তুমিময়_প্রেম ♥ #PART_27,28

0
416

#তুমিময়_প্রেম ♥
#PART_27,28
#FABIYAH_MOMO🥀
27

৭.
‘আঘাত না দিলে মন কাদেঁ না, মন না কাদঁলে ব্যাথা যায়না’ — মেয়েটা কাদঁছে কাদুক! মনটা হালকা করে কাদুকঁ! সবাই মন হালকা করার সুযোগ পায়না! সবার কান্না করার সুযোগ হয়না! আমার বুকে মাথা গুজে ফুপিয়ে কেদেঁ চলছে! আমি শান্ত হতে বললে আরো কেদেঁ উঠে। জানি কষ্টের দাগটা কতো গভীরভাবে কেটেছে! কিন্তু আমি কি করবো? আমি যে নিরুপায়! বেশ খানিকক্ষন পর কিছুটা শান্ত হলে বুক থেকে তুললাম। চোখ মুছে দিলাম। চোখদুটোতে হাত রেখে দেখি কি গরম! কাদতে কাদতে চোখ গরম করে ফেলেছে! নিজের উপর চরম রাগ লাগছে! কি করলাম ধ্যাত? শান্ত হলেও কান্না থামেনি। চোখ থেকে পানি এখনো ঝরছে। চুলে ডানহাত ডুবিয়ে চোখদুটোতে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলাম। কাদঁলে মেয়েদের এতো অদ্ভুত লাগে কেনো? এইযে ফোলা ফোলা চোখ, লাল লাল নাক, চকচক গাল সবকিছুতে যেনো অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে আছে! কপালে চুলগুলো ঘেমে লেপ্টে গেছে ওর। চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে পেছনে ঠেলে দিলাম। ফ্যান অফ ছিলো, ছেড়ে দিলাম। গালে, কপালে, থুতনি ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলাম। ও গুটিশুটি হয়ে বাচ্চার মতো করে আমার বুকে মুখ গুজালো। ওর কপালে ঠোট বসিয়ে দিতেই হাতের বাধন শক্ত করে ধরলো। কিছুদিন আগে আমার সামান্য টিশার্ট ছাড়া গা দেখতে পারতো না, লজ্জায় রক্তগোলাপ হয়ে যেতো সেই মেয়েটা আমার বুকে! ভাবতেই বড্ড অদ্ভুত লাগে! মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলাম,
— এই মেয়ে আমার ইজ্জত হরন করে ফেলছো তো! ছেলেদেরও লজ্জা হয়! শরম লাগে! উঠো!
আরো ঘন করে ধরলো। মানে আমাকে আচ্ছা করে ধরেছে কোনোমতেই ছাড়বে না। আমি আবারো সুর টেনে বললাম,
— উফফ! ছাড়ো তো! মেয়েদের খালি গা দেখাতে নেই! সমস্যা!
শিট! কেদেঁ দিছে! এতোক্ষন চুপ ছিলো এখন ফুপিয়ে কাদঁছে। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম,
— আরে কেদোনা। আমি মজা করছি। প্লিজ চুপ।। চুপ কর। কান্না করো না প্লিজ।
আমি মাথাটা চেপে ধরলাম বুকের সাথে। আমার ভেতরের দহনক্রিয়া কিছুটা শান্ত হোক, আমাকে কিছুটা মুক্তি দিক! আর পারছিনা! চাপা কষ্টের আড়ালে আমি ধুকেধুকে মরছি! প্রচুর যন্ত্রণায় ভুগেছি কেউ পাশে ছিলোনা! কেউ না! দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। খানিকটা পর জিজ্ঞেস করলাম,
— আমার ঠিকানা কোথায় পেলে? তাছাড়া তুমি ভেতরে কিভাবে আসলে পাকনি? নিমেষদা কে পাওনি? নিমেষদা কোথায়?
বুকে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চাপা গলায় উত্তর দিলো,
— আপনার ঠিকানা আপনার বন্ধু রামিম জোগাড় করে দিয়েছে। আমি নিমেষ নামে কাউকে চিনিনা। আসার সময় একজন পুরুষ রাস্তা আটকে দিয়েছিলো তাকে ওভারটেক করে এসেছি।
— ওহ্ মাই গড! নিমেষদাকে তো তুমি কিছু করেছো?
— কিছু করিনি।
— শরীরের কি হাল করেছো? হাড্ডি গুনা যাচ্ছে! কতদিন ধরে খাওয়াদাওয়ার সাথে সম্পর্ক নেই? কি হলো জবাব দিচ্ছোনা কেন? দাও?
কোনো উত্তর নেই। শরীরের সাদা কঙ্কালটা বের হওয়া বাকি শুধু! বুকে যে একটা জ্যান্ত মানুষ চেপে ধরেছি তা মনেই হচ্ছেনা! মনেহচ্ছে বুকে একটা আস্তো কঙ্কাল ধরে আছি! কড়া গলায় বললাম,
— থাপ্পর চিনো? গুণেগুণে দশটা করে টোটাল বিশটা থাপ্পর গালে বসানো দরকার! আমি হৃদয়বান মানুষ! ছেড়ে দিচ্ছি!
এদিক-ওদিক হাতড়ে মোবাইলটা কাছে পেলাম। কিপেডে ডায়াল করে কল দিলাম একটা!
— হ্যালো, মজিদ আঙ্কেল? আপনাদের হোটেল বয়কে দিয়ে কিছু খাবার পাঠিয়ে দিন। না না, তেমন কেউ না। ওইতো রিলেটিভ। আচ্ছা, আচ্ছা ঠিকআছে তাহলে রাখি।
ফোন কাটতেই চেচিয়ে বললাম,
— সত্যি বলো কার সাথে এসেছো? যদি শুনি একা..
আমাকে থামিয়ে ও বলে উঠলো,
— রামিম, রিমি, জেনি আছে। আমি একা আসিনি।
স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। এটলিস্ট একা আসেনি। পাকনি অভিমানভরা কন্ঠে বললো,
— আপনি আমাকে একা ফেলে এসেছেন কেনো? কোন প্রয়োজনে এখানে এসে লুকিয়ে আছেন? আমাকে ভোগ করতে পারেননি বলে মূল্য শেষ?
— থাপ্পর দিবো বাজে কথা বললে! ওরা কোথায়? বাইরে?

