তুমিময়_প্রেম❤ #PART_25,26

0
356

#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_25,26
#FABIYAH_MOMO
25

১.
মুগ্ধের বাসায় যাবো! ওর পেয়ারা বন্ধু তন্ময়ের ইতিহাস বলতে! আব্বুকে বিদায় করে কোনোরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে! উদ্দেশ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুগ্ধের বাসায় পৌছানো এবং সবটা খুলে ওকে জানানো। মুগ্ধের বাসায় যেতেই দারোয়ান আমার হাতে একগুচ্ছ চাবি ধরিয়ে দিল এবং বলল, এগুলো বাসার এক্সট্রা চাবি, যা মুগ্ধ কেবল আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছে। আমি চাবি হাতে দ্রুতপায়ে একেবারে থামলাম মুগ্ধের রুমের কাঠালি দরজার কাছে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো। মুগ্ধ এখনো ঘুমাচ্ছে। চাবি গুচ্ছা থেকে বেছে বেছে একটা চাবি নিয়ে নবে ঢুকিয়ে দিলাম মোচড়! ব্যস! দরজা খুলেছে! আমি টুপ করে ঢুকে পড়ি। দরজাটাও চাপিয়ে দেই। চোখের সামনে বিশাল মাঠের মতো মস্ত এক বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে মুগ্ধ। পা থেকে মাথা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে ঢাকা। আমি আস্তে করে কাধের ব্যাগটা রেখে ওর মাথার কাছে বসি। সাদা নরম তুলতুলে কম্বলটা ধীরগতিতে সরিয়ে দেই। মুগ্ধের চোখে সকালের মিষ্টি আমেজের রোদটা যেয়ে পড়লো। এতে মুগ্ধ নড়েচড়ে ঘুমে ঢুলু চোখে উঠে বসলো। শরীর টানা দেওয়ার জন্য কম্বলটা গা থেকে সরতেই আমি এক চিৎকার দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলি! মুগ্ধ চোখ কচলে আমার উদ্দেশ্যে বললো,

— ভূত দেখছো? চিৎকার দিলে কেনো?
আমি থতমত গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলি,
— তু তুমি উ উদাম!
— উদাম কি শব্দ?
আমি দুইহাতে মুখ ঢেকেই বেড থেকে দাড়িয়ে পড়ি! বিচলিত গলায় বলে উঠি,
— আরে তোমার গায়ে কিছুই নেই! তুমি খালি গায়ে!

আমার কথা শুনে মুগ্ধ নিজের দিকে তাকালো। রাতে ওর খালি গায়ে ঘুমানোর স্বভাব। শুধু একটা ট্রাওজার পড়ে ঘুমায়। মুগ্ধ কম্বল দিয়ে গা ঢেকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— লজ্জার কি আছে পাগল? তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে এতোক্ষনে কতোওও আদর করতো। ডিপলি একটা মনিং কিস দিতো মাস্ট!
— ছি! বাসি মুখে কিস! বমি করে দিবো!
— তাহলে ব্রাশ করি! একটা কিস দাও!
— আগে তুমি গা ঢাকো! নাহলে আমি এক্ষুনি চলে যাবো!
মুগ্ধ বিরক্ত গলায় বললো,
— চোখ খুলুন ম্যাডাম! আমি আপনাকে নিজের গা দেখিয়ে পাগল বানাতে চাইনা। এসব বাজে স্বভাব থাকলে অলেরেডি মুগ্ধের ক্যারেক্টারলেসের সার্টিফিকেট থাকতো।

আমি অতি আস্তে আস্তে মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেলি। ওর চোখ এখনো বন্ধ করা। পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে ওকে! এলোমেলো চুলগুলো কপাল ঢেকে দিয়েছে। আমি পাশে যেয়ে বসতেই মুগ্ধ বাচ্চার মতো ঠোট উল্টে বললো,
— আমি কিন্তু উদাম টুদাম না। ট্রাউজার পড়ে আছি। বাট তুমি আমাকে নিয়ে কি কি অশ্লীল চিন্তাভাবনা করেছো হু নৌস? একটা কাজ করো প্লিজ। আলমারি থেকে টিশার্ট এনে দাও। আর হুট করে এতো সকালে তুমি এখানে? কোনো প্রবলেম?

আমি আলমারি থেকে টিশার্ট নিতেই বলে উঠলাম,
— আমি কালরাতে আসতে চেয়েছিলাম। তোমার ফোন ট্রায় করেছি বন্ধ ছিলো। না পারতে সকালের বাস ধরে চলে এসেছি। এই নাও টিশার্ট..
মুগ্ধ টিশার্টটা হাতে নিয়ে বললো,
— সিট! ফোনটা চার্জে ঢুকাতে ভুলে গেছি। আমি টিশার্ট পড়বো তুমি অন্যদিকে তাকাবে? চাইলে আমাকে দেখতে পারো। আই হেভ নো প্রবলেম।

কথা শেষ করে মুগ্ধ মিচকে একটা হাসি দিলো। আমি সাথেসাথে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলা শুরু করলাম,
— তোমার কল কাটার পর জেনিকে কল করেছিলাম। রামিমের খোঁজখবর নিতে। রামিমের সাথে কথাও হয়েছে..

