তুমিময়_প্রেম🥀♥ #PART_19,20

0
503

#তুমিময়_প্রেম🥀♥
#PART_19,20
#FABIYAH_MOMO🍁
19

মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোটঁ ছুয়িয়ে দিলো মুগ্ধ। গলায় আর তীক্ষ্ম মেজাজের আভাস নেই। নম্র গলায় আলতো করে মাথায় হাত ছুয়িয়ে দিচ্ছে সে। আমার মাথাটা বুকে আগলে ধরে কাটা হাত দিয়ে সামনে থেকে পানির বোতলটা নিলো মুগ্ধ। আমাকে পানি খাইয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে হাতে রুমাল পেচালো। ভাঙা জানালা দিয়ে পানি এসে মুগ্ধের পান্জাবী ভিজিয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধ কোনোমতো হাতে রুমাল বেধেঁ বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রচুর অস্থিরতা কাজ করছে ওর মাঝে। কতক্ষণে গাড়ি ছুটিয়ে বাড়ি পৌছাবে সেই চিন্তাভাবনা মাথায় চেপে বসেছে। আমি কাটাছেড়া একদম দেখতে পারিনা। একটুও না। ওর হাতের দিকে একবার তাকালে আমার দম বন্ধ হয়ে নিশ্বাস আটকে আসে। কাচ দিয়ে গভীর করে কেটেছে হাতটা। অনেক গভীরভাবে কেটেছে। সেলাই পড়ে কিনা কে জানে?

.
.

বৃষ্টির মধ্যে পাড়ি দিয়ে রাত ঠিক একটার দিকে বাসার সামনে নামি। মুগ্ধের সাদা রুমাল আর সাদা অবস্থায় নেই। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে সম্পূর্নটা। রক্ত শুকিয়ে চটচটে আকার ধারন করেছে। রুমালটা এনে বেসিনের ট্যাপের নিচে ভিজিয়ে চিপলে বেশখানিক তরল রক্ত পড়বে গ্যারান্টি! মুগ্ধ গাড়ির দরজায় ঠেস দিয়ে বামহাত দিয়ে কাটাহাত আকড়ে দাড়িয়ে আছে। অসহ্য জ্বালা করছে হয়তো!! আমি ওর অসহায় চাহনিটা একবার দেখে বাসার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। মুগ্ধ হয়তো চোখ দিয়েই বলছিলো, “প্লিজ যেও না! আচ্ছা না গেলে হয়না?? আমার কাছেই থাকো?? আমিতো তোমায় যেতে দিতে চাইনা!! প্লিজ থাকো!!”

সিড়ি দিয়ে উঠতেই সিড়ির জানালায় উকি দিলাম। মুগ্ধ কাটাহাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে, “হাতটা দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ওকে কাছে পেয়েছিলাম! এই হাতটার জন্য মুগ্ধ ধন্য!” দরজায় কলিংবেল দিতেই দেখি দরজায় একটা বড় তালা ঝুলানো। আব্বু আম্মু বাসায় নেই? আশ্চর্য উনারা কোথায় গেলো? আমার কাছে ব্যাগটাও নেই! ধ্যাৎ সেটা মনেহয় হলরুমের ওখানে দৌড়াতে গিয়ে ফেলে এসেছি! এখন কল করি কিভাবে? পায়চারি করতে লাগলাম আমি। কি করি ভেবে পা চালিয়ে একবার এইদিকে, একবার ওইদিকে হাটছি। মুগ্ধকে বলবো? নাহ্ দরকার নেই! ওর হাত কেটে গেছে, এক্ষুনি ড্রেসিং করাতে হবে! গরমে ঘেমে উঠছি আমি। কপাল বেয়ে কানের কাছে ঘামের তরল পড়ছে। আমি শাড়ির আচঁলে ঘাম মুছতেই ঘামের বদলে রক্ত দেখে শিউরে উঠলাম! একি!! আমার মাথাও কি ফেটেছে? মাথার কোথা রক্ত থেকে পড়ছে? আবারো মাথায় হাত দিয়ে ব্যথার পরিক্রমা বুঝার চেষ্টা করছি। আমার তো কোথাও ব্যথা জ্বালা করছেনা!! তাহলে কি মুগ্ধের হাত থেকে রক্ত এসে আমার মাথায় লেগেছে?? আল্লাহ ওর হাত…. আমি ধরফর করে সিড়ি দিয়ে নেমে গেটের বাইরে গেলাম। জোরে জোরে হাপাচ্ছি আমি। মুগ্ধ চলে যায়নি। ও দাড়িয়ে আছে। ঠিক ওভাবেই আছে যেভাবে আমি সিড়ির জানালা দিয়ে দেখেছিলাম। মুগ্ধ আমার দিকে তাকাতেই ভ্রু কুচকে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসলো। কন্ঠে বিষ্ময় গুলিয়ে বলে উঠলো,

