#বিন্নি_ধানের_খইপর্ব_২৮
#মিদহাদ_আহমদ
রাতে মা আমাকে কল করে বললেন, আমি যেনো আগামীকাল আসিফকে নিয়ে বাসায় চলে যাই। মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোমাকে কে বলেছে মা? আর তুমি এসব জানো কীভাবে?’
মা আমতা আমতা করে বললেন,
‘বেয়াইন কল দিয়েছিলেন। ঝিয়ারিকে দেখতে আসবে পর্শু জামাই বাড়ির লোক। আর তুই তো জানিস মা, একটা মেয়ে বাবা মায়ের উপর কতটুকু দায়িত্ব হিসাবে থাকে। এখন যে করেই হোক, তোর ননদের জন্য হলেও তো তোকে ঘরে যেতে হবে তাইনা? আর মেয়ের একমাত্র ভাই আর ভাইয়ের বউ কোথায় এইটা সবাই জানতে চাইবে না? মেয়ের বোনের চেয়ে মেয়ের ভাই আর ভাইয়ের বউ যে পাত্রপক্ষের কাছে বেশি মূল্য রাখে এইটা আমাদের এই সমাজের নিয়ম। সমাজের নিয়ম বহির্ভূত কোনকিছু আমরা করতে পারি না যে!’
মায়ের কথাগুলো স্পিকারে আসিফ শুনছিলো। সে কোন রিয়েক্ট করেনি। কল রাখার পর আসিফ যেনো রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠলো। কিছুটা চিল্লানোর সুরে বললো,
‘অহ! এখন এখানে কল দিয়ে না হওয়ায় সেখানে কল দিয়ে ফোর্স করা হচ্ছে!’
আসিফের এসব কথাবার্তা আমার কখনোই পছন্দ ছিলো না। সে কোন সময় কী বলে নিজেও বুঝতে পারে না। তাকে বললাম,
‘এখানে ফোর্স করা কোথায় হলো আসিফ?’
হন্যে হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে আসিফ আমার শাশুড়ির নাম্বারে ডায়েল করতে লাগলো। হয়তো এক দুইটা রিং হয়ে গিয়েছে এমন সময়ে আমি আসিফের হাত ধরে কেটে দিলাম কল। আসিফকে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম,
‘দেখো আসিফ, দায়িত্ব থেকে সরে আসার চেয়ে ব্যর্থতা আর কিছুতে নেই। আমার ছোট ছোট ভাই দুইটা আছে। আমার যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে আমার মাকে আমি সেলাই করতে দিতাম না। তার সব খরচ আমি নিজে চালাতাম। আমি সামনে থেকে সব দায়িত্ব পালন করতাম। সেই জায়গায় তোমার কি কিছু করা লাগছে এখন? তোমার বিবাহযোগ্যা বোন আছে। আর আমাদের সিলেটের চিরাচরিত রীতি অস্বীকার করার উপায় আছে? তামান্নার এর আগের বিয়েও তো টুনকো একটা জেরে ভেঙ্গে গেলো। লোক জানাজানি করে রমজানের মধ্যেই তার পান চিনি হলো। মোহর ফিক্সড হলো। ঘটা করে আয়োজন হলো। এমন অবস্থার পর আবার এই মেয়ের ভালো একটা ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব যখন এসেছে, তখন আমাদের দিক থেকে তো সবকিছু পার্ফেক্ট রাখা লাগবে তাইনা?’
আসিফ নীরবে আমার কথা শুনলো। তারপর একটা সিগারেট ধরালো। কয়েকটা টান দিয়ে আমাকে বললো,
‘এখন তাহলে আমাদের কী করা উচিত?’
‘বাসায় ফিরে যাওয়া।’
‘একেবারের জন্য?’
