#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৬০

0
471

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_৬০

#মিদহাদ_আহমদ

ঘুমের ঘুরে ছোট্ট মুন্নি মুখে মুখে আওড়াচ্ছে,

‘তুমি যেও না আন্টি। তুমি আমাকে এসে আবার কোলে তুলে নাও। আব্বু সারাদিন ক্লাসে থাকে। আমার সাথে গল্প করার কেউ থাকে না।’

অসুস্থ মেয়ের মুখে এসব ঘুমের ঘুরে কথা শুনে আর নিজেকে সামলে নিতে পারেন না রফিক সাহেব৷ মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, যাই হোক আসিফের দেয়া প্রপোজাল তাকে স্বীকার করে নিতেই হবে। দিনশেষে মেয়েকে ছাড়িয়ে তিনি কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি, আর পারবেন ও না।

এদিকে রাতে খেয়েদেয়ে আমরা রুমে এসেছি মাত্র। আসিফ আমাকে বললো,

‘ফারুক স্যার মানুষ ভালো। কী তার ব্যক্তিত্ব দেখেছো তুমি? সরাসরি মানুষটা না করে দিলো। চিন্তা শুধু একটাই, তার মেয়ের সুখ৷ তাইনা?’

আমি বললাম,

‘আর এদিকে আমি কেমন মা বলো, নিজের জন্য নিজের শিশু কন্যাকে ফেলে আমেরিকা বসে থাকলাম এতটা বছর?’

‘হয়েছে৷ এখন আর আপনার ইমোশনাল হওয়া লাগবে না।’

আসিফের মোবাইলে রিংটোন বাজলো এমন সময়ে। আসিফ আমাকে বললো,

‘ফারুক স্যারের নাম্বার থেকে কল।’

আমি চোখ ইশারায় কল ধরে স্পিকারে দিতে বললাম। আসিফ কল ধরলো। স্পিকারে দিলো। ওপাশ থেকে ফারুক স্যার বললেন,

‘আমি রাজি৷ আপনাদের কোন আপত্তি না থাকলে, আমি আমার মেয়ের জন্য শুধু এই বিয়ে করতে রাজি আছি।’

আসিফ বললো,

‘থ্যাংকস আ লট। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমি এদিকে কনফার্ম হয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।’

আমি আর মুহূর্তও অপেক্ষা করলাম না৷ শাশুড়ির রুমের দিকে ছুটলাম।ননাস পানি খাওয়ার জন্য উঠে এসেছেন ডায়নিং রুমে। আমাকে এভাবে ছুটতে দেখে, তাও মায়ের রুমের দিকে, ননাস জিজ্ঞেস করে বসলেন,

‘কী?এতরাতে কী হলো? মায়ের রুমের দিকে কেন?’

আমি আমতা আমতা করে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। ননাস নিজেই আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রিজের দিকে অগ্রসর হলেন পানির বোতল নিতে৷ আমি শাশুড়ির রুমে গেলাম। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বললাম খুশির সংবাদটা। শাশুড়িও খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। শব্দ সংযত করতে ইশারায় বুঝালাম যে ননাস রান্নাঘরের আশেপাশেই আছে। শাশুড়িও চেপে গেলেন। শ্বশুর বিছানার ওপাশ থেকে বললেন,

‘এখন তোমার ননাসকে মানাবে কে?’

আমি শ্বশুরকে বললাম,

‘এই দায়িত্বটা আপনি আমার হাতে দিয়ে দিন বাবা। দেখবেন আমি কেমন করে মানাই।’

পরেরদিন সকালে গল্পকে স্কুলে দিতে নিয়ে গেলো ননাস। ননাস বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই আমি বের হয়ে যাই। শাশুড়ি জিজ্ঞেস করেন কোথায় যাচ্ছি। ওনাকে ইশারায় বলি যে এসে বলছি। আমি সরাসরি গাড়ি নিয়ে গল্পের স্কুলে চলে যাই৷ গল্পকে স্কুলের গেইটে ঢুকিয়ে ননাস গার্ডিয়ান ওয়েটিং রুমে বসা ছিলো। আমাকে দেখতেই ননাস বলে উঠলো,

