বিবর্ণ_ভালোবাসা,13,14

0
279

#বিবর্ণ_ভালোবাসা,13,14
#Tahmina_Akhter

১৩.

— কি হয়েছিল তখন? যার কারণে আপনি রুদ্রের কাছ থেকে দূরে ছিলেন মিস তনুজা?

ড. রোয়েনের করা প্রশ্ন তনুজার কূর্ণকুহুর অব্দি পৌঁছানো মাত্র সেদিনের দৃশ্য মানসপটে দৃশ্যমান হলো যেদিন রুদ্রের মা এসে অজানা কোনো এক কারণে তনুজার মাকে অনেক অপমান করে। তনুজার খুব ভালোভাবে মনে আছে সেদিন ওর মা কি করে মুখে কাপড় চেপে ধরে অঝোরে ধারায় চোখের জল ফেলছিল!

— আমি ছিলাম পুকুর ঘাটে। রুদ্রের মা কখন আমাদের বাড়িতে এসেছেন তা আমি জানতাম না। বাড়ির ভেতরে কারো চিৎকার চেচামেচি শুনে আমি বাড়ির পথে রওনা দেই। যেহেতু বাড়ির কাছাকাছি পুকুর ঘাট তাই সহজে বাড়ির ভেতরকার উচ্চস্বরের কথাবার্তা অনায়াসে শোনা যেত। বাড়ির ভেতরে আসার পর সর্বপ্রথম আমার নজরে পরে আমার মায়ের দিকে। আমার মা শাড়ির আঁচলের কোণা দিয়ে মুখে চেপে ধরেছেন যাতে উনার কান্না কেউ দেখতে না পায়। এদিক দিয়ে অচেনা একজন মহিলা আমার মাকে বিনা কারনে কথা শোনাচ্ছে এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলব তার আগেই মায়ের ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে হলো। রুদ্রের মায়ের দৃষ্টি এবার আমার ওপরে এসে পরলো। মায়ের উদ্দেশ্য করা গালমন্দ বন্ধ করে এবার আমার সামনে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে লাগলো, যেন আমি উনার ছেলেকে বিয়ে না করি। যদি বিয়ে করি তবে উনার পরিবার নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে। একজন মায়ের আবদার যেন আমি রাখি।

— তো আপনি কি করেছিলেন মিস তনুজা?

উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে ড. রোয়েন। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালার দিকে গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যান্ত্রিক গলায় বলছে,

— সেদিন এক মায়ের আবদার রেখেছিলাম আমি। রুদ্রের মায়ের আবদার রেখেছিলাম আমি। রুদ্রকে ভুলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমি। সেদিন রুদ্রের মা ভীষণ খুশি হয়ে আমাকে অগাধ দোয়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, আমার মনে হলো সেদিনের দেয়া রুদ্রের মায়ের দোয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ। কারণ, আমার মা সে রাতে মারা যায়।

শেষের কথাটি বলে ডুকরে কেঁদে উঠে তনুজা। রোয়েন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় তনুজার মুখের দিকে। এমনও কি হয় মানুষের জীবনে! ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি যেদিন দিতে হলো সেদিন গর্ভধারীনি মা তাকে ছেড়ে চলে গেলেন এই পৃথিবী থেকে। কতটা নির্মম এই পৃথিবীর মানুষজন!

— মা সারারাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছেন। আমি মায়ের শিয়রে বসে মায়ের কাছে হাজারবার জানতে চেয়েছিলাম, মা কি এমন কথা তোমাকে বলেছে রুদ্রের মা যে কারণে তুমি এভাবে কান্না করছো?
মা আমার কথার উত্তর দেয়নি। পলকহীনভাবে তাকিয়ে রয় আমার আর টগরের মুখের দিকে। আমি জানতাম না এই মায়াময় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকা আমার মায়ের শেষ তাকানো হবে। আর কখনো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, বলবে না তনুজা টগর এদিকে আয় তোদের একটু দেখি। আমার মা সেদিন এক বুক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ডক্টর। সেই কষ্টের কথা আমাকে বলেনি আমার মা। যদি জানতে পারতাম কি এমন কথা শোনার পর আমার মা এতটা কষ্ট পেয়ে চলে গিয়েছিলেন?