মুগ্ধ টিশার্টের গলা দিয়ে মাথা ঢুকাতেই বিষ্মিত কন্ঠে বললো,
— কি বললে? রামিমের সাথে কথা বলেছো! হাও ইজ দিস পসিবল!
— প্লিজ আমি কথা শেষ করি। তারপর বলো।
— সরি! ডান পাকনি এখন তাকাতে পারো।
আমি মুখ ঘুরিয়ে মুগ্ধের দিকে ফিরলাম।
— একটা প্রমিস করবে?
— ইয়েস প্রমিস। বলো।
— রামিমের এক্সিডেন্টটা তন্ময় করেছে মুগ্ধ! তন্ময় একটা শয়তান! তলে তল তোমাকেও মারার জন্য প্ল্যান করেছে! আরেকটা কথা! আমাদের বিয়ের ব্যাপারে ও সবটা জানে! তুমিই বলো যেখানে তোমার বাসার চাকররা এই বিয়ে সম্বন্ধে কিছু জানেনা সেখানে তন্ময় জানলো কি করে? আমার মাথা আওলা হয়ে আছে মুগ্ধ! আমি কোনোকিচ্ছু ভাবতে পারছিনা!
মুগ্ধ কপালের চিন্তার ভাঁজ পড়লো। এই মূহুর্তে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে মুগ্ধকে। কিছুক্ষণ চুপটি থেকে কৌতুহল গলায় বললো,
— কথাগুলো রামিম বলেছে? বিয়ের ম্যাটার ও জানে?
আমি মাথা উপর-নিচ নাড়লাম! যার অর্থ ”হ্যাঁ”!
— মামলা সিরিয়াস! ওয়েট! মুখটা ধুয়ে আসি!

মুগ্ধ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— পাকনি আই ডোন্ট নো! বাট আমার হেভি ডাউট হচ্ছে তন্ময়ের উপর! তন্ময়ের মতো মিথ্যুক আমি সেকেন্ড একটা দেখিনি! ওর মাথায় কত খারাপ কনসাইন্স থাকতে পারে জাস্ট আই নো!
মুগ্ধ আলমারি থেকে শার্ট, প্যান্ট, ঘড়ি বের করে রেডি হচ্ছে! আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি! ওর টিশার্ট ছাড়া গা আরেকবার দেখলে সিরিয়াসলি আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো! এমনেই চোখের সামনে একটু আগের দৃশ্য ভাসছে! চোখবন্ধ করলেও একই অবস্থা দেখছি! ওমন ইয়াং একটা ছেলের শরীর দেখতে মেয়েদের চমৎকার লাগলেও আমার জাস্ট একপলক দেখতেই শ্বাস ভারী হয়ে আসছে! নো নেভার তাকানো যাবেনা!

২.
ভার্সিটির প্রাঙ্গণে পা রাখতেই আমার চোখ ছানাবড়া! সবাই দৌড়াচ্ছে কেনো? কিছু হয়েছে? সবাই দেখি একদিকে পালাচ্ছে! আমার হৃৎ গতি হঠাৎ বেড়ে যেতে লাগলো! সবার চোখমুখে আলাদা রকমের ভয় দেখছি! রহস্যজনক ভয়! মুগ্ধ কোথায়? ওকে যে দেখছিনা! আমাকে এখানেই থাকতে বলে মুগ্ধ গাড়ি করে ঢুকেছিলো।আমি কাউকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করবো, কেউই আমার ডাকে শুনছেনা! পায়ের দৌড়াদৌড়িতে বাতাসের ধূলো উড়ছে! অনুভব করলাম কলিজাটা ধুকপুক করছে! দূর থেকে একটা ডাক শুনতে পেলাম! কেউ আমার ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে! আমি উৎসটার খোঁজে এদিক ওদিক দেখতেই মাঠের শেষপ্রান্তটার হলরুমের ওখানে অর্পিতা দাড়িয়ে! দুহাত দিয়ে ঠোটের চারপাশ ঘিরে বেগতিক হারে চিল্লাচ্ছে! আমি দৌড়ে হাফাতে হাফাতে অর্পিতার কাধ ধরে থামলাম। অর্পিতা কান্নার সুরে অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,

— গন্ডগোল হয়ে গেছে দোস্ত! গন্ডগোল হয়ে গেছে! তন্ময়, নাসিফ, আহাদ মিলে মুগ্ধ ভাইকে পিটাচ্ছে! অনেক ফোন করেছি তুই ধরিসনি!! একনাগাড়ে দশমিনিট ধরে মারছে!! ভাইকে বাঁচা প্লিজ! কুত্তাগুলা মেরে ফেলবে ওকে!!

আমার আত্মাটা যেনো সাথে নেই কথাটা শুনার পর! আপনাআপনি অর্পিতার কাধ থেকে পড়ে গেলো হাতটা। বুকের মধ্যে ধুপধুপ করে হাতুড়ি চালাচ্ছে কেউ! কানেও যেনো শব্দটা বিধছে খুব! বহু কষ্টে ঢোক গিলে অর্পিকে প্রশ্ন করলাম,
— উউনি ককোথায়?
অর্পি কান্না করে বলে উঠলো,
— হহলরুমে

