বিবর্ণ_ভালোবাসা,11,12

0
307

#বিবর্ণ_ভালোবাসা,11,12
#Tahmina_Akther

১১.

পাশের ঘর থেকে আমার মায়ের আদরে ভরা কন্ঠ শুনতে পাচ্ছি। কারণ, উনার ভাইয়ের একমাত্র পুত্র এসেছেন। আমি দ্বিধান্বিত মনে বারবার ভাবতে বাধ্য হচ্ছি আমার মায়ের ভাই এলো কোত্থেকে আর ভাইয়ের ছেলে এলো কোত্থেকে? যতদূর মনে পরে আমার মা নাকি এতিম। এলাকার সবাই একই কথা বলে। তবে, আজই কেন অচেনা একজন হুট করে এসে আমার মায়ের ভাইয়ের পুত্র বনে গেল!

এমনিতেই, সেই সময়ের বিব্রতকর পরিস্থিতির স্মৃতি স্মরণে এলে আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। সেই যে একদৌঁড়ে ঘরে এসেছি এখন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হয়নি। গ্রীষ্মের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো এখন পর্যন্ত গায়ে পানি ঢালতে পারিনি তাই তো গা থেকে তাপ বের হচ্ছে।

দরজার একটু ফাঁক করে মাথা বের করে দেখছিলাম কেউ আছে কি না? নাহ্ কেউ নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খাটের ওপর থেকে কমলা রঙের থ্রী-পিছটা নিয়ে দরজা খুলে দিলাম দৌঁড়।

কিন্তু, দৌঁড় দিতে গিয়ে উপুড় হয়ে পরে যাচ্ছিলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে কালেমা পাঠ শুরু করে দিলাম, যদি মরে যাই! অন্তত কালেমা পড়তে পড়তে তো মরতে পারব। কিন্তু, আল্লাহ সহায় হয়েছেন বলে কে যেন আমাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

আমার হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। মনে মনে ওপর ওয়ালার শুকরিয়া আদায় করছি এমন সময় মায়ের কন্ঠ শুনতে পেলাম।

— এত্ত বড়ো মেয়ে দৌঁড়ানোর সময় যদি মাটিতে পরে যাস তখন লোকে দেখলে দাঁত কেলাবে। ফাজিল একটা।

লজ্জা এবং মায়ের বকা শুনে আমার চোখে জল চলে এলো। কেন জানি মা বকা দিলে ভীষন কষ্ট হয় আমার?

—ফুপি, একটু না-হয় অসাবধনতাবশত ভুল হয়ে গেছে। তাই বলে এভাবে বকাঝকা করাটা অনুচিত।

পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকিত দৃষ্টিতে মায়ের পাশে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে তাকালাম। ঝাপসা নয়নে তাকিয়ে তার চেহারার যা বুঝতে পারলাম তা হলো তিনি আমার পক্ষেই আছেন।

আচ্ছা, কিছুক্ষণ আগে যে পরে যাচ্ছিলাম তখন কি উনি মায়ের সাথেই ছিলেন? হুট করে তনুজার মননে লজ্জারা দানা বাঁধতে শুরু করে। তনুজা দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে শুরু করে পুকুর ঘাটে। তনুজার এমন প্রস্থান দেখে তনুজার মা নিজের ভাইয়ের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বাবা, তুমি বিল্ডিংয়ের গোসলঘরে চলে যাও। পুকুরে যাবার দরকার নেই।

ফুপির আদেশ শুনে ভদ্র ছেলের মতো ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে গোসলঘরে চলে গেলো।