— তুমি নিচে নামলে যে?? আঙ্কেল আন্টি বকেছে??

আমার হাপানো শেষ হয়নি। আমি এখনো মুখ হা করে নিশ্বাস ছাড়ছি। মুগ্ধ আমার হাত ধরে বলে উঠলো,
— চলো আমি দেখছি! ব্যাসিক্যালি ফল্টটা আমার। আমিই আঙ্কেল আন্টিকে বোঝাবো। দরকার পড়লে আরো দশটা থাপ্পর খাবো তবুও চলো প্লিজ।। আমি আঙ্কেলকে খোদ বুঝাবো!

থাপ্পড়ের কথা মনে উঠতেই আমার চোখ যেয়ে ওর গালের দিকে আটকালো। গালে পুরোপুরি পাচঁটা আঙ্গুলের ছাপ বসেছে। লাগাতার দুটো কষিয়ে চড় দেওয়াতে রক্ত জমে গেছে গালে। মুগ্ধ আমার হাত ধরে গেটের জন্য পা বাড়াতেই আমি বলে উঠলাম,

— উনারা বাসায় নেই। দরজায় তালা।

কথা কানে পৌছাতেই মুগ্ধ আমার হাত ছেড়ে অবাকচোখে তাকালো। রাতের একটারও খুব বেশি বাজে আর উনারা বাসায় নেই! ব্যাপারটা স্ট্রেন্জ! মুগ্ধ কিছুক্ষন চুপচাপ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,

— আচ্ছা তুমি চলো। আমি থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি থাকতে তোমাকে টেনশান ভোগ করতে দিবো না।

আমি ওর সাথে যাবো যাবো করলেই যাওয়াটা মোটেই ঠিক হবেনা আমার। প্রথমত আব্বু আম্মু কোথায় আছেন জানতে হবে, কেনো এতো রাতে উনারা বাইরে গিয়েছেন, কোনো আপদ এসে বিপত্তি করলো কিনা খোঁজ নিতে হবে। মুগ্ধ আমার ভাবুক দুনিয়ায় ছেদরেখা টেনে বলে উঠে,
— গাড়িতে উঠো! এইবার কথা না শুনলে নিজের বুকে ছুড়ি ঢুকাবো!

.
.

–হ্যালো ইসু? ইসু? তুই শুনতে পাচ্ছিস!! আমার একটা হেল্প লাগবে!! হ্যালো….হ্যালো ইসু…

কল রিসিভ করে কোনো কথা বলছেনা ইসু। আমি এইযে চেচিয়ে ইসু ইসু করছি কোনো লাভ হচ্ছেনা। মুগ্ধ গাড়ি চালাচ্ছেন। রাস্তাঘাট পুরো নিরব। শুধু আমাদের গাড়ি ও কেবল আমরা। মুগ্ধ পাশ থেকে ড্রাইভ করতেই বলে উঠলো,

— তুমি এই মেয়েটাকে আর কক্ষনো কল করবেনা পাকনি। মেয়েটা ভালো না।

আমি অবাক হয়ে গেছি। মুগ্ধ আমার ইসরাতকে নিয়ে কিভাবে খারাপ কথা বললো! ইসু আমার বেস্টু! আমি জবাবের আশায় কপাল কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মুগ্ধ সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
— ক্যাম্পাসে তোমার নামে যতপ্রকার কুটনামি হয়েছে তার জন্য ইসরাত দায়ী। তুমি জানো কিনা ডোন্ট নো, বাট ইসরাত আমাদের গ্যাংয়ের কাছে তোমার কিছু গোপন তথ্য শেয়ার করেছে।
— কি তথ্য??
— সেটা সিক্রেট! জাস্ট এটুকু শুনে রাখো মেয়েটা তোমার জন্য ভয়ঙ্কর। প্লিজ নিজেকে মেয়েটার কাছ থেকে দূরে রাখো। আই বেগ ইউ!