শরীরের শেষটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি! এই দৌড়টা জীবনের শেষ দৌড় এমন নীতিনিষ্ঠে দৌড়াচ্ছি! বুকটা ফেটে ছিন্নভিন্ন লাগছে প্রচুর! এই বুঝি ওরা উনাকে মেরে ফেললো! হলরুমের দরজায় কি ভীড়! ভেতরে যাওয়া মুশকিল! নাহ!! এভাবে হাতে হাত রেখে তামাশা দেখার সময় নেই!ওরা মুগ্ধকে মেরেই ফেলবে! জামার হাতায় চোখ ডলে হলরুমের উল্টোদিকে যাচ্ছি! ওখানে একটা জানালা সর্বদা খোলা থাকে! জানালার নিকটস্থ হতেই নাসিফের হো হো হাসির গলা শোনা যাচ্ছে। আমি জানালা টপকে ভেতরে ঢুকতেই গায়ের সবগুলো পশম কাটাঁ দিয়ে উঠলো! হিরহির করে আলোর গতিতে রক্ত সন্ঞ্চালন বৃদ্ধি পাচ্ছে! আমার পুরো শরীর কাবু হারিয়ে ফেলেছে! মুগ্ধের মাখন রঙের শার্টটা রক্তে লালটম্বুর!হলরুমের ময়লা ফ্লোরে কালো প্যান্টটা ধূসরবর্ণে মাখামাখি। দুইহাত মাথার দুইদিকে মেলে উপুড় হয়ে কাশছে মুগ্ধ! কাশির সাথে মুখ থেকে লালরক্ত বেরুচ্ছে! তন্ময় লাগামহীন পিটিয়ে হাফিয়ে উঠেছে বিধায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছে!

সকালেই না মানুষটাকে হাসিখুশি সুস্থ দেখলাম? লজ্জামিশ্রিত ভাবনায় উনাকে মনের কোণে আনলাম। কি করে দিলো ওরা মুগ্ধকে? কি করে দিলো? জানালা ধরেই কেঁদে দেই আমি। চোখ কুচকে ফুপিয়ে কেদেঁ দেই! মম কাদলে চলবেনা! কাদিস না! থামা নিজেকে! জানোয়ারগুলাকে আগে টাইট কর! তোর মুগ্ধকে পিটিয়েছে না? তুইও কুত্তার মতো পিটাবি! একটাকেও ছাড় দিবিনা! জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে হাতের তালু চোখের পানি মুছে ওড়নাটা হাতে নিলাম! কাধ থেকে কোমর বরাবর বাকা করে বেধেঁ ব্যাগের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় সরন্জামাদি নিয়ে হাতে পুড়লাম! আমি ওদের পেছনদিকে বিধায় এখনো ওরা দেখেনি আমায়! চুপিচুপি বিনা শব্দে ওদের পেছনে দাড়াতেই ওরা বলছে,
— মাম্মা? এই শালাকে মেরে কোথায় ফালাবি? মরা লাশ তো সাথে রাখা যাবেনা।
তন্ময় বললো,
— হুর বেক্কল! এইটা মরছে নাকি! এখনো মরেনাই! শালার নিশ্বাস পড়তেছে! মাথায় দুইটা জোরে দেওয়া লাগবো!
আহাদ বলে উঠলো,
— দেখ মামা! যেমনেই হোক লাশ ড্রেনে ফালাইস না! নদীতে ফালাইতে গেলেও কেউ না কেউ মাস্ট বি দেখবো! তার চেয়ে ভালো ! কবরস্থানে কবর দেওয়া!
নাসিফ ধমকে বলে উঠলো,
— গাধার বাচ্চা! ঘিলু নাই? কবরস্থানের মানুষ মনেহয় তোর চাচা লাগে বললেই একেবারে কবর দিয়ে দিবো!

ওরা নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটিতে ব্যস্ত থাকলে পেছন থেকে সামনে এসে আমি শুরু করি হামলা! টিনের বোতলটা জোরে ঝাকিয়ে ডিরেক্ট হামলা চোখে, পেপার স্প্রে দিয়ে! ওরা চোখ ধরে চিল্লাচিল্লি করছে! কেউ চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা! এইসুযোগে আমি মুগ্ধকে ডাকছি! ও চোখটা পযর্ন্ত খুলতে পারছেনা! ওড়নাটা দিয়ে তাড়াতাড়ি ওর মুখ ঢেকে দেই! বাতাসে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় পেপার গ্যাস যেভাবে ছড়াচ্ছে বেশিক্ষন থাকা যাবেনা এখানে! মুগ্ধকে উঠিয়ে যতদ্রুত সম্ভব ধরে ধরে হলরুমের পিছন গেটে দিয়ে বের হলাম! মাথায় শুধু একটাই কথা পাক খাচ্ছে, মুগ্ধ বাচঁবে তো? তুই ওকে বাচাঁতে পারবি??? পেছন থেকে চেচামেচি করছে ওরা,

‘তোকে আমরা ছাড়বোনা! মুগ্ধকে মেরেই ফেলবো! তুই ওকে যেখানেই নিস যাস কেনো! আকাশ পাতাল ভেদ করতে হলেও মারবো! মার্ক মাই ওয়ার্ডস!’

