#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_০৩
#মিদহাদ_আহমদ
বিয়ের রাতে স্বামীর দ্বারা এক প্রকারের ধর্ষণ হয়েছিলো আমার। কী করেনি লোকটা আমার সাথে! চোখ বেয়ে টপাটপ অশ্রু আর সাথে আমার জমে থাকা আর্তনাদ আমাকে ভেতর থেকে নিশ্বেষ করে দিচ্ছিলো যেন! এ কোন নরকে আসলাম আমি৷ তার সাথেসাথে আসিফের মুখের অশ্রবণীয় সেই কথাগুলো! কথায় কথায় গালিগালাজ! বাজে ভাষা ব্যবহার করে সে বলছিলো,
‘টাকার লোভে বিয়ে করেছিস, তখন তো তোকে খেতেই হয়। একটা না একটা কাজে লাগ৷ তবে তোকে আমি আমার স্ত্রী মানি না। এই বিয়েই আমি মানি না।’
ভোর হতেই যেনো সেই রাতের সমাপ্তি ঘটলো৷ ইতি ঘটলো এক নরকীয় যন্ত্রনার। আমি ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে এসে বসে রইলাম খাটের এক কোণে। এরমধ্যে আসিফ সিগারেট খেয়ে, টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরে খালি গায়ে কোলবালিশ সাথে করে ওপাশ ফিরে শুয়ে রইলো৷ কিছুক্ষণ পর ননদ এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো বাইরে। বাবা এসেছেন নাস্তা নিয়ে। ননদ আর ননাস মিলে এসব খুলছিলো। ননাস আমাকে সরাসরি বলেই বসলো,
‘এই পরোটা আর ফার্মের মোরগী ভূনা দিয়ে তোমাদের নাস্তা হয়তো হয়, আমাদের নাস্তা হয় না। রান্নাঘর থেকে কাজের মেয়ে ট্রেতে করে চায়ের সাথে বিস্কুট নিয়ে যাচ্ছিলো। আমার ননাস ওকে দাঁড় করিয়ে বিস্কুটের প্লেইট রেখে বললো
‘ওসব ড্রাইকেক বড়লোকের খাবার। গরীবের পেটে ওসব হজম হবে না।’
কথাটা ডায়নিং রুমে থাকা সবাই শুনতে পেলো যেনো! আমি দেখলাম সকালের নাস্তার এক টিফিন ক্যারিয়ারে গরুর কলিজিও আছে। আমার মনে পড়ে গেলো আমার ছোট ভাইটার কথা! মাস দুয়েক আগে টিভিতে কলিজা রান্না দেখে সে আবদার করেছিলো তাকে কলিজা রান্না করে খাওয়াতে। বাবা আনতে পারেন নাই। আজ হয়তো সকালে সে কলিজি খেয়েছে। এই শান্তিতে আমি পূর্ণ থেকে গেলাম।
দুপুর নাগাদ আমার বাড়ি থেকে এক গাড়ি ভর্তি লোকজন আমাদের এই সিলেট শহরের আলিসানে আসলো। আমাদের বাড়ির লোকজনেরা আমাদের এই বিশাল অট্টালিকা চেয়ে চেয়ে দেখছিলো শুধু। আমাকে আমার রুমে নিয়ে গেলেন আমার মা। আমাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে বললেন,
‘মারে, সব ঠিকঠাক আছে তো এখানে?’
আমি মাকে বলার আগেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরব বললেন,
‘জানি মা সব ঠিকঠাক নেই। তোর মামা আমাকে আগেই বলেছে সবকিছু। আর দামান্দ ছেলে মানুষ। এখন হয়তো অসুবিধা আছে, হচ্ছে৷ দেখবি মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ওসব তো ওর আগের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক কেউ মেনে নেয়নি। তাইতো বিয়ে দিয়েছে। আর নাহলে কি আর আমাদের মতো গরীব ঘরের মেয়েকে কেউ বিয়ে করে আনে?