গোসল শেষ করে সবেমাত্র গোসলঘর থেকে বের হয়ে ঘরে চলে যাই। যেই কদিন থাকি এই ঘরেই থাকব। বড়ো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুছতে থাকি আমি। জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বাতাস বইতে থাকে। স্নিগ্ধ পরিবেশ, শীতল হাওয়ায় আমার মন যেন শতগুণ ভালো হয়ে গেলো। চুল মুছতে মুছতে হুট করে থেমে গেলাম আমি। হাতের শক্তি নেই বললেই চলে। কারণ, মস্তিষ্ক তখন ভালোলাগার মতো কিছু মূহুর্ত চোখের মাঝে বন্দী করছে। কমলা রঙের থ্রীপিছ পরনে, ভেজা চুল সবুজ রঙা গামছা দিয়ে বাঁধা মোমের পুতুল তার ভেজা কাপড় দড়িতে শুকোতে দিচ্ছে। কাপড় দড়িতে দেয়ার সময় যখন বিন্দু পানির ছিটা এসে মুখে পরছে তখন চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করছে।

— এ কোন মায়া লাগালে আমায়? এসেছিলাম ফুপির খোঁজ নিতে। কিন্তু এখানে আসার পর আমি আমাকে হারাতে যাচ্ছি।

জানালার কাছ থেকে সরে এলো রুদ্র। সেলফোন বের করে নিজের বাবার কাছে কল করলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো কিন্তু ফুপির বাড়িতে যে এসেছে তা বলেনি। হয়তো, গোপনে এসেছে এখানে।

খাবার টেবিলে বসতেই রুদ্রের চোখ ছানাবড়া। না হলেও সাত পদের ভর্তা, ইলিশ মাছ ভুনা, মাষকলাইয়ের ডাল, হাঁসের ডিম ভাজা, দেশী মুরগীর ঝোল, চিকন চালের ভাত। রুদ্র মনে মনে ভয়ের ঢোক গিললো। কারণ, রুদ্রের পেটে যে এই খাবারগুলো চালান করা হবে ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।

রুদ্রের পাশের চেয়ারে টগর এসে সুবোধ বালকের ন্যায় চুপ করে বসে রইলো। রুদ্রের ফুপি রৌশনি রান্নাঘর থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে বের হয়ে এলেন। রুদ্র দেখতে পেলো ওর ফুপির আড়ালে সেই কমলা সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? ভারী অদ্ভুত তো!

রৌশনি পায়েসের বাটি টেবিলের ওপর রেখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো তনুজা রান্নাঘরের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কপালে কুঞ্চিত ভাজ ফেলে তনুজাকে নিজের কাছে ডাক দিলেন। কিন্তু, তনুজা মাথা দুলিয়ে না বোধক অর্থ বুঝাচ্ছে। অর্থাৎ ও এখানে বসবে না। এদিকে রুদ্র আর টগরের দৃষ্টি তনুজার দিকে। রৌশনি উপায়ন্তর না পেয়ে চোখ রাঙানো দিলে তনুজা হুড়মুড়িয়ে এসে টগরের পাশের চেয়ারে বসে পরলো।

রৌশনি সকলের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন যার যার পছন্দসই খাবার। রুদ্র তো আলুভর্তা আর হাঁসের ডিম ভাজা দিয়ে ভাত মুখে দিয়ে বুঝতে পারছে ইটালিয়ান আর থাইফুড ছাড়াও বাঙালি কিছু খাবার আছে যা খেলে মনে হবে অমৃত পান করছে।

খাবারের পর্ব শেষ হতেই রুদ্র আর ঘরে বসে থাকলো না। টগরকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো গ্রাম ঘুরে দেখবে বলে।

টগর সামনে আর রুদ্র পেছনে। রুদ্রের গলায় দামী ক্যামেরা ঝুলানো। যার কারণে গ্রামের বায়জৈষ্ঠ্য থেকে শুরু করে ছোটরা একবার হলেও রুদ্রের দিকে তাকাচ্ছে।

দুই পাশে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে ধান রোপণ করছে চাষীরা। দুই জমির মাঝে তৈরি করা ছোট্ট পথ ধরে ধীর গতিতে হেটে যাচ্ছে টগর আর রুদ্র। একটু ভুল হওয়া মানে সোজা কাদামাটিতে পরে কাপড় নষ্ট করা। মাঝামাঝি পথে এসে রুদ্র দাঁড়িয়ে যায়। এমনসময় দমকা হাওয়ার স্পর্শে রুদ্রের বাবড়ি চুলগুলো এলেমেলো করে দিয়ে যায়। রুদ্র বেশ কয়েকটি ছবি তুললো। নতুন ধান বোনা খেতের ছবি, পুরনো বটগাছের নীচে বসে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের।

