#ভুলবশত_প্রেম পর্ব৪৮

0
383

#ভুলবশত_প্রেম পর্ব৪৮
#লেখনীতে:সারা মেহেক

৪৮

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। ক্ষণিকের মাঝেই নিজেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। মুহূর্তমধ্যেই আমার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো৷ তুমুল গতিতে দ্রিমদ্রিম শব্দে ভয়ের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সে। দু হাত পা বাঁধা দেখে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি, আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়েছে৷ আর এ কাজটি করেছে রোহান ভাইয়া। স্পষ্ট মনে করতে পারলাম সেসময় হোটেল রুমে রোহান ভাইয়া ছিলেন। কিন্তু উনি রুমে এলেন কি করে?

আমি সম্পূর্ণ চোখ মেলে পরিবেশটা দেখলাম। আমাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে চারিদিকে আবছা অন্ধকার। কেমন যেনো গুমোট একটা পরিবেশ৷ ভ্যাপসা এক প্রকার গন্ধও এসে বাড়ি খেলো নাকে। বোধহয় জায়গাটা পরিত্যক্ত ধরনের বা কেউ খুব একটা আসা-যাওয়া করে না। কিন্তু এ জায়গাটা আসলে কোথায়? রোহান ভাইয়া আমাকে কোথায় এনে রেখেছেন? গুমোট পরিবেশের রুমে থেকে বাইরের পরিবেশ অনুমান করতে পারলাম না আমি।

হাত দুটো পিঠের দিকে বাঁধা, পা দুটোও বাঁধা। হাতের যন্ত্রণাকর বাঁধন খুলতে সাধ্যমত চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। পা দুটো নাড়িয়ে পায়েরও বাঁধন খুলতে চেষ্টা করলাম। খানিক সময়ের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ রুমে শব্দ শুনতে পেয়ে তটস্থ হয়ে বসে রইলাম আমি। নিশ্চয়ই রোহান ভাইয়া এসেছেন।
আমার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে রোহান ভাইয়াই রুমে ঢুকলেন। কালো একটা জ্যাকেট পরে মাথায় হুডি তুলে দিয়েছেন উনি। উনাকে দেখামাত্র শক্ত গলায় বলে উঠলাম আমি,
” এভাবে আমাকে কিডন্যাপ করার উদ্দেশ্য কি আপনার? ”

রোহান ভাইয়া হুডি খুলে ফিচেল হাসি দিলেন। ধীরেসুস্থে হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসে বললেন,
” উদ্দেশ্য যে ভালো কিছু না তা তুই ভালো করেই জানিস। ”

রোহান ভাইয়ার এ প্রতিক্রিয়ায় আমার শরীর ঘিনঘিন করতে লাগলো। আমি তীব্র ঘৃণা সহকারে বললাম,
” এক ফর্মুলার পিছনে এভাবে পরে আছেন কেনো আপনি? নিজ বুদ্ধিতে একটা বানলেও তো পারেন। ”

রোহান ভাইয়া কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে বললেন,
” এতো সহজেই যে ফর্মুলা আমি নিতে পারবো সেখানে বছরের পর বছর সময় দিবো কেনো?”

” কে বলেছে আপনাকে যে আপনি এতো সহজেই ফর্মুলা নিতে পারবেন?”

” তা নয়তো কি? গতবার পারিনি। কিন্তু এবার পারবো। কারণ এবার আদ্রিশের কলিজায় হাত দিয়েছি আমি। ”
এই বলে উনি পূর্বের ন্যায় হেসে উঠলেন। উনার হাসি দেখে আমার শরীর জ্বলতে লাগলো। আমি প্রচণ্ড ঘৃণা সহকারে বললাম,
” আপনার মতো জঘন্য মানুষ হয়তো দ্বিতীয়টা নেই। ছিঃ একবারও কি আপনার বিবেকে বাঁধে না এসব করতে?”

রোহান ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন। বললেন,
” আমি তো এখনও কোনে জঘন্য কাজ করিনি রে মিম। করবো। খুব শীঘ্রই করবো। যা তোর বোনের সাথে করতে পারিনি তা তোর সাথে করবো৷ বুঝতে পারছিস তো কি বলতে চাইছি আমি?”
এই বলে রোহান ভাইয়া বাজেভাবে আমার গালে স্পর্শ করলেন। উনার এ স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে কেমন বমি পেলো। উনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে এলাম আমি। হাত পা দুটো ঘামতে শুরু করলো। আমার প্রতিক্রিয়া দেখে রোহান ভাইয়া হাসলেন। বললেন,
” এই ভয়টাই দেখতে চাচ্ছিলাম তোর চোখে। আমাকে থাপ্পড় দিয়ে অপমান করবি আর আমি কিছু করবো না তা ভাবলিও কি করে মিম? আমি এক তীরে দুই পাখি মারার প্ল্যানে আছি। বুঝছিস?”
এই বলে রোহান ভাইয়া খুব বিশ্রি রকমের একটা হাসি দিলেন৷ উনার হাসি দেখে ঘৃণায় চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললাম আমি। রোহান ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” একটা সিক্রেট জানিস মিম? খুব বড় একটা সিক্রেট?”

