেসের ‘ব’ও বুঝে না। দাদুর এত বড় ব্যবসা আর কয়দিনে বাবা হয়তো উড়িয়েই দিত। ফুপা যদি সাহায্য না করত। বাবা নিশ্চিন্তে নিজের অংশের ব্যবসাটুকুও ফুপার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি আছেন। এতদিনে ফুপা নিজের ব্যবসা সহ বাবার ব্যবসাও তিনগুণ বাড়িয়েছে। কত জায়গায় যে ফুপার ব্যবস্থা জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা হয়তো ফুপা নিজেও জানে না। এত টাকাপয়সা দিয়ে ফুপা কী করবে তা নিয়ে ফুপাও দুশ্চিন্তায় আছে। তবে এই দম্পতির কোন সন্তান সন্তানাদি নেই৷ তবুও ওরা সুখী। বিয়ে ষোল বছর পরেও ফুপির কোন সন্তান না হলে একটি মেয়েকে এডপ্ট করেছিল। কিন্তু সেই মেয়েটাও সাত বছর বয়সে সামান্য জ্বরে মারা যায়। তারপর আর ফুপি সন্তানের ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। ফুপাও জোর দেননি। সমস্যাটা ফুপির। ফুপি কখনও মা হতে পারবে না। ফুপা এই নিয়ে কোনোদিনও একটা কথাও বলেনি। অনেক পুরুষই আছে যারা সন্তান না হলে দ্বিতীয় বিয়ে করে। ফুপা তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফুপা অথৈর দেখা আদর্শ একজন স্বামী। সে সবসময় এটাই চায় ফুপার মত কেউ একজন তার জীবনে আসুক। ফুপিকে ফুপা যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই যেন সেই মানুষটাও তাকে ভালোবাসে। আজ সকালে অথৈদের বাড়িতে বিনা মেঘে বজ্রপাত হচ্ছে। বাবার ভীমরতি ছুটাতে ফুপি সকাল সকাল হাজির। বাড়িতে পা রেখেই ফুপি বাবাকে যা-তা বলে গালাগাল দিচ্ছে। অবশ্য আগুনে ঘি ঢালার কাজ অথৈ রাতেই করে রেখেছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here