উত্তর দিলোনা। মুগ্ধ ওদের নাম ধরে ডাকতেই উপস্থিত হলো দুজন। রিমি ও রামিম ধীর কদমে মুগ্ধের বেডে এসে বসেছে। মুগ্ধ গায়ের পাতলা কাথা দিয়ে গা ঢেকে মমকে চুপ করে পাশে বসতে বলল। সর্বপ্রথম রিমি জিজ্ঞেস করলো,
— তুমি নিজেকে কি ভাবো মুগ্ধ? কাউকে না বলে, না জানিয়ে এভাবে হুট করে চলে আসবা ? প্লিজ! জবাবটা দিও।
রামিম মুগ্ধের গম্ভীর মুখখানার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটোতে কেমন কাঠিন্যভাব! রামিম ডানেবামে না ভেবে বলে উঠলো,
— বস জবাবটা দিও! তোমার পাশে যে বসে আছে অন্তত তার দোহাই!
মুগ্ধ ঘাড় বাকিয়ে মমর দিকে তাকালো। মেয়েটা মাঝেমাঝে কেপে উঠছে। মুগ্ধ রামিমের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— দোহাইটা ভালো দিছিস রামিম! মাথায় তাহলে বুদ্ধি হচ্ছে!একটা কাজ তুই ঠিক করিসনি ব্যাটা! আমার বউকে দেখেশুনে রাখবি, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া সব দেখবি! তুই তা না করে এক সপ্তাহের মধ্যে একটা কঙ্কাল এনে হাজির করেছিস! কি করা উচিত তোকে? শাস্তি দিবো?
রামিম মলিন হেসে বলে উঠলো,
— হসপিটালে ছিলাম বস। ভাবীকে দেখে রাখবো!সেই সুযোগ ভাবী নিজেই দেয়নি। ক্যাম্পাসেই আসতো না উনি। বাসায় যেয়ে খোঁজ নিতে গেলেও বকাবকি করে তাড়িয়ে দিতো। কেসটা আউট অফ ছিলো বস!
পাশ থেকে একটা সুর মুগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিসের বউ? আমি কারো বউ না! যেই বান্দা আমাকে ফেলে এখানে এসে শান্তিপূর্ণ দিন যাপন করছে! এটলিস্ট তার লাইফের কোনো তুচ্ছ বস্তুও না!
মুগ্ধ ঝাঝালো গলায় বললো,
— থাপ্পর মারতে ইচ্ছে করেনা, এগুলা শুনলে? কেমন ভাষা! এই তুমি বস্তু? তোমাকে আমি বস্তু ভেবে কান্না থামাইছি? কি ভাবো তুমি নিজেকে? যত্তসব ফালতু কথা শিখে নিছে! খবরদার অশ্রাব্য ওয়ার্ড আর বলবা না!
রামিমের দিকে তাকিয়ে, ‘রামিম? তুই ব্যাটা অজুহাত কম দিস! তোর হাতভাঙ্গা পা ভাঙ্গার খবর বলে আমার সাথে ফাজলামো করিস না! মানুষ ইচ্ছা করলে এভারেস্টে পৌঁছে যায়! তুই গাধা একটা মেয়েমানুষকে দেখে রাখতে পারিসনা! তোর জীবনে হবেটা কি!
‘চোরের উপর বাটপারি’ — কথাটা মুগ্ধের উপর পুরোপুরি খাটে! নিজেই সবাইকে না জানিয়ে গাজীপুর লুকিয়ে থাকে। কিন্তু নিজের দোষের সাফাই বাদ দিয়ে বন্ধুদের দোষের হিসাব টুকছে!
রাত এখন সোয়া এগারোটার ঘরে। সবাই রাতের খাবারটা খেয়ে ক্লান্ত শরীরে কেয়ারটেকার নিমেষের দেখানো রুমে শুয়ে পড়েছে। নিমেষ নিজেও কয়েকঘন্টা জিম্মিদশা কাটিয়ে মাত্র বিছানায় এলিয়ে শুয়েছে। মম মুগ্ধের পাশের রুমটায় শুয়ে আছে। চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। ওর মনে মুগ্ধের ব্যবহারগুলো নিয়ে প্রচুর খটকা লাগছে। মুগ্ধ যদি সুস্থ থাকে তাহলে কেনো সব ছেড়ে এখানে এসেছে? মুগ্ধের জীবনে কি অন্য কোনো মেয়ের আগমন ঘটেছে নাকি ব্যাপারটা আসলে অন্যকিছু? কি কারন হতে পারে মুগ্ধের এমন রহস্যময় পদক্ষেপে পেছনে? আচ্ছা মুগ্ধ কি ইন্টার্নাল ভাবে সিক? মনে তো হয়না। এক মিনিট! মুগ্ধ যেটাই করুক সবসময় বসে বসে অর্ডার দেয়! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? একবারো কি দুপায়ে দাড়াবে না? ঝট করে বিছানা থেকে নামলো মম। মাথায় এখন মুগ্ধের পা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে! ইশ..বিষয়টা একবারো চোখে পড়লো না? ও কি …? ছিহ্! না! কিছুই হয়নি শিউর! ও ঠিক আছে! ওর কিচ্ছু হয়নি, ঠিক আছে!

