#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ১৯ ( নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিশোধ)

0
600

#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ১৯ ( নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিশোধ)
#লিখা_তানজিলা

কালো মেঘেদের লুকোচুরি খেলার মাঝে রাতের গভীরতা বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটায় নজর গেলো আইজার। দেড়টা বেজে গেছে। দুই ঘন্টা আগে আরফানের সাথে কথা হয়েছিলো আইজার। সে আগের বাড়িতেই ঘুমোবে আজ। আইজাও আরফানকে এখানে আসতে বলেনি। ছেলেটা এ জায়গা থেকে দূরে থাকলেই ভালো।

তবে এই মুহুর্তে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে কাউকে ধরে বেঁধে টেনে আনার দৃশ্যে কিঞ্চিৎ থমকে গেলো ও। সীমান্তর স্টাডি রুম থেকে ডান দিকে যাওয়া ছোট্ট করিডরে সে জানালা। সচরাচর কেউই যায় না ওদিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করছিলো আইজা। অন্ধকারে সেরকম কিছু দেখা না যাওয়ায় নিজেই নিচে যেতে পা বাড়ালো আইজা। সীমান্তও সেই মুহূর্তেই স্টাডি রুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। আইজাকে সামনে দেখতেই মুখে তীক্ষ্ণ বিব্রতবোধের রেখা ফুটে উঠলো।
-“এখন কী এ বাড়িতেও মানুষ ধরে আনবেন!”

-“আপনি এত রাতে এখানে কী করছেন! রুমে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।”
একপ্রকার আদেশ দিয়েই চলে গেলো সে। এখন আইজা কী করবে! চুপচাপ সীমান্তর কথামতো রুমে গিয়ে বসে থাকবে! কখনোই না! অবাধ্য মেয়ের মতোই সীমান্তর পিছু পিছু ছুটলো আইজা। নিচে নেমে পিলারের পেছন থেকে উঁকি দিতেই বেঁধে রাখা ব্যাক্তির পড়নের শার্ট টা নজরে পড়লো ওর। এই শার্ট ওর পরিচিত! পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রিয়াদকে ধাক্কা মেরে বসলো আইজা। নিচে হয়তো দুই একটা পাথর পড়ে ছিলো। তাই এমন আচমকা ধাক্কায় কোন একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে নিচে পড়ে গেলো লোকটা। সীমান্ত পাশেই চোখ বন্ধ করে হাত দুটো শক্ত ভাবে মুঠ করে রেখেছে। চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে আইজার এখানে এসে আকস্মিক হামলা তাকে বিস্মিত করছে না। তবে প্রচন্ড বিরক্ত সে।

আইজা সীমান্তর দিকে ওর রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে অজ্ঞান অবস্থার আরফানের এক হাত জাপটে ধরলো। তৎক্ষনাৎ আরফানের মাথাটা আইজার কাঁধে ঢলে পড়লো। আরেকটা হাত যে লোক ধরে ছিলো সে একবার সীমান্তর দিকে তাকায় আর একবার আইজার দিকে। পরবর্তীতে সীমান্তর ইশারায় লোকটা আরফানকে ছেড়ে দিতেই সীমান্ত আরফানের আরেক হাত ধরে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,

-“আগে আরফানকে ওর রুমে রেখে আসা যাক। পরে যা বলার বলবেন!”

আইজা ওর মুখ খুলতে গিয়েও বন্ধ করে দিলো। আরফানের শরীর টাও বেশ দূর্বল মনে হচ্ছে। হালকা জ্ঞান ফিরছে হয়তো। এক ধাপ দুই ধাপ করে ধীরে ধীরে পা ফেলছে। রিয়াদ বললো,

-“ভাবি চিন্তা করবেন না! পর পর দুইবার ক্লোরোফোম নাকে ধরায় হয়তো মাথাটা ঝিমাচ্ছে! একটু বিশ্রাম নিলেই…!”
আর কোন শব্দ রিয়াদের মুখনিঃসৃত হলো না। আইজার চোখগুলো দেখেই সে থম মেরে রইলো। আইজার হাতগুলো এই মুহুর্তে আরফানকে নিয়েই ব্যস্ত! নইলে..!