মুগ্ধ গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দ্রুত চালালো। আমি থতমত খেয়ে জানালায় তাকিয়ে রাতের অন্ধকার দেখছি। গাড়িতে থাকতেই মুগ্ধ একটা কল করে বসলো,

— হেই রিনি! আর ইউ স্লিপিং? প্লিজ! আই নিড হেল্প নাও! বেব্ তোর বাসায় আসছি। হ্যাঁ আমি গাড়িতে। আমার সঙ্গে…আমার সঙ্গে কে আছে সেটা পরে দেখিস প্লিজ আগে থাকার ব্যবস্থা কর! থ্যাংকিউ সো মাচ্ বেব! থ্যাংকিউউ! আমি আসছি!!

.
.

আভিজাত্য সোসাইটির শৌখিন রাস্তা ধরে গাড়ি ঢুকলো মুগ্ধের। রাস্তার দুধারে অসংখ্য ল্যাম্পপোস্টের বাতি জ্বলছে। মুগ্ধ একটা বিল্ডিংয়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে পার্কি লটে গেলো। আমি বিল্ডিংয়ের মেইন গেটের কাছে মুগ্ধের জন্য অপেক্ষা করছি। সুন্দর একটা নয়তলা বিল্ডিং। নিখুঁত নিপুণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিল্ডিংয়ের দেয়ালে দেয়ালে। নাম, “আজগর ভিলা”। বোঝাই যাচ্ছে খুব ভালোমানের প্রকৌশলী দ্বারা বিল্ডিং নকশা করা হয়েছে। মুগ্ধ গাড়ি পার্ক করে আমার হাতটি ধরলো এবং “চলো” উক্তি শুনিয়ে গেটের ভেতরে নিয়ে গেলো। লিফটের ছয়নাম্বার বাটন চেপে দিলো মুগ্ধ। লিফট উপরে উঠছে। মুগ্ধ নিচের ঠোটটা দাঁতে চেপে খিচ মেরে আছে। ওর হাত কি প্রচন্ড জ্বালা করছে? করতেই পারে! অনেক খানি কেটেছে!

বড় একটা কাঠের দরজার সামনে দাড়িয়ে বেল দেওয়া হলো। বেল বাজাতে দেরি চট করে দরজা খুলতে সময় লাগলো না। গোলাপি রঙের টিশার্ট ও লাল রঙের ট্রাউজার গায়ে দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে রিনি। চোখ বিশাল আকারে বড় করে দেখছে আমাকে, চোখ ঝুলে গেছে ওর। মুগ্ধ রিনিকে দরজা থেকে সরতে বলে ভেতরে ঢুকলো আমার হাত ধরে। রিনি হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে এখনো। মুগ্ধ ওকে স্বাভাবিক হতে বলে রুম দেখাতে বললো। রিনির দেখানো গেস্টরুমে গিয়ে বেডে বসলাম। মুগ্ধ সোফায় গিয়ে পা তুলে বসলো। রিনি সার্ভেন্ট ডাকিয়ে লেমনেড আনালো। মুগ্ধ ফোনে ব্যস্ত। চুটিয়ে চ্যাটিংয়ে করছে ফোনে। রিনি আমতা আমতা করে বলে উঠলো,

— মুগ্ধ তুমি এই অবস্থায় কেনো? কোথায় ছিলে? পান্জাবীতে রক্ত কিসের? হাত! হাতে কি হয়েছে??
— মাই গড! রিনি থাম তো! চেচাস না প্লিজ। আমি ইর্ম্পট্যান্ট একটা কাজে ছিলাম। হাতে কিছুই হয়নি। নরমাল ইন্জুরি।
— না ! এটা নরমাল না মুগ্ধ! তোমার সাদা রুমালটা ব্লিডিংয়ে ভরে গেছে! দেখি হাতটা দেখাও দেখি!!
— দূরে থাক! কাছে আসবি না! একটা ফাস্ট এড বক্স দিয়ে যা প্লিজ। বাকিটা ও দেখবে! গো!
রিনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চিকিৎসা বাক্স আনতে ছুটে গেলো। রিনি যেতেই দরজা ঠেলে দিলো মুগ্ধ। ওর ফোনটা আমার হাতে বললো,

— আরেকটা বার ট্রায় করো দেখো! যদি আঙ্কেল ফোন পিক করে!! নাও ধরো!