আমি চোখ খুলে চাইলাম৷ রোহান ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,
” তোকে কোথায় এনে রেখেছি জানিস? তোদেরই কোম্পানির গ্রাউন্ড ফ্লোরের বিল্ডিং এ। যেখানে সহজে কেউ আসে না৷ পরিত্যক্ত আর কি। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? আদ্রিশের ধরা ছোঁয়ার মধ্যেই তুই থাকবি৷ অথচ আদ্রিশ তোকে খুঁজে পাবে না। ”

রোহান ভাইয়ার কথা শোনামাত্র আমি বিস্ফোরিত নয়নে উনার দিকে চাইলাম৷ উনি যে আমায় নিয়ে সিলেট শহর থেকে চলে এসেছেন তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি৷ এখন আদ্রিশ আমাকে কি করে খুঁজে পাবেন! উনি নিশ্চয়ই সিলেট শহরে তন্নতন্ন করে খুঁজছেন আমায়। কিন্তু আমি যে উনাদের কোম্পানিরই গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছি। কি করে সম্ভব আমাকে এখান থেকে বের করা? উনি নিশ্চয়ই অনুমানও করতে পারবেন না রোহান ভাইয়া এ কাজ করেছেন। তাহলে কি আমার মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে? এখানেই বন্ধি থেকে রোহান ভাইয়ার ঘৃ’ণ্য ষ’ড়’য’ন্ত্রের শিকার হতে হবে?

রোহান ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আড়মোড়া ভেঙে বললেন,
” যাই একটু রেস্ট নিয়ে আসি। তারপর না হয় তোর কাছে আসবো। ততক্ষণ তুইও একটু রেস্ট নিয়ে নে৷ ”
এই বলে রোহান ভাইয়া হাতের নাগালে থাকা কাপড় দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিলেন। যেনো আমি চিৎকার না করতে পারি। এ পর্যায়ে আমার হাত ও পায়ের বাঁধন ছোটার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু শক্ত বাঁধন থেকে ছুট পাওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। আমার এ চেষ্টা দেখে রোহান ভাইয়া খুব করে হাসলেন। বললেন,
” চেষ্টা করে লাভ কি বল৷ এখান থেকে বের হওয়া এতোটা সহজ ভেবেছিস? আর তুই চেষ্টা করলেও বের হতে পারবি না। কারণ আমি তোকে বের হতে দিবো না। ”

এই বলে রোহান ভাইয়া উল্টো পথে পা বাড়ালেন৷ কিন্তু কি মনে করে আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
” আদ্রিশকে তোর কিডন্যাপিং এর কথা কখন বলেছি জানিস? যখন আমরা সিলেটে ছিলাম তখনই। ও বেচারা তো তখন থেকেই তন্নতন্ন করে খুঁজে যাচ্ছিলো তোকে। কিন্তু ততক্ষণে আমরা সিলেট ছেড়ে দিয়েছি। অবশ্য এখন ও এখানেই আছে৷ কারণ ওকে আমরাই এখানে এনেছি। আফটার অল ফর্মুলা লাগবে আমাদের। কিন্তু এবার আমি ওর সাথে আর কোনো প্রকারের যোগাযোগ করিনি। কারণ ও যে লোকেশন ট্রেস করে ফেলবে। এজন্য এবার ইকবাল সাহেবের লোকদের দিয়ে কাজ করিয়েছি৷ আদ্রিশ ইকবাল সাহেবকে ফর্মুলা দিবে। তারপর তোর খোঁজ পাবে। কিন্তু ততক্ষণে তো সব শেষ। বুঝেছিস এবার? কি করে এক তীরে দুই শিকার করবো আমি? ওদিকে আদ্রিশের কাছে ফর্মুলাও নেওয়া হয়ে যাবে, আবার এদিকে তোর কাছ থেকে অপমানের শোধও তোলা যাবে। আচ্ছা, অনেক কথা বললাম। একটু জিড়িয়ে আসি। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া চলে গেলেন। আমি অসহায় চাহনিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম। সহিসালামত বেঁচে ফিরার সব আশা দুরাশা মনে হচ্ছে আমার কাছে৷ সবদিক দিয়েই বিপদ ঘিরে ধরেছে। আদৌ কি এ থেকে বের হওয়া সম্ভব?