মুগ্ধের রুমে ঢুকে মম রীতিমতো একটা শক খেলো! দরজায় খাম্বার মতো দাড়িয়ে পড়লো দেখে! মুগ্ধ এখনো জেগে আছে এবং বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। কোলের উপর ট্যাবলেট। অন্ধকার রুমে ট্যাবলেট পিসির আলোতে মুগ্ধের মুখটুকু কেবল আলোকিত হয়ে আছে। মম দুঠোট চেপে ধীরেধীরে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে নিলে পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
— ‘শ্বশুড় মশাইকে কি বলে এতোদূর এসেছো? টেনশন করছে না?’
মম চমকে উঠে দরজা লাগিয়ে পেছন ঘুরে তাকায়। লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছে, ধুর!মুগ্ধ টের পেয়ে গেলো ইশশ!মম রুমের লাইট জ্বালাতে সুইচবোর্ডে হাত দিলে মুগ্ধ বলে উঠে,
— লাইট অফ! জ্বালাবা না! রুম অন্ধকার থাকুক! চুপচাপ এসে বসো!
গুটিগুটি পায়ে পাশে যেয়ে বসলো। মুগ্ধ ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,
— কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম।
— আব্বু জানে আমি রিমির সাথে হোস্টেলে আছি।
— রিমি কে চিনে? না চিনলে কিন্তু সমস্যা! পরে হোস্টেলে খোঁজ করতে গিয়ে দেখবে তুমি নেই।বিরাট ঝামেলায় ফাসবে!
— ফাসলে ফাসবো! আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন! কেন হুট…
— আমি কেন এসেছি জানতে চাও,তাইতো? তাহলে শুনো,
মুগ্ধ ট্যাবটা পাশে রেখে কথা বলার জন্য উদ্যত হলো। শুরু করলো তার অব্যক্ত কথা,
— ‘তন্ময়, নাসিফ এবং আহাদ’ আমি ওদের কলিজার বন্ধু বলতাম। আমার সবকিছুতে ওরা থাকতো, ভালোবাসতাম ওদের। কিন্তু কখনো মুখ ফূটে বলিনি, ‘বন্ধু তোদের খুব ভালোবাসি! তোরা আমার সব!’ কখনো বলিনি। আমি চুপ থাকতাম। বন্ধুত্ব তো এমনই তাইনা পাকনি? কিছু বলা লাগেনা, বুঝাতে হয়না ওরা কেমন করে যেনো চট করে সব ধরে ফেলে। ওরা আমাকে হাসিখুশি হলরুমে নিয়ে গেলো। আমি রামিমের ব্যাপারটা আলোচনা করে জিজ্ঞেস করলাম। ওরা অস্বীকার করে বললো তুমি যা যা বলেছো সব মিথ্যে। আমি একমূহূর্তের জন্যে ওদের হ্যাঁতে হ্যাঁ বললাম। তন্ময় শান্ত হয়ে আমার কাছে আবদার করলো। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওদের হাতে তোমায় তুলে দিতে। তুমি বেশরম, বেলাজা ব্লা ব্লা গালিগালাজ করে তোমার ইনসাল্ট করলো! বিশ্বাস করো ওই মূহুর্তে আমার ইচ্ছা করছিলো জিহবা কেটে সবকয়টার গলায় ছুড়ি চালিয়ে দেই! নিজেকে কন্ট্রোল করলাম। ওদের ভালোভাবে বুঝালাম কাজ হলোনা। হকিস্টিক তুলে পেটাতে লাগলো। হয়তো সেদিন মরে যেতাম..রূহ কবজের উছিলায় না, ওদের ধোকাবাজির কর্মে মরে যেতাম।

