#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১৪

0
888

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১৪

#মিদহাদ_আহমদ

নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না৷ শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনার মেয়ের বাড়িতে আপনি যেকোন সময়ে যাওয়ার অধিকার রাখনে না মা?’

আমার কথা শুনেই আমার মামি শাশুড়ি হায় হুতাশ করা শুরু করে দিলেন৷ ঝরঝরে কথায় বলতে লাগলেন,

‘আরে আরে আরে! ঘরভর্তি মানুষের সামনে মেয়ের মুখের কথা দেখো! একী আদব কায়দা! আমরা আমাদের শাশুড়ির সামনে মাথার কাপড় নামাইনি আর এই মেয়ে দেখছি শাশুড়ির পায়ের তলার মাটি খুঁড়ছে এসে! দুনিয়া কই গেলো। গেলো রে গেলো। এগুলা কেয়ামতের আলামত। তা আপনি কি আপনার মেয়েকে সামান্য ভদ্রতাটুকু শেখাননি? মেয়ে এমনিই সিংলার ডালের মতো তড়তড় করে বেড়ে উঠেছে?’

শেষের কথাগুলো আমার মাকে বললেন মামি শাশুড়ি। আমার মা একেবারে নিশ্চুপ। তার চোখদুটো টলমল করছে একেবারে। আমি মামি শাশুড়িকে বললাম,

‘এই একই প্রশ্ন আপনার জন্যও মামি। আপনি কি আপনার মেয়ের বাড়িতে তিথি নক্ষত্রে মেনে যাবেন? আপনাদের কারো লজ্জা শরম নাই? আর আদব শেখানোর কথা আমাকে বলছেন? এই একই কথা যদি আপনাকে বলি? যদি বলি আপনাকে আপনার বাবা মা আদব শেখায়নি?’

‘চুপ করো নুপুর। তুমি কীভাবে কথা বলছো আমার মামির সাথে। মেহমানদের ভদ্রতার সাথে ট্রিট করতে হয় এইটা জানো না? নাকি এই জানাটুকুর মাঝেও কোন অজানা কাজ করছে?’

ননাসের কথা শুনে সামনে গিয়ে বললাম,

‘আপা তোমার কথাতেই তাহলে বলি। মেহমানদের সাথে কীভাবে ট্রিট করা লাগে এইটা এই ঘরের লোকজন কেউ জানে না? নাকি জানিয়ে দেয়া লাগবে? কোনটা? নাকি শিখিয়ে নিতে হবে আমাকে?’

আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন,

‘আমি চলে যাচ্ছি রে মা। তুই আর কোন কথা বাড়াস না এখন।’

আমি আরও ভারসাম্য হারিয়ে বসলাম। বললাম,

‘কেন? কেন চলে যাবে তুমি? এইটা তোমার মেয়ের বাড়ি। এই বাড়িতে এসে তোমার সম্মান আর অসম্মান আমার সম্মানের সাথে জড়িত। এখানে তোমার মেয়ের যে সম্মান, সেই সম্মান তোমাকেও পেতে হবে।’

শ্বশুর হাক ছাড়লেন এবার। এসে বললেন,

‘এই গরমের দিন, তার উপর রমজান মাস। বাসায় মেহমান এসেছে। তোমরা কী শুরু করলে এসব? বেয়ান আপনি আসুন। ভেতরের রুমে গিয়ে বসুন। ‘

শ্বশুর আমার মাকে ভেতরের রুমে বসতে বললেন।আমিও আর কথাগুলো চেপে গেলাম। ঘরভর্তি মানুষের সামনে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না। আমার মা রুমে গেলেন। শাশুড়ি শুধু ফিসফিস গলায় বললেন,

‘এই পানচিনি হয়ে যাক ভালোয় ভালোয়। তারপর দেখবো কার বাড়ন্ত এই ঘরে কীভাবে থাকে।’

সব কাজকাম শেষে বিকালে আমি আমার রুমে যাবার অবকাশ পেলাম। আসিফ পেপার পড়ছে। আমাকে আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছিলো দুপুরে?’

আমি জবাব দিলাম না। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছিলো দুপুরে?’

এবার বললাম,

‘কিছু না।’

‘কিছু না মানে?’