কথাগুলো বলতে বলতে উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে থাকে তনুজা। রোয়েন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখ। কিন্তু, লোকের আবার মানা পুরুষ লোকের কাঁদতে নেই। কিন্তু, মাঝে মাঝে কিছু দুঃখ শুনলে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করে পুরুষ মানুষের। কিন্তু সমাজের নিয়মনীতি আর লোকলজ্জায় সেই কান্না টুকু প্রকাশ করা যায় না। তনুজা নামক মেয়েটাকে কি বলে স্বান্তনা দিবে জানা নেই রোয়েনের? তবে ভবিষ্যতে কখনো যদি তনুজার কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পন্য করবে না রোয়েন।

বাম হাতের কব্জি উঁচু করে দেখলো সময় তখন দুপুর একটা। লাঞ্চ টাইম তাই ড. রোয়েন তনুজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবিনের বাইরে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে তনুজাকে বলে যায় রোয়েন আবারও ফিরে আসবে। কারণ তনুজার সাথে তার অনেক কথা বলার বাকি আছে।

বিকেল পাঁচটা.

সূর্যের লাল রঙের আভা পুরো শহরের বুকে ছড়িয়ে আছে। যানজট পূর্ণ রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে মেঘলা। মনে তখন হাজারো প্রশ্নের আনাগোনা। তনুজাকে যবে থেকে দেখেছে তখন থেকেই ছোট বোন বলে ভেবে এসেছে। কিন্তু, আজকের পর থেকে তনুজার মনে হয়তো মেঘলার জন্য কোনো সম্মান থাকবে না, না থাকবে বোনপ্রীতি। যা অবশিষ্ট আছে তা হয়তো ঘৃণা বৈ কিছুই না। আজ দুদিন ধরে রুদ্রের সঙ্গে দেখা হয় না মেঘলার। একপ্রকার রুদ্রই হয়তো মেঘলাকে এড়িয়ে চলছে। রুদ্রের মনের অবস্থা তেমন ভালো নয়। নিজের প্রেয়সীকে এতটা কাছে পাওয়ার পর যখন হারিয়ে ফেলতে হয় তখন মানুষ পাগল হয়ে যায়। অথচ, রুদ্র এমন একটা মানুষ যে কিনা তনুজাকে ফিরে পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করেছে? যার সবটাই মেঘলার কাছে উন্মুক্ত।

দূর আকাশের দিকে মেঘলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হুট করে তলপেটসহ দুই উরুতে অসহনীয় ব্যাথা করছে। মেঘলার সন্তানের এই পৃথিবীতে আশার সময় হয়েছে তবে। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সর্বপ্রথম কল দেয় ওর বাবার কাছে। মেঘলার বাবা মেয়ের কল পেয়ে অতি দ্রুত রওনা হয় শপ থেকে। মেঘলার বাবা এসে অতি দ্রুতই মেয়েকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়। হসপিটালের সকল ফর্ম্যালিটি শেষ করার পর মেঘলাকে অটিতে শিফট করা হয়। মেয়েটা একা একা কেন এতকিছু করছে বুঝতে পারছে না মেঘলার বাবা! রুদ্রকে কল করে মেঘলার অবস্থা জানিয়ে দিলেন মেঘলার বাবা। রুদ্র তখন নিজের ঘরে বসে ছিল। কল পেয়ে অতি দ্রুত রওনা হসপিটালের উদ্দেশ্য।

———————–

তনুজা তখনও ঘুমিয়ে আছে। অথচ সকাল সাতটা বাজে। কেবিনের বাইরে থেকে কাচের দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে মোমের পুতুলের দিকে। মোমের পুতুল সেই আগের মতো নেই। চেহারায় কতটা মলিনতায় ছেয়ে আছে! গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে আছে, চোখের নীচে অধিক দুশ্চিন্তার ফল। দেখলে যে কেউ ভাববে কাজল লেপটে আছে। রুদ্র নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে রুদ্র। তনুজার পায়ের কাছে বসে পরে রুদ্র। তনুজার মুখের দিকে স্বস্তি ফিরে আসে রুদ্রের হৃদয়ে। আজ তিনদিন ধরে কতশত অনুরোধ আর কাকুতি মিনতি করেও তনুজাকে একপলকের জন্যেও চোখের দেখা দেখতে পায়নি। তাই তো আজ চোরের মতো সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তবেই তনুজাকে দেখতে এসেছে।