হাঁটতে হাঁটতে টগর রুদ্রকে নিয়ে নদীর পাড়ে চলে এলো। রুদ্র সুবিশাল সমুদ্রের বুকে কতবার স্পিডবোট দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। কতবার সে সমুদ্রের তলদেশে গিয়েছে এডভেন্চারের জন্য। সমুদ্রের তলদেশে কতশত মূর্হুত রুদ্রের চোখে স্মৃতি হয়ে আছে। কিন্তু, এই নদীর পাড়ে এসে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের সঙ্গে কোনো সৌন্দর্যের কম্পেয়ার করতে নেই। যে যার জায়গায় সুন্দর! পাহাড়ের জায়গায় পাহাড়ের সুন্দর। সমুদ্রের জায়গায় সমুদ্র সুন্দর। আর নদীর জায়গায় নদী সুন্দর। এই জন্যই বুঝি বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। এই জন্যই বুঝি এদেশের কবিরা বারবার তাদের লেখা শব্দের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছেন এই দেশের সৌন্দর্য সম্পর্কে।

— কি দেখছেন অমন করে?

— দেখছি নিজের মাতৃভূমির সৌন্দর্যকে। কতটা মনোমুগ্ধকর আর স্নিগ্ধ পরিবেশ। হরেক পাখির কলরব শুনতে ভালো লাগছে।

আনমনা হয়ে টগরের প্রশ্নের জবার দেয় রুদ্র।

— কই আমরা তো এত মুগ্ধ হই না!

টগরের কথা শুনে রুদ্র মেকি হাসি দিয়ে বললো,

— কারণ, তোমরা এমন পরিবেশ দেখে অভ্যস্ত।
গ্রাম্য পরিবেশ দেখার ভাগ্য হয়নি আমার। কারণ, বাংলাদেশের মাটিতে আমার জন্ম হয়নি ; হয়েছিল সুদূর মালদ্বীপে। আমার মা মালদ্বীপের নাগরিক। বাবা চাকরিসূত্রে মালদ্বীপে গিয়েছিলেন। কোনো একসূত্র ধরে বাবা-মায়ের পরিচয়। পরিচয় থেকে পরিণয়। মায়ের ইচ্ছে ছিল না বাংলাদেশের আসার তাই তো আমাকে সেই দেশে বড়ো হতে হলো। আজকের পর থেকে বাংলাদেশের সৌন্দর্যের কাছে আর কোনো দেশের তুলনা করতে ইচ্ছে করবে না আমার।

রুদ্র এবং টগরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তনুজা রুদ্রের প্রত্যেকটি শব্দ মোহমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করে।হৃদয়ের এক কোণায় রুদ্রের প্রতি আলাদা সম্মান তৈরি হয়। কারণ, দেশপ্রেম আজকাল কার মাঝে দেখতে পাওয়া যায়? সকলেই তো পশ্চিমাদের অনুকরণ করতে ব্যস্ত।

কারো গলা খাঁকারি শুনে রুদ্র আর টগর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে তনুজা দাঁড়িয়ে আছে। টগর
এক লাফে বোনের সামনে চলে যায়। রুদ্র এদিকসেদিক তাকায় তবুও ভুল করে হলেও তনুজার দিকে তাকায় না। এই মেয়ের দিকে তাকালে রুদ্রের বুকে অজানা তোলপাড় শুরু হয়।

—আপনারা দাদীজান এসেছেন। আপনাকে মা ডাকছেন। অতি শীঘ্রই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে।

তনুজার কথা শেষ হবা মাত্রই রুদ্র দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। পেছন পেছন টগর আর তনুজা এগিয়ে যাচ্ছে। টগর এসবের কিছু বুঝতে না পারলেও তনুজা ঠিকই বুঝতে পারছে কোনো কিছুর কারনেই হয়তো ওদের মা এতদিন অভিমান করে বাবার বাড়িতে যোগাযোগ রাখেননি।

—নানীজান এসেছেন মানে আজ বড়ো ধরনের কিছু হতে চলেছে। দীর্ঘ বিশবছর পর মা-মেয়ের মিলন হলো। না জানি কি হয়?