‘না। আমি বলছি না একেবারের জন্য। আমি বলছি বাসায় ফিরে যাওয়া। তারপরের বিষয় তার পরে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আগামীকাল সকালেই আমরা বাসায় যাবো।’
আমার কথায় আসিফ অমত করলো না। শুধু বললো, আমার পরীক্ষা যে সামনের সপ্তাহেই! আমি আসিফকে বুঝিয়ে বললাম, পরীক্ষার সময় আছে এখনও। এই নিয়ে যেনো সে চিন্তা না করে।
পরেরদিন সকালে উঠেই আমরা দুজন বাসায় চলে গেলাম। এই সেই বাসা, যেই বাসা থেকে কয়েক মাস আগে আমি আর আসিফ বের হয়ে এসেছিলাম। শাশুড়ি এসে আমাকে আর আসিফকে রুমে যেতে বললেন। রুমে গিয়ে দেখলাম সবকিছু সাজানো গোছানো। আমাদের খাটের ঠিক উপরে বড় করে আমার আর আসিফের ছবি পেইন্টিং করে টাঙিয়ে রাখা। আমার আর আসিফের বিয়ের পোশাকে আঁকা পোর্টেট দেখে আমি অবাক হলাম খুব। আমাদের তো এমন কোন ছবি একসাথে তোলা হয়নি! আসিফও তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধ হয়ে।
কিছুক্ষণের মাথায় শাশুড়ি মা চা নিয়ে এসে ঢুকলেন রুমে। আসিফ আর আমাকে বললেন
‘তোমরা দুজন এসেছো বলে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বিশ্বাস ছিলো তোমরা আসবা। আমার আসিফ তার দায়িত্ব থেকে কখনো পিছু হটতে পারে না।’
আমি শাশুড়িকে দেয়ালের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম
‘মা ওইটা…’
‘অহ ওইটা? আমিই বানিয়েছিলাম। তোমরা যখন এই বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলা, এই রুমটা যেনো একেবারে খালি খালি হয়ে গিয়েছিলো। তারপর আমি নিজেই শিল্পী হাশেম খানকে দিয়ে তোমাদের দুজনের এই পোর্টেট আঁকিয়েছিলাম। হ্যাঁ কাস্টমাইজ করা ছবিটা। এই পোশাকে তো বিয়েতে আসিফের কোন ছবি নেই যদিও, তার পরও শিল্পীর তুলিতে সব হয়েছে।’
‘হাশেম খান? অহ মাই গড! আমার ছবি হাশেম খান এঁকেছেন?’
আসিফ আগ্রহচিত্তে বলে উঠলো।
শাশুড়ি মা বললেন,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই দেখো, কর্ণারে ওনার সিগনেচার করা আছে। এই ছবিতে উনি আড়াই লক্ষ টাকা নিয়েছেন সম্মানী।’
টাকার এমাউন্ট শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। জীবনে এই প্রথম শুনলাম ছবি কেউ আড়াই লাখ টাকা দিয়ে আঁকিয়েছে। আসিফকে খেয়াল করলাম টাকার বিষয়টা তুচ্চ করে দিয়ে বললো,
‘হাশেম খান স্যারের সিগনেচার ওয়ার্ক! এইটা আমি টাকা দিয়েও কল্পনা করতে পারি না।’
কথাটা বলেই সে আমার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো
‘আই লাভ ইউ আম্মু।’
শাশুড়ি মা ছেলেকে ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘তোর জন্য চুটকি সেমাই রান্না করেছি। নারিকেল দিয়ে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আয়৷ রেডি করা আছে।’
মা ছেলের দূরত্ব নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। এমন দৃশ্য দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে উঠলাম। মা কল দিলেন। মায়ের সাথে কথা বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে শাশুড়ি মায়ের রুমে গেলাম। শাশুড়ির পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মা কোনকিছু করতে হলে আমাকে বলবেন। আমি আছি তো।’
শাশুড়ি মা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে বললেন,
‘আপাতত কিচ্ছু করতে হবে না তোমার নুপুর। তুমি যে আসিফকে নিয়ে এসেছো, এটাই অনেক।’
পরেরদিন দুপুরে তামান্নাকে দেখতে জামাই বাড়ির লোকজন এলো। দুইটা লাইটেস ভর্তি মানুষ। দুইটা মোটরসাইকেল সাথে। কমবেশি জন ত্রিশেক মানুষ তো হবেই। এত লোক শুধুমাত্র কনে দেখতে এসেছে দেখে আমি ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। ননাসও এসেছে বাসায়। ননাস আমাকে একটা শাড়ি দিয়ে বললো, শাড়িটা পরে নিতে। তামান্নাকেও সে রেডি করে দিলো। আমি খাবার রেডি করতে লাগলাম টেবিলে। জামাইর মা, বোন, ভাবি এরা ভেতরে চলে এলো। এই ঘর ওই ঘর হাঁটাহাঁটি করছে তারা। আমার কেমন জানি লাগলো তাদের এমন অবস্থা দেখে। জামাইর বোন আমার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,
‘খালা আপনাদের বাসাটা সুন্দর। শেষ কবে রঙ করিয়েছিলেন?’