ততক্ষণে তনুজার ঘুম হালকা হতে শুরু করেছে। ভালোবাসার মানুষের গায়ের গন্ধ এসে নাকে লাগছে তনুজার। বিভ্রান্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাতেই স্থীর হয়ে যায় তনুজা।

মানুষটা কিছুটা দূরত্বে বসে আছে। চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ। চোখের দৃষ্টি নিজের কোলের মাঝে নিবদ্ধ করে রেখেছে। রুদ্রের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তনুজা রুদ্রের কোলের দিকে তাকায়।

ফুটফুটে এক শিশু রুদ্রের কোলে। পরম মমতায় আগলে রেখেছে রুদ্র। তনুজার এই দৃশ্যটা ভীষণ ভালো লাগে। মনটা কেমন উৎফুল্ল হয়ে যায়! কিন্তু, হুট করে মনের এককোনা থেকে কেউ জানান দেয়, তনুজা রুদ্র তোমাকে ধোকা দিয়েছে। আর কোলের বাচ্চাটা নিশ্চয়ই তোমার সতীনের।

তনুজার দুচোখে ছাপিয়ে জল নামে। তনুজা কি করে ভুলে গেল সেই কালো স্মৃতি! রুদ্রের সাহস তো কম নয় ওর প্রথম পক্ষের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তনুজার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?

রুদ্র তখনও টের পায়নি যে তনুজা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।

— আপনি কেন এসেছেন এখানে?

তনুজার গলার স্বর শুনে রুদ্র তনুজার পানে তাকায়। তনুজার চোখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। রুদ্র হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় তনুজার মুখের দিকে। কাঁদছে কেন তনুজা? রুদ্র জানেও না কেন তনুজার চোখের জলের কারণটা হচ্ছে রুদ্র এবং রুদ্রের কোলে থাকা বাচ্চাটি।

চলবে…

#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৪.

— আমাদের মেয়েকে দেখবে না তনুজা?

যান্ত্রিক গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে রুদ্র। এমন প্রশ্ন শুনে তনুজার ভীষণ রাগ করার কথা। কিন্তু, কেন যেন তনুজার রাগ হলো না। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।

— তনুজা??? এই তনুজা???

তনুজা রুদ্রের ডাকে সাড়া দেয় না। রুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে নিজের কোলে থাকা ছোট্ট মনুষ্য পুতুলকে। ছোট্ট চোখ জোড়া, ছোট নাক আর রক্তাভ ঠোঁট, ছোট ছোট হাত-পা গুটিয়ে কি করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে!

তনুজা এমন দৃশ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ফোসফাস করছে। কিন্তু, রুদ্রের মুখ থেকে শেষের কথাটি শুনে তনুজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় রুদ্রের মুখের দিকে।

— জানো তনুজা আমার কোলে থাকা এই পুতুলটা না পৃথিবীর আলো টুকু দেখতে পায়নি। অন্ধকার জগত থেকে এসেও ফের ওর অস্তিত্ব অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে আমার তনুজাকে মা বানানোর স্বপ্ন। শত আশা আজ ভেঙেচুরে গিয়েছে। আমার তনুজা কোনোদিন মা ডাক শুনতে পাবে না।

তনুজার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। রুদ্র কি বলছে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না । তাই তো কাঁপা কাঁপা গলায় তনুজা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বলছেন আপনি এসব? আমাকে মা বানানোর স্বপ্ন ভেঙেচুরে যাবে কেন? আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তান মারা গেছে তারমানে এই না যে আমিও এই সন্তানের মা।

তনুজার কথা শুনে পাগলের ন্যায় উচ্চস্বরে হাসতে থাকে রুদ্র। রুদ্রের এমন আচরণ দেখে তনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রুদ্র নিজের হাসি বন্ধ করে তনুজার সামনে গিয়ে মৃত বাচ্চাটাকে তনুজার কোলে আলতোভাবে রেখে দেয়। তনুজা বাচ্চাটির গায়ের শীতলতা অনুভব করতে পারছে। মিশ্র এক অনুভূতি তনুজার হৃদয় থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কি শীতল এই ছোট্ট দেহখানা! বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে তনুজার চোখের দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে। রুদ্র পাগলের মতো নিজের চুলগুলো টানছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই মাথায় ঢুকছে না রুদ্রের! রুদ্রের এমন পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে তনুজা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মনের মাঝে তখন বিভিন্ন প্রশ্নের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। না জানা অব্দি শান্তি পাবে না হয়তো তনুজা। তাই তো মনের রাগকে এককোনায় রেখে তনুজা শীতল কণ্ঠে রুদ্রকে প্রশ্ন করে,

— আপনি এমন করছেন কেন? বলুন না আমাকে?