মুগ্ধ মাথাটা উপরে তুলে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। ভেতরের দুঃখগুলোকে ঝেড়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। আমার পাচ্ছিলো ওর কথা শুনে। একটা মানুষ পদে পদে ধোকার সম্মুখীন হয়ে স্বাভাবিক থাকে কিভাবে? মুগ্ধ মাথা নামিয়ে বলা শুরু করলো,
— আমি তোমাকে ভালোবাসি। ঠিক কেমন ভালোবাসি ব্যখ্যা জানা নেই। আমি নিজেকে সবচেয়ে দুঃখী এবং একা মানুষ ভাবতাম, কিন্তু তোমার পাশে যখন থাকতাম আমার উপর কিসের ইফেক্ট পড়তো জানিনা, আমি রাতে ঘুমাতে গেলেও তোমার আজগুবি কথা মনে করে হাসতাম। প্রচুর হাসতাম। শাওয়ার ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা নিরবে তোমার কথা ভাবতাম। একটা সত্যি কথা বলি? ফাইজাকে পড়ানো একটা উছিলা ছিলো। উল্টো আমি ওইসব মেয়ে টিউটরকে বকাঝকা করে বিদায় করতাম। ফাইজাকে পড়াতে আর আমি চুপিচুপি দেখতাম। ততোদিনে আমি বুঝে গেছি আমার মন পিন্জরা অন্য কারোর জন্য বাসা বুনে ফেলেছে। উদাস হয়ে ক্লাস বাঙ্ক মেরে তোমাকে দূর থেকে ফলো করতাম। তুমি কখনো খুজে পেতে না। তোমায় জোর করে হুমকি দিয়ে বিয়ে করলাম। তুমি আমার মনটা বুঝলে না, উল্টো অযৌক্তিক শর্ত জুড়ে দূরে ঠেলে দিলে। চুপচাপ সব মেনে নিচ্ছিলাম কিন্তু কোথাও যেনো ক্ষতটা বড় হচ্ছিলো। জ্বলতো, পুড়তো, কষ্ট দিতো। সমাজের কাছে তোমাকে পরিচয় দিলাম না তুমি আমার বউ বা তোমায় আমি বিয়ে করেছি! সব আমি চুপচাপ সহ্য করলাম। কিন্তু আমার কি কারনে কষ্ট হয়েছে জানো? যখন আমি তোমার জন্য তোমার পরিবারের কাছে হালালটা চাইলাম! আমি তোমাকে তিন কবুল বলেই বিয়ে করেছি! জাস্ট ওই সময় তোমার ফ্যামিলির কেউ ছিলো না বলে ব্যাপারটা সুন্দর ও গোছালো করার জন্য একটা স্টেপ নেই। ভাবি তোমার আব্বুকে জানিয়ে আবার আমরা বিয়ে করবো। ঘরোয়াভাবেই সিধাসাদায় বিয়ে করবো! তুমি চাইলে তখন তোমাকে পড়াশোনা শেষ করার আগ পযর্ন্ত পরিবারের সাথে থাকতে দিতাম। আমার আপত্তি থাকতো না! তবুও বুকভরা অধিকার খাটিয়ে বলতে পারতাম তুমি আমার বউ! সেদিন তোমার বাসায় গেলাম। তুমি ছিলেনা, অসুস্থ মামীকে তোমার আম্মুর দেখতে ঢাকায় গিয়েছিলে। বাসায় কেবল তোমার বাবা ছিলো। আমি আমার অসুস্থ মারখাওয়া ব্যান্ডেজে মোরা শরীরটা নিয়েই তোমার আব্বুর সামনে নত হয়ে সম্পূর্ণ কথা পেশ করলাম। উনি বিশ্বাস করলেন না। বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার দেখালাম উনি রেগে গেলেন। আমি উনাকে বুঝিয়ে বললাম, আঙ্কেল আমার তো কেউ নেই। আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। আপনি পাগলামি ভাবেন বা অন্যকিছু আমি বিয়েটা করে ফেলেছি। তোমার আব্বু শর্ত দিলেন। শর্তটা কি জানো? আচ্ছা পাকনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, ধরো তোমার আব্বুআম্মু কেউ নেই। তোমার ভাইটা বেশ ছোট। তোমার জন্য বিয়ের ঘর আসলো, তারা রাজিও হলো এবং বললো, তুমি বিয়ের পর ছোটভাইকে সাথে রাখতে পারবে না। তুমি কি এতিমখানায় ফেলে রাখবে? দূরে পাঠিয়ে দিবে?
আমি ভ্রুকুচকে আৎকে উঠলাম! ঝাঝ মাখানো গলায় বললাম, ‘অসম্ভব! দরকার পরলে আমি বিয়েই করবো না! তবুও ভাইকে কোত্থাও পাঠাবো না!’
— এ্যাকজেক্টলি মাই পয়েন্ট! আমিও ফাইজাকে দূর করতে পারবো না। তোমার বাবার কাছে উনার মেয়ের খুশি যদি একটা নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চার জন্য আটকে থাকে! তাহলে আটকে থাকুক! আমি তোমাকে চাইনা! দরকার পড়লে তোমার কাছ থেকে আজীবন দূরে থাকবো তবুও ফাইজার জন্য নিজের খুশি চাইবো না! তুমি আমাকে স্বার্থপরও বলতে পারো আবার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বোকা! ভাইয়ের মেয়ের জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিবে… এমন গাধা মেবি দ্বিতীয়টা জন্মায়নি।তোমাকে আমি দূর থেকেই ভালোবাসবো পাকনি। অনেক বেশি ভালোবাসবো। হয়তো তুমি রিখটার স্কেলে মাপতে তোমার জন্য কতটুকু ভালোবাসা নিজের মধ্যে রাখি। কিছু ভালোবাসা পাওয়া না হলেও কোনোদিন সেটার জায়গা পূর্ণ হবেনা। ভুলা যাবেনা। তুমি তো আমার প্রথম প্রেম! শেষ নিশ্বাসটা ফেলার আগ পযর্ন্ত তোমায় স্মরন করবো। ভুলবো না।আমার মন কখনো তোমার স্মৃতি মিটাবেনা। শূন্যময় জায়গাটার কাছে, পুরোটা জুড়ে তুমি, তুমি এবং তুমি হয়েই থাকবে! মৃত্যুর পরও যদি চাওয়ার উপায় থাকে আমি তোমাকে চাইবো! কিন্তু ফাইজার বদৌলতে আমি তোমাকে চাইনা পাকনি। তুমি আমার #তুমিময়_প্রেম হয়েই থাকো। এই প্রেমে শুধু দূর থেকে ভালোবাসা যায়, কাছে এসে মেবি থাকা যায় না।
মুগ্ধ চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। চোখ ঝাপসা ট্যাবের স্ক্রিন ভিজে গেছে। চোখের দু’কোণা থেকে একের পর এক পানি পড়ছে তার। দাত দিয়ে নিচের ঠোটটা শক্ত করে চেপে আছে। মাথা নিচু করে আছে। হয়তো আড়ালে থাকার জন্যই রুমটা অন্ধকার রাখা হয়েছিলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আমি পাচঁ আঙ্গুলে বিছানার চাদর আকড়ে মাথা নুয়ে আছি। চোখ থেকে টপটপ করে বিছানায় পানি পড়ছে। আমার শরীরের একটা অংশ কিরূপ অকার্যকর লাগছে তা বলে বুঝাতে পারছিনা। বারবার মুগ্ধের কথাগুলো কানের পর্দায় ভনভন করছে। ‘এই প্রেমে শুধু ভালোবাসা যায়, কাছে এসে মেবি থাকা যায় না’….ভয়ঙ্কর শব্দগুলো কিভাবে উচ্চারণ করলো? কিভাবে! কতো ভয়ঙ্কর শব্দ! রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে এই শব্দগুলো ভয়ানকের চেয়েও ভয়াবহ লাগছে। বুকে চিড়ে কান্না চলে আসছে আমার! শব্দ করেও কাদার শক্তি পাচ্ছিনা। কেমন অকেজো লাগছে স্নায়ুবিক ভরে। মানুষ কতোটা সাহসী হলে ভালোবাসা ভুলানোর মতো ভয়াবহ পদক্ষেপ নিতে পারে! জানা নেই, জানা নেই…

-চলবে

#তুমিময়_প্রেম ❤
#PART_28
#FABIYAH_MOMO
৮.

