#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১৫

0
1114

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_১৫

#মিদহাদ_আহমদ

আসিফ চিৎকার করে বললো,

‘আমার সামনে থেকে চলে যাও। এক্ষুণি চলে যাও। বিদায় হও’

আসিফের রাগান্বিত গলা শুনে আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। কেন এই জীবন আমার? যাকে নিয়ে কখনো কখনো স্বপ্ন বাধি সেই আবার দূরে ঠেলে দেয়? সে নিজেই আবার তাড়িয়ে দেয় নিজের মনকোটর থেকে? একটা মেয়ের কী জীবন মানেই এই গঞ্জনা সহ্য করা? অবহেলা অনাদরে জীবন মানিয়ে নেয়া? আমার তো জীবন এমন হওয়ার ছিলো না। এমন আমার হওয়ার কথা নয়!

শাশুড়ি বললেন,

‘আসিফের কানে কানে থাকলে এমন করেই গাল বকা খেতে হবে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে যত আগেই ধারণা করতে পারবা, তত আগেই তোমার মঙ্গল৷ দুইবেলা খেতে পারছো, মাথার উপরে ছাদ আছে, আর এই যে দেখছো বৃষ্টির দিনেও কোন পানি টপকে ঘরে আসতে পারছে না, এতেই বা কম কিসে? নিজের বাপের ঘরে তো মেঘ বাদলার দিনে এক প্রহরও তো ঘুমাতে পারতে না। এখন পারছো! এ ও বা কম কীসে?’

শ্বাশুড়ির এহেন মতামত আমার আজকাল সব দিনই শোনা হয়ে থাকে। আজকেরটাও নতুন না৷ আজ শুধু মনে হচ্ছে, এইটা মিথ্যা হলেও পারতো! আমার এতদিনের স্বপ্ন, কল্পনা সব যেনো নিমিষেই পিষে যেতে লাগছে!

আমার ননাস তানিয়ার শাশুড়ি খোদেজা বেগম আসলেন সামনে৷ শাশুড়িকে বললেন,

‘বেয়ান একটা জরুরী কথা ছিলো আপনার সাথে। আর আজই কথা বলতে হবে।’

‘কী জরুরী কথা বেয়ান? এখন তো চায়নিজে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তানিয়া তামান্নাও পার্লার থেকে সরাসরি চলে যাবে চায়নিজে। ‘

‘এর আগেই আমি আমার জরুরী কথা সেড়ে নিতে চাই বেয়ান”

শাশুড়ি বললেন,

‘আচ্ছা আপনি আমার রুমে আসুন৷ আর নুপুর, এখন আসিফের সামনে যেও না। হুদা হুদাই আজকের অনুষ্ঠান সে মাটি করে দিবে। তারপর চায়নিজে সে না আসলে আবার আরেক সমস্যা। সবাই জিজ্ঞেস করবে কনের বড় ভাই কোথায়? আমি তোর আর উত্তর দিতে পারবো না যে তার বউ তার সাথে কানাঘুষা করতে লেগেছিলো বলে আজকের আসাটাই মাটি হয়ে গিয়েছে! আমি শাড়ি এনে দিচ্ছি। তুমি আমার রুমে এসে রেডি হয়ে নিও।’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। রান্নাঘরে গিয়ে আগামীকাল সকালের কাজ কাজের মেয়েদের গুছিয়ে দিয়ে শাশুড়ির রুমে এলাম। শাশুড়ি এর ভেতরেই শাড়ি এনে রেখেছেন তার রুমে। আমি শাড়ি পরতে ছিলাম। এমন সময়ে খোদেজা বেগম শাশুড়িকে বলতে লাগলেন,

‘বেয়ান, জানি কথাগুলো আপনি মা হিসাবে সহ্য করতে পারবেন না। তবুও আমার বলতেই হচ্ছে। কিচ্ছু করার নাই৷ আপনারা এরপর কি জানাবেন বা জানাতে আসবেনে এর কোন পরিণতি আমি জানতে চাচ্ছি না।’

শাশুড়িকে দেখলাম বেশ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে আছেন। বললেন,

‘আমার মেয়ের কি কোন ভুল হয়েছে বেয়ান?’

‘না না। ভুল তার হবে কেন? সে যে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না এইটা কি সে জেনেছিলো আগে নাকি আপনারা জেনেছিলেন বলেন?’