‘তুমি এখানে? মেয়েকে নিয়ে আসতে হলে আমাকে বললেই হতো। আমি আসতাম না।’

ননাসের এমন হুটহাট কথা বলা আর বলার ধরণ আমার অনেকদিনের পরিচিত৷ ওনার কথায় না ধরে আমি ননাসের হাত ধরে রুম থেকে বের করে এনে বললাম,

‘এক জায়গায় যেতে হবে আপা।’

‘কোথায়?’

‘আপনি আসেন তো।’

ননাসের হাতে ধরে তাকে গেইট ক্রস করে গাড়ির সামনে নিয়ে এলাম। ননাস এবার বললো,

‘আশ্চর্য নুপুর! তুমি কোথায় নিয়ে যাবা আমাকে বলবা তো?’

‘বলবো। আগে আসেন আমার সাথে।’

কেক কোর্টে নিয়ে গেলাম আমি ননাসকে৷ ননাস বললো,

‘এখানে কারোর জন্মদিন নাকি? বা সামনে কারো জন্মদিন আসছে? এসব কী? এখানে নিয়ে এলে কেন? আমি বাচ্চা নাকি?’

‘আগে চলেন আমার সাথে আমি বলছি সব।’

ফেরদৌসী’স কেক এ ঢুকলাম আমি ননাসকে নিয়ে। ভেতরে আগ থেকেই বসা ছিলেন ফারুক স্যার আর মুন্নি। মুন্নি ননাসকে দেখেই উঠে এলো। জড়িয়ে ধরলো ননাসকে। আমি খেয়াল করলাম প্রচন্ড রাগে থাকা ননাস কেমন যেনো জল হয়ে গেলেন! মুন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আজ তোমার জন্মদিন মা? আমি তো জানতাম না। কোন গিফটও সাথে আনিনি।’

ফারুক স্যার পাশ থেকে বললেন,

‘না না। আজ মুন্নির জন্মদিন না।’

‘তাহলে?’

আমাদের কারো জবাব দেয়ার আগেই মুন্নি টেনে নিয়ে ননাসকে চেয়ারে বসালো। তারপর সে তার পাশে থাকা কেকের এক পিস ননাসের মুখে দিতে দিতে বললো,

‘তুমি কি আমার আম্মু হবা বলো? এভাবে রোজরোজ আমার ফেভারিট কেক খাওয়াবো তোমাকে।’

ননাস কেমন যেনো স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম নিজেকে সামাল দিলো৷ কোন রিয়েকশন দেখালো না। ননাস কেক খেতে লাগলো নিশ্চুপে৷ ছোট মুন্নি ননাসের গালে হাত দিতে দিতে বললো,

‘কী হলো? তুমি চুপ করে আছো যে?’

‘বারোটা হয়ে যাচ্ছে। গল্পের স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। আমি উঠছি এখন। আজ বৃহস্পতিবার।’

‘আর আমি যে তোমার সাথে গল্প করার জন্য আজ স্কুলেই যাইনি। তুমি কি আমার আম্মু হবা বলো?’

ননাস উঠে গেলো চেয়ার থেকে। আমি মনেমনে ভয় পেলাম ননাস কিছু বলে বসে কিনা। ননাস মুন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো

‘মা আমি আসছি কেমন? পরে কথা হবে’

অনেকটা দ্রুত গতিতে প্রস্তান করলো ননাস। আমিও পেছন পেছন ছুটে এলাম। গাড়িতে উঠে বসলাম। কর্কশ গলায় ড্রাইভারকে এসি অন করতে বললেন তিনি৷ আমি কথা বলতে চাইলেও গ্লাসের জানালার দিকে মুখ তাক করে নীরবে বসে থাকলেন ননাস। কোন শব্দ আর তিনি করলেন না।
পুরো রাস্তায় ননাস একদম পিনপতন নীরবতা পালন করে গেলেন৷ গল্পকে রিসিভ করার সময়ে গাড়ির দরজা খুলার সময়ে শুধু আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘যা করেছো তা ঠিক করোনি নুপুর’