জানিস মা, তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে নগদ তিন লক্ষ টাকা দিয়েছে। আমি তোর বাবাকে বলিনি৷ তোর বিয়ের জন্য মানুষটা ঋণ নিয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। ঘরের টিন ফুটা। আসছে বর্ষার আগে যদি ঠিক না করাই, তাহলে তোর অসুস্থ বাবা আর ছোট ছোট ভাই বোনদের নিয়ে থাকবো কীভাবে? তুই হয়তো ভাবছিস তোর মা তোর সাথে অবিচার করেছে। কিন্তু মা দেখ, এই যে বিশাল ঘর, এই যে দুই মুঠো খাবার, সম্মান, এতকিছু তুই এই ঘরে পাচ্ছিস, এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? আমার মতো বাসন মেজে, মাটির ঘর টিপতে টিপতে তো তো দিন পার করা লাগবে না। এরচেয়ে তো তুই অনেক ভালো আছিস রে মা। অনেক ভালো আছিস। দেখিস মা, তুই এখানে অনেক ভালো থাকবি৷ পেট ভরে ভাত খেতে পারবি, একবেলা শান্তিতে ঘুমাতে পারবি। মা যাই করেছি শুধু তোর ভালোর জন্যই করেছি। এখানে বিন্দুমাত্র আমার নিজের স্বার্থ নাই রে মা।’
মায়ের এই কথাগুলো শুনে আমি থ বনে গেলাম। আমার অনুভূতি শক্তি একেবারে শেষ হয়ে এসেছে যেনো৷ মুখের বাসা উবে গেলো মুহূর্তেই। বলার কোন ইচ্ছা আমি পেলাম না ভেতর থেকে। শুধু দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মা তার আচল দিয়ে আমার চোখের কোণা মুছতে মুছতে আবার বলা শুরু করলো,
‘দুনিয়া অনেক কঠিন রে মা। এই দেখ, লোকজন তোর কত সুনাম করছে, তোর ভাগ্যের তারিফ করছে, এই ভাগ্যের জন্য হলেও অনেক কিছু আমাদের বিসর্জন দিতে হবে। আমাদের মেনে নিতে হবে। এছাড়া আর এই গরীব ঘরের মেয়েদের কোন উপায় নেই, কোন জীবন নেই।’
আমি মাকে এবার বললাম,
‘তোমার ভাইও তাহলে আমাকে বিক্রি করে চার লাখ টাকার মালিক হয়েছে তাইনা?’
মা আমার মুখ চেপে ধরলেন৷ আমার হাতে শক্ত করে ধরে বললেন,
‘এসব কী বলছিস তুই? যা মুখে আসছে তা? তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে দিয়েছে মেয়ে খুঁজে এনে দেয়ার জন্য৷ সে তোকে না দিলে অন্যকে এনে দিলেও এই টাকা নিতো৷ এখানে তুই অন্যায়ের কী দেখিস? কী বলছিস এসব?’
‘অহ! বুঝতে পেরেছি। তাহলে আমার মা আমাকে তিন লাখে, আর আমার মামা আমাকে চার লাখে এই আলিশানে বিক্রি করে দিয়েছে। এইতো?’
এমন সময়ে আমার ছোট ভাই আমার রুমে এসে ঢুকলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বললো,
‘জানো জানো আপু, আজ সকালে আমি পেট ভরে গরুর কলিজা খেয়েছি। আমি কলিজা এর আগে জীবনেও খাইনি৷ এতো স্বাদ! ইশ। তুমি থাকলে না, তোমাকেও খাইয়ে দিতাম। আমার তো দারুণ লেগেছে৷ মা আমাকে পুরো জামবাটির অর্ধেক বাটি খেতে দিয়েছে আপু। আজ একদম আমার মনভরে খাওয়া হয়েছে ‘
কথাগুলো বলেই আমার আট বছর বয়সী ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
(চলবে)