ঘোর বিপদে পরে সব সম্ভাবনা ধোঁয়ার ন্যায় উবে যেতে লাগলো। আমার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগলো। শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে এলো। ভয়ে ক্রমশ উর্ধগতিতে চলমান হৃদপিণ্ডটিও ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে এলো যেনো। মস্তিষ্ক শূন্য অনুভূত হলো। তবুও জোরপূর্বক চেষ্টা করছি এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। সে আশাতেই চারপাশ তাকালাম৷ কিন্তু হাত পায়ের বাঁধন খোলার মতো কিছু পেলাম না।
হঠাৎ আমার দৃষ্টি আটকে রুমে কোনার একটি দেয়ালের দিকে। রুমের ঐ কোনায় ভেন্টিলেটর এর মতো বোধহয় কিছু দেখতে পেলাম। এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আমি ফ্লোর ঘেঁষে ডান পাশে এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটু এগিয়ে যেতেই পিলারের পিছনে ভেন্টিলেটর দেখতে পেলাম। তৎক্ষনাৎ আমার ভেতরে সাহস ও আশা সঞ্চার হলো যেনো। কোনোরকমে ঐ ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে আশেপাশে কেউ থাকলে হয়তো সাহায্য চাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে যাবো কি করে? পা দুটো যে বাঁধা আমার!

আমি কিছুক্ষণ পায়ের বাঁধনের দিকে চেয়ে রইলাম। কি করে এটা খুলবো? হাত দুটো যে পেছনে বাঁধা। কিছুক্ষণ এ নিয়েই চিন্তা করলাম। অতঃপর বেশ দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে পা ভাঁজ করে পেছনের দিকে নিলাম। কোমড়ের কাছে বাঁধা হাত দুটো দিয়ে খুব কষ্টেসৃষ্টে বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। বহু চেষ্টার পর এ পায়ের বাঁধন খুলতে সক্ষম হলাম। দু হাঁটুর সাহায্যে মুখের কাপড় টেনে সরিয়ে খুলে ফেললাম। সাথে সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি৷ অতঃপর কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে দ্রুত উঠে সেই ভেন্টিলেটরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেন্টিলেটরটা অনেকটাই আমার নাগালে। শুধু পা দুটো একটু উঁচু করে দাঁড়ালেই বাইরের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

বাইরে রাত হয়ে এসেছে। কিন্তু কত রাত অর্থাৎ সময় কত তা অনুমান করতে পারলাম না। মাথা উঁচু করে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে রইলাম। এই আশায়, যদি কেউ আসে।
বোধহয় পাঁচ দশ মিনিট বা তারও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। হঠাৎ এ বিল্ডিং থেকে বেশ খানিকটা দূরে একজন মানুষের অবয়ব দেখতে পেলাম। মুহূর্তমধ্যেই মানুষটি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিগোচর হলো। আমি কোনোপ্রকার বিলম্ব না করে মুখ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শব্দ করতে লাগলাম। কোনো প্রকার বাক্য উচ্চারণ করলাম না। কারণ রোহান ভাইয়া যদি আশেপাশে থেকে থাকে তাহলে আমার কথার মাধ্যমেই নিশ্চিত তিনি ধরে ফেলবেন যে আমি বাইরে সাহায্য চাইছি।

আমি নানা প্রকারের শব্দ করে লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু লোকটি যেনো কিছুতেই কিছু শুনছে না। অদ্ভুত! ক্ষণিকের মাঝেই আমার বেঁচে ফেরার একমাত্র সম্বল স্বরূপ লোকটি আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। আমি হতাশ হয়ে দেয়াল ঘেঁষেই বসে পড়লাম। দু চোখ বেয়ে নিঃশব্দে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ রোহান ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আমি চকিতে ফিরে তাকালাম।
” হেল্প চাচ্ছিলি না কি মিম? পেয়েছিস? পাবিও না। কারণ এ দিকটায় কেউ আসে না। ”
এই বলে রোহান ভাইয়া ক্রুর হাসি দিলেন। মুহূর্তমধ্যেই পরনের শার্টের বোতাম খুলতে খু্লতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। পৈশাচিক আনন্দিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
” ভেবেছিলাম আরেকটু পর আসবো। কিন্তু তুই তোর ভুলের কারণে সময়টাকে কমিয়ে আনলি। কি আর করার৷ পরে যা করবো তা এখন করে নিলেই হয়। ”
রোহান ভাইয়া অগ্রসরমান চলন ও কথায় ভয়ে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো।
®সারা মেহেক(গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ

#চলবে
ছবি ক্রেডিট :৷ Maksuda Ratna আপু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here