মুগ্ধের ফোন দিয়ে এই পযর্ন্ত বহুবার কল দিয়েছি। আব্বু আম্মু কেউই কল রিসিভ করছেনা। কি হলো উনাদের? আমার তো এখন কাদঁতে ইচ্ছে করছে! উনারা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো?? ফোন ধরলো না কেউ। বাজতে বাজতে কেটে গেলো কল। মুগ্ধ আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে চার্জিং সকেটে বসালো। জানালা দিয়ে দুমকা হাওয়া আসছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উঠছে বারবার। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। চোখের বাধ মানছেনা কিছুতেই। গালের উপর দিয়ে নোনা বিন্দু গড়াতে লাগলো নিমিত্তে। মুগ্ধ আবারো ব্যস্ত হয়ে উঠলো। প্রতিবার এই মানুষটা অস্থির হয়ে উঠে কেনো? আমার মন খারাপের প্রতিটা প্রহরে সেও কি অনুভব করে ক্ষনে ক্ষনে? মুগ্ধ আমার খুব কাছে এসে বসলো। বাতাসের প্রবাহে মুখের উপর থেবড়ে পড়া চুলগুলো আলতো করে কানের পিছনে সরিয়ে দিলো মুগ্ধ। আমার থুতনিতে হাত রেখে মুখটা সম্পূর্ন তার দিকে ঘুরিয়ে ঝট করে আমাকে চমকে দিয়ে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিলো কপালে। আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে!! মুগ্ধ চোখের পলকে কি করলো !! আমি এক ধাক্কা দিয়ে ওকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলাম। ঠোঁট কুচকে থাপ্পর মারার জন্য হাত উঠালে মুগ্ধ খপ করে আমার হাত ধরে নিজের দিকে টান মারে। কাটাহাত দিয়ে আমার ঘাড়ের উপর আগলে ধরে মুখের উপর চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে মুগ্ধ বলে উঠে,

— থাপ্পর মারবে না পাকনি। উহু!!এই ভুল করবেনা!! আদর করবো কিন্তু…আদর!! তুমি থাপ্পর মারলেই চটান করে চুমু বসিয়ে দিবো!! এন্ড বাকিটা ইতিহাস..

আমি ছাড় পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছি। মুগ্ধ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছে ওর সাথে। আমি ছুটার চেষ্টা করলে মুগ্ধ আরো দ্বিগুণ শক্ত করে চেপে ধরে। নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে। আমাদের মধ্যে ছোটোখাটো দস্তাদস্তি শুরু হতেই কেউ দরজার কাছে ভ্যাবাচেকা দৃষ্টিতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

— মুগ্ধ? ততুমি মমকে জড়িয়ে ধরেছো কেনো?

মুগ্ধ রিনির কন্ঠ পেয়ে তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিলো। লজ্জায় মিশে যাচ্ছি আমি! মুগ্ধ রিনির দিকে ঝাঝালো সুরে বলে উঠলো,

— ইডিয়েট! ড্যামিশ! রুমে ঢুকার আগে নক করতে হয় মেনার্স জানিস না! গেট আউট ইডিয়েট! আই সেইড গেট লস্ট!

-চলবে♥

#তুমিময়_প্রেম❤
#PART_20
#FABIYAH_MOMO 🍁

— ‘ইডিয়েট! গাধা কোথাকার! কথা কি কানে যাচ্ছে না! বেরিয়ে যাওবলছি! বেরিয়ে যাও!আই সেইড গো! গেট আউট!