৩.
রাদিফ মুগ্ধ চিকিৎসাধীন! প্রচুর রক্ত গেছে ওর! আমার নিজের জামাটাই ওর রক্তে চটচটে আকার ধারন করেছে! ওড়নাটা চিপলে বেসিন ভর্তি রক্ত ঝড়বে! অর্পির সাহায্য নিয়ে মুগ্ধকে বাসায় এনে ব্যবস্থা করেছি! ভেতরে একটা ডাক্তার, দুটো নার্স মিলে ওর ট্রিটমেন্ট করছে ! আমি রুমের বাইরে পায়চারি করছি। সার্ভেন্টরা সবাই এটা ওটা এনে হেল্প করছে। সবচেয়ে বড় সাহায্য করেছে মুগ্ধকে রক্ত দিয়ে! ডাক্তার এসে ব্লাড চাইলেই তিনজন এগিয়ে আসে!
— ‘স্যারের ব্লাড আমি দিবো ডাক্তারসাহেব!আমার থেকে রক্ত নিন!’
আরেকজন বলে উঠলো,
— ‘ডাক্তার বাবু! আমার শরীরে যত্টুক রক্ত আছে নিয়ে নেন! তারপরও আপনে মুগ্ধ বাবারে বাচায়া দেন ডাক্তার বাবু!

আমি হতবিহ্বল হয়ে কাদছিলাম শুধু! সার্ভেন্টদের এমন রক্তদান হৈহৈ দৃশ্য আমার কাছে একটা রঙিন দৃশ্যপট! আচ্ছা মুগ্ধ এমন কি জাদু করেছে উনাদের মনে এতো দাগ চিড়ে গিয়েছে?বেশিরভাগ সার্ভেন্ট দরজার বাইরে ফ্লোরে বসে দুহাত তোলে দোয়া পড়ছে। হয়তো প্রতিটি মোনাজাতে কাদঁতে কাদঁতে মুগ্ধের জন্য অকুল কন্ঠে সুস্থতা কামনা করছে। একটু দূরে গিয়ে দাড়ালাম। অনবরত চোখের স্থল ভরে ভরে পানি গড়াচ্ছে। বারবার মুছলেও যেনো অশ্রুর সোডিয়াম ক্লোরাইডের কমতি হচ্ছেনা। আমার পাশে এসে সেদিনের বৃদ্ধাটা দাড়ালো। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন,

— মিস্টি মা টা? নাক ফুলিয়ে ফেলছো… কান্না করেনা মা। ও দেখো সুস্থ হয়ে যাবে।
আমি হেঁচকির সুরে আটকা গলায় বললাম,
— সসুস্থ হহবে তো?
বৃদ্ধা আঙ্গুল উচিয়ে সার্ভেন্টদের দিকে দেখালেন এবং নম্র গলায় বললেন,
— এদের মোনাজাত বিফলে যাবে না মিস্টি মা। পরিস্কার মন থেকে নিজেকে ভিখারি করে আল্লাহর দরবারে চাচ্ছে। আল্লাহ কি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়? দেয় না। মানুষ শূন্যহাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ্ নাহ্! ভরসা রাখো। সব ঠিক হবে। আমার দাদুভাইয়ের কিচ্ছু হবেনা।
আমি অস্পষ্ট সুরে থেমে বলি,
— উউনি আআপনার নানাতি?
বৃদ্ধা আমার চোখের পানি মুছে বললেন,
— হুম মিস্টি মা। দাদুভাই আমার। যাও দাদুকে দেখে আসো। ডাক্তার ভেতরে যেতে অনুমতি দিয়েছে।

আমি হ্যাঁ সূচকে মাথা নাড়িয়ে দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। চোখের সামনে সটান হয়ে শুয়ে আছে মুগ্ধ! সকালের পরিস্কার চাদরটা এখন রক্তে মত্ত! সুস্থ ফাজলামি করা মানুষটা এখন বিছানায় আহত! মুগ্ধ চুপ করে আমাকে দেখছে। কপাল কুচকে ঠোট নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠোটের কোনাটা একদম চিড়ে আছে! একটা সেবিকা পাশ থেকে বললেন,
— আপনি পেশেন্টকে কথা বলতে দিবেননা প্লিজ! উনি এখনো দূর্বল! চুপচাপ পাশে বসে কথা বলুন। উনাকে মনের ভুলেও টু শব্দ করতে দিবেন না। চলি।

নার্সটা চলে যেতেই আমি বিছানায় বসলাম। মুগ্ধ ঠোটটা নাড়াচ্ছে এখনো! যন্ত্রণায় কথা বলছেনা একটুও!

আমি শাষন গলায় বললাম,
— ভালো হইছেনা একা একা মার খেতে! ভালো হইছে? মনের স্বাদ মিটছে আপনার? না করছিলাম না? কথা কানে নিছেন?

মুগ্ধ জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
— সরি! আ’ম সরি।

ঠোঁট কাপিয়ে শক্ত করে থাকলেও আমি ওইটুকু শব্দ শুনেই ডুকরে কেদেঁ দেই। যদি আজ আমার ক্যাম্পাসে যেতে দেরি হতো? যদি আজ অর্পিতা সঠিক সময়ে ওকে গাড়িতে না তুলতো? তাহলে কি এই দুটি শব্দ শোনার মতো অবস্থাটুকু বাচঁতো? নাকি লাশে পরিণত হওয়ার মতো মুরদা হয়ে যেতো? কে জানে?

