#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০৫

0
690

#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০৫

#মিদহাদ_আহমদ

ইফতারিতে শাশুড়ির আবদার, কমপক্ষে যেনো দুইশো লোকের ইফতার আসে আমার বাপের বাড়ি থেকে। এদিকে আমার মা, উৎসাহ, আমেজ নিয়ে বলছে, বাবা ধান বিক্রি করেছেন, আগামীকাল ঘটা করে চল্লিশ জনের ইফতারি নিয়ে আসবেন! আমার গরীব মা বাবার কাছে চল্লিশ জনের ইফতারি নিয়ে আসাটা যেটা ঘটা করে আসা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে, সেই ঘটা করে ইফতারি নিয়ে আসলে আমার শাশুড়ি মা আমাকে কথা শুনাতে আস্ত রাখবেন না। আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম ফোনের মাঝে। মা আমাকে আমার উৎসাহ নিয়ে বললেন,

‘নুপুর, বাড়িতে যে মোরগ পেলেছিলাম না, ওগুলা সব আজ জবাই করে ফেলেছি। গুণে গুণে চারটা মোরগ। দেশি মোরগের পোলাও দেখিস তোর শ্বশুর বাড়ির সবার পছন্দ হবে।’

এদিকে আমি মনে মনে ভাবছি, মোরগে আমার শ্বশুরের এলার্জি৷ এই বাড়িতে কেউ মোরগ খায় না। তার উপর আগামীকাল মোরগ পোলাও নিয়ে আসলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে।’

এদিকে মা আবার বললেন,

‘জানিস নুপুর, প্রথমে ভেবেছিলাম ত্রিশ জনের ইফতারি দিবো, পরে ভাবলাম কম হয়ে যাবে। চল্লিশ জনের ইফতারি আসবে। তুই কোন চিন্তা করিস না ‘

অন্যদিকে আমার শাশুড়ি মা আশা করে বসে আছেন দুইশো জনের ইফতারির!

আমি এবার নিজের বাধ ভেঙ্গে ফেললাম। জানি আমার অসহায় বাবা মায়ের কোন উপায়েই এই বিশাল অঙ্কের টাকার আয়োজন করে দুইশো লোকের ইফতারি নিয়ে আসা সম্ভব না। আমি আমার রুমের ভেতরের কোণায় বসে, উচ্চকণ্ঠের সাথে মাকে বললাম,

‘যখন সব নিয়ম মেনে চলতে পারবে না, তখন কেন আমাকে বিয়ে দিয়েছো এমন ঘরে? বামুন হয়ে চাদে হাত দেয়ার স্বপ্ন কেন দেখেছো? কেন আমাকে এই নরকে ফেলেছো? এখন আবার কেনই বা তাদের সমানে তাল মেলাতে পারছো না? কেনই বা এমন অসহায়ের মতো আমার কাছে এসবের ফিরিস্তি দিচ্ছো মা।’

আমি বুঝলাম আমার এই আকস্মিক কথায় আমার মা তথমথ খেয়ে গিয়েছে। আমি মাকে সরাসরি বললাম এবার,