— তুতমি আমাককে ইইনসসাল্ট কররলে মুমুগ্ধ…

কথা আটকে আসছিলো রিমির। নিজের বাড়িতেই রিমি এতোটা অপমানিত হবে ভাবতেও পারেনি! নিমিষেই মুখের রঙ পাল্টে কাদোঁকাদোঁ চেহারা করে রুম থেকে দৌড়ে পালালো। এদিকে মুগ্ধ এমন অপ্রতিভ কান্ড
করবে আন্দাজের বাইরে ছিলো আমার! আমি বোকা বনে ঝিম খেয়ে দাড়িয়ে আছি। মুগ্ধ জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। ওর কাটা হাতটা চোখের সামনে এনে বলে উঠলো,

— এই নিরীহ প্রাণীটার উপর একটু দয়া করবে? ব্যথাটা প্রচুর যন্ত্রনা দিচ্ছে….পারলে এটাকে আমি খন্ডখন্ড করে কেটে ফেলতাম! কিন্তু পারছিনা….অসহ্য লাগছে…ব্যথাটা আমি নিতে পারছিনা…

মুগ্ধের ওমন আকুতি ভরা কন্ঠ শুনলে যে, কারো যে মন গলবে, এটা আমি নিশ্চিতরূপে বলতে বাধ্য। মাঝে মাঝে মানুষের আকুতির মধ্যেও খানিকটা সত্য মেশানো থাকে! কিন্তু এখানে খানিকটা নয়, অনেকটাই সত্য জড়ানো! মুগ্ধের অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু সে মুখে না বলে চুপচাপ দাতঁ চিবিয়ে বসে আছে। আমি লম্বা দম নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।এলোমেলো চুলগুলোকে দুহাতে শক্ত খোপা পেচিয়ে নিলাম।। ফাস্ট এ্যাড বক্সটা রিনি দরজার ওখানে ফেলে দিয়ে গেছে। আমি ততক্ষণে বক্সটা নিয়ে দরজা ঠেলে মুগ্ধের কাছে ফ্লোরে আটোঁ হয়ে বসি। ঝটপট ড্রেসি করবো তা না! উল্টো হাতের রুমাল খুলে স্যাভনল দিতেই গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগলো। তুলো দিয়ে মুছেও আমি রক্তপাত বন্ধ করতে সক্ষম হচ্ছিলাম না! আমার হাত পযর্ন্ত রক্তে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিলো! আমি বুঝতে পারছিলাম না রক্ত কীভাবে বন্ধ করবো! মুগ্ধের দিকে একবার তাকালাম। ও কেমন শান্ত দৃষ্টিতে পূবের আকাশ দেখছে!! যেনো একবিন্দু জ্বালা হচ্ছে না!! একদম কিছু হয়নি!!ওর জায়গায় আমি থাকলে এতোক্ষনে চিৎকার করে বাড়ি মাতিয়ে ফেলতাম! বড় একটা ঢোক গিলে নিজেকে ঠান্ডা করলাম। আমার হাত থরথর করে কাপছিলো! বেগতিক হারে কাপছিলো! তুলোটা ওর কাটা ঘা-য়ে দিতে যেয়েও দিতে পারছি না। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছি! এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমি আদৌ পড়িনি। তুলোর সম্পূর্ন প্যাকেটটা মুছতে মুছতে বহু চেষ্টার পর রক্তপাত বন্ধ করি। ব্যান্ডেজের শেষ গিটটা দিয়ে উঠতে যাবো হঠাৎ মুগ্ধ বলে উঠলো,

— তুমি প্লিজ আমার একটা কথা রাখবে?
— রাখতে পারলে রাখবো!
— আমার সাথে আমার বাসায় চলো। তুমি ওখানে থাকবে। আমি তোমাকে রিনির কাছে রেখে যেতে ভয় পাচ্ছি! আমার কারনে যদি ও তোমার ক্ষতি করে?
— তাহলে এখানে আনলেই কেনো তুমি! আমি বলেছিলাম আনতে? বলো? বারবার আমাকে নিয়ে এতো ছয়নয় করছো কেনো?
— আ’ম সরি! প্লিজ, আমার সিচুয়েশনটা বুঝো! এমনেই আঙ্কেল আন্টির হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে কোনো এ্যাঙ্গেলে ভালো মনে হচ্ছে না। তার উপর রিনির এমন গোয়েন্দাগিরীর, রাগচটা স্বভাবটা….ড্যাম! আমারই ভুল হয়েছে তোমাকে এখানে আনা! রিনির নেচার সম্পর্কে আমি ভালো জানি! ও যে তলে তলে তল্লাশি করবে, ফ্যাক্টটা ভুলেই গিয়েছিলাম! নাহ্…চলো!