-চলবে

#ফাবিয়াহ্_মম

#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_26
#FABIYAH_MOMO🥀🍁

মেঘের গর্জনে ঢেকে গেছে পরিস্কার আকাশ! আকােশর দিকে তাকালেই যেনো গা শিউরে উঠে! রাস্তাঘাট খালি হচ্ছে অতি জলদিতে! আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে নিউজ পোর্টাল! অতি শিগগিরি নিরাপদে সবার চলে যাওয়ার আহ্বান! বাতাসের তান্ডব শুরু হয়ে গেছে! মুগ্ধ বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশটা দেখছে। ওর কাছে আকাশটা আজ মস্ত আশ্চর্যের বস্তু! বারবার ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে মন বেচইন করে ফেলেছে। মনে প্রশ্ন একটাই! কখন নিজের চোখদুটোতে একটু উষ্ণতা পাবে! তৃষ্ণায় চোখদুটো জ্বালাময় করছে। এই তৃষ্ণা কিন্তু পানির তৃষ্ণা না! অন্যকিছুর তৃষ্ণা! স্বাভাবিক তেষ্টায় মানুষের ঘিলু শুকিয়ে যায়! কিন্তু চোখের তেষ্টায় হৃদয়ের অলিন্দসমূহ খরা হয়ে যায়!

ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে আকাশ দেখছে মম। চোখদুটো আজ আকাশের মতো বিষন্ন। আকাশ যখন বিষন্ন হয়ে থাকে তখন ‘বৃষ্টি’ হিসেবে পৃথিবীতে জলকণা ছাড়ে। মানুষের বেলায়ও তাই। বৈরি আবহাওয়ার দারুন প্রবলে বাতাস ছুটছে জোরে জোরে। মুখের উপর ঝাপটানি খাচ্ছে খোলামেলা চুলগুলো। মুগ্ধ ওকে কাছে ভিড়তে দেয়না। দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় সবসময়। আজ এক সপ্তাহ হতে চলল মুগ্ধ বিছানায়। একটাবারো খোঁজখবর নিতে দেয়নি, নিজেকে দেখতে দেয়নি, কারনটা জানতে দেয়নি। কেন মুগ্ধ হঠাৎ পরিবর্তন হলো? এভাবে কারোর পরিবর্তন মেনে নেওয়া যায়না! ভালোবাসার মানুষের পরিবর্তন তো আরো আগেনা! তখন ইচ্ছে করে নিজের গলায় দড়ি দিতে! মরে যেতে! মম হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো। ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো। আকাশের পানে তাকিয়ে অশ্রুপূর্ণ চোখদুটো দিয়ে নিশব্দ বার্তা পাঠালো..


— মুগ্ধ তোর কল পিক করেনি, না?
— না।
— ওর কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেছিস?
— না।
— ও কি সুস্থ? তুই নিজের চোখে দেখেছিস?
— জানি না।
অর্পিতা ‘মম’ নামক মেয়েটার জেরা করা কিছুক্ষন অফ রাখলো। অর্পিতার মনে হচ্ছে ও একটা রোবটের সাথে কথা বলছে! ‘ইয়েস’ ‘নো’ ছাড়া ব্যতিক্রম আন্সার ফিচারে যেনো নেই।। বাইরে মুখলধারে বৃষ্টি। অর্পি দেখল মম কোলে বালিশ রেখে জানালার গ্লাসে বৃষ্টির ছাট দেখছে। অর্পি গুটিশুটি হয়ে মমর কোল থেকে বালিশ সরিয়ে কিছুটা কাছে আসলো। মমর থুতনিটা ধরে ওর দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
— মুগ্ধ ভাই তোর সাথে দেখা করছেনা দেখে তোর কি হাল হয়েছে আয়নায় দেখছিস? আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত এখন ডাউট করছে তোর উপর। তুই জানিস তোর রুমে আসার আগে আন্টি আমাকে কি আস্ক করেছে? আস্ক করেছে তুই প্রেমটেম করিস নাকি, ছ্যাকা খেয়েছিস ইত্যাদি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছিলো। তুই বুঝ! তুই কেমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করছিস! আঙ্কেল আন্টি পযর্ন্ত তোর ফেস দেখে কারেক্ট গেস করে ফেলছে! এভাবে আর কতদিন চলবে? কিছুদিন পর এক্সাম! এক্সামে ভালো না করলে ড্রপ যাবে এক ইয়ার। প্লিজ নিজেকে ঠিক কর। এভাবে কোনোকিছুর সমাধান হয়না। মুগ্ধ নিজেই যেহেতু তোকে আর লাইফে চায়না। তুই কেন নিজেকে সস্তা বানাবি? তুই কি সস্তা? স্টিল কানে আসছে তন্ময় তোকে লাভ করে। পারলে তন্ময়কে মাফ করে ওর সাথে রিলেশনে যা। মুগ্ধকে জেলাস করা। তারপরও মুগ্ধ যদি ভুল বুঝতে না পারে সেটা অন্য হিসাব! মুগ্ধকে ভুলার জন্য তন্ময়কে ট্রায় কর!