সকালটা হলো ঠিকই। কিন্তু আমার জীবনে সূর্যোদয় হলোনা! অস্তমিত আকারে সবকিছু চোখের পানিতে পরিণত হলো। রিমি ঘুম থেকে উঠেই আমাকে শান্ত করার মতো ব্যর্থ চেষ্টায় লেগে আছে, রামিম মুগ্ধকে নানাভাবে বুঝাচ্ছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য হিসেবেই রয়ে গেছে। দরজায় ঠক ঠক শব্দ করলো কেউ। রিমি আমার পাশ থেকে উঠে গেল কিন্তু আর ফিরলো না। আমি মাথা তুলে ফোলা ফোলা চোখে ওদিকে তাকাই। দেখি মুগ্ধ মাখন রঙের টিশার্ট পরে দরজায় হেলান দিয়ে হাতভাজ করে দাড়িয়ে আছেন। আমি চার আঙ্গুলে গাল মুছে চোখ আগের জায়গায় আনি। কিছুক্ষণ বাদে মুগ্ধ আমার সামনে এসে চুপচাপ দাড়ালো। আমি শুধুমাত্র ওর পা দুটো দেখছি মাথা তুলে ওর দিকে তাকাচ্ছিনা। মুগ্ধ আমার সামনে ফ্লোরে আটোঁ করে বসে আমার হাতদুটো ওর হাতের ভাজে নিলো। আমার হাতদুটো নিয়ে নিজের গালদুটোতে বসিয়ে আমার কোলে থুতনি রাখলো। চোখ উঁচু করে দেখছেন মুগ্ধ। কিছুক্ষন পর উনার ঠোটের কাছে আমার ডানহাত টেনে ঠোঁট ছোয়ালো। নরম গলায় বলে উঠলো,

— একটা দিন হবে তোমার কাছে? শুধু একটা দিন চাইছি? শেষবারের মতো তোমাকে চাচ্ছি। আর তো পাশে পাবো না। রাখবে শেষ অনুরোধটা?

ওর গলায় কি ছিলো জানিনা। আমি ঢোক গিলে লম্ব আকারে মাথা ঝাকাই। এতেই মুগ্ধের ঠোঁটের কোণে রাজ্যজয়ের হাসিটা ফুটলো! মনোমুগ্ধকর সেই ঠান্ডা হাসি। ফ্লোর থেকে ব্যস্ত হয়ে উঠে আমাকেও সাথে দাড় করালো। পাচঁ আঙ্গুলে আমার হাত আবদ্ধ করে বাইরে নিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে রামিম ও রিমি যাত্রার জন্য রেডি হয়েছে। আমাদের দেখে সোফা ছেড়ে ওরা কাছে আসতেই রিমি বললো,

— মুগ্ধ? তুমি কখনো কঠিন নিষ্ঠুর হয়ে যাবা ভাবতে পারিনি। ফার্স্ট টাইম আমার তোমার জন্য না, মমর জন্য কষ্ট হচ্ছে। ওকে দেখলে নিজেকে এতো অসহায় লাগে!(দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে)..ভালো থেকো মুগ্ধ।

রামিম পাশ থেকে ম্লান গলায় বললো,

— বস সময় আছে এখনো! ফাতরা ডিসিশনটা চেন্জ করো। আমি জানি তুমি শান্তিতে থাকতে পারবানা। প্লিজ বস, একটাবার বুঝো?

রিমি পেছন থেকে রামিমের কাধে হাত রেখে চুপ থাকতে ইশারা করলো। রামিম রিমির দিকে একবার তাকিয়ে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আসি বস। ভালো থাকবা। দরকার পড়লে একটা ফোন দিও, রামিম যেইখানেই থাকুক। আসবো!
মুগ্ধ মৃদ্যু হেসে বলে উঠলো,
— গাইজ? মম তোদের সাথে যাচ্ছেনা। ও কাল যাবে। তোরা রওনা দে কেমন? বাকিটা আমি দেখবো।
রিমি ও রামিম বেশ অবাক হলেও শেষপর্যন্ত ওরা বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। মুগ্ধ আমাকে নিয়ে রান্নাঘরে এলো। ওর মনটা বেশ ফুরফুরে। একচিলতে বিষন্নতার আভাস নেই মনে। হাস্যোজ্জ্বল গলায় আদেশসূচকে বলে উঠলো ,
— নাস্তা বানাও তো। খিদে পেয়েছে। তোমার হাতের রান্না খাবো। ওয়েট! এক কাজ করো আজ খিচুড়ি রান্না করো। আমি গরমাগরম খিচুরি খেতে চাই। উফ! সাথে টক ঝাল মিষ্টি আচার!! শিট! আমি আচারটা রোদে দিতে ভুলে গেছি।। তুমি শুরু করো তো।।

৯.
‘দুই অনুপাত এক’ হিসেব করে চালের সাথে ডাল মিশিয়ে রেডি করছি। মুগ্ধ চুলার পাশে উচু ঢিপে পা দুলিয়ে বসে আছেন। মরিচ, পেয়াজ, ভাজা মচমচে মাংস, ছোট করে কাটা নতুন আলু, রঙিন সবজি…সব কেটে সুন্দর করে থালা গুছিয়ে চুলায় হাড়ি বসিয়েছি। মৃদ্যু আচেঁ সব উপকরণ দিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিলে ফ্রিজ থেকে দুধের প্যাকেট নামালাম। মুগ্ধ ছুড়ি দিয়ে সালাদের শশা কাটছে। মাঝেমাঝে মরহুম দাদুর স্মৃতিগুলো বলতে বলতে হুহা করে হাসছেন! দুধটা জ্বাল দিয়ে লেবু চিপে দিলাম। মুগ্ধ হা করে কিছুক্ষণ আমার কর্ম দেখে চুপ থেকে বলে উঠলো,

— এগুলো কি করছো? লেবু চিপলে কেনো?
— ইশ চুপ করো তো। দেখছো না কাজ করছি? করতে দাও। ছানা বানাচ্ছি!