#চলবে

#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১২.

ঘরের এক কোণে মাথা নীচু করে বসে আছি। আমাকে ঘিরে থাকা চেনা-অচেনা মানুষগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে একপ্রকার বিরক্তি সৃষ্টি হচ্ছে আমার মাঝে। তবুও, নিরুপায় আমি চুপটি করে ভদ্র বালিকা সেজে বসে আছি। নয়তো লোকে আবার নতুন কথা রটাবে মেয়েকে ভালো শিক্ষা দেয়নি আমার মা।

এমনসময় আমার ডান হাতের কব্জিতে কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম হাসোজ্জল মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আমার নানীজান। আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করতে যেয়েও বাধাপ্রাপ্ত হলাম। কারণ, আমার নানীজান আমার থুতনিতে হাত রেখে বললেন,

— হয়তো, আমাদের উপস্থিতি এখন তোর কাছে খারাপ লাগছে। কিন্তু ,পরে যখন আমাদের সিদ্ধান্ত বুঝতে পারবি তখন এই বিরক্তিবোধ থাকবে না। আমার রুদ্র ওতটাও খারাপ নয়। বিয়ের পাত্র হিসেবে একেবারে তোর উপযুক্ত।

কথাগুলো শেষ করে আমার হাতে পুরনো একজোড়া স্বর্ণের বালা দিয়ে উঠে চলে গেলেন আমার নানীজান। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। কি থেকে কি হয়ে গেলো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এই তো বিকেলে গেলাম আমার মায়ের ভাইয়ের ছেলেকে খবর দিতে যে উনার দাদিজান এসেছেন। বাড়িতে এলাম ঠিকই কিন্তু এসে যেন আকাশ থেকে মাটিতে এসে পরলাম। সেই তখন থেকেই মাথায় এক আকাশসম দুশ্চিন্তা এসে ভর করেছে ।

অতি চেনা-জানা আমার গর্ভধারিনী মাকে এখন আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। মা নিজের পরিবারের কথা এতদিন আমাদের কাছ থেকে গোপন করে রেখেছিল। জানি না কি কারণ হতে পারে? তবে আজ যখন সব পরিষ্কার হলো তবে মরিচীকা ধরে যাওয়া সম্পর্ককে নতুন করে ঝালাই দেবার দরকার কি! তাও নিজের মেয়েকে ভাইয়ের পুত্রের কাছে বিয়ে দিয়ে?

রাগের মাথায় হাতে থাকা বালা জোড়া ছুঁড়ে ফেলতেই মা কোত্থেকে এসে আমার গালে সপাটে থাপ্পড় মেরে দিলেন। থাপ্পড়ের জোড় এতটাই ছিল যে আমার মনে হলো, যেন আমার চোখে কীসের আলো যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠেছে। গালে যেন কে মরিচ ডলে দিয়েছে। চোখের পানি গড়িয়ে পরছে কিন্তু, তখন আমার মনে আবেগ কাজ করছিল, তাই ব্যাথা আমার শরীরে দাগ কাটতে পারিনি।

— তোর কি মাথাটা খারাপ হলো? যাত্রা করে তোকে আজ প্রথমবারের মতো জমিদার বাড়ির ঐতিহ্যবাহি বালাজোড়া দিয়ে গেলো আমার মা। আর তুই কিনা ফেলে দিচ্ছিস! সমস্যা কি তোর?