বিছানায় গা পড়তেই চোখগুলো বন্ধ করে ফেললো আরফান। আইজাকে দেখতেই শান্ত হয়ে গেছিলো ও। আলোতে আরফানের কপালের সাইডে কালচে দাগ দেখতে পেলো আইজা। হিংস্র ক্রোধ তাড়নায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে ফেললো আঁখি জোড়া। সীমান্ত রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। পুরো ঘরটাতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো আইজা। ছোটোখাটো ফুলের টব টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ফুঁসতে থাকা মানবী।

সীমান্তর চোখ জোড়া ফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। হঠাৎ নিজের শরীর থেকে কিঞ্চিত দূরত্বে কোন কিছু ভাঙার আওয়াজে খানিকটা দূরে সরে এলো সে। আরেকটু কাছে হলে সোজা মাথায় গিয়ে পড়তো।

-“পেয়েছেন কী আপনি? আরফানের সাথে এরকম আচরণ করার সাহস হলো কী করে আপনার! আমার ভাইয়ের যদি কোন ক্ষতি হয়..!”

হঠাৎ সীমান্তর হাত নিজের মুখের ওপর অনুভব করলো আইজা। আরেক হাতে আইজার কোমর জড়িয়ে রেখেছে সে। ধীর ক্ষুব্ধ কন্ঠ সীমান্ত বললো,
-“আওয়াজ নিচে নামিয়ে কথা বলুন! বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগানোর কোন প্রয়োজন নেই!”
আইজা নিজেকে ছাড়ানোর কোন প্রচেষ্টাই করছে না। শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সীমান্তর চোখে তাকিয়ে আছে। আইজাকে শান্ত দেখে ওর মুখ থেকে হাত টা সরিয়ে নিলো সীমান্ত। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,

-“আরফান বলেছিলো রাতের আগেই চলে আসবে। হয়তো ভেবেছিলো পরে এ বাড়িতে ফিরে না আসলেও আমি কিছু বলবো না। গাধা একটা! আপনাদের আমি এখানে নিয়ে এসেছি। আপনি এবং আপনার প্রিয় ভাইবোন এখানেই থাকবেন। আমার পারমিশন ছাড়া যাতে এ বাড়ি থেকে এক পা ও না নড়ে! নাহলে আজ তো শুধু বেঁধে এনেছি, এরপর কী করবো আমি নিজেও জানি না!”

শেষের কথাগুলো বলার সময় সীমান্তর গলার স্বর কিঞ্চিত কর্কশ রূপ ধারণ করলো। আইজা সীমান্তর চোখে চোখ রেখে কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“আমার যেখানে ইচ্ছে আমি সেখানে যাবো। কী করবেন আপনি!”
সীমান্তর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো স্মিথ বাঁকা হাসি। আইজাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিলো সে। আরেকটা হাত ওর চিবুকে গিয়ে ঠেকলো। কন্ঠে ধূর্ততার আভাস নিয়ে বললো,
-“একবার সে স্পর্ধা করে দেখুন!”

-“বাড়িতে সবার পারসোনাল রুম তো একটা কারণেই থাকে না-কি! রাতের বেলা বাইরে দাঁড়িয়ে প্রেম চলছে!! সাথে বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙা ফ্রি!”
হঠাৎ সীমান্তর ভাই রায়হানের কন্ঠে আইজাকে ছেড়ে দিলো সীমান্ত। রায়হান বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। ফিহাও এসেছিলো পিছু পিছু। রায়হানের কথা শুনে চোখে মুখে বিব্রোতবোধের রেশ নিয়ে সে চলে গেলো।

তবে আইজার চোখ আটকে আছে রায়হানের দিকে। কী যেন একটা গভীর চিন্তায় ডুবে আছে ও। রায়হান ঢুলতে ঢুলতে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। তখনই পেছন থেকে কারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দে ফিরে তাকালো আইজা। সীমান্ত আইজার দিকে দৃষ্টি রেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

-“একটু ঘুমোলে হয়তো সকালে সুস্থ ফিল করবে আরফান! আমি ওর জন্য ঔষধ আনিয়ে রাখবো। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না!”