চট করে আমাকে উঠতে বলে টেবিলের উপর থেকে ফোন ও গাড়ির চাবিটা দ্রুত পকেটে ঢুকাতে লাগলো মুগ্ধ! আমি সোজা হয়ে দাড়াতেই মুগ্ধ তাড়াহুড়ো করে আমার হাতের কবজি ধরে সামনের দিকে পা ফেলতেই হুট থমকে দাড়ালো! আমার মুখপানে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইতস্তত করছিলো মুগ্ধ! ‘জিজ্ঞেস করবে নাকি করবে না’ ঠিক এমন টাইপ জড়তা!

— কি হলো? কিছু বলবে? ওমন মিনমান করছো কেনো?
— মানে…বিষয়টা হলো…
— হ্যাঁ বিষয়টা কি? চুপ হলে কেনো? বলো?
— প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবে না। একচুয়েলি, তোমার শাড়ি টারি ঠিক করতে হবে? যেহেতু আমি তোমাকে ফ্রেশ হতে অতো সময় দেইনি… মানেটা বুঝেছো তো??

আমি ফিক করে হেসে দিলাম!! সামান্য একটা প্রশ্ন করতেই ওর জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো!! আল্লাহ্ এগুলো ভাবা যায়??মুগ্ধ আমার হাসি দেখে লজ্জায় কাচুমাচু করছিলো। আমি হাসি আটকে কোনোরকমে বলে উঠি,

— তোমার গ্যাংয়ের রিমি, জেনি শাড়ি পড়লে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ‘উলালা উলালা’ গানে ডান্স দিয়ে ছেলেদের মনোরন্জন দিতে পারবে মুগ্ধ সাহেব! আমি ওমন না! বাঙালি মেয়েরা শাড়িতে ‘স’ থেকে ‘সবকিছু’ করতে পারে! বুঝলেন??

মুগ্ধ জড়তা কাটিয়ে আমার দিকে একচিলতে গর্বসূচক হাসি দিয়ে যাত্রা ধরলো বাসার উদ্দেশ্যে! রিমি নাকি রুমের দরজা বন্ধ করে হু হু করে কাদঁছে। ওর আব্বু আম্মু চিকিৎসার জন্য বাইরে বিধায় আমাদের অযথা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। ওদের একটা সার্ভেন্টকে জানিয়ে আমরা চলে এসেছি রিমির বাসা থেকে।

.
.

রাতের আধারে সুনশান সড়কে গাড়ির চলাচল খুব কম! মাঝেমাঝে দু-একটা গাড়ি শান বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যস্থলে। মুগ্ধ একহাতে গাড়ি চালাচ্ছে, অন্যহাতটা আপাতত রেস্টে আছে। গাড়িতে লাইট জালানো হয়নি। সেটা বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে। আমি সিটে গা হেলিয়ে বাইরের আধার দেখছি। হঠাৎ চলন্ত গাড়িতে বিকট রিংটোনে মুগ্ধের ফোনটা বাজতে লাগলো। স্বাভাবিক ভাবে, মুগ্ধ ফোনটা হাতে নিলো। কিন্তু স্ক্রিনে লক্ষ্য করতেই যেনো মুখের অবস্থা পাল্টে গেলো! একবার আমার দিকে, আরেকবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো! সামান্য একটা কল নিয়ে মুগ্ধের আচমকা পরিবর্তনটা আমার কাছে খটকা লাগছিলো! খচখচ করছিলো মনে, কে দিলো কলটা ফোনে! মুগ্ধ আমার দিকে একটা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে কলটা রিসিভ করলো! গাড়িটা পার্ক না করে কানে ফোন লাগালো মুগ্ধ,

