#বিবর্ণ_ভালোবাসা,15,16 last
#Tahmina_Akhter
১৫.
….পাকিস্তানী এক ছেলের সঙ্গে আমার কঠিন প্রেম জমে গেলো ভার্সিটির প্রথমদিনেই। এত মায়াময় চেহারা ছিল তার! ছোট্ট ছোট্ট চোখগুলো দিয়ে যখন আমার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো না তখন আমার এক অন্যরকম অনুভূতি হতো! বলে প্রকাশ করা যাবে না কেমন অনুভব করতাম আমি? ক্লাস মিস করে দুজনে চলে যেতাম পাশের কোনো আয়ল্যান্ডে। মাথার ওপরে নীলচে আকাশ, বাতাসের দোলে নারকেল গাছের মন জুড়ানো শীতল বাতাস, সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোতে যখন ইমরান চোখ মুখ কুচকে মুগ্ধ হয়ে সুমদ্রের চারপাশের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত তখন আমি ওকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। ইমরানকে দেখার মাঝে আমার কোনো ক্লান্তি ছিল না। সময় আমার কাছে কোনো ম্যাটারই ছিল না। ও যখনই পার্ট টাইম জব কিংবা পড়াশোনা থেকে ফাঁকফোকড় পেয়ে আমাকে কল দিয়ে আধভাঙা বাংলায় বলতো,
” চলো না মেঘলা সাথ মে ঘুমতে যাতে হে”
তখন যদি আমার সামনে পাহাড় অবস্থান করতো তবে আমি পাহাড় ভেঙে হলেও ইমরানের কাছে চলে যেতাম।
হুট করে একদিন ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে মজার ছলে বলেছিলাম,
” ইমরান চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি”
আমার কথায় ইমরানের কি যে হলো সেদিন ও আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো ওর এক বন্ধুর বাড়িতে। ব্যস, সেদিন স্বল্প পরিসরে আমার আর ইমরানের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
মাঝেমাঝে ভার্সিটির বাহানায় ওর ভাড়া বাসায় চলে যেতাম। সেখানে কিছু সময় আমাদের একান্তই বহাল থাকতো। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার আর ইমরানের বিয়ের ছয়মাস কেটে যায়।
এতকিছুর পরও কে জানত এত ভালোবাসার মাঝে কোনো খুঁত থাকতে পারে! একদিন হুট করে ইমরানের চিহ্ন এই শহরের বুক থেকে হারিয়ে যায়। এমন কোনো এরিয়া নেই যে যেখানে ইমরানকে আমি খুঁজিনি। ও যেই রেষ্টুরেন্টে পার্টটাইম জব করতো সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, ইমরান ওর স্বদেশ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। এতটুকু বাক্য আমার পুরো জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। পেটে দেড়মাসের বাচ্চা নিয়ে যখন আমি নানানরকমের প্ল্যান করছিলাম ইমরানকে কি করে এই খুশীর খবরটা জানাবো। ঠিক তখনি জানতে পারলাম আমার এতদিনের ভালোবাসা, ওর পায়ের কাছে সমর্পন করা আমার দেহের অন্তরালের সবটুকু বিলিয়ে দেয়ার পর আজ ইমরান আমাকে এই সমাজের কাছে কলঙ্কিনী বানিয়ে চলে গেছে।
আমার মরণ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। একদিকে এক অমানুষের কাছে নিজের ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়ার অনুশোচনা। অন্যদিকে নিজের মাঝে অন্য এক প্রাণের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার অনুভূতিতে আমি দিশেহারা বোধ করছিলাম। সুইসাইড করতে গিয়ে ফিরে আসি কারণ নিজের প্রাণ নেবার মতো সাহস আমার মাঝে নেই।