শাশুড়িকে দেখলাম একেবারে থ মেরে বসে আছেন৷ ননাসের শাশুড়ি বলা শুরু করলেন,

‘ আগামীকাল আমার ভাইয়ের মেয়ে লন্ডন থেকে আসছে। সবাই আসছে। তানিয়া চিনে সবাইকে৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার ছেলের সাথে আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে দিবো। আর তানিয়ার সাথে তো অনেক ভালোই চলছিলো সব। আমরা একটা নাতি চেয়েছিলাম। আর কিছু না। বিয়ের কয়েক বছর হয়ে গেলো। এখনও কোন খবর এর মুখ দেখলাম না৷ যার একবারে হয় না তার আর জীবনেও হয় না। বেয়ান সিলেটি প্রবাদ আছে জানেন তো, ‘যার সাতে হয় না তার সাতাইছেও অয় না’ ‘

শাশুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

‘বেয়ান দেখেন, এসবে কারো হাত নেই৷ আমার দুইটা মেয়ে মাত্র৷ আমি আমার জীবনে দুই মেয়ে ছাড়া আর কারো সুখের চিন্তা করি না। দেখেন এই ঘর এই বাড়ি এই সম্পত্তি সবকিছুর যদি তিন ভাগও করি, স্রেফ আমাদের এই বাড়ির জায়গাই তো আট কোটি টাকার,! এক ভাগ আপনার ছেলের হলেও তো জীবন কেটে যায়!’

ননাসের শাশুড়ি বললেন,

‘বেয়ান সব টাকা দিয়ে হয় না। আপনার আট কোটি টাকার বাড়ি আছে। গার্মেন্টস আছে, এজেন্সি আছে, ফার্ম আছে। জানি কোটি কোটি টাকার কারবার আছে। আমাদেরও কম নয় জানেন ই। আমার আরও তিন পুরুষ বসে বসে কাটাতে পারবে জীবন অনায়াসে। কিন্তু তিন পুরুষ তো লাগবে? যদি না আপনার মেয়ে এক পুরুষ না এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে বসে খাওয়া তো দূরে থাক, কাকদের ছিটিয়ে দিতে হবে আমাদের সব! জানি আমার কথা খারাপ লাগছে আপনার। খারাপ লাগলেও আমাদের কিছু করার নেই এখন। আমার ভাইঝি দেশে এক সপ্তাহ থাকবে। এর ভেতরেই বিয়ে দিতে হবে। আপনাকে আজ তাই জানালাম। আগামীকাল এডভোকেট ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবেন। আর তানিয়াকে বিয়েতে দেয়া এগারো ভরি স্বর্ণ ফেরত দিতে হবে না৷ কাবিনের পনেরো লাখ টাকা আগামীকাল ডিভোর্সের সাথে সাথে পাঠিয়ে দিবো।’

ননাসের শাশুড়ি কথাগুলো বলে উঠে চলে গেলেন। সাথে ননাসের ননাসও চলে গেলো। দেখলাম বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো তারা দুজন। শাশুড়ি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেন! আমি কাছে গেলাম। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। শাশুড়ি জমে যেনো একেবারে শক্ত হয়ে আছেন!

কোন কথা বলছেন না আর।
আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘মা আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখছি। আমি কোন ভাবেই আপার সংসার ভাঙ্গতে দিবো না। কোন ভাবেই না। আমি নিজে দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলবো।’

‘কোন লাভ নেই। কিচ্ছু হবে না। আমার মেয়ের সংসার আর রইলো নারে মা। আমার মেয়ের সংসার আর রইলো না।’

বলেই শাশুড়ি বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি এই প্রথম আমার শাশুড়ির কাছে আমাকে মা বলে ডাকটা পেলাম। আমার ভেতর আত্মা কেঁপে উঠলো। শাশুড়ির এহেন নরম দিক আগে আমি দেখিনি। আমি শাশুড়িকে ধরে চোখ মুছে দিয়ে বললাম,

‘মা! এখন কান্নার সময় না। একটু পরেই সব মেহমানদের আপনাকে সামাল দিতে হবে। তামান্নার পান চিনি। আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আর লোক জানাজানি হলে এর প্রভাব কিন্তু তামান্নার উপর এসে পড়বে। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। প্লিজ!’