‘কিছু না মানে কিছু না।’

‘আশ্চর্য! আমি যে শুনলাম…’

‘শুনলে তো ঠিকই আছে। যা শুনেছো তাই। আমি সব অপমান, সব ঘৃণা সহ্য করে আছি। এর কারণ, আমি মেয়ে। আমাকে স্বপ্ন দেখতে নেই, আমাকে বাঁচতে নেই। আমাকে বড় হতে নেই। আমাকে আল্লাহ রূপ দিয়েছেন, সুন্দর করে বানিয়েছেন। এই সুন্দরের দামে আমার বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। আমার তো এটুকুই অনেক। এরচেয়ে বেশি আশা করাই তো ঠিক না আমার। আমি স্বামী, সংসার, ঘর এসব নিয়ে সব অপমানের সাথে ঘর করতে রাজি হয়েছি। এইতো আমার জীবন।’

এক নাগাড়ে বললাম কথাগুলো। কয়েক মিনিট আসিফ নীরব হয়ে গেলো। তার এই অদ্ভুত কাজগুলো আমাকে ভাবায়। আমাকে প্রফুল্লচিত্তে বিস্ময়ের জন্ম নিতে বাধ্য করে। মানুষটা তার ভেতরে কী চেপে রাখে সে নিজেও হয়তো জানে না। তারপর আবার বললো হুট করে,

‘আমার স্বপ্নগুলো আমি সেই মেয়েটার সাথে শেয়ার করতাম। তাকে ভালোবাসতাম যে ভীষণ! আমাদের দুজনের মিল ছিলো অনেক। তার ইচ্ছা ছিলো নাট্যকলা নিয়ে পড়বে। অন্যদিকে আমার চারুকলা। দুজনের মধ্যে এই সংস্কৃতির বিচরণের জন্য একে অপরের প্রতি আগ্রহ আমাদের সমান তালে ছিলো। মাঝেমধ্যে পড়াশোনার ফাকে যখন টুকটাক ফিগার ড্রইং, স্কেচ বানাতাম তখন সেই মেয়েটা হা হয়ে দেখতো। প্রতিবার তারিফ করতো আমার। বাসার অবস্থা যখন তাকে বলতাম, যখন তাকে জানাতাম যে বাসায় চায় আমি ইঞ্জিনিয়ার হই, তখন সেও আমাকে না করতো। আমাকে বললো, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেনো আমি কিছুই না করি। তার এই সাপোর্টিভ মনোভাবের জন্য আমার ভেতরে পুষে রাখা আগ্রহটা একেবারে প্রস্ফুটিত হতে লাগলো যেনো! স্কুলে আর্ট এক্সিবিশনে আমার আর্ট সেরা ঘোষণা হয় সেইবার। অন্যদিকে কালচারাল এওয়ার্ড এ স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয় নুপুর।’

এবার আমার কথা যেনো শুরু হলো।

‘ নুপুর?’

‘হ্যাঁ। আশ্চর্য না?’

‘কী আশ্চর্য! আমি তো কোনকিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলছো এসব?’

আসিফ শুরু করবে করবে এর আগেই শাশুড়ি ডাক দিয়ে নিয়ে গেলেন আমাকে। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে ইফতার রেডি করতে হবে।

বাসায় আসা আসিফের মামার বাড়ির সব লোকজন বসে আছে ড্রইংরুম ও ডায়নিং রুমে। আমি ইফতার রেডি করছি। খেয়াল করছিলাম আমার মা, ভাইকে কেউ ডাক দেয় কিনা। কিন্তু না। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে আসলো। আমার ননাস একে একে সবাইকে নিয়ে এনে বসালো টেবিলে। আমার মাকে আর ভাইদেরকে কেউ ডেকে আনলো না। আমিই অগ্যতা রুমে গিয়ে তাদের ডেকে আনলাম। আমার ভাইদেরকে শাশুড়ি ড্রইংরুমে যেতে বললেন। তারা সেখানে চলে গেলো। বিশ সিটের ডায়নিং টেবিলের যে কোণায় আমার মা বসেছিলেন, সেই সাইডে শাশুড়ি এসে আমার মাকে তুলে কাঠের চেয়ার সরিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,