ঠিক সেইসময় আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় আমার বাল্যবন্ধু রুদ্র। আমার পেটের সন্তানকে নিজের সন্তানের পরিচয় দিয়ে সমাজের কাছে আমাকে ওর স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো। সেদিন নিজের ভাগ্যকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিব বুঝে উঠতে পারিনি! আমার বৈধ সন্তানকে যাতে কেউই জারজ বলতে না পারে সেই উদ্দেশ্য আমার বন্ধু রুদ্র নিজের সন্তান বলে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বাবা-মায়ের কাছের। রুদ্রের বাবা-মা সেদিন ভীষন অবাক হয়েছিল কারণ রুদ্র একজনকে ভালোবাসে। অজানা কারণে ওর ভালোবাসায় পূর্ণতা পায়নি। যেই রুদ্র প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনেও কোনো নারীকে ওর জীবনের সঙ্গে জড়াবে না। সেই রুদ্র সকলের আড়ালে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছে, স্ত্রীর যখন দেড়মাসের অন্তঃসত্তা ঠিক তখনি সবার সামনে এনেছে ব্যাপারটা। রুদ্রের বাবা-মা সেদিন ছেলেকে বিশ্বাস না করতে চেয়েও বিশ্বাস করেছিলেন।
আমার মনে তখনও হাজারো প্রশ্নের জবাব পাওয়া বাকি। এক সপ্তাহ কেটে যায় তবুও কোনো প্রশ্নের জবাব যখন পাচ্ছিলাম না ঠিক তখনি একরাতে রুদ্র আমাকে নিয়ে ওদের বাড়ির ছাঁদে নিয়ে যায়। আমাকে দোলনায় বসিয়ে নিজেও আমার পাশে বসে। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রুদ্র খানিকটা সময় নিয়ে আমাকে বললো,
— মেঘলা মাতৃত্বের স্বাদ নেয়াটা বুঝি একটা নারীর জন্য ভীষন জরুরি। দেখ না আমার বাবা বড়ো মাকে বিয়ে করলো কিন্তু সন্তান দিতে অক্ষম দেখে আমার বাবা এই দেশে চাকরি বাহানায় থেকে আমার মাকে বিয়ে করলো। আমি হলাম ব্যস আমার মা হলো এখন জমিদার বাড়ির যোগ্য বৌ। আর বড়ো মা আগাছার ন্যায় পরে আছে জমিদার বাড়িতে। পুরোটা জীবনে না পেলো স্বামীর সুখ আর না পেলো সন্তানের সুখ। কিন্তু, দেখ না বিধাতার কি খেল! সেই একই ঘটনা আমার জন্য আল্লাহ তায়ালা পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। আমার হৃদয়ে যার নাম খোদাই করে লেখা, যাকে একপলক দেখার জন্য আমার মন ছটফট করে, যাকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি চাই সেই তনুজাকে নাকি আমি কখনোই আমার করে পাবো না। কারণটা, হলো ও আমাকে বাবা বানাতে ব্যর্থ হবে। জমিদার বংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্ষম আমার তনুজা। এই অক্ষমতার জের ধরে তনুজার সঙ্গে আজ আমার পাঁচ বছর ধরে নেই কোনো যোগাযোগ। আমি জানি গত পাঁচটা বছর ধরে কি করে আমার দিন কাটছে! খেয়ে থাকি বেঁচে থাকার আশায় কিন্তু, মনটা তো সেই কবেই মরে গেছে। এই বেঁচে থাকা কি আর প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকা বলে?
এতটুকু অব্দি বলে রুদ্র চুপ হয়ে যায়। মেঘলা চুপ হয়ে থাকে রুদ্রের বাকি কথা সম্পূর্ণভাবে শোনার জন্য। রুদ্র ঢোক গিলে কাঁপা গলায় মেঘলার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— তোর সন্তানকে আমার পরিচয় দিয়েছি যাতে কেউ বলতে না পারে ওর বাবার পরিচয় নেই। তুই আমার স্ত্রী না কিন্তু সমাজের লোক জানবে তুই আমার স্ত্রী। কিন্তু, তোর কাছে আমার একটাই আবদার মেঘলা, আমার তনুজাকে মা ডাক শোনার অধিকারটুকু দে। ওকে যেন আমার বুকের মাঝে এনে রাখতে পারি মেঘলা। আজ এতগুলো বছরে তনুজাকে পাওয়ার অপেক্ষায় আমার এই হৃদয় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তোর বেস্টফ্রেন্ডকে আজ খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না মেঘু। নয়তো, আমি মরে যাব। এভাবে আমি আর বেচে থাকতে পারছি না।
সেদিন আমি দেখেছিলাম রুদ্রের কান্না, তনুজাকে নিজের করে পাওয়ার রুদ্রের চোখের তারায় যেই আশাটুকু দেখছিলাম সবটাই ছিল আমার একটি হ্যা’র।
সারারাত ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, রুদ্রকে ওর তনুজার কাছে ফিরিয়ে দিবে। মেঘলার সন্তান রুদ্রের মতো মানুষের কাছ থেকে পিতৃ স্বীকৃতি পাবে এরচেয়ে বড়ো পাওয়া আর কি’বা হতে পারে!