শাশুড়িকে বিছানা থেকে তুলে আমি শাড়ি পরিয়ে দিলাম৷ আমি চুলে গাজরা পড়ার জন্য রুমে গেলাম৷ দেখলাম আসিফ নেই৷ চিন্তায় পড়ে গেলাম মানুষটা গেলো কোথায়! এরকম করে সে ঠিক বারে আর নাহলে নারীতে মত্ত হয়ে উঠে! আজও কি সেখানে গেলো!

আটটা নাগাদ বাসার গাড়িতে করে আমি আর শাশুড়ি চায়নিজে চলে গেলাম। বাসার সব মেহমানও চলে এলো৷ শাশুড়ির মুখে চিন্তার ছাপ। আমি তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করলাম। শাশুড়ির মুখে হাসি নেই তবুও!

এদিকে আমরা যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মাথায় আমার ননাস আর ননদ পার্লার থেকে চলে এলো। ননাসকে দেখেই আমার শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সে কী কান্না! বাচ্চাদের মতো করে! আমার ননাস মাকে ছাড়িয়ে বললো,

‘কী হলো? আমাকে বিদায় করছো না। আর তামান্নাকেও তো আজ বিদায় করে দিচ্ছো না। আজ দেখি মায়ের আবার বড় মেয়ের জন্য দরদ শুরু! কান্না করছো কেন?’

শাশুড়ি আর জবাব দেয়ার অবস্থায় রইলেন না। লাল লাল চোখ। আমি চোখ মুছে দিলাম। ননদ বললো

‘তোমার এত দরদ দেখাতে হবে না ভাবি৷ এখানে লোক দেখানোর জন্য এসব করছো ঠিক ই বুঝা যাচ্ছে।’

ননাসও কথা শুনিয়ে দিলো আমাকে। একবারও সে অপেক্ষা করলো না আজকের দিনটা ভেবে!

কিছুক্ষণের মাথায় বর পক্ষের সবাই চলে এলো। ঘরের সবাই একসাথে বসে আমার ননদের মোহরানা ঠিক করতে লাগলো৷ আমার ননাস আমার শাশুড়িকে বললো কানে কানে,

‘বড় অঙ্কের মোহর ঠিক করো মা। আজকালকার বিয়েতে এসব গ্যারান্টি নাই। মোহরানা বেশি হলে কেউ যেই সেই করে ছেড়ে দিতে পারে না। আমার পনেরো ছিলো, তামান্নার ত্রিশ ধরো।’

আমি পাশে থেকে মনে মনে বললাম, আমার ননাস জানে না তার সংসার যে ভাঙ্গতে চলেছে। তার পনেরো লাখ টাকার মোহরেও বিয়ে ঠিকছে না আর। হায়রে মানুষের গরিমা! হায়রে মানুষের চাওয়া!’

বড়দের মাঝখানে গিয়ে ননাস দাবি ছাড়লেন বিয়েতে মোহর ত্রিশ লাখ আর স্বর্ণ যার যার ইচ্ছা মাফিক নির্ধারণ করতে। বলে দিলেন স্বর্ণ সুন্দর। তারা তাদের পুত্রবধূকে যা ইচ্ছা তাই দিবেন৷ বেশি দিলে তাদের সুন্দর! আদতে তো আপনাদের ঘরেই যাবে৷ আমরা তো আর এগুলো রেখে দিবো না। যাই যাবে, আপনাদের। আমাদের বলে কিছু নেই, কিছু দাবিরও নেই। আর জানেন ই তো, মেয়েদের একটু আধটু ইচ্ছা থাকেই এসবে। সব মেয়েরাই গহনা গায়ে জড়াতে পছন্দ করে। নতুন বিয়ে হলে তো এই শখটা আরও একটু বেশি মাথা চড়া দিয়ে উঠে তাইনা?