মম ঝামটা দিয়ে অর্পির কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। চোখ শক্ত করে তাকিয়ে বললো,
— তন্ময়ের সাথে রিলেশনে যাওয়ার চাইতে আমি বিষ খাইতেও রাজি! আমি তন্ময়কে জীবনেও মাফ করবোনা!
— তুই কিন্তু ঘুরেফিরে একইদিকে যাচ্ছিস মম! তুই বারবার মুগ্ধের ফ্যাক্ট লাইফের সাথে জড়িয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস! তন্ময় মুগ্ধকে ওর বেয়াদবির জন্যেই মেরেছিলো! মুগ্ধ তন্ময়দের সাথে লিমিটলেস রুড বিসেভ করেছে। এমনেই ছেলেদের রক্ত গরম! সো মারামারিতে একদল জিতবে আরেকদল বাচবে এটাই নিয়ম!
— পুরো সত্য না জেনে তন্ময়দের সভ্য বলা উচিত না অর্পি! আধা সত্য মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর !
— পুরো ক্যাম্পাস কি মিথ্যা বলবে, বল?
— জানিনা! আমি জানতেও চাইনা! আমি জাস্ট জানতে চাই মুগ্ধ কেন আমায় ওর লাইফ থেকে হুট করে তাড়িয়ে দিলো! কেনো ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিজের রাস্তা রফাদফা করলো! আমি জাস্ট কারনটা জানতে চাই! পারবি হেল্প করতে? পারলে বলিস! নাহলে তোর কথার ঝুলি নিয়ে আজকের মতো যেতে পারিস!

অর্পি কিছুক্ষন ভেবেচিন্তে বললো,
— তুই কি সত্যিই চাচ্ছিস মুগ্ধের বদলে যাওয়ার কারন জানতে?
— হ্যাঁ চাচ্ছি।
— আমি হেল্প করবো! বাট তুই প্রমিস কর এরপর থেকে তুই ওর দিকে ফিরেও তাকাবিনা! মন ও মনোযোগ সবটা এক্সামের দিকে দিবি! প্রমিস কর!
— আই প্রমিস! বাট আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু নো হোয়াট হেজ হেপেন্ড টু মুগ্ধ!

রাত আটটার দিকে মম ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পা মেলে টিভির রিমোট হাতে ফিল্ম দেখছিলো। চুলায় ভাত বসিয়ে রুমে গেল মা। ওয়ারড্রবের উপর থেকে একটা পেটমোটা খাম এনে মমর সামনে টি-টেবিলে রাখলো। মমর সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত নেই। মা মমকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— খামটা খুলে দেখ তো। কিছু ছবি আছে। যেটা ভালো লাগবে, আলাদা করে রাখিস।
মম রিমোটটা কোলের উপর রেখে খামটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। ভেতর থেকে কিছু ছবিসহ বায়োডাটার কাগজ বেরিয়ে এসেছে। মম গম্ভীর মুখে সব কয়টা ছবি উল্টেপাল্টে দেখে ভাবলেস ভঙ্গিতে আবারো খামে ভরে রাখলো। রান্নাঘর থেকে একটা শব্দ আসলো,
— ছবি দেখছিস তুই? কোনোটা পছন্দ হইছে?
মম উত্তর দিলো না। হঠাৎ ছোট ভাই দৌড়ে এসে মমর সামনে দাড়ালো। মমর দিকে ভাইব্রেট ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
— আপু আপু!! তোমার কল আসছে!! দেখো!!
ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে দেখল বড় করে ‘অর্পি’ লিখা। কলটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বললো,
— দোস্ত মুগ্ধ বাসা ছেড়ে চলে গেছে! ও বাসায় নেই!
— নেই মানে? কেমন কথা বলছিস ‘বাসায় নেই’?
— ওদের দলের সাঙ্গু রামিম ছিলো না? ওর সাথে এইমাত্র আমার রাস্তায় দেখা হইছে!ও বললো মুগ্ধ গত দুদিন আগেই বাসা ছেড়ে এব্রর্ড চলে গেছে!
— ইমপসিবল! জাস্ট ইমপসিবল! এ হতেই পারেনা!
— এটাই হয়েছে! হ্যালো? হ্যালো…তুই জবাব..
টুট টুট শব্দ শুনতে পেলো অর্পি! এই মেয়ে রাগের মাথায় অঘটন কিছু করে ফেলে কিনা কে জানে? টেনশন হচ্ছে অর্পির!