পরদিন রুদ্রের সঙ্গে সবটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় বসে মেঘলা। রুদ্র মেঘলার সিদ্ধান্ত শুনে ভীষণ খুশি হয়। মেঘলার হাত ধরে বারবার ওর শুকরিয়া আদায় করতে থাকে।
তারপরই, রুদ্র তনুজার বিয়ে হলো। বিয়ের পর রুদ্র যখন মালদ্বীপ ফিরে এসে মেঘলার কাছের হাসিমুখে বলেছিল,
— সবটাই সম্ভব হয়েছেন তোর জন্য। তোর এই ঋণ কখনোই ভুলবার নয়। তুই যা চাইবি তাইই আমি দিব।
এই কথার প্রেক্ষিতে সেদিন আমি মুচকি হেসে বলেছিলাম,
— সময় হলে আমিই চেয়ে নিব।
সঠিক সময়টা আর এলো না রে রুদ্র। তোর কাছে আমার চাওয়া হলো না, আমি কি চাই তোর কাছে? ভেবেছিলাম বাচ্চাটা হলে তোদের কাছে দিয়ে অজানা কোনো প্রান্তে গিয়ে বসবাস করব যেখানে আমার কোনো পিছুটান থাকবে না। কিন্তু, ডক্টরের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম আমার প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন আছে। বাচ্চা কিংবা আমার দু’জনেরই ক্ষতি হতে পারে। তখন অতটা গায়ে মাখিনি। ভেবেছিলাম হয়তো আমারই সমস্যা হবে। কিন্তু কে জানত আমার মনিটা পৃথিবীতে এসে আলোর মুখ না দেখে চলে যাবে!
এতটুকু অব্দি লেখা অতঃপর ডায়েরিটা বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রুদ্র। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাথায় আধপাকা চুল আর গালে দাঁড়ি ভর্তি। বয়সের তুলনায় এখনো যথেষ্ট ইয়াং দেখায় রুদ্রকে। কাঁপাকাঁপা হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে নীল চিরকুট বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলো। লাল কলমের আচরে লেখা মেঘলার শেষ কিছু বাক্য এই চিরকুটে।
প্রিয় রুদ্র,
ভালো আছিস কিনা জিজ্ঞাসা করব না। কারণ, তনুজা যেহেতু তোর পাশে আছে তবে তুই সবসময় ভালোই থাকবি।
তুই একবার বলেছিলি না, আমি যা চাই তুই তাই দিবি? মনে আছে না তোর কথাটি। জীবনের অন্তিম মূহুর্তে এসে আমার মনে হলো, আমি দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবেসেছি। তাও আবার তোকে। লজ্জায় কিংবা সংকোচে বলতে পারিনি এতদিন। তবে আজ বলতে বাঁধা নেই। ভয় পাস না কারণ তোর কাছে আমার ভালোবাসার প্রতিদান চাইব না। কারণ, তোকে এই চুপি চুপি ভালোবাসায় আলাদা এক অনুভূতি আছে। তোকে হারাবার ভয় নেই। আর না আছে আমার ভালোবাসায় কারো হস্তক্ষেপ। হয়তো, হাতেগোনা কিছু মূহুর্ত আছি তোদের পাশে। আমি জানি আমার এই বিবর্ণ ভালোবাসা আমারই মতো একদিন হারিয়ে যাবে। ঠিক তেমনি ভাবে কাগজে পানির স্পর্শে কলমের কালি যেভাবে বিলীন হয়ে যায় ঠিক সেভাবেই আমার হৃদয়ে তোর জন্য জন্ম নেয়া ভালোবাসা একদিন বিবর্ণ হয়ে যাবে। তবে, হাশরে যদি আমার কিছু চাওয়ার অনুমতি থাকে তবে আমি তোকেই চাইব।
ভালো থাকিস রুদ্র।
ইতি
তোর, বিএফ।
চলবে….