‘বেয়ান সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই? ওই আমার মেয়ের শাশুড়ি এসেছেন তো। ওদিকটায় একটা চেয়ার শর্ট৷ তাই এইটা নিয়ে নিচ্ছি।’

পুরো ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ঘটছে। আমার মা মুখে হাসি এনে বললেন,

‘আরে না। কোন সমস্যা নাই। ঠিক আছে বেয়ান ‘

আমার ননাসের শাশুড়ি ইফতারের বসার আগেই আমার শাশুড়িকে বললেন,

‘আপনার সাথে কিছু কথা আছে বেয়ান। ইফতার করতে আসিনি আসলে।’

আমার শাশুড়ি বললেন,

‘আরে ইফতার করতে আসেননি মানে? আপনারাই তো আমাদের চিফ গেস্ট। এখন আজান হয়ে যাবে। আপনার জরুরী কথা আমি পরে শুনবো। নুপুর তুমি আমার সাথে রান্নাঘরে চলো৷ মাল্টা কাটা হয়নি এখনও।’

আমি রান্নাঘরে গেলাম। সাথে সাথে আমার ননাস ও শাশুড়িও এলেন। ননাস শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী বলেছে ওই কুটনা বুড়িটা? সারাদিন পা খেয়ে খেয়ে জর্দা নিচে ফেলে আর আমাকে ক্লিন করতে হয় বুঝছো! ওই কুটনা বুড়িটা মরলে তবে শান্তি পাবো।’

‘আরে আরে আরে! আস্তে কথা বল। যদি কেউ শুনতে পায় তাহলে…’

‘শুনলে শুনুক। আমি আগেই বলেছিলাম তোমাকে এমন ঘরে দাও যেখানে কেউ নাই। একা একা। কিন্তু না। কী করলা? দিলা যেখানে লোকভর্তি পরিবার৷ অন্যরা তো ঠিক আছে কিন্তু কুটনা বুড়িটাকে আমার অসহ্য হয়ে যায়।’

শাশুড়ি তার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন এবার,

‘কুটনা বুড়িটা এলো কেন তাহলে আজ? এমনি এমনি তো তাকে দাওয়াত কেন, গাড়ি পাঠিয়েও নিয়ে আসা যায় না। আজ চলে আসলো তাকে ইফতারের দাওয়াত না দিতেই!’

আমার মুখ আর আটকালো না এবার। বলেই ফেললাম মনের কথাটা। বললাম,

‘আমার মা আর আপার শাশুড়ি দুজনেই তো সম্পর্কে আপনার এক সমান কুটুম। কিন্তু আমার মা চলে আসলে অপমান করতে হয়, প্লাস্টিকের চেয়ারে আমার মাকে বসিয়ে আপার শাশুড়িকে কাঠের চেয়ারে বসাতে হয়, এই দুই নীতির মানুষ যে এখনও আছে সেইটা আমার জানা ছিলো না।’

আমার কথায় শাশুড়ি আর ননাস চুপ মেরে গেলেন। শাশুড়ি এবারও বললেন মিনমিন করে,

‘যখন খেল দেখাবো তখন বুঝবা এই বাড়ন্ত মুখের খেসারত কীভাবে দেয়া লাগে।’

আজান হয়ে গেলো। ইফতার শেষ হলো। ইফতার শেষ হতে না হতেই আমার ননাস আমার ননদকে সাথে করে বের হয়ে গেলো পার্লারের উদ্দেশ্যে। আমি রুমে চলে এলাম। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি পার্লারে যাও নাই?’

‘না।’

‘কেন?’

‘কেউ আমাকে বলেনি তাই।’

আসিফ তখনই রুম থেকে বের হয়ে তার মায়ের রুমে গেলো। আমি পেছনে পেছনে গেলাম৷ বাড়িভর্তি লোকের সামনে সে নতুন কোন কান্ড করে না বসে। আসিফ মায়ের রুমে গিয়েই জিজ্ঞেস করলো,

‘ওকে নিয়ে পার্লারে গেলে কী সমস্যা ছিলো?’