বেশ জোরে কথাগুলো বললো তনুজার মা। তনুজা এতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারলেও এবার আর পারল না। ঝাপসা নয়নে কেঁদে কেঁদে ওর মাকে বললো,

— চিনি না জানি না কার সাথে তুমি আমার বিয়ে ঠিক করেছো?

— চিনব না কেন! রুদ্র আমার রক্তের মানুষ। আমার আপন ভাইয়ের ছেলে।

— এতকাল পর তোমার পরিবার আছে আমরা জানতে পারলাম! আমাদের কাছ থেকে গোপন রাখলে কেন? আর উনারা যদি তোমার পরিবারের লোক হয় তবে এতদিন কেন তোমার খোঁজ খবর রাখেনি?

— সবকথা জানতে নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি বহুকাল আগে মাতৃস্নেহের কাছে প্রেম-ভালোবাসা জিতে গিয়েছিল। যার পরিণিতি হিসেবে আমি ছিলাম পরিবার হীন। কিন্তু , আজ যখন আমার পরিবার আমাকে ফিরে পেতে চায় তবে আমি মুখ ফিরিয়ে নেব কেন?

— তুমি অনেক স্বার্থপর মা। নিজের জন্য মেয়ের ইচ্ছেকে বলিদান দিচ্ছো।

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হয়ে আমবাগানে চলে যায়। মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালাজোড়া কুড়িয়ে এনে আলমারিতে তুলে রাখে।

মনে মনে তখন হাজারো তান্ডব চলছিল তনুজার মায়ের। একদিকে বাপ মরা মেয়ে অন্যদিকে বিবাহযোগ্য মেয়ে ঘরে থাকলে পাড়ার দুষ্ট লোক থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। জেনে শুনে নিজের মেয়েকে কেউ আগুনে ফেলে দেয়! তাই তো আজ যখন নিজের মায়ের মুখ থেকে রুদ্রের জন্য তনুজার বিয়ের প্রস্তাব পায় তখন আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি তনুজার মা। রুদ্রের চাইতে ভালো ছেলে তনুজার জন্য হতেই পারে না। মেয়ে যতই কাঁদুক কাটুক বিয়ের পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।

এমন হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে মেয়েকে খুঁজতে বের হলেন কারণ সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে ।

মা-মেয়ের মান-অভিমান চলছে আজ চারদিন ধরে। তনুজা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে একবার রুদ্রের সঙ্গে বিয়েটা হোক আর কখনোই ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না। হুহ তখন নিজের মেয়েকে দেখতে না পেলে এমনিতেই তনুজা তনুজা বলে কাঁদবে আর তখন মায়ের একটা উচিত শিক্ষা হবে।

সদ্য কিশোরী বয়স পেরিয়ে যাওয়া তনুজার এমন বাচ্চামো ভাবনা টগর গালে হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে শুনে রোজ পুকুর ঘাটে বসে।

এমনি একদিন পুকুর ঘাটে বসে ছিল তনুজা। কোত্থেকে এসে টগর তনুজার কানে কিছু একটা বলতেই তনুজার গালে লজ্জার লালিমা ভেসে ওঠে। পুকুরের জলে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে কপালে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিতে গিয়েও থেমে যায় তনুজা। কি করতে যাচ্ছিল সে! তনুজা যেন নিজের কাজে নিজেই লজ্জা পেলো।

টগর হাতের ইশারায় তনুজাকে ওদের বাড়ির ছাঁদের দিকে তাকাতে বললো। তনুজা ছাঁদের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরনে শুভ্র বর্ণের সুঠাম দেহের অধিকারী এক পুরুষকে। যার সঙ্গে আর কিছুদিন পরেই তনুজার জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধবে। গালের দাঁড়ি যেন আরও ঘনকালো হয়ে গজিয়েছে। স্বাস্থ্য বুঝি আগের থেকে আরও শুকিয়ে গেছে। তনুজা যখন রুদ্রকে দেখছে আর কথাগুলো মনে মনে বলছে এমনসময় কিছু একটা দেখে তনুজার মন নিমপাতার স্বাদ মুখে ছুলে যেমন তিক্ততায় পুরো মুখে ছড়িয়ে যায় ঠিক তেমনি হলো।