আইজার মুখ থেকে কোন কথা বেরুনোর আগেই শেষের কথাটা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো সীমান্ত। তৎক্ষনাৎ সে স্থান পরিত্যাগ করলো সে। আইজা এখনও ওখানে দাঁড়িয়ে। একবার আরফানের ঘুমন্ত মুখটা দেখে নিলো ও। বেশ শান্ত হয়ে আছে। একবার হুঁশ ফিরলে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আইজাকে।

ঘুমের দেখা নেই আজ। সীমান্ত পাশেই শুয়ে আছে। এখনো ঘুমিয়েছে কিনা জানে না আইজা। খাটের একদম কিনারে এসে পড়েছে ও। আর একটু এগোতে চাইলেই ঠাস করে নিচে পড়ে যাবে।

-“আমি আপনাকে খেয়ে ফেলবো না। ঠিক ভাবে শুয়ে পড়ুন! পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙলে তো আবার আমাকেই সামলাতে হবে!”

সীমান্তর কথার কোন জবাব দিলো না আইজা। আগের ভঙ্গিতেই শুয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পর নিজের পেটে ঠান্ডা এক হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই গা শিউরে উঠলো আইজার। জায়গা না থাকা সত্বেও আরও সামনে এগোনোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলো ও। ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফল ব্যর্থতার মধ্যেই আটকে রইলো। অসহ্য অনুভূতি সহ্য না হওয়ায় পরক্ষনেই উঠে বসতে চাইলো ও। তাতে সীমান্ত যেন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আইজাকে। ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
-“প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে আইজা। আপনার নাটক কালকের জন্য বরাদ্দ রাখুন! এখন আমি ক্লান্ত!”

-“আপনি একাই না যে এসবে ক্লান্ত।”
আইজার অধৈর্য্য কন্ঠের বিপরীতে ওপর সাইড থেকে কোন উত্তর এলো না। একরাশ নিরবতা নিয়ে পড়ে রইলো ও। ক্লান্ত মস্তিষ্কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওভাবেই চোখ গুলো বন্ধ করলো আইজা।

*****

-“আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, ঐ সীমান্ত সুবিধার না। তুই আমার কথা টা পাত্তা দিলি না! তোদের বিয়ের দিনই সাহিলকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলো সে। গুন্ডা একটা!”

আরফানের ফরফর করে বলা কথায় তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো আইজা। এসবের কিছুই জানতো না ও!
-“তুই কী করে জানলি?”
-“আমি নিজের চোখে দেখেছি!”
আরফান কথাটা বলতে না বলতেই ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বসলো আইজা।
-“তুই আমাকে এসব এখন বলছিস!”
মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন আইজার কথায় আরফান আকাশ থেকে পড়লো।
-“আমি মনে করেছিলাম তুই জানিস!”

নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো আরফান। আরফানকে কী জবাব দিবে এই চিন্তায় মাথা ব্যথা করছিলো আইজার। কিন্তু এই আরফান তো আরও আগে থেকেই জেনে বসে আছে। আইজা আর সীমান্তর বিয়ের পর থেকেই আরফান কখনোই সীমান্তর সামনে যেতো না। প্রচন্ড অপছন্দ করে সে সীমান্তকে। গতরাতের পর তো সে মাত্রা আরও বেড়ে গেছে।

চুপচাপ শান্ত হয়ে থাকা লোকটার এ রূপ দেখবে কখনো ভাবেনি আইজা। না! সীমান্তর এ কাজকে ঈর্ষা অথবা ভালোবাসার কাতারে ফেলবে না ও। নিজের ফোন টা বের করে একবার রায়হানের রুমের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আইজা। আর এক ঘন্টা পর সীমান্তর সাথে অফিসে যাবে ও। এই এক ঘন্টাই সুযোগ। সীমান্ত এখনো জগিং থেকে আসেনি। বাড়িতে আইজার শ্বশুরও নেই। ফিহা হয়তো নিজের ঘরে। রাজিয়া আর পাখি রান্নাঘরের দিকে।

বাঁকা হেসে রায়হানের রুমে কড়া নাড়লো আইজা। গতরাতে সীমান্তর কাজের বিপরীতে হয়তো শতগুণ ভয়ংকর প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে তার জন্য!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here