#বিবর্ণ_ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter
অন্তিম পর্ব….
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
তুমি চলে এসো, এক বর্ষায়।
সবুজ ঘাসে বিস্তীর্ণ কবরস্থানে কত আপন মানুষ গভীর নিদ্রায় শায়িত আজ। অথচ কিছু বছর আগেও তাদের সাথে কত সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, অভিমান, রাগ জিইয়ে রেখেছিল! কিন্তু, আজ সময়ের পালাবদলে সবই স্মৃতি। মাঝে মাঝে কিছু স্মৃতিরা এভাবে তাড়া করে যে মনে হয় যেন হৃদয় থেকে, এই পৃথিবী থেকে তারা প্রস্থান না নিলেও পারত। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কি চলা যায়? সময়ের স্রোতে কত মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে, কত মানুষ চলে গেছে পৃথিবীতে স্বল্প সময় কাটিয়ে।
— রুদ্র?? এই রুদ্র??
প্রেয়সীর ডাকে মোনাজাত শেষ করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে রুদ্র দেখতে পেলো তনুজা মুখে কাপড়ে দিয়ে চেহারা আড়াল করে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে কবরস্থানের মুখ্য দুয়ারের বাইরে। তনুজার সাথে একটুখানি হাসি বিনিময় করে রুদ্র মেঘলার কবরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আপন সুরে বলে উঠলো,
— ভালোবাসা বড্ড অবেলায় আসে রে! তোর এত গাঢ় ভালোবাসা তুই কেন অপাত্রে ঢেলেছিস আমার জানা নেই। ইমরান কিংবা আমি কেউই তোর ভালোবাসার পাবার যোগ্য ছিলাম না। তবুও, তোর ভালোবাসায় আমাদের কারোর মনে একটুখানি ভালোবাসা জাগায়নি। আমি জানি না ইমরানের তোর ভালোবাসার প্রতি কি ধারণা ছিল? কিন্তু, আমারটা আমি হলফ করে বলতে পারি মেঘলা তোকে আমি সবসময় ভালবেসেছি তবে বন্ধু হিসেবে। কারণ, রুদ্রের হৃদয়ে শুধু একজনই আছে, ছিল এবং থাকবে। আর সেই মানুষটা হলো আমার তনুজা। তবে, তোর সাহসী সেই সিদ্ধান্তে আমার মন গর্বে ফুলে ওঠে। আমার বন্ধু শুধুমাত্র আমার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় নিজের সন্তানকে বিনাশর্তে আমাকে দিয়ে দিতে চেয়েছে। তুই অনেক বড়ো মনের মানুষ মেঘলা। দোয়া করি পরপারে তুই যেন অনেক অনেক ভালল থাকিস। আজ আসছি, ভালো থাকিস।
রুদ্র আর পেছন ফিরে তাকালো না। সোজা কবরস্থানের মুখ্য দুয়ারের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। তনুজার সামনে এসে রুদ্রের পায়ের গতি থেমে যায়।
তনুজা রুদ্রকে নিজের সম্মুখে দেখে মুখের কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললো,
— আজ এতক্ষণ অব্দি এখানে! নামাজ তো সেই কখন শেষ হলো।
ঘর্মাক্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রুদ্র স্তব্ধ হয়। নাকের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ঘামের দিকে চোখ পরতেই রুদ্রের একটা কথা মনে পরে যায়। যার নাকি নাকের ডগায় ঘাম জমে তার স্বামী বা স্ত্রীর কাছ থেকে নাকি অতিরিক্ত আদর-সোহাগ পায়। এমন কথা মনে আসতেই বেশ হাসি পেলো রুদ্রের। হুটাৎ রুদ্রের এমন আচরণ দেখে তনুজা ভয় পেয়ে যায়। কবরস্থানের কোনো অজানা জিনিস রুদ্রের ওপর ভর করলো না তো আবার।
— এই..ই কি হলো আপনার? এভাবে হাসছেন কেন?