তনুজার শীতল কণ্ঠ শুনে রুদ্র স্থীর হয়। হৃদয়কে প্রশান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টাটুকু করে দীর্ঘ শ্বাস চেপে বললো,

— শুধুমাত্র তুমি সন্তান দানে অক্ষম দেখে সেদিন আমার মা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল।

কথাটি বর্জ্যঘাতের ন্যায় তনুজার মাথার ওপর পরলো। রুদ্রের বলা একটা শব্দ বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। তবুও, মন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে এই ভেবে যে, শুধুমাত্র ওর অক্ষমতার জের ধরে হয়তো ওর বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। যার দরুন ওর মা এই দুঃখ টুকু সামাল দিতে না পেরে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় পরকালে। কিন্তু, সেদিন মা কেন বললো না যে, তনুজা তুই মা হতে পারবি না দেখে তোর বিয়েটা ভেঙে গিয়েছে। সেদিন যদি একটিবার ওর মা বলতো তবে তনুজার মনে আজ যতটা আঘাত লেগেছে কথাটি শুনে তখন তার চেয়েও শতগুণ আঘাত কম পেতো সে ।

তনুজার হৃদয়ে আজ অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু, দেখার মতো কেউ নেই। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেই-বা দেখতে পারে! চোখের জল শুকিয়ে গেছে তাই তো বেরুবার নাম নেই। শক্ত পাথরের ন্যায় বসে আছে মৃত বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে। তনুজাকে দেখে মনে হচ্ছে জগতে ওর চেয়ে দুঃখী, নিঃস্ব বোধহয় আর কেউই নেই।

কিছুটা সময় ব্যয় করে তনুজা নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো,

— আমার অক্ষমতা জেনেও তবে কেন আপনি বিবাহিত হবার পরও আমাকে বিয়ে করতে গেলেন? তাও আবার সবটা গোপন রেখে? আজ আমি সবটা জানতে চাই।

তনুজা একপ্রকার চিৎকার দিয়ে কথাটি বলে। তনুজার এমন আচরণ এবং প্রশ্ন শুনে রুদ্র নড়েচড়ে বসে সবটা জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। আজ যদি না জানাতে পারে তবে আর কোনোদিনও জানাতে পারবে না।

— মা তোমাকে দেখতে চাওয়ার বাহানায় আমাদের কাউকে না জানিয়ে চলে যায় তোমাদের গ্রামে। গ্রামের মানুষ মাকে চিনতে পারছিল না দেখে পরিচয় জানতে চায়। মা নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তোমার কথা এবং ফুপির কথা বললে। উনারা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলেছিল, তুমি নাকি কোনোদিনও মা হতে পারবে না কারণ ছোট্ট বেলা তোমার কোন সমস্যা কারণেই নাকি তোমার জরায়ু কেটে ফেলা দেয়া হয়।

এতটুকু অব্দি বলে রুদ্র চুপ হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে কারণ এরপরের ঘটনার জন্য রুদ্র কিংবা তনুজা কেউই দায়ী ছিল না। তবুও দুজনে একই কষ্টে দিনের পর দিন জর্জড়িত হয়েছে। তনুজা নির্বাক শ্রোতা হিসেবে সবটা শুনছে। রুদ্রকে চুপ হয়ে যেতে দেখেই তনুজা এবার বললো,

— সবটা শুনে ছোট মামি আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা ভেঙে দিলেন। কষ্ট পায়নি সেদিন যখন শুনেছিলাম আমি আপনার স্ত্রী হতে পারব না। কষ্ট তখন পেয়েছিলাম যখন আপনার মায়ের বেপরোয়া ব্যবহার দেখে আমার মায়ের দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরেছিল। আমার মা সেই রাতটা কেঁদে কাটিয়েছে একটিবারের জন্যেও আমাকে বুঝতে দেয়নি আমার অক্ষমতার কারণেই এই বিয়েটা ভেঙে গেছে। মা মারা গেল সেই সাথে আমার অক্ষমতার খবরটি হারিয়ে গেছে কালগর্ভে।