গল্পকে নিয়ে আমাদের বাসায় যেতে যেতে একটা বেজে গেলো। আসিফও চলে এসেছে অফিস থেকে। শাশুড়ি আমাকে একা পাওয়ার পায়তারা করছেন বুঝতে পারলাম। আমি শাশুড়ির রুমে গেলাম সুযোগ করে। শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন সব ঠিকঠাক হবে। শুধু সময়ের হাতে ছেড়ে দিন।’

দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসলেও ননাস আসেননি। আসিফ উঠে গেলো উপরে তাকে ডেকে আনার জন্য। ননাস বিছানায় শুয়ে আছেন৷ আসিফ বার কয়েক খেতে আসার কথা বলার পরও ননাস বললেন যে তার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। আসিফ নিচে নেমে এলো। আমি বুঝতে পারলাম তার এই রাগ, এই অভিমান আমার উপরেই হয়তোবা। আমি উঠে গেলাম। ননাসের রুমে ঢুকতেই ননাস আমাকে বললেন,

‘এখানে এসেছো কেন? আমি খাবো না বলে দিয়েছি মানে খাবো না।’

আমি পাশে গিয়ে বসলাম। ননাসের হাত আমার হাতের উপর তুলে নিলাম। কী তুলতুলে হাত ওনার! হাতের আঙুল ধরতে ধরতে ননাসকে বললাম,

‘আপা, জীবন কারোর জন্য কখনোই থেমে থাকে না আমাদের। আজ নাহয় কাল, আমাদের একদিন না একদিন ফিরে যেতেই হবে মহান রবের কাছে৷ কিন্তু যতদিন সুযোগ আছে ততদিন কেন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবো না বলেন? কেন আমরা এই সুযোগের মাধ্যমে জীবন সাজাবো না? আজ আপনি ভালো থেকেও ভালো নেই৷ দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর। এখানে মানুষের আপন বলতে কেউ নেই। আর আপন বলতে যারাই আছে, তারাই আবার মুহূর্তে নিজের পর হয়ে যায়৷ ছোট্ট মুন্নিকেই দেখেন। মেয়েটার কি এই বয়সে এত বড় কষ্ট নেয়ার কথা ছিলো? তার মা হারানোর কথা ছিলো? সেই এইটুকু জানের মধ্যে সে কেমন করে তার জীবন কাটাবে? কেমন করে কষ্ট সহ্য করবে? আমাদের জীবনের মানেই তো অন্যের কষ্টে নিজেকে উজাড় করে দেয়া। অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। সেই বিলানোর মাঝেই তো প্রকৃত সুখ আর ভালোবাসার প্রকাশ।’

এর মাঝে ননাসের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো৷ ফারুক স্যারের নাম্বার থেকে কল। ননাস কল উঠালো। ওপাশ থেকে কে কথা বললো কিছুই বুঝতে পারলাম না। ননাস এপাশ থেকে উত্তর দিলো

‘হ্যাঁ মা খেয়েছি৷ তুমিও খেয়ে নিও কেমন? আর খেয়ে ঘুমিয়ে যেও। ‘

বুঝতে বাকি রইলো না মুন্নি কল করেছে। ননাস নেমে এলো নিচে খাবার খেতে। খাওয়া শেষ করে আবার সে রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালেন। আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনি কোন চিন্তা করবেন না মা। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে আর ননাসও রাজি হবেন। দেখে নিয়েন আপনি…’