শাশুড়িও তেড়ে এলেন। বললেন,

‘তোর বউয়ের ভাত দিচ্ছি, কাপড় দিচ্ছি, তোর মদের টাকাও নিচ্ছিস আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস থেকে, দুই টাকা রোজগার করার মুরোদ আছে তোর? বউকে আবার পার্লারে পাঠাবি? এত শখ হলে নিজের টাকায় বউকে পার্লারে নিয়ে যা। আর নাহলে ঘরে চুপটি মেরে বসে থাক!’

শাশুড়ির এই কথাটা শুনে আসিফ তার রুমে চলে এলো। পেছনে পেছনে আমিও এলাম। শাশুড়িকে শুধু বলে এলাম,

‘আপনি তো জানেন ই আপনাদ ছেলে কেমন। এখন এই কথাগুলোর কোন নেগেটিভ ইফেক্ট যদি তার উপর…’

‘এই ছেলের না আছে বোধশক্তি, না আছে কিছু করার মুরোদ। হাতে গিটার আর আঙুলে রঙ তুলে দাও। গলা বাজবে। আর কোন কাজের না।’

আমি বলে এলাম,

‘এটাই ওর কাজের হয়ে উঠবে মা। আজ যা বলছেন শুধু শুধু কোন কাজের না, আগামীতে তাই হয়ে উঠবে ওর সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে বড় কাজ। দেখে নিয়েন মা। দেখে নিয়েন।’

আসিফের পেছনে পেছনে রুমে এলাম। আসিফ যখন প্রচন্ড রাগে থাকে তখন সে কেমন জানি চুপসে যায়! একেবারে নীরব হয়ে উঠে। এবারও তাই হলো। বারান্দায় যেতে যেতে বললো,

‘ওইযে গোলাপি শাড়িটা পরেছিলা না একদিন, ওই শাড়িটার সাথে খোপায় গাজরা দিও। কপালে একটা ছোট কালো টিপ দিও। তোমাকে সুন্দর লাগবে।’

আমার মাথায় বুদ্ধি কাজ করলো একটা। আসিফ এই প্রচন্ড মন খারাপ আর রাগের মাথায় নিশ্চিত সিগারেট খাবে। মদ খাবে। আমি আসিফকে বললাম,

‘আমাকে একটা জিনিস এনে দিবে?’

‘শুনেছো না মা কি বলেছে? বলেছে নিজের টাকায় এনে দিতে! নিজের টাকায়! আমার টাকা আছে? আছে আমার টাক? নাই!’

‘আছে।’

‘কোথায়?’

‘ওইযে ডায়রি, ওই ডায়রিটা আমি খুলে দেখেছি। কাল রাতেই আমি পড়েছি। আমি সব জেনেছিও। তোমার কাছে আমি নিজেই সরি বলতাম ওই ডায়রিটা লুকিয়ে পড়ার অপরাধে৷ আমি জেনেছি নুপুর কে। সে যে রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে এইটাও জেনেছি৷ আর দেখো আল্লাহর কী অদ্ভুত নিয়ম যেনো! আমিও নুপুর! নুপুর তোমাকে একবার পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলো না তোমাকে? বাজিতে জিতেছিলে? ওই টাকাটা স্টেপলার করা আছে ডায়রিতে দেখলাম। তুমি ওই নুপুরের টাকা দিয়ে, এই নুপুরকে এক পাতা কালো রঙের টিপ এনে দিবা? আমি তোমার নুপুরের দেয়া টাকায়, তোমার কিনে আনা টিপ পরেই সাজবো!’

‘যাস্ট লিভ মাই রুম! তোমার সাহস হলো কীভাবে আমার ডায়রিটা পড়ার? আর সাহস করলে কীভাবে এই আবদারটা করার? হাউ?’

অন্যদিকে আমার ননাস তানিয়ার ননাস তার মাকে বলছে,

‘সন্ধ্যা থেকেই বসে আছো এখানে। তাদেরকে বলবা কোন সময় যে ভাইয়া আর তানিয়ার ডিভোর্সের জন্য আমরা এসেছি?

আকাশ থেকে দৈববাণীতে ভেসে এলো,

‘পীড়ন করিলে সে পীড়া এসে, পিড়িবে তোমাকেই’

[আসসালামুয়ালাইকুম। ঈদ মুবারক। ঈদ স্পেশাল পর্ব অনেক বড় করে লেখলাম। সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা। কেমন লাগলো জানাবেন কিন্তু! ভালোবাসা]

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here