তনুজার চোখ দিয়ে এবার জল নেমেছে। এতদিনের মনের মাঝে কষ্ট পুষে রাখার কারণ উদঘাটন হবার পর আজ চোখের জল ফেলে নিজেকে হালকা করার বৃথা চেষ্টা চলছে। রুদ্র তনুজার কান্না দেখে নিজেকে ধাতস্থ করতে না পেরে তনুজার মাথাটা নিজের বুকে মাঝে চেপে ধরলো। ভরসাস্থল জায়গায় মাথা গুঁজতে পেরে যেন তনুজার কান্নার মাত্রা বহুগুণ বেড়ে ওঠে। রুদ্র তনুজাকে বাঁধা দেয় না কারণ আজ দুঃখকে বুকের মাঝ থেকে বের করে আনতে হবে নয়তো তনুজা নামক শক্ত মানবী কখনোই বের করে আনতে চাইবে না, নিজের চোখের জল অন্য কেউ দেখুক তাও চাইবে না।

সময় অতিক্রম হয় একসময় ঘড়ির ঢংঢং শব্দে জানান দেয় সময় তখন সকাল আটটা বাজে। তনুজা রুদ্রের বুকে থেকে মাথা উঁচু করে নিজের কোলে থাকা বাচ্চাটির গালে আলতোভাবে ধরে বললো,

— মেঘলা আপু কেমন আছে?

মেঘলার নামটি শুনে রুদ্রের চেহারায় কালো মেঘের ঘনঘটা ছেয়ে যায়। মুখটা অন্ধকার করে তনুজার হাত ধরে বললো,

— চলো মেঘলার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।

তনুজা একহাতে বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে অন্যহাত তখন রুদ্রের বন্দি। রুদ্রের পেছনে পেছনে তখন তনুজা রওনা হয় মেঘলাকে দেখার উদ্দেশ্য। একটিবার খালি মেঘলার সঙ্গে দেখা হোক তনুজার সবটা জানতে চাইবে। কেন এতকিছু করেছে ওরা দুজনে মিলে? খুব কি প্রয়োজন ছিল রুদ্র আর মেঘলার মাঝে তনুজাকে প্রবেশ করানোর? সুখের সংসারে কে নিজ হাতে আগুন ধরায়?

————————————

হসপিটালের সাদা বেডে অসাড় হয়ে শয়নরত অবস্থায় আছে মেঘলা। দুচোখের পাতায় যেন পুরো রাজ্যের ক্লান্তি ছেয়ে আছে। এসির হিমশীতল হাওয়ার মাঝে থেকেও দরদর করে ঘামছে। জীবনের অন্তিম মূহুর্তের দাঁড়গড়ায় এসে পৌঁছেছে। তবুও, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসি টুকু দেখলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য হবে যে, মেঘলা হয়তো তাদের মাঝেই থাকবে, কোথাও হারিয়ে যাবে না ।

মেঘলার বেডের পাশের ছোট্ট টুলে বসে মেঘলার ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে রুদ্র। অদূরেই মেঘলার সদ্য জন্মানো ছোট্ট ফুটফুটে মৃত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। তনুজার মনের আসন্ন ঝড় নিমেষে উধাও হয়ে যায় মেঘলার অসহায় মুখখানা দেখে। হাসোচ্ছ্বল মানুষটা হুট করে যেমন গম্ভীর হয়ে গেলে পরিবেশে গুমোট ধারণ করে ঠিক তেমনটাই অনুভব করছে তনুজা।

বহু কষ্টে হাতের ইশারায় তনুজাকে কাছে ডাকলো মেঘলা। তনুজা মেঘলার ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না। তড়িঘড়ি করে মেঘলার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তনুজাকে দেখে রুদ্র টুল ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেঘলা কোনোমতে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

— আল্লাহর কাছে এবং রুদ্রের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওয়াদা আর রাখতে পারলাম কই? মেয়েটা পৃথিবীতে এসেও আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেছে। তনুজা তোকে মা ডাক শোনাতে আমি ব্যর্থ হলাম রে..

তনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় মেঘলার দিকে। মেঘলা কি বলছে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মেঘলা কেন ওকে বাচ্চা দিতে যাবে? যেখানে রুদ্র এবং মেঘলার সুখের সংসার !

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here