‘হ্যালো…’
প্রথম শব্দটা বলার পর মুগ্ধ আমার দিকে অনাকাঙ্ক্ষিত চাহনি ছুড়লো। ড্রেসিং করা হাত দিয়ে পাশের জানালাটা নামিয়ে সেদিক মুখ করে কথা বলতে লাগলো। মেইন কথা, মুগ্ধ চাচ্ছিলো না ওর কথোপকথন আমি কোনোভাবে শুনি! একটু আধটু শোনা যাচ্ছিলো। যা ছিলো এমন…

‘হোয়াট! তুমি আমাকে এই নিউজ দেওয়ার জন্য কল করেছো? হোয়াট সরি? আমি তোমার সরি শোনার জন্য বসে আছি! আই উইল ফায়ার ইউ নিজাম! রিজাইনেশন লেটার নিতে প্রস্তুত থাকো!’

কথা দ্বারা যতদূর বুঝলাম সম্ভবত স্টাফের কোনো বড়ো ভুল নিয়ে মুগ্ধ এখন চেচামেচি করছে। চোখে প্রচুর ঘুম। তবুও চোখের পাতা বেশি ঠেলেঠুলে খোলা রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছি। আমি হাই তুলতেই দেখি, মুগ্ধ কল কেটে ফোনে ধুমাধুম টাইপিং করছে। টাইপ শেষ হতেই ফোনটা গাড়ির পিছন সিটে ছুড়লো! এবং রাগী গম্ভীর মুখ করে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

.
.

ঠিক একঘন্টা পর মুগ্ধের বাসায় পৌছলাম। ওদের দারোয়ানটা আমাকে মুগ্ধের সাথে গাড়ি থেকে নামতে দেখে চোখের গোলক ইয়া বড় বড় করে দেখছিলো! যখন আমরা লিফটে আবদ্ধ, মুগ্ধ তখন বলে উঠলো,
— আমার একটু ইর্ম্পট্যান্ট কাজ আছে পাকনি। তোমাকে ভেতরে পৌছে দিয়ে আমাকে জরুরী কাজে বাইরে যাওয়া লাগবে। তুমি থাকো? কোনো টেনশান করবে না। সার্ভেন্ট আছে, চাচা আছে, উনারা তোমার দেখাশোনা করবে। কেমন? আমি খুব জলদি কাজ সেরে আসবো! আই প্রমিস!

‘কি এমন মহা ইর্ম্পট্যান্ট কাজ তোমার যাওয়াই লাগবে!’ প্রশ্নটা করা হলো না, লিফটের দরজা খুলে গেলো! লিফট খুলতে দেরি মুগ্ধের অপেক্ষায় থাকা সার্ভেন্ট দল দৌড়ে সেবা দিতে দেরি করলো না! মুগ্ধ তাদের চোখের ইশারায় কি যেনো বুঝালো তারপর লিফটের বাটন টিপে চলে গেলো। সার্ভেন্টরা আমাকে নানা ভাবে নানা কাজ করার জন্য হুকুম চাইলো। এতোগুলো চোখ যখন আমার দিকে আমি হড়বড় করে বলে উঠি,

— আমি ঘুমাবো। বেডরুম চাই। ফ্রেশ হতে চাই।প্রচন্ড খুদা পেয়েছে। খাবো আমি!

উনাদের মধ্যে অলরেডি ক’জন নির্দেশ পাওয়ার মতো একেকদিকে ছুটে গেলো। বাকি কিছু সার্ভেন্টের মধ্যে একটু বয়স্ক মতোন এক বৃদ্ধ এসে আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন। পথিমধ্যে অনেককিছুই আমাকে বললেন উনি। জানতে পারলাম, উনার নাম রফিকুল ইসলাম। মুগ্ধ এনাকেই ‘চাচা’ বলে ডাকেন। এ বাড়িতে প্রায় একুশ বছর ধরে ঢ় গিয়ে দেখি লক ঘুরছেনা! মূহুর্তেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো! আমাকে…আমাকে কি ইচ্ছাকৃত ভাবে অপহরণ করা হলো? মুগ্ধের প্ল্যান কি তাহলে কিডন্যাপ করা ছিলো? শত জোরাজুরি করলেও কেউ লক খুললো না। আমার চিৎকার করা গলার আওয়াজ শুনেও না। কেউ দরজা খুললো না।