মুগ্ধ ঠোঁটের উপর আঙুল বসিয়ে চুপটি থাকার ইশারা করলো। ইশশ..যেনো একটা বাচ্চা কড়া শাষন পেয়ে মুখে আঙুল বসিয়েছে। আমি মুচকি হাসলাম। ঘন্টা খানিকের মধ্যে সব আইটেম শেষ হলে ছাদের ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে সব সাজাচ্ছি। মুগ্ধ মাথার উপর তেড়পাল টাঙিয়ে সকালের তীর্যক রোদটাকে একটু আটকে দিচ্ছেন। ঠান্ডা শীতল বাতাস, টুকরো টুকরো সাদা মেঘে ভরা নীল আকাশ, রোদের উষ্ণতা। সব মিলিয়ে দিনটাকে যেনো স্মৃতিময় করে দিচ্ছে প্রকৃতি। হয়তো প্রকৃতি ভালোকরেই জানে আজকের এই দিনটার শেষে দুইকূলে বিভক্ত হয়ে যাবে দুই মানব-মানবী। কাব্যের মতে, প্রেমিক-প্রেমিকা? নাকি শরিয়ত মতে, ‘স্বামী-স্ত্রী?

১০.
দুপুরে গোসল শেষে একটা শাড়ি পড়েছি। সাদা শাড়ি, লাল টকটকে পাড়। পুরোনো যুগের মেয়েদের মতো বাঙালী স্টাইলে শাড়ি পড়েছি। চুলের মাঝখানে সিথি গেথে পিঠের উপর সব চুল ছড়িয়ে রেখেছি। হাতভর্তি লাল-সাদার ঝনঝন রেশমি চুড়ি। আয়নার সামনে নিজেকে অন্যরূপে দেখছি। পরিপূর্ণ বাঙালী মেয়ে। আজ মুগ্ধ নিশ্চয়ই পান্জাবী পড়েছে? আচ্ছা ওকে আজ কেমন লাগবে? সবসময়ের মতো মনোমুগ্ধকর? নাকি শুধু আজকের দিনটার জন্য অদ্ভুত মুগ্ধকর? খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, পুরো বাড়ির আনাচেকানাচে ঝনঝন চুড়ির খিলখিল হাসিতে মেতে উঠতে ইচ্ছে করছে!! আচ্ছা আজ এতো আনন্দের দিন কেন? চোখের মনিতে যাই পড়ছে, তাই এত অদ্ভুত লাগছে কেন? আহ্.. সব কত সুন্দর! কত পরিপাটি! কতো পরিপূর্ণ!

আমার সময় মোতাবেক বিকেল চারটার মধ্যে ছাদে থাকার কথা। আচ্ছা, ঘড়িতে কয়টা বাজে? ইশশরে! চারটা দেখি বেজে গেছে! উনি বারবার বলেছে লেট করতে না। এখন উনি রেগেমেগে বারুদ হয়ে থাকে কিনা, কে জানে?

দু’হাতে শাড়ি ধরে আমি ছাদে পৌছাতেই ছাদের শেষ কোণাটায় নজর পড়লো। হাতভাঁজ করে আকাশে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ। নির্মল বাতাসে মাথার তালুর দিকে কিছু চুল উড়ছে। বাতাসকে দেখে হিংসে হচ্ছে! ওই চুলগুলোতে আমার অধিকার! অন্য কেউ কেন ছুবে? সাদা পান্জাবী, গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, হাতে কালো ঘড়ি, হাতা ফ্লোডেড। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি। হাটাঁর তালে তালে চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ সবদিকে মুখরিত হচ্ছে। মুগ্ধ সম্পূর্ণ ঘুরে আমার দিকে ভ্রু কুচকে ঠোট শক্ত করে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে হাতার ফোল্ডটা এতো আর্কষন করছে! কি মায়া লুকিয়ে আছে হাতার এই গুটানোতে? মুগ্ধ হাতঘড়ির হাতটা তুলে ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘড়ির উপর ইশারা করলো। মানে বুঝালো, ‘ম্যাডাম লেট করেছেন!’ আমি অপরাধীর মতো মুখ করে ঠিক ওর সামনে দাড়ালে মুগ্ধ আমার না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। উনার মুখে স্পষ্ট অভিমানের ছোপ পরিদৃষ্ট। আমি কাচুমাচু করে বললাম,

— শেষবারের মতো মাফ করা যাবে না সাহেব? ভুল করার জন্য যে আমি আর থাকছিনা মুগ্ধ.. প্লিজ?

এটুকু কথাতে মুগ্ধ আহত হলো যেনো। আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে অনুনয় সুরে বলে উঠলো,
— আজকের দিনটায় এমন বলো না গো, শুধু আজকের দিনটা রেহাই দাও। প্লিজ মাথা থেকে সব ফেলে দাও? সব ভুলে যাও!

আমার হাতদুটো শক্ত করে ধরে বিনীত সুরে বললেন মুগ্ধ। এমন করে আকুতি করলে! কি করতে ইচ্ছে করে বলুন তো! মনটা চায় কলারটা টেনে বলি, ‘এই বদ ছেলে! কিসের শেষদিন বুঝাচ্ছো? আমাকে পাগল করে রেখে তোমায় যাবা? কোত্থাও যেতে দিচ্ছি না! আন্ডারস্টেন্ড!’ কথাগুলো বলা হলোনা। পরিশ্রান্ত চাহনিতে মলিন হাসলাম আমি। মুগ্ধ আচমকা টান মেরে বুকে মিশিয়ে কাধের পেছনে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। আরো চেপে ধরে থুতনিটা আমার কপালে লাগিয়ে তপ্তকর শ্বাস ছেড়ে বললেন,

— রক্তিমশুভ্রতায় সেজেছো কেন শ্যামকণ্যা? তোমায় দেখলে যে এ প্রাণ সহে না। ভালোবাসি বলতে এসে প্রাণঘাতী কেন করছো? আমি তো তোমাতেই মুগ্ধ, আর কতো প্রমাণ চাচ্ছো?