বেশ সুন্দরী একটি মেয়ে রুদ্রের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। হাসিমুখে কতশত কথা হচ্ছে তাদের মাঝে। দু’জনকে মানিয়েছে বেশ। লম্বা গড়নের মেয়েটার কোমড় ছাড়িয়ে যাওয়া কোঁকড়ানো কেশরাশি দেখলে যে কোনো মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। দূর থেকে মেয়েটার চেহারার গঠন বুঝতে না পারলেও তনুজা হলফ করে বলতে পারবে মেয়েটা কোনো উপন্যাস থেকে উঠে এসে টুপ করে তনুজাদের ছাঁদে এসে পরেছে।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে টগরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির টিন আর বাশের কন্চি দিয়ে তৈরি সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে তনুজা। ততক্ষণে তনুজার মা হবু জামাতার জন্য নানান পদের খাবারের আয়োজন শুরু করেছেন। মেয়ের কাছে এসে কাজের ফাঁকে বলে গিয়েছেন, যেন পরনের কাপড় বদলে সুন্দর দেখে একটা থ্রী-পিছ পরে নেয়। তনুজা ওর মায়ের কথায় হ্যা কিংবা না উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। এরই ফাঁকে টগর একদৌড়ে রুদ্রের কাছে গিয়ে বলে দিলো তনুজা ওর ঘরে ফিরে এসেছে।

মেঘলাকে সঙ্গে নিয়ে তনুজার ঘরের সামনে চলে যায় রুদ্র। যতই তনুজার ঘরের সামনে অগ্রসর হচ্ছে ততই রুদ্রের বুকে অসহনীয় মাত্রায় কাঁপছে। বুকে হাত রেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করছে রুদ্র। মেঘলা নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের এহেন অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে কুটি কুটি হচ্ছে।

রুদ্র একবার মেঘলার দিকে তাকাতেই মেঘলা চুপ হয়ে যায়। কারণ, রুদ্রকে রাগিয়ে দিলে ভালো হবে না। তনুজার ঘরের দরজার সামনে এসে রুদ্র চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিনের প্রতিনিয়ত একপলক তনুজাকে দেখার অদম্য আগ্রহকে কি করে কড়া শাসনের মাঝে রেখেছিল সে। নিজের মনের সঙ্গে নিজের যুদ্ধে জিতে যাওয়াটা মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পরে। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল রুদ্রের। মনের সঙ্গে হার মেনে তবেই আজ তনুজাকে একটি পলক দেখার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এসেছে।

এমন সময় দরজা খুলে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসে তনুজা। হুট করে রুদ্রকে চোখের সামনে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় তনুজা। তাই তো চোখের দৃষ্টি তখন নিজের পায়ের পাতা অব্দি নিবদ্ধ রেখেছে তনুজা। তনুজাকে দেখে রুদ্রের মনে এক পশলা বৃষ্টির জল এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় ওর হৃদয়কাননে। মোমের পুতুলকে যেন আগের থেকে আরও আদুরে দেখাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি নীচু করে রেখেছে কেন! গভীর ওই কালো দুচোখের দিকে তাকিয়ে মহাসমুদ্রে সাঁতরে বেড়ানো যায় আর এমনটাই রুদ্রের মনে হয়। বেগুনি রঙের থ্রী-পিছ পরনে থাকা এই বাঙালি তরুণীকে দেখে রুদ্র ফের প্রেমে পরলো। এই প্রেম থেকে উঠতেই মন চাইবে না। মনের এই কিনারা থেকে ওই কিনারা পর্যন্ত শুধু তনুজার হৃদয়বক্ষে সাঁতরে বেড়াবে।

— এহেম, এহেম আমি মেঘলা। রুদ্রের বিএফ।

মেঘলার মুখ থেকে বিএফ শব্দটি বর্জ্যঘাতের ন্যায় রুদ্র আর তনুজার মাথার ওপরে এসে পরে। মানে কি বিএফ!