এহেন প্রশ্ন শুনে আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। কনে দেখতে এসে এসব জিজ্ঞাসা কেন আবার!
শাশুড়ি জবাব দিলেন,
‘না বছর দেড়েক হবে। এর ভেতরে আর রঙ করানো হয়নাই।’
‘অহ আচ্ছা। তাহলে পরেরবার যখন রঙ করাবেন তখন সামনের রুমে হালকা ক্রিম দিয়েন। রাতে ঘর বড় আর উজ্জ্বল দেখাবে। গাঢ় দিলে ঘর ময়লা ময়লা আর কেমন ছোট ছোট দেখায়।’
শাশুড়ি আর জামাইর বোনের কথা চলার সময়ে জামাইর ছোট বোন আমাকে এক কোণে নিয়ে এলো কথা বলে বলে। তারপর আমার হাত ধরে কিছুটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
‘তোমার ননদ কেমন? আমাকে বলতে পারো। আমি কাওকে বলবো না। আর একটা ঘরের সবচেয়ে ভালো খবর সেই ঘরের পুত্রবধূই দিতে পারে। তুমি কী লক্ষ্মী দেখতে! আহা তোমার গায়ের রঙ। একেবারে যেনো দুধে আলতা!’
আমি একেবারে স্তব্ধ বনে গেলাম। ইচ্ছা করছিলো সবাইকে বলি গিয়ে, এ কেমন প্রশ্ন করছেন উনি! অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দিলাম। সামলিয়ে হেসে হেসে বললাম,
‘আমার ননদের গায়েত রঙ আমার চেয়ে কিছুটা চাপা। এ তো আপনারা দেখছেন ই।’
আমার কিছুটা কথা শুনেই জামাইর বোনের চোখে মুখে যেনো উল্লাস ফুটে এলো। সে বললো
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তোমার মতো তো নয় ই। বলো বলো। তোমার সাথে কি খারাপ আচরণ করে সে?’
এবার উনি আমার যে উত্তর শুনলেন, তাতে যেনো একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। আমি বললাম,
‘রঙ চাপা হলেও আমার ননদ গুণে আমাকে টপকিয়ে। কী করতে পারে না বলেন? আজকালকার যুগে এমন সংসারী মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি৷ আমি গ্রামের মেয়ে। কিন্তু এখানে এসে দেখি যে, কাজে আমি কী? আমার চেয়ে আমার ননদ একেবারে একশো গুণ এগিয়ে।’
আমার তারিফ শুনে ওনার মুখ চুপসে গেলো একেবারে। শুধু বললেন
‘অহ আচ্ছা।’
শাশুড়ি মা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে বললেন,
‘নুপুর ওনাকে নিয়ে টেবিলে আসো।’
আমি শাশুড়ি মাকে বললাম
‘হ্যাঁ মা আসছি। ওনাকে এখানের রঙ দেখাতে নিয়ে এসেছি৷ জানতে চাচ্ছিলাম এদিকে কোন রঙ দিলে ভালো লাগবে।’
ফিরে যাবার সময় সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস করে বসলাম,
‘আপা এখানে কোন রঙ ভালো মানাবে?’
‘এসব জানি না। বড় আপাকে জিজ্ঞেস করে নাও৷’
কথাটা বলেই উনি আমাকে তরতর করে পার করে ডাইনিং টেবিলে চলে গেলেন।
এদিকে তামান্না মনে মনে ভাবছে,
‘আমি তো সবকিছু তোমাকে একা একা নিতে দিবো না আপু। তুমি ভেবেছো আমাকে সরিয়ে দিয়ে, ভাইকে সরিয়ে রেখে এই সম্পত্তি তুমি একাই ভোগ করবা, এমন আমি হতে দিবো না। ভাইকে কেমন করে খুশ করা লাগে এইটা আমি জানি। তাইতো শিল্পীর আঁকা ছবিটা এনে ভাইকে সারপ্রাইজ দিয়ে মায়ের প্রতি পজেটিভ ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করলাম।’
[আসসালামুয়ালাইকুম। একদিকে অসুস্থতা অন্যদিকে পানিবন্দি হয়ে আছি। সিলেট শহরের অবস্থা একেবারে নাজেহাল। আপনারা অনেকে অপেক্ষা করে থাকেন এজন্য গল্প না দিয়েও পারি না৷ বিদ্যুৎ থাকলে এতো ভোগান্তি পোহাতে হতো না। ৩ দিন হতে চললো বিদ্যুৎ, পানি কোনটাই নাই। দোয়া করবেন। ]
(চলবে)