এদিকে তামান্নার হবু ননাস বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। স্বর্ণ যা দেয়া হবে তা আবার মোহর থেকে কর্তন হবে।’

আমার ননাস বললেন,

‘না না৷ আমারও তো কর্তন হয়নি। এগুলা তো উপহার হিসাবে…’

‘না। আমাদের এখানে কর্তন হয়।’

এসব বিষয়ে বিস্তর আলাপ শেষে, মোহর সাতাশ লাখ আর স্বর্ণ উপহার হিসাবে বিয়ে ঠিক হলো। রোজা শেষ প্রায়। ঈদের এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো৷ আমার ননদ তামান্নার ননাস বললো

‘বিয়ে যখন ফিক্সড তাহলে এবার রমজানে আমরা আমাদের ভাইর বউর বাড়ি থেকে ইফতারি খাচ্ছি তো?’

আমার শ্বশুর বললেন,

‘ঝিয়ারি বেটি ইতা আর কওয়া লাগবোনি খউছাইন? আমি কাইলকু হাইঞ্জাবালা আইরাম। তোমাতানোর গোষ্ঠীগাড়া হক্কলরে লইয়া খাইলিবায়নে ইফতার। (এইটা সিলেটি ভাষা। এর শুদ্ধ বাংলা হলো,’ মেয়ে এগুলো আর বলা লাগবে বলো? আমি আগামীকাল সন্ধ্যায় আসছি। তোমাদের বংশের সবাইকে নিয়ে ইফতার করে ফেলবে।)’

এসব দেয়া নেয়ায় একটা বিয়ে ঠিক হলো। অন্যদিকে আমি আমার ননাসের স্বামীর নাম্বার এনে যোগাযোগ করলাম ওনার সাথে। ওনাকে বললাম,

‘যে করেই হোক আজ রাতের মধ্যে যেনো আমার সাথে যোগাযোগ করেন। জরুরী কথা আছে।’

কলে কথা বলে ভেতরে যাবার রাস্তায় এক কোণে কয়েকটা ছেলেকে দেখতে পেলাম। আমি পেছন থেকে স্পষ্ট শুনলাম একটা ছেলে বলছে,

‘তামান্নাকে আমার না হলে আর কারোর হতে দিবো না আমি। আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি বাঁচতে পারবো না।’

কথাগুলো শুনে আমি ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। পথ আটকিয়ে সামনে এলো আসিফ। এতক্ষণ সে কোথায় ছিলো! আসিফের পরনে মোদি কোর্ট আর প্যান্ট। গোলাপি রঙের! আমার সাথে ম্যাচিং! পায়ে নাগরা৷ হাতে ঘড়ি। চুলগুলো একপাশ থেকে অন্যপাশে গিয়ে পড়ছে যেনো! তাকে দেখতে আজ আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় লাগছে৷ আমার চোখ আটকে থাকলো আসিফের দিকে। আসিফ আঙুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বললো,

‘কী? কী? এমন তাকাচ্ছো কেন?’

আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। আসিফ তার পকেট থেকে একটা টিপের পাতা বের করে একটা টিপ নিলো হাতে। আমার কপালে একটা টিপ পড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘এখন তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। কালো টিপ, গোলাপি শাড়ি, সাদা গাজরা! খুব মানিয়েছে তোমাকে। আর সরি আজকের বিহেইভের জন্য৷ এই আমি কান ধরলাম’

আমার সব অনুরাগ, সব কষ্ট, সব অপ্রাপ্তি নিমিষেই যেনো গলে গেলো!

নারীরা এত সহজ কেন! যখন ইচ্ছা কঠোর হয়, কখনোবা গলে হয় জল! এই উঠানামার জীবনেই কি আসল নারী জীবনের স্বাদ?

[আসসালামুয়ালাইকুম৷ নিয়মিত গল্প দিচ্ছি ঈদের মধ্যেও। আমার খালামণি, আপু, ভাইয়া যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা নিয়মিত লাইক কমেন্ট করে যাচ্ছেন৷ কিন্তু গত দুইদিন থেকে গল্পের রিচ আগের মতো হলেও লাইক কমেন্ট আগের মতো হচ্ছে না। মানে যারা পড়ছেন, গোপনে পড়ে যাচ্ছেন। আজকে ২ হাজার লাইক আর ৫০০ কমেন্ট না আসলে সত্যিই আগামীকাল আর দিবো না গল্পটা। আমি কষ্ট করে সময় বের করে গল্প দেই, অথচ আপনারা অনেকেই লাইক করার সময় পান না!]

(চলবে যদি আপনারা চালাতে চান…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here