তনুজার প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায় রুদ্র। তার মানে ওর চেহারায় হাসি রেখা ফুটে উঠেছে! নিজেকে স্বাভাবিক করে রুদ্র তনুজার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তনুজা শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে রুদ্রের পেছনে পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভাদ্র মাসের প্রখর রোদ গায়ে লাগছে বেশ। বাগানের উঁচু গাছগুলো কি করে ডালপালা এদিকসেদিক ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে তীব্র হাওয়ার আগমনী বার্তা। উত্তরের ডোবায় দশ-বারোটা রাজহাঁস সাতার কাটছে। মাঝে মাঝে ওদের ডাক প্যাক-প্যাকানো ডাক শোনা যাচ্ছে।
রুদ্র এবং তনুজা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই আট-দশটা ছেলে-মেয়ে এসে ওদের ঘিরে ধরলো। তনুজা আর রুদ্র একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে সবচেয়ে ছোট্ট দুজন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে এগিয়ে যায় খাবার ঘরের দিকে। যেখানে প্রায় পঞ্চাশ জনের অধিক লোক একসঙ্গে বসে খাবার খেতে পারে।
তনুজা এবং রুদ্র নিজেদের কোলে থাকা বাচ্চাদের নিয়ে নীচে বিছানো দস্তরখানায় বসলো। অন্যান্য বাচ্চারা এসে একে নিজেদের জায়গায় এসে বসে পরে। তারপর, একে একে জমিদার বাড়ির দাসীরা সবার পাতে খাবার তুলে দেয়।
রুদ্র নিজের কোলে থাকা তিনবছরের ছোট্ট কন্যা আয়রাতের মুখে ছোট্ট এক লোকমা ভাত তুলে দেয়। আয়রাত ছোট্ট মুখে খাবার তুলে নিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়। মেয়ের হাসি দেখে রুদ্র এবং তনুজা হেসে ওঠে।
সকলের খাবার-দাবার শেষ হলে যার যার ঘরে চলে যায় বাচ্চারা। তনুজা আর রুদ্রের কাছে আয়রাত থেকে যায়। আয়রাতকে ঘুম পাড়িয়ে দখিনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রয় রুদ্র। তনুজা তখন নিজের চুলগুলো চিরুনি চালিয়ে জট ছাড়াচ্ছে। তারপর, খুব সুন্দর করে হাতে চুল পেঁচিয়ে বড়ো খোপা করে রুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তনুজার উপস্থিতি টের পেয়ে রুদ্র তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো গভীর দৃষ্টি নিয়ে। রুদ্র খেয়াল করলো তনুজার কানের দুপাশে উপরিভাগে সাদা চুলের আনাগোনা বেড়েছে। মুখটায় তেমন বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়নি তবুও যেন ধীরে ধীরে তনুজা মাঝে বার্ধক্যের চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে। রুদ্র মনে হলো এই তো সেদিন মোমের পুতুলকে দেখে রুদ্রের কঠিন মন গলে গিয়েছিল একটুখানি ভালোবাসা পাওয়ার নেশায়। অথচ, আজ পনেরোটা বছর কেটে গেছে তাদের বিবাহিত জীবনের। জীবনের কত উত্থান-পাথানের পর আজ রুদ্র – তনুজা এক হয়েছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুদ্র তনুজাকে টেনে এনে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। তনুজা রুদ্রের বুকে মাথা গুঁজে চুপ করে থাকে। রুদ্রের হৃদয়ের আনাচে-কানাচে কি কথা হয় সবটা জানতে চায় তনুজা। কিন্তু, চাইলেও কি আর সবটা জানা যায়?
— তনুজা???
— হুম??