— আরে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি! বেস্ট ফ্রেন্ডের ইনশর্ট বিএফ । এভাবে অবাক হয়ে তাকানোর মানে কি?

মেঘলার কথায় রুদ্র যেমন তেমন তনুজার প্রানে জল আসে। মেঘলা হুট করে তনুজাকে জড়িয়ে ধরে। তনুজা নেঘলার এমন আচরনে কিছুটা অবাক হয়। কারণ, ওদের মাঝে ওতটাও পরিচিত হয়নি।

— আমার ছোট্ট একটা বোনের শখ ছিল কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যকিছু তাই তো আমার বোন দূরের থাক ভাই অব্দি নেই। তোমাকে দেখার পর আমার কেমন আপন বোন হচ্ছে। তাই একটু বুকে জড়িয়ে নিলাম। আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন। এখন তুমি আমাকে বোন মানো আর না মানো।

কথাগুলো বলতে বলতে তনুজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় মেঘলা। বোকা বোকা চোখে মেঘলার গমনের পথের দিকে চেয়ে রইলো তনুজা। তনুজার চোখের চাহনির মানে বুঝতে পেরে রুদ্র বললো,

— ও একটু এমনি তবে মনের দিক দিয়ে ভীষন মিষ্টি একটা মেয়ে।

রুদ্রের কথায় তনুজা নিজেকে ধাতস্থ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুদ্রের মনে তখন হাজারো কথার মেলা কিন্তু মুখ দিয়ে টু শব্দ বের হচ্ছে না। কিন্তু, কথা তো বলতেই হবেই। তাই মনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে রুদ্র তনুজাকে বললো,

— গতকাল আমাদের বাড়িতে গেলে অথচ আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে এলে যে?

তনুজা চোর ধরা পরে যাওয়ার মতো নিজেকে আড়াল করতে চাইল ঘোমটার পেছনে। কিন্তু, পারল না কারণ তার আগেই রুদ্রের কথায় তনুজা থমকে যায়।

— আমি কিন্তু তোমাকে দেখেছি যখন তুমি বরই গাছের দিকে ঢিল ছুড়ছিলে। লোকে যখন জানবে জমিদার বাড়ির ছোট বৌ নিজের শ্বশুরবাড়িতে এসে বরই চুরি করে খেয়েছে তখন আমি মুখ দেখাব কি করে?

তনুজা যেন লজ্জা পেয়ে মুখটাকে এইটুকুন করে ফেলল। আসলেই তো কি দরকার ছিল জমিদার বাড়িতে গিয়ে বরই চুরি করার! নানীজানের সঙ্গে চুপচাপ বসে থাকতো আর দাসীদের সঙ্গে জম্পেশ আলাপ চলত সেটাই তো বেশ ছিল।

তনুজা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্র তনুজার মন খারাপের আভাস বুঝতে পারে। তাই তো এক কদম এগিয়ে এসে তনুজার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

— বিয়ের পর তোমার সাথে আমিও বরই চুরি করব। একসঙ্গে বসে লবনমরিচ মাখিয়ে বরই খাব। আর যদি বড্ড ঝাল লেগে যায় তবে অন্য উপায়ে ঝাল সংবরণ করব।

কথাটি বলে তনুজার কাছ থেকে সরে এসে দাঁড়ায় রুদ্র । রুদ্রের কথার মানে বুঝতে পেরে তনুজা যেন লজ্জায় মরে যাবে। না পারছে রুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আর না পারছে এক দৌড়ে এইখানে থেকে বহুদূরে চলে যেতে যেখানে রুদ্র নামক বেহায়া কথা বলা মানুষটাই থাকবে না।

কিন্তু, কে জানত তনুজার এই দোয়া একদিন সত্যি পূরণ হয়ে যাবে? মানুষটার থেকে বহু ক্রোশ দূরে হারিয়ে যেতে হয়েছিল তনুজাকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here