‘জানো আমার শাশুড়ি কতজনকে দাওয়াত করেছেন? জানো বাসার ছাদে প্যান্ডেল হচ্ছে আমাদের এখানে? জানো আগামীকাল বিশাল আয়োজন করা হচ্ছে ইফতারির। আর সেই ইফতারি আসবে তাদের পুত্রবধূর বাপের বাড়ি থেকে। চল্লিশ জনের ইফতারি না কিন্তু, এক এক করে পুরো দুইশো জনের। আর তোমার মোরগ পোলাওয়ের ইফতারি না৷ গরুর পোলাও, খাসির রেজালা, ভালো ভালো ফল, মন সমান ছানার দামি মিষ্টি, অর্ধ মন চিকন জিলিপি আরও কত কি! আর তুমি কিনা আমাকে হিসাব দিচ্ছো জন চল্লিশের? মা আমার কথা শুনতে কষ্ট হবে তোমার। হচ্ছেও হয়তো। তবে কেন এমন করতে গেলে? কেন এমন অসমতার মাঝে নিজেকে জড়িয়ে নিলে? কেন আমার অসুস্থ বাবাকে এখন চাপ দিয়ে মেরে ফেলছো প্রতি ক্ষণে ক্ষণে? আর তোমাদের ধান কি খুব বেশি উপরি থেকে যাচ্ছে আমার বিয়ের পর? যা ধান পাও, সেই ধানের চাউলেও তো আমি থাকতে মাস চারেকের বেশি যেতো না। এখন বুঝি সেই মাস চারেকের ধানও বিক্রি করতে বসেছো? এখানে এসির ভেতরে, আলিশানের ভেতরে, দামি শাড়ি, দামি গহনা, হাত ভর্তি সোনার চুড়ির মাঝে আমার আটকা জীবনের বিনিময়ে তোমরা মরে যাবা এখন? এটাই কি জীবন? আমার স্বপ্নগুলোও ভেঙ্গে দিলা! আমার ইচ্ছা ছিলো মেডিকেলে পড়ার৷ ডাক্তার হওয়ার৷ আমার সেই ইচ্ছাগুলো? আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো৷ সবকিছু… ‘

আমার কথাগুলো সব মা শুনলো। মা কোন উত্তর দিলো না তেমন করে। শুধু বললো,

‘আচ্ছা আমি দেখছি।’

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম, মা নিশ্চয়ই আবুল চেয়ারম্যানের ভাগনার কাছে যাবে এই সন্ধ্যারাতে। তারপর ঠিক সে সেখান থেকে কড়া শোধে টাকা চেয়ে আনবে। আর সেই কড়া শোধের টাকা পরিশোধ করতে আমার অসুস্থ বাবার মাঠের কাজ বিকালে শেষ হওয়ার কথা, সেই কাজ বাবা নিশ্চয়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়িয়ে নিবে৷ বিনিময়ে আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ইফতার করবে। দুইশো লোক জানবে, তাদের ছেলের বিয়ে করা বউয়ের বাড়ি থেকে ইফতার এসেছে! আহা! কী আয়োজন, কী সমারোহ!

মায়ের সাথে এমন কথা বলার পর আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না৷ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি৷ কিছুক্ষণ পর পিঠে কার যেনো ঠান্ডা হাত অনুভব হলো আমার৷ আমি পেছন ফিরে তাকালাম। একটা টিশার্ট আর টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরা আসিফ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম৷ উঠে দাঁড়ালাম৷ আসিফ আমার হাত টেনে ধরলো৷ আমাকে বিছানায় বসালো৷ তারপর বললো,

‘আমি সব কথা শুনতে পেয়েছি৷ আমি বারান্দায় বসা ছিলাম। মদ খাচ্ছিলাম। জীবনটা আসলেই অনেক কঠিন৷ মানুষের চাওয়ামতো কোন কিছুই হয়না। জানো নুপুর, আমার তখন সদ্য ইন্টার শেষ হয়েছে৷ আমি অনেক ভালো আঁকতাম। আমার সব সময় আঁকাআঁকির নেশাই ছিলো প্রচন্ড। সেভাবে কারোর কাছে আমি শিখিনি। ইন্টারের পর আমার ইচ্ছা আমি ঢাবির চারুকলাতে পড়বো। আমার এই ইচ্ছাটা যখন বাসায় জানলো সবাই, তারপর বাসায় সে কী হট্টগোল! মায়ের সাফ নিষেধ, আমি চারুকলায় পড়তে পারবো না। আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। সাইন্স বেকগ্রাউন্ডের ছাত্র হলেও সাইন্সের সাবজেক্টে আমার কোন আগ্রহ ছিলো না৷ আর্টকালচারেই যেনো আমি আমার সবকিছু খুঁজে পেতাম। আমার শান্তি, আমার ইচ্ছা, আমার মুক্তি…
সব সব সব। মায়ের কথায় ভর্তি হলার ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এ। অন্যদিকে আমি ভেতরে ভেতরে প্রিপারেশন নিতে লাগলাম ঢাবির চারুকলার৷ আমার ইচ্ছা আমাকে পূরণ করতেই হবে৷ পরিচিত কিছু বড় ভাইদের সাথে পরিচয় ছিলো আগ থেকেই৷ তারা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে৷ তারপর আমি দিলাম পরীক্ষা। আমার ঢাবিতে হয়ে গেলো চারুকলায়। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং আর এ ইউনিটের কোথাও হলো না৷ বাসায় আমার উপর ক্ষেপে গেলো সবাই৷ একদিকে বাসার সবাই চায় আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি, অন্যদিকে আমি চাই আমি চারুকলায় পড়বো। জানো নুপুর, আমাকে কখনো বাইরে যেতে দেয়া হতো না, আমাকে টিভি দেখতে দিতে হতো না, আমাকে কোন মানুষের সমান মূল্যই দেয়া হতো না এই ঘরে৷ একা একা, নিজের জীবন সম্পূর্ণ একাই আমি গড়ে নিয়েছি যেনো৷ সর্বক্ষণ টিচার, হুজুর, স্কুল তারপর বাসায় এসে আবারও পড়া, এই যেনো আমার রুটিন হয়ে দাঁডিয়েছিলো৷ ঢাবির চারুকলায় যেদিন ভর্তি ছিলো আমার, বাবা আমাকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু হায়, আমি জানতাম না সেইটা ছিলো আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দিন। বাবা নিজে গিয়ে আমার ভর্তি ক্যান্সেল করে দিয়ে এলেন৷ এইতো জীবন। আমার অধরা জীবন আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হলো৷ আমাকে একঘরে বন্দি জীবন আবার এক করে নিতে হলো।