প্রিয় পাঠক, আসসালামুয়ালাইকুম। আশাকরি আপনারা সবাই ভালো আছেন৷ আমিও ভালো আছি৷ এই লেখাটা পড়বেন সবাই৷ এই গ্রুপের মাধ্যমেই একটা এতিমখানায় একজন খালামণির কুরবানি ও কুরবানির মাংস পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আরেকটা এতিমখানায় আমি দুই দুইবার এক সপ্তাহের খাবার ও আরেকবার চার রুমের মেঝের প্লাস্টিকের কার্পেট দিয়ে এসেছি আপনাদের ডোনেশনের মাধ্যমেই৷ অনেকেই আমাকে তারপর বলেছিলেন যে এতিমখানায় ডোনেশন করতে চান৷ নতুন কোন উদ্যোগ নিলে আমি যেনো জানাই। আমি না করে দিয়েছিলাম কারণ এরপর আর কোন কাজ হাতে নেয়ার মতো শক্তি বা সময় কোনটাই আমার ছিলো না৷ আর আল্লাহর ঘরে দান করার জন্য শুধু টাকা না আল্লাহর হুকুমও লাগে এমনটা আমি মনে করি। এই পর্ব যখন লিখছিলাম, এমন সময়ে ওই এতিমখানার প্রিন্সিপালের কল আসে আমার মোবাইলে। কুশল বিনিময় শেষে আমি ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, সেখানে খাবার সমস্যাই প্রধান। আমি খাবার দিয়ে সহায়তা করলে তাঁদের ভালো হয়। আমি ইনশাআল্লাহ বলেছি শুধু।

প্রিয় পাঠক, আল্লাহর রাসূল (স.) এতিমদের ভালোবাসতেন এবং তিনি নিজেও এতিম ছিলেন। ওই এতিমখানায় এর আগে আমি দুইবার এক সপ্তাহ করে খাবার নিয়ে গেলেও এবার আল্লাহর ঘর আর এই ছোট ছোট এতিম বাচ্চাদের জন্য আমি অন্তত এক মাসের খাবার একসাথে দিয়ে আসার চিন্তা করছি। এবং এক আল্লাহ এই ব্যবস্থা করে দিবেন আমি এইটাও বিশ্বাস করি। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সাহেব কলেও বলেছেন, ইনশাআল্লাহ আল্লাহর হুকুম হলে এইটা ম্যানেজ হবে আমার মাধ্যমেই। আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব৷ আমি জানি এই গ্রুপে এমন অনেক আছেন যারা এই সাহায্য চাইলেই করতে পারেন, শুধু আল্লাহর হুকুম প্রয়োজন। ইনশাআল্লাহ, আমার আল্লাহ এই হুকুমও করে নিবেন বলে আমি বিশ্বাস করি৷ কারণ আল্লাহর ঘরের খবর, ছোটছোট বাচ্চাদের খবর আমার আপনার চাইতে আমার আল্লাহ আরও ভালো করেই জানেন৷ বিশ্বাস করেন, ভাঙ্গা মেঝেতে বসে বসে কুরআন পড়তে থাকা বাচ্চাদের জন্য আল্লাহ মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে আমাকে সেখানে প্লাস্টিকের কার্পেট নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনারা কেউ যদি ডোনেশন করতে চান, বা কেউ যদি সম্ভব হয় ডোনেশন কালেক্ট করে দিতে চান, প্লিজ জানাবেন। কারণ দেশের বাইরে থেকে অনেকেই আছেন, চাইলেই ভালো অংকের একটা ডোনেশন কালেক্ট করে দিতে পারবেন খুব সহজেই। এই গ্রুপে লন্ডন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের অভাব নেই। ডাক্তার আপুরা তো শুরু থেকেই বন্যার্তদের জন্য ডোনেশন করে আসছেন। সাধারণ মানুষেরা তো আরও বেশি এগিয়ে এসেছেন প্রথম থেকেই। ভালোকাজে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করুন। কবুল করুন ভালোকাজে যুক্ত হওয়ার বাসনাও। কেউ যদি ব্যাংক একাউন্ট চান, তাহলে আমাকে ইনবক্স করতে পারেন৷ আর আমার বিকাশ পারসোনাল নাম্বার হলো, 01762095729

আসসালামুয়ালাইকুম।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here