একেকটা বর্ণ, একেকটা শব্দ, একেকটা বাক্য বুক চিড়ে অন্তঃস্থলে দাগ কাটছিলো! বুকের ভেতরে হাতুড়ি পিটছিলো শতবার। অন্যরকম ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। যেনো অন্য জগতের প্রবেশ করতে চলছি। চিবুকে আলতো করে ঠোট ছুয়িয়ে দিলেন উনি। কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে কানেও ছুয়িয়ে দিলেন ঠোটজোড়া। প্রতিটা ছোয়ায় শিরশির করে শিহরণ বয়ে চলছে। সমস্ত শরীরে সেই শিহরন ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ মুগ্ধ আমায় ছেড়ে দিলো। আমি তখনো লজ্জায় পুরোপুরি বুদ অবস্থা! উনি আমার গালদুটো টেনে বললেন,

— ইশশ, লজ্জায় লাল হচ্ছোনা কেন? তাড়াতাড়ি লাল হও তো, একটা কামড় দিবো!
আমি চোখ তুলে বললাম,
— আপনি কামড় দিবেন দেখেই হয়তো লাল হয়নি। ঠিকআছে না?
— উহু! একদম ঠিক না!
কথাটুকু শেষ করতেই মুগ্ধ বৃদ্ধা আঙ্গুলটা আমার ঠোটে বসিয়ে আলতো ঘষা দিতেই সামান্য লিপস্টিক উনার আঙ্গুলে এসে পড়লো। আমি অবাক হয়ে উনার কীর্তি দেখছি! মুগ্ধ কি করার চেষ্টা করছে? লিপস্টিক লাগা আঙ্গুল দিয়ে আমার গালের চিবুকে আলতো ডলে মিশিয়ে দিচ্ছে। স্নো বা ক্রিম যেভাবে স্মুথলি মেশায় ঠিক ওভাবে। আমি এখনো ভ্যাবাচেকা হয়ে আছি। মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। হঠাৎ গালে কামড় বসানোর জন্য হা করলে আমি ভীত হয়ে কিছু বলবো! তার আগেই উনি! মুখ স্বাভাবিক করে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

— একটা ডিসেন্ট, ইনোসেন্ট, কমিটমেন্ট টাইপ ছেলে এসব পাগলামি করেনা। এসব কামড় দিয়ে দাতঁ বসিয়ে আমি ভালোবাসা প্রকাশ করিনা। আমার ভালোবাসা টোটালি পিউর! বায় দ্যা ওয়ে! আ’ম টোটালি ডিফারেন্ট ইউ নো না?সো লাভ স্টাইলও ইউনিক হবে রাইট?

ফিক করে হেসে দিলাম। উনার বিচিত্র সব কথার মাঝে বিচিত্র সব রূপ দেখে অভিভূত হলাম। চোখ সরছিলো না একবারো! একটা মানুষ এতো সুন্দর কি করে হয়? কি চমৎকার ভাবে গায়ের সাদা পান্জাবীটা মোহনীয় লাগছে। হাসিটাও কতো মায়াকাড়া। একবার হাসিটা দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে। মন ভরবে না। তৃষ্ণা মিটবেনা।। উনি আমাকে নিয়ে ছাদের একপাশে যেদিকটায় পাটি বিছানো সেখানে বসলেন। আমি বসতেই লক্ষ করলাম পাটির উপর রঙবেঙরের বাটিতে নানাপদের আচার। তেতুল, বড়ই, জলপাই, চালতা, কমরচা…এই পাচঁ থেকে আচারের হরেক দাড়ালো ঠিক পচিঁশটা। মুগ্ধ চোখ ঘুরিয়ে বললো ‘খাও’। আচারের টক-ঝাল-মিস্টিতে বিকেল পেরুলো। এখন সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। চারিদিকে উড়ন্ত পাখিরা ব্যস্ত হয়ে নীড়ে ফিরছে। ছাদের উপর দখিনার ঠান্ডা হাওয়ায় চুল উড়ছে আমার। মুগ্ধ আরেক পসরা সাজানোর জন্য নিচে গিয়েছে। সূর্যটা চোখের সামনে যখন অস্তে ঢলে গেল ভেতর থেকে চাপা কষ্ট কেমন ফুপিয়ে আসতে লাগলো! এই বুঝি সব শেষ! এই বোধহয় আমার একটা দিনের ইতি এখন টেনে নিচ্ছে! কে জানে? জীবনটা কি পরিণতি বয়ে আনছে?

১১.
ঘড়িটা আটটা বাজে। শাড়ি পাল্টে নরমাল বেশভূষায় আছি। বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। কি নির্জন, শান্ত, স্তব্ধ রাত। অদ্ভুত ভাবে কেটে গেলো পুরো একটি দিন। দরজা খুলার শব্দ এলো, আমি জানি উনি মুগ্ধ। কারন, বাড়িতে আজ কাজের লোকদের ছুটি। খুব ধীরেসুস্থে পাশে বসলেন উনি।

— ‘ম্যাডাম কি ঘুমিয়েছেন? উঠুন! আমার দিন এখনো শেষ হয়নি! এখনো পুরো রাত বাকি!ওয়্যাক আপ কুইক!

উনার কথায় পাত্তা না দিয়ে আমি ডানকাত হয়ে শুলাম। মুগ্ধ ব্যাপারটা নিতে পারলেন না। ঝটকা মেরে মুখ থেকে কাথা সরিয়ে আচমকা আমার বাহু চেপে উঠালেন। আকষ্মিক কান্ডে আমি অবাক হয়ে আছি। হাতটাও কি প্রচন্ড ব্যথা করছে!! মুগ্ধ ছাড়ছেন না! উনি একদম আমার মুখের কাছে এসে অগ্নিচ্ছটার মতো তাকিয়ে আছেন। এই চোখ দিয়েই আমাকে ভষ্ম করে দিবেন বুঝি! উনি ঠোট কুচঁকে বাহু আরো জোরে চেপে বলে উঠলেন,

— কথা না শুনলে কি করতে ইচ্ছে করে! ভুলে গেছো? স্মরন করাতে হবে?
— ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ো! উফফ..ছাড়ো মুগ্ধ! সত্যি ব্যথা পাচ্ছি!
— তোমার চেয়ে হাজারগুণ ব্যথা আমার হচ্ছে! আমি তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করছি! তোমার জন্য নিজের ক্ষতপূর্ণ ব্যথা লুকাচ্ছি! আর তুমি আমাকে ইগনোর করছো?
— ইশ..ছাড়ো না!! কই ইগনোর করলাম? আমিতো এমনেই উঠিনাই।
— চুপ! মিথ্যা কথা বললে একদম গালে থাপ্পর বসিয়ে দেবো!
— হ্যাঁ হ্যাঁ !! দিন! দিন থাপ্পর! সাথে হাতটাও মুচড়ে ভেঙ্গে দিন!