তারপর তো দেখছোই৷ নারীতে আসক্ত হলাম।খারাপ সঙ্গ পেলাম। মদ আর নারী ছাড়া আমার এখন চলেই না৷ দুটোর নেশায় আমি বেঁচে আছি যেনো!

আচ্ছা শুনো নুপুর, আগামীকাল যদি ইফতার নিয়ে না আসতে পারেন তোমার বাবা, তাহলে এখানে আবারও তোমার জীবন নরকে চলে যাবে। আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আসবো কাল সকালে তোমার বাবার কাছে। তুমি কল করে বলে দিও তোমার বাবাকে। আর এই টাকা যে আমি দিচ্ছি, বাসায় যেনো কেউ বিন্দুমাত্রও টের না পায়।’

কথাগুলো বলেই আসিফ আমার ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁট লাগিয়ে দিলো। আজ তিন মাসের মধ্যে এই প্রথম যেনো আমি অন্যরকম আসিফকে অনুভব করতে লাগলাম। মানুষ একাকী থাকতে থাকতে নিজের ভেতরের নিজেকে কখন যে ভুলে যায়, তা সে কল্পনাও করতে পারে না হয়তো….

গ্রুপে রিচ সিস্টেম টা দেখা যায়। মানে একটা পোস্ট কতজন পর্যন্ত রিচ হলো সেইটা দেখা যায়। আমার নরমাল পোস্ট রিচ হয় ১/১.৫ হাজার। আর গল্পের প্রতিটা পর্বের রিচ হয়, ২.৫/৩ হাজার। এর মানে গল্পটা সবাই পড়ছে এসে। গল্পটা যদি ভালো না লাগতো, তাহলে পড়তোও না৷ রিচও হতো না। পড়ার পর লাইক কমেন্ট করে না যাওয়াটা কি মানসিক দৈন্যতা না? আর লাইক কমেন্ট চাওয়ার মোটিভ আমি আগেও ক্লিয়ার করেছি। লাইক কমেন্ট করলে গল্প রিচ হয়। লেখক হিসাবে অনেকের সামনে গল্প যাক, এই চাওয়াটাতো আমার কোন ভুল নয়৷ গল্প পড়ে যারাই লাইক কমেন্ট করেন, আপনাদের আমি ভালোবাসি। আপনাদের মাধ্যমেই আমার গল্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর যারা লাইক কমেন্ট না করে চলে যান, আজকের পর্বে মিনিমাম ৮০০ লাইক আর ২০০ কমেন্ট চাই। অন্যথায় আমি কন্টিনিউ করবো না। ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here