৫.
ভালোলাগা ও ভালোবাসার মধ্যে সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য থাকলেও দুটোর বেলায় মন খুব ছটফট ও অস্থির থাকে। সেটা ভার্চুয়ালে ভালোলাগা হোক বা রিয়েলে ভালোলাগা! দুটোর পরিনাম কিন্তু একটাই! “মন অসুখে আক্রান্ত হওয়া!” জেনি, রিমি, রামিম একাডেমিক ভবন-২’ এর দ্বিতীয় ফ্লোরে বসে আছে। সবার মধ্যে একরাশ ভয় ও মাথাভর্তি চিন্তা! কোন জরুরি তলবে মম ওদের একত্রে ডেকেছে কেউ জানেনা। সময় ঠিক মিনিট দশেক পেরুলো বৈকি, দরজা খুলার আওয়াজ ওরা সবাই শুনতে পেলো। সবাই দেখলো মম শান্তমুখে এদিকে আসছে। মম কাধের ব্যাগটা লোবেন্ঞ্চে রেখে ওদের সাথে নিজেও হাইবেন্ঞ্চে উঠে বসলো। জেনি সবার প্রথম বলে উঠলো,
— তুমি আমাদের ডেকেছো কেন?
— দরকার আছে তাই ডেকেছি। তোমাদের সকলের সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে এজন্যই প্রাইভেট বৈঠকে বসা!
রিমি বৈঠকের নাম শুনেই ফট করে বললো,
— কি বিষয়ে বৈঠক? কি বলতে চাও?
— রিল্যাক্স! সব খুলে বলছি। মুগ্ধ এব্রর্ড চলে গেছে কথাটা সত্যি?
রামিম বললো,
— চলে গেছে সত্যি। বট এব্রর্ডের ব্যাপারে সিউর না। মুগ্ধ যাওয়ার আগেরদিন আমার সাথে দেখা করেছে।
জোরে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। মুগ্ধের যাওয়ার নিউজ আমার কান পযর্ন্ত এলোনা এমন কি হলো ওর সাথে? জেনি আমার হাতের উপর ওর হাতটা রাখলো। আমি কিছুটা অবাক চোখে ওর দিকে তাকালাম। রিমি ওর ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতলটা এগিয়ে বললো, ‘পানি খাও।’ আমি বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলাম। জেনি নম্রকন্ঠে বলে উঠলো,
— জানি তুমি কেমন পরিস্থিতির মধ্যে আছো। দেখো আমি মেয়ে আমিও বুঝি। তোমাকে আগে ঘৃনা করলেও তুমি কিন্তু মোটেও খারাপ না। উল্টো আমি মনে করি তুমি খুব ভালো। আমরা তোমার সাথে খারাপ আচরন করেছি। নিজের উপর ঘেন্না হয়।
রিমি বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
— মুগ্ধের এমন স্টেপে আমারই রাগ লাগছে মম। সামনে থাকলে দুটো থাপ্পর দিতাম। তুমি প্লিজ স্ট্রং হও। ভেঙ্গে পড়াটা জাস্ট তোমার সাথে যায়না।
কিছুকালব্যাপী নিরবতা কাটতেই রামিম ব্যস্ততার সুরে বলে উঠলো,
— ভাবী? আপনি চাইলে আমি বসের লোকেশন বের করতে পারি। শুরু করবো?
আমি মুখ তুলে রামিমকে কিছু বলবো তার পূর্বেই জেনি ও রিমি একসঙ্গে বলে উঠলো,
— কর! ইডিয়েট!
— যো হুকুম মেরে আকা! আমি মুগ্ধের লোকেশন বের করতে রওনা দিচ্ছি! কেমন?

৬.
‘ঢাকা-টু-গাজীপুর’ রোডে রওনা হয়েছি আমরা! গাড়িটা রিমির। রিমির ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। রিমি, জেনি দুইপাশে এবং আমি মাঝখানে বসে আছি। রামিম ড্রাইভারের পাশের সিটে। জেনির অবস্থা ভালো না, বমি করতে করতে শেষ। এতোবার বমি করলে কেউ সুস্থ থাকে? আমার কাধে মাথা হেলিয়ে জেনি ঘুমিয়ে আছে। মুগ্ধ কোনো এব্রর্ডে যায়নি, ও দেশেই আছে। আজ মনটা কেমন শান্তি লাগছে বলতে পারছিনা। যারা জেনি, রিমি, রামিমদের কখনো সহ্য করতো না, ভালো বলতো না…আজ এই মানুষগুলো নিজেদের সুধরে ফেলেছে। মানুষের ভালো হতে সত্যি কোনো সময় লাগেনা। লাগে একটা সুযোগ! সুযোগের সৎব্যবহারে মানুষ হতে পারে সর্বোত্তম।
গাড়িটা গাজীপুরের কলেজরোড সড়কে থামলো। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে একটা গলি ধরে হেঁটে যাচ্ছি। সরু একটা গলি, মেটো রাস্তা, ছিমছাম নিরিবিলি, মানুষজন খুব কম। রামিম আগেভাগে এসে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। জেনির খুব নাজুক অবস্থা, গাড়ি থেকে নামতেই দুইবার বমি করলো। রিমি ও আমি জেনিকে ধরে ধরে নিয়ে এসে বাড়িটার সামনে আসলাম। রামিম পকেট থেকে ফোনটা বের করতে বলে উঠলো,
— জেনি? তুমি কি খুব অসুস্থবোধ করছো? হসপিটালে নিয়ে যাবো?
জেনি থেমে থেমে অসুস্থ গলায় বললো,
— না রামিম। এখন হসপিটাল না। আ’ম ফাইন। তুমি প্লিজ আমার জন্য মুগ্ধের খোঁজ বন্ধ করোনা।
— ওকে।
রামিম ফোনের স্ক্রিন থেকে বাড়িটার ঠিকানা মিলিয়ে আমাদের দিকে ইশারা করলো পিছু পিছু আসতে। রামিম দরজায় কলিংবেল দিয়ে লুকিং মিররে হাত রেখে ঢেকে দিলো। জেনি খুব দূর্বল। সম্পূর্ণ ভর আমাদের দুজনের উপর ছেড়ে দিয়েছে। আরো কয়েকটা বেল দিতেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো একজন পুরুষ। তার চোখেমুখে কৌতুহল। লোকটা জিজ্ঞেস করলো,
— জ্বি? আপনারা কে?
— একচুয়েলি আমরা আমাদের এক বন্ধুকে খুজতে এখানে এসেছি। এইযে দেখুন ছবিটা..ছেলেটাকে দেখেছেন? এর নাম রাদিফ মুগ্ধ। ঠিকানা পেয়েছি ও এই বাড়িতে থাকে।
লোকটা রামিমের ফোন থেকে মুগ্ধের ছবিটা তীক্ষ্মভাবে পরোখ করলো। গলায় আশ্চর্য ভাব এনে বললো,
— এই ছেলের নাম মুগ্ধ?
— জ্বী আঙ্কেল। আপনি চেনেন? চিনলে প্লিজ বলবেন ও কোথায় আছে?
— এই ছেলে তো এখানে থাকেনা। কিন্তু হ্যাঁ তোমরা যেই নামটা বলেছো সেই নামে একজন এখানে থাকে। রাদিফ মুগ্ধ নাম।