— হয়তো, বিধাতা চায়নি বলে সেদিন মেঘলার মেয়েটা বাঁচেনি। হয়তো বিধাতা চেয়েছেন তোমার আমার সম্পর্ক কোনো বাচ্চার মাধ্যমে আমাদের ভালোবাসার সেতুবন্ধন রচিত না হয়। চেয়েছেন আমরা যেন একে অপরকে ভালোবাসতে পারি আমৃত্যু পর্যন্ত কোনো কারণ ছাড়াই।
— তাই হবে হয়তো। কিন্তু, আল্লাহ যদি আমাদের এক সন্তানের সুখ দেননি কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর আমরা কতজনের বাবা-মা হলাম। এতিম বাচ্চাগুলো আমাদের বাবা-মা মেনে বুকের হাহাকার মেটায় আর আমরা ওদের মুখ থেকে বাবা-মা ডাক শুনে নিজেদের শূন্য মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পাই।
কথাটি বলতে বলতেই তনুজার গলা ভারি হয়ে আসে। রুদ্র তনুজাকে বুকে চেপে ধরে শক্ত করে।
সেদিন মেঘলার প্রস্থানের পর মেঘলার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দেশে আসার বন্দোবস্ত করে রুদ্র। তনুজা সেদিন প্রতিবাদ করেনি। কারণ রুদ্রের করা কাজের উদ্দেশ্য জানার পর তনুজার রুদ্রের প্রতি ধারণা পুরোটা বদলে যায়। তনুজা এবং মেঘলা আর মৃত মেয়েটাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে রুদ্র। নিজেদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করে মেঘলা এবং ওর মেয়েকে। রুদ্র তনুজাকে নিয়ে থাকতে শুরু বাংলাদেশের মাটিতে। বছর দুয়েক অতিক্রম হবার পর রুদ্রের দাদি এবং ওর বড়ো মা রুক্মিণী মারা যায়। সেদিনের পর থেকে রুদ্র আর তনুজা যেন একাকীত্বের বেদনায় জর্জড়িত হতে থাকে।
অতঃপর, অনেক ভেবেচিন্তে রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয় বিশাল এই জমিদার বাড়ির একাংশে এতিমখানা খুলবে। যেখানে বাবা-মা হীন সন্তানেরা এসে থাকবে রুদ্র এবং তনুজাকে বাবা-মা হিসেবে জানবে। আজ তেরো বছর হলো এই প্রতিষ্ঠানের। বাচ্চাগুলো যেন সত্যি রুদ্র এবং তনুজার। কত মায়া নিয়ে কথা বলে ওরা। বিশেষ করে আয়রাতকে পেয়ে যেন রুদ্র আর তনুজার জীবন আমূল-পরিবর্তন হয়েছেন।
পুরনো সবটা ভেবে তনুজার গর্বে বুক ফুলে ওঠে। কারণ এমন একটা মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছে তনুজা যে সাত জনম তপস্যা করলেও এমন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না তনুজার। সন্তান দিতে অক্ষম মানুষটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাটুকু আজ বিধাতার কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে।
রুদ্র তনুজার হাতে হাত রেখে বললো,
— তনুজা, আমি যদি কখনো মরে যাই কিংবা হারিয়ে যাই ধরনী থেকে তবে যত্ন রেখো তোমার আর আমাদের বাচ্চাদের। যদি সময় বের করতে পারো তবে মেঘলার কবরটা বছর বছর লোক দিয়ে পরিষ্কার করে রেখো।
রুদ্রের কথায় বুকে কাঁপন ধরে যায় তনুজার। রুদ্র পাঞ্জাবি খামছি দিয়ে ধরে বললো,
— আমি যেন আপনার আগে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারি। কারণ, আপনার হাতের এক মুঠো মাটি যদি আমার কবরে পরে তবে আমার চেয়ে সৌভাগ্যবতী আর কে হবে রুদ্র?
কান্নারত অবস্থায় তনুজাকে দেখল রুদ্রের বেশ কষ্ট অনুভব হলো। তাই তো তনুজার হাত ধরে বাড়ির বাইরে যেতে যেতে তনুজাকে বললো,
— তোমার আমার ভালোবাসা বিবর্ণ হবে না কোনোদিনও। যতদিন থাকব বেঁচে ততদিন শুধু তোমারই রব,প্রেয়সী।
অজানা প্রান্তরে হেঁটে যাচ্ছে দুজন। শেষ বিকেলের আলো, আর নাম জানা পাখির কলরব জানান দিচ্ছে ওদের ভালোবাসা যেন চিরদিন বেঁচে রয় এই পৃথিবীর বুকে।
সমাপ্ত…