আমি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে হাল ছাড়ার মতো বসে পড়েছি। চোখের সামনে দূরদূর পযর্ন্ত অন্ধকার। কিছুই ধরতে পারছিনা। সব ঘোলাশা। সব! চোখ বন্ধ করতেই চোখের দুকোণা থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে হাতের উপর পড়লো। শব্দ করে কাদঁতে মন চাচ্ছিলো। আব্বু-আম্মু-ভাই এই তিনজন সদস্যের কোনো লাতাপাতা নেই! অনুষ্ঠানের উছিলায় হলরুমে কে উগ্র স্পর্শ করেছিলো জানা নেই! মুগ্ধ হেলাখেলা করে কেনো কিডন্যাপ করলো উত্তর নেই! এ কেমন বিপদে পড়লাম আল্লাহ্? এ কেমন সঙ্কট? চোখ থেকে থেমে থেমে পানি ঝরছিলো! কান্না পাচ্ছিলো ডুকরে! তবুও নিজেকে সামলে চোখ মুছে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ দেখি। আচঁলে মুখ মুছে ব্যাগ খুলে দেখি কিছু জামা রাখা এবং ওগুলো যে কেবল আমার জন্যই ছিলো সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো জামাগুলো কালার। সবগুলো আমার পছন্দসই রঙের! একটা জামা তুলে ওয়াশরুমে গেলাম।শাড়ির গেটআপ পাল্টে বেরিয়ে দেখি, এখন টেবিলের উপর খাবার রাখা! খাবারটা খেলাম না। ওভাবেই রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কাথাটা মেলে শরীরে জড়াতেই ঘুম এসে হানা দিলো…

.

সূর্যের সোনালি মিষ্টি আলোয় ঘুমটা ভাঙলো আমার। আড়মোড়ে শরীর টানা দিয়ে উঠে বসতেই জানালার কাছে কারো উপস্থিতি দেখলাম। সে দুহাত ভাজ করে জানালার বামপাশে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সাদা পান্জাবীর জায়গায় এখন কালো পান্জাবী। সূর্যের আলোয় মাথার চুলগুলো চকচক করছে।যেনো সদ্য তেল মাখানো ঝলমল চুল!! বর্তমানে তার বাহ্যিক রূপ বর্ননা করার মতো নয়! শুধু চেয়ে চেয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে হয়! বিছানা থেকে চুপিসারে নেমে মুগ্ধের ঠিক পেছন দাড়িয়ে বলে উঠি,

— আমায় কিডন্যাপ কেনো করেছো রাদিফ মুগ্ধ!
হাতের ভাজ খুলে ঘুরে দাড়াতেই মুগ্ধ আমাকে দেখলো। সে মুচকে হেসে জবাব দিলো,
— ভুল! কিডন্যাপ করিনি। যা করেছি, যে জন্যে করেছি। সময়মতো সব জানবে পাকনি।
— খবরদার! পাকনি ডাকবেনা! ডাকবেনা!
মুগ্ধ আলতো করে আমার নাকটা টেনে হেসে বলে উঠলো,
— ইশশ…তুমিও না!! একটু বেশি বেশি!! কেনো ডাকি জানো না?? তুমি হচ্ছো রাদিফের পাকনি! মুগ্ধের মম! রাদিফ মুগ্ধের পাকনি মম!
আমি রাগী চোখে নাক ফুলালে মুগ্ধ হাসা বন্ধ করে এবং স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে,
— যারা মূলত ত্যাড়া, শুদ্ধ বাংলা ভাষা বুঝেনা ও অন্যের উপদেশ না মেনে নিজেকে পন্ডিত মনে করে, তাকে মুগ্ধের ভাষায় ‘পাকনি’ বলে। তোমায় আমি পাকনি ডাকবো! এবং এই নামে ডাকার অধিকার স্রেফ আমার! ‘বাবু,সোনা,পাখি,ময়না,গিলা,কলিজা ব্লা ব্লা ব্লা… আমি এইসব নামে ভালোবাসা দেখিয়ে শো-অফ করতে চাইনা! নেভার এভার! আমার বিহেভিয়ারের সাথে ভালোবাসার শোঅফ…ধুর! ইমেজিন করতেও সমস্যা হয়! ছিহ্ঃ!

‘ চলবে ‘

#ফাবিয়াহ্_মম ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here