মুগ্ধ রাগে ঠোঁটটা তীব্রভাবে কুচকে আমার বাহুটা কঠিনরূপে ধরলো! কিছুক্ষণের মধ্যে, হাতে পাচঁ আঙ্গুলের দাগ পাবো সিওর! প্রচুর ব্যথা পাচ্ছি! অসহনীয় ব্যথা! ব্যথায় আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম হলে চোখের দুইকোণা থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। তবুও একে অপরের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি! একদিকে আমার চোখ অশ্রুতে টলমল, অন্যদিকে মুগ্ধের চোখ জলন্ত অগ্নিকণায় ব্রত! একপর্যায়ে মুগ্ধ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো। নিরব নির্জন রুমে মুগ্ধের শ্বাসটা প্রচুর ধারালো হয়ে বিধছে! নিজেকে শান্ত করতে ব্যস্ত উনি! আমি বাহুতে ফু দিয়ে হাত ডলছি। ব্যথায় টনটন করছে! রাগে, দুঃখে, অভিমানে আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,

— সারাটা দিন আদর ভালোবাসা দেখিয়ে রাতে আসলেন টর্চার করতে!! ভালোই!পারলে গালে দুইটা চড় মেরে লাঠি দিয়ে পেটান! কি হলো? আসেন পেটান! মেরে শেষ…

আমি কথা শেষ না করতেই মুগ্ধ ঝড়েরবেগে আমাকে জোরে জাপটে ধরলেন! নিশ্বাস আটকে আসছে আমার।তবুও চুপ করে আছি। উনি আমার পিঠের কামিজে খামচে ধরলে আমি ঠোট কুচকে ব্যথায় কুকড়ে উঠি। নিতান্তই রাগের বশে উনি চেপে ধরেছিলেন! রাগ ছাড়া মুগ্ধ কখনোই আমার ক্ষতি করবেন না। উনি হড়হড় করে বলে উঠেন,

— সরি, সরি, মাফ করে দাও প্লিজ… প্লিজ আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। তোমায় আমি টর্চার করবো? না পাগলী!!তার চেয়ে আমি নিজের মৃত্যু চাই!! প্লিজ মাফ করো!! আমি বুঝতে পারিনি!! তুমি তো আমার কাছে এই রাতটুকুই থাকবে!! আর তো কখনো তোমার সামনে আসবো না!! কাছেও আসতে পারবো না! আমাকে একটাবার বুঝো? তোমার এই মুগ্ধের ভেতরটা কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে!! একটু বুঝো প্লিজ?? আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি!! মরতেও পারছিনা!! কাল থেকে তুমি আমার কাছে থাকবেনা!! কি হাল হবে আমার, ভাবো!! প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও…আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজজ..

অস্থির হয়ে উঠছে মুগ্ধ। পাগলের মতো অনবরত বলেই যাচ্ছে। আমি পিঠে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা হতে বলছি। উনার মধ্যে কি পরিমাণ যন্ত্রণা হচ্ছে তা পরিমাপ করার সাহস আমার নেই। বারবার মুখে একই কথা, তুমি আমার কাছে এই রাতটুকুই আছো, আমার তো কেউ নেই, আমি তো একা, আমি রাগের মাথায় ব্যথা দিয়ে ফেলেছি, আমি তোমাকে আর দেখতে পারবো না…

উনার দু’কানে হাত রেখে নাকে নাক লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। মুগ্ধ ঠোঁট প্রসার করে এখনো হাপানি রোগীর মতো শ্বাস ছাড়ছে। ঘন পাপড়িপূর্ণ মায়াময় চোখদুটোতে ঠোট এগিয়ে উষ্ণ ছোঁয়া বসিয়ে দিলাম। মুগ্ধ আমার কোমরে দুহাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,

— আল্লাহর কাছে সবসময় চাইতাম আমার জীবনটায় কেউ আসুক। আমার মতো উন্মাদ ছেলেকে স্বাভাবিক করে তুলবে। ভাঙ্গাচুড়া এই অলুক্ষনে ছেলেকে নিজের পরম ভালোবাসার চাদরে আগলে রাখবে, কান্না পেলে তার কাছে গেলে নিঃশর্তে কাছে টেনে নিবে। আজ তুমি এলেও কেনো কাছে রাখতে পারছিনা? আমার শূন্যতা জীবনে কেনো তোমায় রাখতে পারছিনা? আমি কি পাপ করেছি জীবনে? কোন মহাভুলের শাস্তি পাচ্ছি!! আমি ভালোবাসতাম! ভালোবাসার আগে বিয়েটা ফরজ! বিয়েটাও করলাম!! কিন্তু কেনো সমস্যা হলো বলো? কেন ভাগ্য চাচ্ছেনা তুমি আমার সাথে থাকো? মন মানতেই চাচ্ছেনা তোমাকে দূরে ফেলে দিতে!! বেহায়া মন নিতেই পারছেনা কাল ভোরের সকাল হলে তোমাকে নিজের থেকে আলাদা করে দূরে পাঠাতে হবে। একটা মানুষ কতটা হেল্পলেস হলে নিজের মৃত্যুকামনা করে? ভাগ্য যদি সহায় না হয়, পাশে যদি কেউ না থাকে, অবশিষ্ট পথ হিসেবে সুইসাইডই থাকে পাকনি। আমি সুইসাইড করতে চাইলেও পারছিনা!! জীবন আমার সাথে এমন কেন করলো??

-চলবে

#ফাবিয়াহ্_মম ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here