রামিম পিছু ফিরে আমাদের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছে। রিমি ও আমি দুজন দুজনের দিকে চাওয়াচাইয়ি করলাম। মুগ্ধ আমাদের বিরাট গুল খাইয়েছে। গাড়ির কাছে ঘুরেফিরে উপস্থিত হলাম । জেনি খুব অসুস্থ বিধায় ওকে রিমির গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সাথে রিমির যাওয়ার কথা থাকলেও রিমি আমাকে একা শহরে ফেলে যাবেনা। কাজেই ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে জেনিকে। আশেপাশের সব কয়টা বাসাবাড়ি ও অলিগলিতে ঢুকে তিনজন মিলে মুগ্ধের সন্ধান করলাম। কিন্তু কোনো হদিশ মেললো না! কেউ ওকে চিনেনা, জানেনা, দেখিনি আদৌ! দুপুরের কোল গড়িয়ে রাত্রির আধারে চারপাশ আচ্ছন্ন হতেই মাগরিবের আযান শুনছি।। ক্লান্ত শরীরে খিদা পেটে তিনজন গেলাম এসিওয়ালা রেস্টুরেন্টে। রামিম হোয়াইট সস পাস্তা খাচ্ছে, রিমি খাচ্ছে রামেন। আমি বসে বসে চাওমিনের কাটাচামচ ঘুরাচ্ছি। গলা দিয়ে খাবার নামছেনা একদমই। রামিম চামচভর্তি পাস্তা নিয়ে মুখে পুড়তেই বলে উঠলো,
— ভাবী? ফিরে যাবেন? মুগ্ধকে তো পাওয়া গেলো না।
রিমি রাগী সুরে চেচিয়ে বললো,
— তুই মুগ্ধকে পাসনি বলে ফিরে যাবো? এতো সহজ?
— রিমি তুমি থামবে! আমার উপর চিল্লাচ্ছো কেন? আমি কি জানতাম? মুগ্ধ আমাদের বাশঁ খাওয়াবে!
আমি দুজনকে থামিয়ে বলে উঠলাম,
— প্লিজ গাইজ অফ যাও! তর্কবিতর্ক শুরু করো না!
— ভাবী! আপনিই বলুন এখন আমরা কি করবো? রাতে নাহয় হোটেলে থাকলাম বাট? মুগ্ধ যদি এখানে নাই থাকে! আমাদের থেকে কি লাভ?
— রামিম শেষবারের মতো ওই বাড়িটা আবার চেক দিবে? আমার ইনটুশেন বলছে মুগ্ধকে ওই বাড়িতেই পাবো।

রিমি ও রামিম দুজন খাবারটুকু শেষ না করে বিল পে করে উঠে দাড়ালো। আমরা আবার ফিরে গেলাম ওই বাড়িতে। এবার একটা কৌশল করে আগে আমি কলিংবেল টিপলাম। মুখে সার্জিকাল মাস্ক পড়েছি যাতে চিনতে না পারে। লোকটা দরজা খুলে একইভাবে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি লোকটাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকে যাই! লোকটা তেড়ে আসতে নিলে পেছন থেকে রামিম ও রিমি লোকটার হাত ও মুখ বেধেঁ দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি সবকয়টা রুমে ঢুকে চেক করছি। ওরা লোকটাকে ধরেবেধে সোফার রুমে বসে আছে। প্রায় সব রুম চেক হলেও কোণাচে একটা রুম দেখা এখনো বাকি। আমি সেদিকে পা বাড়িয়ে দরজা খুলে উকি দিতেই কেউ ঘুমাবস্থা কন্ঠে ‘কে? কে?’ করে উঠলো! অলৌকিকভাবে সমস্ত শরীর হিমবাহে কেপে উঠলো! বুকের মধ্যে ধুকপুকনি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। শ্বাস নিতে যেয়েও গলা ধেয়ে আসছে। শ্বাস নিতে পারছিনা আমি। মুখের মাস্ক খুলারও শক্তি পাচ্ছিনা। প্রচুর দূর্বল লাগছে, জেনির থেকেও দূর্বল! হাটুর নিচ থেকে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে।
— হু আর ইউ! টেল মি! কে তুমি!
আমি মুখ থেকে মাস্ক খুলতেই মুগ্ধের চক্ষুতারা সজাগ হয়ে উঠলো! তোতলিয়ে বলে উঠলো,
— পাকনি..
মুগ্ধকে দেখে একদৌড়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম। ফুপিয়ে কেদেঁ চলছি অনবরত। আজো ওর গা খালি কিন্তু নির্দিধায় দুহাতে চেপে ধরেছি। মুগ্ধ বারবার হতবিহ্বল সুরে বলে উঠছে,
— পাকনি তুমি ভেতরে ঢুকলে কিভাবে? তুমি চলে যাওনি..
আমি চুলে হাত ডুবিয়ে কাধে কপাল লাগিয়ে কাদছি। ওর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছিনা। মুগ্ধ মাথায় হাত বুলিয়ে চোখবন্ধ করে বলে ঊঠলো,
— চুপ কর। চুপ চুপ…

-চলবে

#ফাবিয়াহ্_মম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here